স্বাধীনতার পর থেকে নানা সময়ে আমাদের দেশে সংবিধান ও নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে নানা কাজ হয়েছে। এগুলো ঠিক কতটা সাধারণ মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণ করে, কতটা তাদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে, তা প্রশ্নবিদ্ধ।

আমরা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এসব বিষয়ে উন্নতির জন্য এখানে তিনটি প্রস্তাব করব। আপাতত এগুলো সংক্ষিপ্ত। পরে বিস্তারিত দেওয়া হবে।

১.

সংযুক্ত সারণিতে বিভিন্ন নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভো‍ট ও প্রাপ্ত আসনের ভেতরে অগ্রহণযোগ্য পর্যায়ের অসংগতি দেখা যায়। যেমন ২০০১ সালের নির্বাচনে প্রায় সমান ভোট পেয়েও বড় দুই দলের আসনপার্থক্য প্রায় ৪৩ শতাংশ।

আবার ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোটের পার্থক্য ১৬ শতাংশ, আসনপার্থক্য প্রায় ৬৬ শতাংশ। অন্য নির্বাচনগুলোতেও একই রকম অবস্থা। এই অসংগতি তৈরি হওয়ার কারণ আমাদের বর্তমান পদ্ধতিতে ৫০ শতাংশের অনেক কম ভোট পেয়ে এবং মাত্র ১টি ভোটের ব্যবধানেও কোনো আসনে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হতে পারে।

দুঃখজনকভাবে এ সমস্যা সমাধানে দীর্ঘদিন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নজরে পড়ে না। এ বিষয়ে আমাদের প্রস্তাব এই ৩০০টি আসনের সঙ্গে আরও ৩০০টি আসন যোগ করা, যেগুলো দলগুলোর মধ্যে বণ্টন করা হবে সারা দেশে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে।

আরও পড়ুনএত কিছুর পরও নির্বাচন নিয়ে ফেব্রুয়ারি-এপ্রিলের দোলাচল কেন১১ জুলাই ২০২৫

এ রকমটা হলে ২০০১ ও ২০০৮ সালের ফলাফলে কোনো দলের দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাওয়া সম্ভব হতো না। প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর ভেতরে এই রকম আসন বণ্টন আমাদের দেশে নতুন হলেও নানা দেশে চালু রয়েছে।

আমাদের প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় প্রচলিত স্থানীয় আসনের প্রার্থী তালিকার সঙ্গে ভোটের আগেই দলগুলো এই রূপ আসনের জন্যও তাদের ৩০০ জন করে প্রার্থী ঘোষণা করবে। তারপর ভোটের পরে যত শতাংশ প্রাপ্ত ভো‍ট তার ভিত্তিতে তালিকা থেকে প্রথম তত শতাংশ আসন করে দলগুলোকে দেওয়া হবে।

এই প্রস্তাবিত ব্যবস্থা দুটি কারণে শ্রেয়োতর:

১. স্থানীয় সমস্যা সমাধানে স্থানীয় প্রতিনিধি যেমন থাকতে পারে আবার জাতীয় সমস্যা সমাধানে জাতীয় দক্ষ প্রতিনিধি থাকতে পারে।

২. আর অকারণ উচ্চমাত্রার সংখ্যাগরিষ্ঠতা এড়ানো যাবে ফলে সরকারি দলের আধিপত্যবাদী হয়ে ওঠার প্রবণতা কম হবে।

প্রসঙ্গগত বলা যায়, এ মুহূর্তে আলাপ হচ্ছে, সংসদের উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ নিয়ে। এ বিষয়ে সংস্কার কমিশন সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থাকে উচ্চকক্ষে ব্যবহার করার কথা বলেছেন, কিন্তু মূল শাসনক্ষমতা তো থাকবে নিম্নকক্ষের হাতে।

এতে নিম্নকক্ষ আগের মতোই নিরঙ্কুশ অবস্থায় দুর্বল গণতন্ত্র ও আধিপত্যবাদী সরকার ব্যবস্থার জন্য প্রস্তুত থাকবে। সংসদের উচ্চকক্ষ আমাদের দেশে জটিলতা বাড়াবে বই কমাবে না।

আরও পড়ুননির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলা গণতন্ত্রের সঙ্গে ‘ব্লাসফেমি’০৫ আগস্ট ২০২৫২.

