জাতীয় পার্টির নিয়ন্ত্রণ নিতে তৎপর আনিসুল, ঠেকাতে সক্রিয় জিএম কাদের
Published: 13th, August 2025 GMT
নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর জি এম কাদের এবং সম্মেলন অনুষ্ঠানের পর আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির (জাপা) দুই পক্ষই তৎপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায়। দুই পক্ষই নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দ্বারস্থ হয়েছে।
সম্মেলন করে নতুন কমিটি গঠন করার পর আনিসুল ইসলামরা গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনের ‘স্বীকৃতি’, অর্থাৎ দলের নিবন্ধন ও ‘লাঙ্গল’ প্রতীক ব্যবহারের অধিকার চাইছে। অন্যদিকে জি এম কাদের সম্মেলন অনুষ্ঠান, কমিটি গঠনসহ পুরো প্রক্রিয়াকে অবৈধ বলে ইসিকে জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, আনিসুল ইসলামের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির ‘দশম কাউন্সিল’–এর পর নবনির্বাচিত নেতৃত্বের তথ্য দিয়ে ইসি সচিবের বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে তারা দলীয় গঠনতন্ত্রের বিতর্কিত ধারা ২০/১/ক বাতিল করার কথা বলেছে। এ ধারায় চেয়ারম্যানকে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ধারাটি সংশোধন করে আনিসুল ইসলামরা দলের কোনো কেন্দ্রীয় সদস্যকে বহিষ্কার বা অব্যাহতি এবং জেলা ও ইউনিটি বাতিল করার আগে প্রেসিডিয়ামের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বাধ্যবাধকতার কথা উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া চেয়ারম্যান কাউকে বহিষ্কার বা অব্যাহতি দিলেও প্রেসিডিয়াম সভায় তাঁর অনুমোদন নেওয়ার কথাও যুক্ত করেছে। গঠনতান্ত্রিকভাবে সম্মেলনের মাধ্যমে এসব সংশোধনী আনার কথা উল্লেখ করে তারা ইসির স্বীকৃতি চেয়েছে।
সম্মেলনের পরদিন ১০ আগস্ট আনিসুল ইসলামদের নেতৃত্বাধীন নবনির্বাচিত কমিটির শীর্ষ চার নেতার তালিকা কমিশনে জমা দেওয়া হয়। এ কমিটিকে জাতীয় পার্টির ‘মূলধারা’ দাবি করে তারা বলেছে, ‘লাঙ্গল’ প্রতীক ব্যবহারের বৈধ অধিকার কেবল তাদের কমিটির আছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এখন তারা জাতীয় পার্টির কার্যালয় ও দলীয় তহবিল বুঝিয়ে দিতে এবং দলের নিবন্ধন নম্বর ১২ ব্যবহার না করতে জি এম কাদেরকে আইনি নোটিশ পাঠানোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে।
এদিকে আজ বুধবার জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির একজন নেতা রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশনে গিয়ে চিঠি দিয়েছেন। জানা গেছে, ওই চিঠিতে দলের গঠনতন্ত্রের বিভিন্ন ধারা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, যাঁরা সম্মেলন আহ্বান করেছেন, তাঁরা দল থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত। চেয়ারম্যান ছাড়া অন্য কারও সম্মেলন ডাকার এখতিয়ার নেই। ফলে এ সম্মেলন ও কমিটি গঠনের পুরো প্রক্রিয়া অবৈধ, বেআইনি।
৯ আগস্ট রাজধানীর গুলশানের একটি মিলনায়তনে জাতীয় পার্টির ‘দশম কাউন্সিল’ করেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মহাসচিব মুজিবুল হক (চুন্নু)। সম্মেলনে আনিসুল ইসলাম চেয়ারম্যান, মুজিবুল হক নির্বাহী চেয়ারম্যান, কাজী ফিরোজ রশীদ সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ও এ বি এম রহুল আমিন হাওলাদার মহাসচিব নির্বাচিত হন। জি এম কাদের তাঁদের জাতীয় পার্টির প্রাথমিক সদস্য পদসহ অন্যান্য পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জি এম কাদের ও যুগ্ম দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলমকে বিবাদী করে আনিসুল ইসলামসহ ১০ নেতা ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মামলা করেন। আদালত দুজনের সাংগঠনিক কার্যক্রমের ওপর ১২ আগস্ট পর্যন্ত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেন। এ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে (৯ আগস্ট) আনিসুল ইসলামরা সম্মেলন করে নতুন কমিটি করেন।
১২ আগস্ট ছিল জি এম কাদেরের ওপর আদালতের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার শেষ দিন। সেদিনই বাদীপক্ষ মামলাটি প্রত্যাহার করে নেওয়ার আবেদন করে। এদিকে মামলার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে বিব্রতবোধ করায় ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত থেকে ১১ আগস্ট মামলাটি ষষ্ঠ যুগ্ম জেলা জজ আদালতে বদলি করা হয়। পরদিন (১২ আগস্ট) বিচারক মামলা প্রত্যাহারের আবেদন মঞ্জুর করেন। ফলে জি এম কাদেরসহ দুজনের সাংগঠনিক কার্যক্রমের ওপর দেওয়া অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আর থাকছে না।
এ বিষয়ে জি এম কাদেরের জাতীয় পার্টির মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এতে আমরা আনন্দিত। এর ফলে চেয়ারম্যানের সাংগঠনিক কার্যক্রমের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আইনগতভাবে নেই। এখন তিনি মুক্তভাবে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে পারবেন।’
আনিসুল ইসলামসহ ১০ নেতা হঠাৎ কেন মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করলেন, তা নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির নবনির্বাচিত নির্বাহী চেয়ারম্যান মুজিবুল হক বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন তো তিনি (জি এম কাদের) জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান নন। আমরা সম্মেলন করে নতুন কমিটি করেছি, মামলা থাকবে কেন? মামলা থাকলে তো তাঁকে চেয়ারম্যান স্বীকার করা হয়।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এম ক দ র প রথম র ওপর আগস ট গঠন ক
এছাড়াও পড়ুন:
নেতৃত্ব কেন উদাসীন থাকবে
সম্প্রতি ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) সম্মেলনে লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রাজনৈতিক দলের স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত গণতন্ত্র শক্তিশালী করার ওপর জোর দিয়েছেন।
যেকোনো রাজনৈতিক দল পরিচালিত হয় গঠনতন্ত্র ও নীতি-কর্মসূচির ভিত্তিতে। কিন্তু আমাদের নেতা-নেত্রীরা দেশবাসীকে গণতন্ত্রের সবক দিতে যতটা উদ্গ্রীব, দলের গণতন্ত্রায়ণ নিয়ে ততটাই উদাসীন। তারেক রহমানের এ বক্তব্যে যদি সেই উদাসীনতা কাটানোর সদিচ্ছা প্রকাশ পায়, আমরা স্বাগত জানাই।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৫১টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আছে। এর বাইরে অনেক অনিবন্ধিত দল আছে, যারা নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে। আশা করি, নির্বাচন কমিশন দ্রুততম সময়ে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন থাকুক আর না-ই থাকুক, তাদের কিছু দায়বদ্ধতা থাকে। তারা যে জনগোষ্ঠীর সমর্থন চায়, তাদের আস্থা অর্জন করতে হয়। মানুষ দলটির নীতি-আদর্শের পাশাপাশি নেতৃত্ব গঠনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াও দেখতে চাইবে। বিশেষ করে দলটি গণতান্ত্রিক রীতিনীতি কতটা মেনে চলছে, সেসব বিষয়ে তাদের আগ্রহ থাকা অস্বাভাবিক নয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর উপস্থিতি কম থাকায় এ টি এম শামসুল হুদা কমিশন প্রতিটি দলের সব স্তরের কমিটিতে এক-তৃতীয়াংশ নারী সদস্য নেওয়ার শর্ত জুড়ে দেয়, যা ২০২০ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। কিন্তু কোনো দলই সেই শর্ত পূরণ করেনি। বাংলাদেশে কিছু দল আছে, তারা নারী নেতৃত্বের ঘোর বিরোধী। তারা কমিটিতে নারীর উপস্থিতি দেখতে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যেসব দল দশকের পর দশক নারী নেতৃত্বে পরিচালিত হয়ে আসছে, সেসব দলও এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা নেই। এ কারণে কোনো দলের কোনো স্তরে ১০ শতাংশ নারী নেতৃত্বের দেখা পাওয়া যায় না। এই পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন বাধ্য হয়ে ২০২০ সালের বাধ্যবাধকতা তুলে নেয়।
যে রাজনৈতিক দল জনগণকে নেতৃত্ব দেবে, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে, তাদের কর্মকাণ্ডে কেন জবাবদিহি থাকবে না। একনায়ক পদ্ধতিতে দল পরিচালিত হওয়ার পরিণাম কতটা বিপজ্জনক হয়, তার প্রমাণ আমরা নিকট অতীতে কিংবা তারও আগে বহুবার পেয়েছি। তারপরও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মানসিকতার দৃশ্যমান পরিবর্তন হয়েছে, এমন দাবি করা যাবে না।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যে দলে গণতন্ত্রায়ণের কথা বলেছেন, সেটি সব রাজনৈতিক দলের জন্যই প্রযোজ্য। প্রতিটি দল পরিচালিত হতে হবে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী। সেই সঙ্গে যেসব দলের গঠনতন্ত্রে দলীয় প্রধানকে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা পরিবর্তন করার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকেও দলে গণতন্ত্রায়ণের বিষয়টি সামনে আসে। কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক দলের গণতন্ত্রায়ণের জন্য আলাদা কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। এ মুহূর্তে সেই সুযোগ না থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতৃত্ব গঠনের কাজটি এগিয়ে নেওয়া।
বিএনপির দ্বিতীয় প্রধান নেতা যখন দলে গণতন্ত্র সংহত করার কথা বলেছেন, তখন সেই দলের সাংগঠনিক শৃঙ্খলা কতটা মজবুত, দলটির নেতৃত্বের উচিত সেটা খতিয়ে দেখা। বিএনপির তৃণমূল স্তরে যে নানা রকম অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটছে, তার জন্য নেতৃত্ব গঠনের দুর্বলতাও কম দায়ী নয়। যে দলটি ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্ব দিতে চাইছে, সেই দলটির নেতৃত্ব দলের গণতন্ত্রায়ণের বিষয়ে উদাসীন থাকতে পারে না।