তাঁরা তিনজন। হতে পারেন বান্ধবী। অথবা অন্য কোনো সম্পর্ক। রিকশায় করে যাচ্ছিলেন কোথাও। হঠাৎ উঠল ঝোড়ো হাওয়া। সঙ্গে ঝমঝম বৃষ্টি। একজন বাহারি রঙের একটি ছাতা মেলেছিলেন বটে, কিন্তু দমকা হাওয়ার ঝাপটায় সেই ছাতা গেল উল্টে। ফল যা হওয়ার তাই। ঝুম বৃষ্টিতে অসময়ের স্নান।
বর্ষাকালে ঢাকা নগরীতে এমন দৃশ্য অচেনা নয়। বৃষ্টির দিনে এমন বিপত্তিতে পড়েছেনও হয়তো অনেকে। এই দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দী করেছেন স্বনামখ্যাত আলোকচিত্রশিল্পী ও শিক্ষক আবির আবদুল্লাহ। বৃহস্পতিবার থেকে ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে শুরু হলো তাঁর ‘ট্রাবলিং রেইন’ নামের একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী। সেখানেই আছে তিন তরুণীর এক রিকশায় যেতে যেতে আচমকা বৃষ্টিতে ভেজার এই দৃশ্য।
প্রায় দুই দশক ধরে আবির আবদুল্লাহ নগরজীবনে বর্ষার বিড়ম্বনা ও ঋতু–প্রকৃতির সৌন্দর্য আলোকচিত্রে তুলে আনছেন। সেখান থেকেই ৩৩টি ছবি নিয়ে এই প্রদর্শনী। প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত প্রদর্শনী খোলা থাকবে। চলবে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত।
প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস এই মহানগরীতে। নিষ্কাশনব্যবস্থা বড়ই বেহাল। ফলে প্রতিবছর বর্ষায় বিভিন্ন মহল্লায় জলাবদ্ধতা এখনো অনিবার্য। ভারী বৃষ্টি হলে বড় সড়কগুলোর অবস্থা হয় খাল-নালার মতো। সেই দৃশ্য ধারণ করেছেন আবির আবদুল্লাহ। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে—মহাসড়ক দিয়ে একই সঙ্গে রিকশা, ভ্যানের পাশাপাশি চলছে ডিঙিনৌকা। কোনো বাড়ির ছাদ বা এমন কোনো উঁচু স্থান থেকে একই সঙ্গে জনদুর্ভোগ ও মজাদার এই দৃশ্যটি ধারণ করেছেন তিনি।
আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ইঞ্জিনে পানি প্রবেশ করে থেমে যাওয়া মোটরযান ধাক্কা দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে কয়েক কিশোর। ছবিতে শব্দ নেই। কিন্তু সেদিক তাকালেই পানিতে হাঁটার ‘ছপ্ ছপ্ শব্দ’, আর ‘মারো ঠেলা হেঁইও’ আওয়াজ যেন কানে আসে। সেলফি তো এখন জীবনেরই অংশ। কাজেই রাজধানীর সড়কের হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে সেলফি তোলা হবে না, তা কি করে হয়! এক যুবক সাইকেলে চালিয়ে যেতে যেতে কোনো এক বৃষ্টির দিন জলমগ্ন পথে একটু থেমে সেলফি তোলার সময় তাঁকে ক্যামেরায় ধরে ফেলেছেন আবির আবদুল্লাহ।
স্কুলে বাচ্চাকে নিয়ে যেতে বৃষ্টির বিড়ম্বনায় পড়া মা, মার্কেটের ভেতরে হাঁটুপানি ভেঙে কেনাকাটা করতে থাকা নগরবাসী, জলমগ্ন পথের গর্তে চাকা পড়ে উলটে যাওয়া রিকশা, রাতের রাস্তায় হেডলাইট জ্বালিয়ে জলমগ্ন সড়কে চলতে থাকা গাড়ির সারি এমন অনেক ছবি উঠে এসেছে আবির আবদুল্লাহর ক্যামেরা।
বর্ষায় নগরজীবনে দুর্ভোগ আছে। কিন্তু বাংলার প্রকৃতিতে বর্ষা প্রাণসঞ্চারি। সাহিত্যে–শিল্পে এই ঋতু সৃজন প্রেরণাময়। বর্ষার বন্দনায় সমৃদ্ধি পেয়েছে কাব্য সংগীত। সেই নান্দনিকতাও কাব্যিক ব্যঞ্জনায় আবির আবদুল্লাহ তাঁর ছবিতে তুলে এনেছেন। আবির আবদুল্লাহ বলেছেন, বর্ষার নোংরা কাদা,পানি, নাগরিক জীবনের কষ্টকেই শুধু তিনি তুলে ধরতে চাননি, প্রকৃতি ও পরিবেশের বিরূপতার ভেতরেও মানুষের বেঁচে থাকার অনিঃশেষ মনোবলের গল্পগুলোও ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। দর্শকেরা প্রদর্শনীতে এলে এই বর্ষাতে তাঁদের নিত্যদিনের জীবনযাত্রাকেই দেখতে পাবেন এক অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