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটি চমৎকার। কিন্তু এই রূপ সরকার কাদের নিয়ে গঠিত হবে এ বিষয়ে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থাহীনতার চর্চা ও প্রভাব খাটানোর চেষ্টা দেখেছি। ফলে ১৯৯৬, ২০০৬ বা ২০১৪-এর পরে থেকে নানান রাজনৈতিক সংঘাতও আমরা দেখেছি।

তা ছাড়া দলগুলো নানা সময়ে রুদ্ধদ্বার আলোচনা করেছে, কিন্তু সেগুলো জন সমক্ষে আনেনি। আবার কোন কোন দল এরূপ আলোচনায় অংশ নেবে, সে বিষয়েও কোনো স্বচ্ছতা পরিলক্ষিত হয়নি।

বর্তমান ঐকমত্য কমিশন কিছু দলকে ডেকেছে। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে নাকি গণতান্ত্রিক উপায়ে এখানে সিদ্ধান্ত গৃহীত হচ্ছে, এটি স্পষ্ট নয়। বর্তমান সংবিধান সংস্কার কমিশন ১৯৯৬ সালের নিয়মের মতোই প্রস্তাব দিয়েছে: তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হবে ভূতপূর্ব প্রধান বিচারপতি, যিনি অবসরে গেছেন, তিনি অপারগ হলে আগেরজন, তার আগেরজন, এভাবে আপিল বিভাগের বিচারপতি, অপারগ হলে তার আগেরজন ইত্যাদি। আর উপদেষ্টা কারা হবেন, তা স্পষ্ট নয়।

আরও পড়ুননির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে যাক১৬ জুন ২০২৫

এসব বিষয়ে আমাদের প্রস্তাব হলো পুরো বিষয়টিকে জনসমক্ষে আনতে হবে। বিগত নির্বাচনগুলোতে ন্যূনতম প্রাপ্ত ভোট বিবেচনায় প্রধান দলগুলো থেকে তাদের অনাপত্তি আছে এই রকম নামের তালিকা নেওয়া হবে (শুধু বিচারপতি নয়, অন্যান্য পেশারও)। এসব তালিকা থেকে যেই নামগুলো সব তালিকায় আছে শুধু তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

এখানে একাধিক ব্যক্তি উপযুক্ত হলে যাঁদের ক্রম আগের দিকে, তাঁরা অগ্রাধিকার পাবেন। দলগুলো বড় তালিকা দেবে এবং প্রত্যেকের তালিকা থেকে সাধারণ নামগুলো চয়ন করা হবে।

জাতীয় টেলিভিশনে এই চয়ন প্রণালি সরাসরি সম্প্রচার করা যেতে পারে। এই ব্যবস্থায় কোনো একটি দল ইচ্ছাকৃতভাবে যাতে অন্যদের সঙ্গে না মেলে, সে জন্য দুষ্ট একটি তালিকা নিয়ে আসতে পারে। সরাসরি সম্প্রচার হলে এসব দুরভিসন্ধি আমজনতার কাছে ধরা পড়ে যাবে।

তবে এরপরও যেটা হতে পারে, দলগুলোর তালিকার মধ্যে কোনো মিল না থাকতে পারে। এসব ক্ষেত্রেও সমাধান পাওয়ার জন্য পূর্ববর্তী নির্বাচনে তুলনামূলক কম ভোট পাওয়া দলগুলোকে একে একে বাদ দিয়ে বিবেচনা করা যেতে পারে।

এভাবে ন্যূনতম প্রধান দুটি দলের তালিকা থেকে যেতে পারে এবং সেখান থেকে সাধারণ একটি নাম চয়ন করা যেতে পারে। সরকারের অন্যান্য উপদেষ্টা বা নির্বাচন কমিশনপ্রধান বা কমিশনারদেরও একইভাবে পাওয়া যেতে পারে।

এ ধরনের প্রত্যক্ষ ব্যবস্থা গণতন্ত্রের সহায়ক হতে পারে। এ রকম সরকারের উপদেষ্টাদের কীভাবে পাওয়া গেল, সে বিষয়ে আমাদের আর অন্ধকারে থাকতে হবে না।

৩.

আমাদের দেশের সংসদে মোট আসনসংখ্যা ৩০০। এই সংখ্যা কোথা থেকে এল? কোন বিভাগে বা জেলায় কতটা আসন হবে, তারই বা ভিত্তি কী? পূর্ব পাকিস্তানের ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে আসনসংখ্যা ছিল ৩০০। সেই থেকেই আমাদের স্বাধীন দেশের সংসদেও ৩০০ আসন এসেছে ধারণা করা যায়।

এখানে কোনো তত্ত্ব, তথ্য বা উপাত্ত নেই। আসনবিন্যাস ও পুনর্বণ্টনের একটা আইন আগে ছিল কিন্তু বর্তমানে নেই। এটি হলো ‘কমিশন প্রশাসনিক সুবিধা বিবেচনা করিয়া প্রতিটি আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ করিবে, যাহাতে প্রতিটি আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকার ভৌগোলিক অখণ্ডতা বজায় থাকে, এবং এইরূপ সীমানা নির্ধারণ সর্বশেষ আদমশুমারি প্রতিবেদনে উল্লিখিত জনসংখ্যার, যত দূর সম্ভব, বাস্তব বণ্টনের ভিত্তিতে করিতে হইবে।’

এটাতে জনসংখ্যার বণ্টন ছিল মূল ভিত্তি। কিন্তু আসলে কী হওয়া উচিত? কোনো এলাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিমাণ? বা মোট ভূমির পরিমাণ? বা অন্য কিছু? আমেরিকার জেফারসন বা হ্যামিল্টন আসন বণ্টনের জন্য জনসংখ্যাভিত্তিক সূত্র এবং বণ্টনের কারণে উদ্ভূত ভগ্নাংশের জন্য এপরসনমেন্ট গণিত নিয়ে জনপরিসরে আলোচনা ও প্রস্তাবনা করে গেছেন।

আরও পড়ুননির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলা গণতন্ত্রের সঙ্গে ‘ব্লাসফেমি’০৫ আগস্ট ২০২৫

আমাদের দেশে সেসব সূত্র প্রয়োগ করতে হবে তেমন কথা নেই, কিন্তু কোনটি প্রযোজ্য হবে, সেই পাঠও কি হয়েছে? আমরা আমাদের সংখ্যাতাত্ত্বিক পরীক্ষণে দেখেছি, জনসংখ্যা, ভূমির পরিমাণ বা ঘনত্ব কোনোটিই আমাদের বর্তমান আসন বণ্টনের সঙ্গে মেলে না।

যেমন ঝালকাঠির এক আসনে ভোটারসংখ্যা ১ দশমিক ৭৯ লাখ অথচ ঢাকার এক আসনে ভোটারসংখ্যা ৭ দশমিক ৫ লাখ। আমরা জানি ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগের আসন বণ্টনের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ ছিল।

অথচ তৎকালীন নির্বাচন কমিশন প্রধানের লিখিত পুস্তক থেকেও বোঝার উপায় নেই এই সীমানা নির্ধারণ বা আসন বণ্টন কী প্রকারে হয়েছে। ১৯৯১ বা ১৯৯৬ সালেও বা কীভাবে হয়েছে, কিংবা এখন পর্যন্ত অনিশ্চিত ২০২৬-এর নির্বাচনেই-বা কীভাবে ঘটবে।

জনসংখ্যার অনুপাতে সুষম বণ্টন হলে ঝালকাঠি, মেহেরপুর বা নড়াইলের বর্তমান বরাদ্দ ২টি আসনের জায়গায় ১টি করে আসন পাওয়ার কথা এবং গাজীপুর বর্তমানের ৫টি আসনের জায়গায় ১০টি আসন পাওয়ার কথা।

আমাদের প্রস্তাব হলো, এটি জনসংখ্যা ঘনত্বের সঙ্গে সমানুপাতিক হারে করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ভূমির পরিমাণ বা সম্পদের পরিমাণ তথা জাতীয় রাজস্বে ভাগ ও জনসংখ্যা দুই-ই গুরুত্ব পায়।

স্বাক্ষর শতাব্দ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়; মু আ হাকিম নিউটন, ইউনিভার্সিটি অব নিউ ক্যাসেল, অস্ট্রেলিয়া; ফারজানা আলম, ইউনিসেফ লিডারশিপ প্রোগ্রাম; মোহাম্মদ কায়কোবাদ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের ফেলো

* মতামত লেখকদের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম দ র দ শ গণতন ত র র পর ম ণ সরক র র জনস খ য ব যবস থ দলগ ল র র জন য তত ত ব আসন র

এছাড়াও পড়ুন:

