গোপালগঞ্জে কাশিয়ানী উপজেলার ভাটিয়াপাড়ায় মধুমতি নদীর বাঁধে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। এরইমধ্যে পাড়ের কিছু অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এতে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে এলাকাবাসীর মধ্যে। ভাটিয়াপাড়া বাজারের ব্যবসায়ীরা দোকান-পাট ও মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। ভাঙনকবলিত এলাকায় দ্রুত স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

এরইমধ্যে ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। গোপালগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ভাটিয়াপাড়া বাজারের মধুমতি নদী ভাঙনপ্রবণ এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলে নেওয়া হয়েছে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা। তবে বরাদ্দ পেলে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার অন্যতম বাজার ভাটিয়াপাড়া বাজার। বাজারটি গড়ে উঠেছে মধুমতি নদীর কোল ঘেঁষে। নদীবন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার পাশাপশি এ বাজারে রয়েছে রেল স্টেশন। হঠাৎ করে শুক্রবার (৮ আগস্ট) রাতে মধুমতি নদীর বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এরইমধ্যে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে বাঁধের প্রায় ১০০ মিটার এলাকা। পানির স্রোতে ভেসে গেছে নদী শাসনের জিও ব্যাগ ও ব্লক।

একসময় মধুমতি নদী ও ভাটিয়াপাড়া বাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল উত্তর বঙ্গের সাথে রেল যোগাযোগ। এখান থেকে রাজবাড়ি-গোয়ালন্দ ঘাট এবং উত্তর বঙ্গের পার্বতিপুর রেল যোগাযোগ চালু ছিল। নদীপথে খুলনা পর্যন্ত লঞ্চ ও নৌ যোগাযোগ চালু ছিল। সেই সময়কার উন্নত যোগাযোগের কারণে এখানে চারটি খাদ্য গুদাম গড়ে ওঠে। সেই সাথে ব্যাবসায়ীদের নিজস্ব শতাধিক গুদাম রয়েছে। পাশাপাশি গড়ে উঠেছে ছোট বড় এক হাজারেরও বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, তহসিল অফিস ইত্যাদি।

দোকানপাট অন্য সরিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

ভাঙন আরো তীব্র আকার ধারণ করলে মসজিদ, দোকান, সেতু ও রেলের আংশিক এলাকাসহ এসবই নদী গর্ভে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা এখানকার বাসিন্দাদের। 

নদীপাড়ের চা দোকানদার মো.

ইউসুফ শেখ (৫৫) বলেন, “নদীর ওপারে নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার আমডাঙ্গা গ্রাম থেকে এসে ভাটিয়াপাড়া বাজারে চায়ের দোকান করি। সংসারে স্ত্রী, এক মেয়ে, দুই ছেলে, ছেলের বউ ও নাতি রয়েছে। এই চায়ের দোকানের আয় দিয়ে ৮ সদস্যদের পরিবারের ভরণ-পোষণ চালাতে হয়। কিন্তু হঠাৎ করেই শুক্রবার রাতে মধুমতি নদীর বাঁধে দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। নদীর পাড়ে দোকান হওয়ায় ঝুঁকিতে পড়েছি, এখন সরিয়ে নিতে হচ্ছে। রোজগারের একমাত্র সম্বল এই দোকান সরিয়ে নেওয়ায় আমাদের না খেয়ে কাটাতে হবে। তাই কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি, যেন দ্রুত ভাঙন ঠেকাতে ব্যবস্থা নেয়।”

স্থানীয় ওষুধ ব্যবসায়ী মো. সজল সরদার বলেন, “এ বাজারে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ না করায় প্রতিনিয়ত ভাঙনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এর আগেও কয়েকবার ভাঙনের শিকার হয়েছে এখানকার ব্যবসায়ীরা। ফলে জীবিকার একমাত্র উৎস ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হারিয়ে বহু ব্যবসায়ীকে নিঃস্ব হতে হয়েছে। দ্রুত স্থায়ী সমাধানের দাবি জানাই।”

রাইস মিল মালিক সিরাজ চৌধুরী বলেন, “গত দুই বছর আগে এই বাজারে সবার অজান্তে এক রাতে মাত্র তিন ঘণ্টার ভাঙনে ৩০টি দোকান নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এ বছরে আবার হঠাৎ করে ভাঙন শুরু হয়েছে। এতে এখানকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, কখন কার দোকান চলে যায়। স্থায়ী সমাধান না হওয়ায় প্রতিনিয়ত আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয় আমাদের।”

স্থানীয় ব্যবসায়ী মশিউর রহমান খান জানান, গত দশ বছর আগেই এখানে পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কাজ করেছে। নদী শাসনের কাজ করার পর এই বাজারেই তিন দফা ভেঙেছে। নদীগর্ভে গেছে ব্লক ও জিও ব্যাগ। এ কারণেই ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।”

