আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি তার মিত্র দলগুলোর সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়টি দ্রুত চূড়ান্ত করতে চায়। এ জন্য ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের কাছে তাদের দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকা চেয়েছে বিএনপি।

দলীয় সূত্র থেকে জানা গেছে, এই বিষয়ে গত মঙ্গলবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় আলোচনা হয়েছে। বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা চাইছেন দ্রুত শরিক বা মিত্র দলগুলোর মনোনয়নের কাজ চূড়ান্ত করতে; যাতে নির্বাচন ও প্রার্থিতা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে অনিশ্চয়তা ও বিভ্রান্তি কাটে এবং তারা নির্বাচনী এলাকায় কার্যক্রম শুরু করতে পারে।

ইতিমধ্যে কোনো কোনো দল ও জোটের প্রধানকে মৌখিকভাবে প্রার্থী তালিকা দিতে বলা হয়েছে বলেও জানা গেছে। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের অন্যতম শরিক ১২-দলীয় জোটের প্রধান মোস্তফা জামাল হায়দার গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে। মনোনয়নের ব্যাপারে আমরা কয়েক দিনের মধ্যে বসব।’

আমরা মনে করি, নির্বাচনে আমাদের কৌশল কী হবে, কাদের বিরুদ্ধে আমরা লড়ব—আগে এগুলো ঠিক হওয়া উচিত। এরপর প্রার্থীর তালিকা।গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শরিক দল নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির দায়িত্বশীল দুজন নেতা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিমসহ যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলের কোনো কোনো শীর্ষ নেতাকে বিএনপির পক্ষ থেকে মনোনয়নের ব্যাপারে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুনবিএনপি মহাসচিবের সাক্ষাৎকার ঘিরে বিতর্ক২১ ঘণ্টা আগে

যুগপৎ আন্দোলনের আরেক শরিক জোট গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদেরও তালিকা দিতে বলা হয়েছে। লিয়াজোঁর দায়িত্বে থাকা বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য এ বিষয়ে গতকাল গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের ফোন করেছেন বলে জানা গেছে।

বিএনপির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে। মনোনয়নের ব্যাপারে আমরা কয়েক দিনের মধ্যে বসব।১২-দলীয় জোটের প্রধান মোস্তফা জামাল হায়দার

বিষয়টি স্বীকার করে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শরিক দল নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মনে করি, নির্বাচনে আমাদের কৌশল কী হবে, কাদের বিরুদ্ধে আমরা লড়ব—আগে এগুলো ঠিক হওয়া উচিত। এরপর প্রার্থীর তালিকা।’

গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক একাধিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা শুধু মনোনয়ন বা প্রার্থী তালিকা নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাইছেন না; এর আগে নির্বাচনের কৌশলসহ সংস্কার বাস্তবায়ন নিয়েও আলোচনা করতে চান।

এ বিষয়ে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র হিসেবে নির্বাচনের কৌশল ও সমীকরণ নিয়ে আমাদের বৈঠক হবে। একই সঙ্গে সংস্কার বাস্তবায়ন নিয়ে যে অনৈক্য, সে বিষয়েও আলোচনা হবে।’

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, গণতন্ত্র মঞ্চসহ বাম ধারার দলগুলোর সঙ্গে লিয়াজোঁর জন্য বিএনপির দিক থেকে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও ইকবাল হাসান মাহমুদ দায়িত্বপ্রাপ্ত। ইসলামপন্থীসহ অন্য দলগুলোর সঙ্গে লিয়াজোঁর দায়িত্বে আছেন নজরুল ইসলাম খান, আবদুল আউয়াল মিন্টু ও বরকতউল্লা (বুলু)।

যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র হিসেবে নির্বাচনের কৌশল ও সমীকরণ নিয়ে আমাদের বৈঠক হবে। একই সঙ্গে সংস্কার বাস্তবায়ন নিয়ে যে অনৈক্য, সে বিষয়েও আলোচনা হবে।গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি

মহাসচিবের সাক্ষাৎকার নিয়েও আলোচনা

বৈঠক-সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে মঙ্গলবার রাতের স্থায়ী কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের ধূম্রজাল তৈরি ও দলীয় প্রার্থিতা বাছাইয়ের কাজ নিয়েও আলোচনা হয়।

সভায় কলকাতার বাংলা সংবাদপত্র এই সময়-এ প্রকাশিত বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গও আলোচনায় ওঠে বলে স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য জানান। সভায় বিএনপির মহাসচিব যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত ছিলেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সভায় মির্জা ফখরুল জানিয়েছেন, সাক্ষাৎকারে যেভাবে তাঁর নামে কথাগুলো এসেছে, তিনি সেভাবে বলেননি। সভায় দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁকে এ বিষয়ে সৃষ্ট বিভ্রান্তি দূর করতে বলেন। পরে মঙ্গলবার মধ্যরাতে এ বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়, এই সময়-এ যে সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়, সেটি ডাহা মিথ্যা ও মনগড়া।

সভায় কলকাতার বাংলা সংবাদপত্র এই সময়-এ প্রকাশিত বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গও আলোচনায় ওঠে বলে স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য জানান। সভায় বিএনপির মহাসচিব যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত ছিলেন।

এর আগে মহাসচিবের পক্ষে বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি পাঠিয়েছিলেন। তাতে বলা হয়, সাক্ষাৎকারটি ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, যা বিভ্রান্তিকর।

উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দল ও মহাসচিবের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য কল্পনাপ্রসূত সাক্ষাৎকারটি প্রচার করা হয়েছে। বানোয়াট এই বক্তব্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণের মনে সন্দেহ ও সংশয় তৈরি করা।

মঙ্গলবার রাতে বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলামের নামে পাঠানো দলের এক বিবৃতিতে বলা হয়, সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব কোনো বিদেশি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেননি। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দল ও মহাসচিবের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য কল্পনাপ্রসূত সাক্ষাৎকারটি প্রচার করা হয়েছে। বানোয়াট এই বক্তব্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণের মনে সন্দেহ ও সংশয় তৈরি করা।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব এনপ র ম ব এনপ র স উদ দ শ য দলগ ল র ল ইসল ম প রক শ কম ট র আম দ র সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

স্বৈরতন্ত্র উত্থানের দায় আসলে কাদের

প্রাচীন গ্রিসে ক্ষুদ্র অসংখ্য নগররাষ্ট্র ছিল। সেখানে নগরের অধিবাসীকেই বলা হতো নাগরিক, যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল নাগরিকের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমরা সেই সব ব্যক্তিকে নাগরিক বলব, যাদের আইন প্রণয়ন ও বিচারিক কার্যাবলিতে অংশগ্রহণের ক্ষমতা আছে।’ তাঁর মতে, যে ব্যক্তি নগররাষ্ট্রের শাসনকাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে অক্ষম, তিনি প্রকৃত নাগরিক নন।

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নাগরিককে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে—যেকোনো রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন, রাষ্ট্র প্রদত্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করেন এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য ন্যায়ের সঙ্গে পালন করেন, তাঁকেই নাগরিক বলা যায়। একই সঙ্গে নাগরিককে অবশ্যই অন্য মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন না করার ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে।

প্রতিটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো সৎ, যোগ্য ও নীতিবান নাগরিক। রাষ্ট্রের কাঠামো ও ভবিষ্যৎ নির্ভর করে নাগরিকের চরিত্র ও আচরণের ওপর। তাই রাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন সচেতন নাগরিক—যিনি নিজের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত। এ জ্ঞান ও সচেতনতাই রাষ্ট্রকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে বলা হয় জনগণের অংশগ্রহণে, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের কল্যাণে পরিচালিত শাসনব্যবস্থা; কিন্তু প্রশ্ন হলো যদি জনগণ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অসচেতন থাকেন, তবে কি গণতন্ত্রের প্রকৃত স্বরূপ অক্ষুণ্ণ থাকে? বাস্তবতা হলো নাগরিকের অজ্ঞতা ও উদাসীনতাই স্বৈরতন্ত্রকে জন্ম দেয়।

প্রথমত, যেখানে মানুষ নিজের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞ, সেখানে শাসকগোষ্ঠী সহজেই ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে। ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন—এসব বিষয়ে নাগরিক উদাসীন থাকলে শাসকের জবাবদিহি বিলীন হয়ে যায়, তখন গণতান্ত্রিক কাঠামো টিকে থাকলেও এর প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়।

দ্বিতীয়ত, নাগরিকেরা ভয়, অজ্ঞতা বা উদাসীনতার কারণে যখন অন্যায় ও অনিয়ম মেনে নেন, তখনই স্বৈরতন্ত্র শিকড় গাড়ে। শাসকের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত তারা অন্ধভাবে মেনে নিলে সরকার জবাবদিহি এড়িয়ে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে; কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—শক্তিশালী শাসকের শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয় কেবল তখনই, যখন জনগণ ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। জার্মানি থেকে পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশের অতীত—সবখানেই দেখা যায়, নাগরিক–সচেতনতার অভাবেই স্বৈরতন্ত্রের বিস্তার ঘটেছিল।

তৃতীয়ত, নাগরিক সমাজ দুর্বল হলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শ্রমিক সংগঠন কিংবা নাগরিক সংগঠনগুলোও কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। তখন শাসকেরা সহজেই বিকল্প কণ্ঠরোধ করে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। অর্থাৎ, নাগরিকের নীরবতাই শাসকের জন্য সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্রে পরিণত হয়।

অতএব, স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন নাগরিক শিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতনতা। পরিবার থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে মানুষকে জানতে হবে তাদের অধিকার, কর্তব্য ও রাষ্ট্রের কাছে দাবি করার উপায়। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হতে হবে সত্য প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম, তোষণ বা প্রোপাগান্ডার যন্ত্র নয়। মনে রাখতে হবে—অধিকার চর্চা না করলে অধিকার হারিয়ে যায়। তাই প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য হলো নিজের অধিকার সম্পর্কে জানা ও তা প্রয়োগ করা।

সবশেষে বলা যায়, নাগরিকের অধিকার বিষয়ে অসচেতনতা কোনো ব্যক্তিগত দুর্বলতা নয়; বরং তা রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর। সচেতন নাগরিক সমাজই পারে জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র গড়ে তুলতে আর অসচেতন নাগরিক সমাজই সৃষ্টি করে স্বৈরতন্ত্রের জন্মভূমি।

ইসরাত জাহান

শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এমন মানুষও আছে, যারা বলছে ৫ বছর থাকুন, ১০ বছর থাকুন, ৫০ বছর থাকুন
  • স্বৈরতন্ত্র উত্থানের দায় আসলে কাদের
  • পিআরের নামে জামায়াত ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে: কায়সার কামাল