স্বৈরতন্ত্র উত্থানের দায় আসলে কাদের

প্রাচীন গ্রিসে ক্ষুদ্র অসংখ্য নগররাষ্ট্র ছিল। সেখানে নগরের অধিবাসীকেই বলা হতো নাগরিক, যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল নাগরিকের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমরা সেই সব ব্যক্তিকে নাগরিক বলব, যাদের আইন প্রণয়ন ও বিচারিক কার্যাবলিতে অংশগ্রহণের ক্ষমতা আছে।’ তাঁর মতে, যে ব্যক্তি নগররাষ্ট্রের শাসনকাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে অক্ষম, তিনি প্রকৃত নাগরিক নন।

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নাগরিককে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে—যেকোনো রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন, রাষ্ট্র প্রদত্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করেন এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য ন্যায়ের সঙ্গে পালন করেন, তাঁকেই নাগরিক বলা যায়। একই সঙ্গে নাগরিককে অবশ্যই অন্য মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন না করার ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে।

প্রতিটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো সৎ, যোগ্য ও নীতিবান নাগরিক। রাষ্ট্রের কাঠামো ও ভবিষ্যৎ নির্ভর করে নাগরিকের চরিত্র ও আচরণের ওপর। তাই রাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন সচেতন নাগরিক—যিনি নিজের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত। এ জ্ঞান ও সচেতনতাই রাষ্ট্রকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে বলা হয় জনগণের অংশগ্রহণে, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের কল্যাণে পরিচালিত শাসনব্যবস্থা; কিন্তু প্রশ্ন হলো যদি জনগণ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অসচেতন থাকেন, তবে কি গণতন্ত্রের প্রকৃত স্বরূপ অক্ষুণ্ণ থাকে? বাস্তবতা হলো নাগরিকের অজ্ঞতা ও উদাসীনতাই স্বৈরতন্ত্রকে জন্ম দেয়।

প্রথমত, যেখানে মানুষ নিজের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞ, সেখানে শাসকগোষ্ঠী সহজেই ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে। ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন—এসব বিষয়ে নাগরিক উদাসীন থাকলে শাসকের জবাবদিহি বিলীন হয়ে যায়, তখন গণতান্ত্রিক কাঠামো টিকে থাকলেও এর প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়।

দ্বিতীয়ত, নাগরিকেরা ভয়, অজ্ঞতা বা উদাসীনতার কারণে যখন অন্যায় ও অনিয়ম মেনে নেন, তখনই স্বৈরতন্ত্র শিকড় গাড়ে। শাসকের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত তারা অন্ধভাবে মেনে নিলে সরকার জবাবদিহি এড়িয়ে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে; কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—শক্তিশালী শাসকের শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয় কেবল তখনই, যখন জনগণ ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। জার্মানি থেকে পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশের অতীত—সবখানেই দেখা যায়, নাগরিক–সচেতনতার অভাবেই স্বৈরতন্ত্রের বিস্তার ঘটেছিল।

তৃতীয়ত, নাগরিক সমাজ দুর্বল হলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শ্রমিক সংগঠন কিংবা নাগরিক সংগঠনগুলোও কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। তখন শাসকেরা সহজেই বিকল্প কণ্ঠরোধ করে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। অর্থাৎ, নাগরিকের নীরবতাই শাসকের জন্য সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্রে পরিণত হয়।

অতএব, স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন নাগরিক শিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতনতা। পরিবার থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে মানুষকে জানতে হবে তাদের অধিকার, কর্তব্য ও রাষ্ট্রের কাছে দাবি করার উপায়। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হতে হবে সত্য প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম, তোষণ বা প্রোপাগান্ডার যন্ত্র নয়। মনে রাখতে হবে—অধিকার চর্চা না করলে অধিকার হারিয়ে যায়। তাই প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য হলো নিজের অধিকার সম্পর্কে জানা ও তা প্রয়োগ করা।

সবশেষে বলা যায়, নাগরিকের অধিকার বিষয়ে অসচেতনতা কোনো ব্যক্তিগত দুর্বলতা নয়; বরং তা রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর। সচেতন নাগরিক সমাজই পারে জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র গড়ে তুলতে আর অসচেতন নাগরিক সমাজই সৃষ্টি করে স্বৈরতন্ত্রের জন্মভূমি।

ইসরাত জাহান

শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এমন মানুষও আছে, যারা বলছে ৫ বছর থাকুন, ১০ বছর থাকুন, ৫০ বছর থাকুন
  • স্বৈরতন্ত্র উত্থানের দায় আসলে কাদের
  • পিআরের নামে জামায়াত ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে: কায়সার কামাল