ব্যবসায়ী মো. জাকের মোল্যা বলেন, “শুনেছি তৎকালীন সময়ে মধুমতি নদীকে কেন্দ্র করেই গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ভাটিয়াপাড়া বাজারটি গড়ে উঠেছিল। সেই সময়ে খুলনা, বরিশাল, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও মহাকুমা থেকে নৌ-পথে যোগাযোগ ও মালামাল আনা-নেওয়ার খরচ ছিল কম এবং সহজ। কিন্তু এ বাজারে নদী শাসনে তেমন কোন উদ্যোগ না নেওয়ায় প্রতি বছর ভাঙনের শিকার হতে হয় আমাদের।”

এরইমধ্যে ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা।

ভাটিয়াপাড়া বাজার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মামুন শরীফ বলেন, “প্রতি বছর মধুমতি নদীর ভাঙনে ভাটিয়াপাড়ার ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। বাজার এলাকায় তিনবার বড় ধরনের ভাঙনের কারণে ব্যবসায়ী এবং এলাকাবাসী ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন। কিন্তু স্থায়ী সমাধানের কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। শুনেছি পানি উন্নয়ন বোর্ড ছয় হাজার জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙনরোধ করবে। এভাবে জিও ব্যগ ফেলে ভাঙনরোধ করা সম্ভব নয়। স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ না হলে আমাদের প্রতি বছরই ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। আমরা এর স্থায়ী সমাধান চাই।”

গোপালগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম রেফাত জামিল জানান, ভাঙকবলিত এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে। এরইমধ্যে ভাঙনরোধে ছয় হাজার জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে।

তিনি বলেন, “ভাটিয়াপাড়া বাজার একটি ঐতিহ্যবাহী বাজার। এ বাজারটি রক্ষায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলে স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে।”

ঢাকা/বাদল/এস

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র ব যবস য় ব যবস য় র গ প লগঞ জ এরইমধ য উপজ ল র আম দ র ত এল ক আতঙ ক

এছাড়াও পড়ুন:

‘চোখের সামনে বসতবাড়ি ভাইঙ্গা নিল, পোলাপান লইয়া কই যামু’

চার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে এক রাতে ঘর ছাড়তে বাধ্য হন শেরপুর সদর উপজেলার গৃহিণী নাজমা বেগম (৪৬)। চোখের সামনে নিজেদের শেষ আশ্রয়স্থলটি নদীতে বিলীন হতে দেখেন। এই অবস্থায় কোথায় যাবেন, কী করবেন—কিছুই বুঝতে পারছেন না। এমন অসহায়ত্ব প্রকাশ করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ভাগলঘর গ্রামের এই বাসিন্দা বলেন, ‘চোখের সামনে বসতবাড়ি ভাইঙ্গা নিল (ব্রহ্মপুত্র নদ), পোলাপান লইয়া কই যামু?’

আপাতত দিনমজুর স্বামী আবদুল্লাহ ও সন্তানদের নিয়ে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন নাজমা। তবে ভবিষ্যতে কোথায় যাবেন, এই ভেবে চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন। ব্রহ্মপুত্র নদে বসতভিটা হারানোর এই কষ্ট কিংবা অসহায়ত্ব শুধু নাজমা বেগমের একার নয়, চরপক্ষীমারি ইউনিয়নের দক্ষিণ ভাগলঘর গ্রামের প্রায় শতাধিক পরিবারের একই দুর্দশা। পরিবারগুলোর অভিযোগ, সরকারি উদ্যোগে ভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছে তারা।

গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিন দেখা যায়, চরপক্ষীমারি ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে দক্ষিণ ভাগলঘর গ্রামের একাংশে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। গ্রামটির প্রায় ৫০০ মিটার এলাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যেই অনেকের বসতভিটা নদে পুরোপুরিভাবে বিলীন হয়ে গেছে। আবার কোথাও নদের পাড় ঘেঁষে থাকা শূন্য ভিটায় উঁকি দিচ্ছে বাঁশের খুঁটি। এগুলো এখন সেই দুঃসহ বাস্তবতার সাক্ষী যেন। অনেকে তড়িঘড়ি নিজেদের ঘর থেকে আসবাব সরিয়ে কোনোরকমে এখানে-সেখানে ছড়িয়ে রেখেছেন।

ব্রহ্মপুত্রের তীর থেকে মাত্র ২০ মিটার দূরে আছে ভাগলঘর দক্ষিণপাড়া জামে মসজিদ ও সামাজিক কবরস্থান। ভাঙন রোধ করা না গেলে যেকোনো সময় এগুলো নদে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন গ্রামবাসী। এর মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উদ্যোগে ভাঙনকবলিত এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলার জন্য বালু ভরার কাজ চলতে দেখা যায়।

নদের ভাঙনকবলিত স্থানে জিও ব্যাগ ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ভাগলঘর গ্রামে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘চোখের সামনে বসতবাড়ি ভাইঙ্গা নিল, পোলাপান লইয়া কই যামু’