‘বিষ খাওয়াইয়া হাঁসগুলা মারিয়া আমারে পথে বসাই দিল’
সবে সকাল হয়েছে। বাড়ির পাশের জলমগ্ন জমিতে এদিক-ওদিকে ভাসছিল মৃত হাঁস। খামারি চেরাগ আলী ও তাঁর স্বজনেরা পানিতে নেমে সেই মৃত হাঁসগুলো তুলে জমির আলে জমা করছিলেন। একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন চেরাগ আলী। তিনি বলেন, ‘এই হাঁসগুলাই আমার সম্বল আছিল। কত যত্ন করি এইগুলারে পালছি। বিষ খাওয়াইয়া হাঁসগুলা মারিয়া আমারে পথে বসাই দিল। আমি নিঃস্ব হই গেলাম।’ তাঁর কান্নায় পাশে থাকা কয়েকজন প্রতিবেশীরও চোখ ভিজে ওঠে।
চেরাগ আলীর (৬৫) বাড়ি মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার জায়ফরনগর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে। প্রায় ১৪ বছর ধরে তিনি হাঁস পালন করছেন। তাঁর খামারে দেশি প্রজাতির ৫০০ হাঁস ছিল—কিছু ডিম দিত আর কিছু অচিরেই ডিম পাড়া শুরু করার কথা ছিল। জলমগ্ন জমিতে খাবার খেতে নেমে গতকাল মারা গেছে ৩৩৫টি হাঁস।
আজ শুক্রবার সকালে গোবিন্দপুরে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের পাশে নিচু কয়েকটি জমিতে পানি আটকানো আছে। স্থানীয়ভাবে জলমগ্ন সেই স্থান ‘গোবিন্দপুরের জাওর’ নামে পরিচিত।
চেরাগ আলী জানান, প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবার সকালে তিনি হাঁসগুলো ওই স্থানে ছেড়ে বোরো ধানের বীজতলা তৈরির কাজে দূরের জমিতে চলে যান। বিকেলে এসে দেখেন, অনেক হাঁস মৃত অবস্থায় ভাসছে। জমির আলে ছড়ানো-ছিটানো ধান দেখে তাঁর সন্দেহ হয়। দ্রুত জীবিত হাঁসগুলো বাড়িতে নিয়ে আসেন। আলো কমে যাওয়ায় মৃতগুলো তুলতে পারেননি। বাড়িতে নেওয়ার পর আরও চার-পাঁচটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তিনি জানান, তেঁতুলের রস খাইয়ে সেগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। তাঁর ধারণা, জলমগ্ন স্থানের আশপাশে ছড়ানো বিষ মেশানো ধান খেয়েই হাঁসগুলো মারা গেছে।
চেরাগ আলী আরও বলেন, ‘প্রায় ১৪ বছর ধরি হাঁস পালি। ডিম বেচিয়া সংসার চালাই। পাঁচ মাস আগে কিশোরগঞ্জ থাকি ৪০০ বাচ্চা কিনি আনি বড় করি তুলছিলাম। কিছুদিন পরেই এইগুলা ডিম পাড়া শুরু করি দিত। সব মরিয়া শেষ হই গেল।’
চেরাগ আলী জানান, জলমগ্ন স্থানটিতে এলাকার বিভিন্ন ব্যক্তির জমি আছে। বর্ষায় জমিগুলো দীর্ঘ সময় পানিতে তলিয়ে থাকে এবং মাছের আবাসস্থল হয়। শুষ্ক মৌসুমে বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রেখে সেই জলাশয় মাছ ধরার জন্য ইজারা দেওয়া হয়। এবার পশ্চিম গোবিন্দপুরের মফিজ আলীসহ কয়েকজন এটি ইজারা নিয়েছেন। মাছ ধরা শেষ হলে বোরো ধানের মৌসুমে পানি ছেড়ে দেওয়া হয়।
খামারি চেরাগ আলী ও তাঁর স্বজনেরা পানিতে নেমে সেই মৃত হাঁসগুলো তুলে জমির আলে জমা করছিলেন। আজ শুক্রবার সকালে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামে