নেত্রকোনা শহরের নাগড়া আনন্দবাজার এলাকার এক দম্পতি অভাবের কারণে তাঁদের আড়াই মাস বয়সী যমজ সন্তান ‘বিক্রি’ করে দিচ্ছেন। ‘দামও’ প্রায় ঠিক হয়ে গেছে। খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জামান হতদরিদ্র পরিবারটির পাশে দাঁড়ান, সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ফলে আর সন্তান বিক্রি হয়নি। ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে সামনে আসে ওই দম্পতির দুঃখভরা জীবনের গল্প।

বৃহস্পতিবার দুপুরে আনন্দবাজার এলাকায় গিয়ে স্থানীয়দের কাছে সন্তান বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁরা রাজন মিয়ার বাড়ি দেখিয়ে দেন। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় একটি ঝুপড়িতে থাকেন রাজন মিয়া (২৬) ও তাঁর স্ত্রী সুমি আক্তার (২০)।

তখন বেলা একটা। ভেতরে ঢুকে দেখা গেল, ছোট্ট ছাপরাঘরটির তিন পাশে ত্রিপলের বেড়া। এক পাশে পুরোনো ফুটো হওয়া টিন। টিনের ছাউনিও ফুটো। তাই ঢেকে রাখা হয়েছে পলিথিন দিয়ে। ভেতরে অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে আসবাব বলতে দুটি ছোট চৌকি, কিছু প্লাস্টিকের চেয়ার।

একটি চৌকিতে বসে দুই নবজাতককে ফিডারে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন সুমি। অন্য চৌকিতে বসে রাজন মিয়া আলুসেদ্ধ মাখানো ভাত খাওয়াচ্ছিলেন বড় দুই সন্তান আমান মিয়া (৬) ও তুহিন মিয়াকে (৩)।

কথায় কথায় রাজন জানান, বহু বছর ধরে সরকারি জায়গাটিতে প্রায় ৩৫টি পরিবার বসবাস করে আসছে। তাঁর বাবা বাবুল মিয়া মারা গেছেন ১০ বছর আগে। বছর সাতেক আগে রাজন মিয়া সদর উপজেলার সিংহের বাংলা গ্রামের সুমি আক্তারকে বিয়ে করেন। এর বছরখানেক পর ছেলে আমানের জন্ম হয়। সংসারের হাল ধরতে রিকশা চালানো শুরু করলেও নিজের রিকশা নেই। এখন যে কাজ পান, তা–ই করেন। কখনো কাজ পান, কখনো পান না। এভাবেই চলছে সংসার। দুই বছর ধরে কিছু টাকা জমিয়ে ঘর মেরামতের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু আড়াই মাস আগে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে যমজ সন্তানের জন্মের সময় জমানো ১০ হাজার টাকা শেষ হয়ে যায়। উল্টো ৮ হাজার টাকা ঋণ করতে হয়। কাজ না থাকায় সংসারে অচলাবস্থা, খাবারের অভাবে স্ত্রীর বুকের দুধও কমে যায়। ফলে বাইরে থেকে দুধ কিনতে হয়। একে তো কাজ না পাওয়ায় টাকার অভাব, অন্যদিকে খাবারের অভাব। এমন অসহায় পরিস্থিতিতে যমজ সন্তান বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা।

বিষয়টি স্থানীয় এক ব্যক্তি জেলা প্রশাসককে জানালে তিনি গতকাল বুধবার রাতে তাঁর কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা ও সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালককে নিয়ে রাজন মিয়ার বাড়িতে আসেন। এ সময় জেলা প্রশাসক দুই টিন শিশুখাদ্য, দুই প্যাকেট শুকনো খাবারসহ পাঁচ হাজার টাকা সহযোগিতা করেন। এরপর তিনি পরিবারটি যাতে স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে, সে বিষয়ে সহায়তার আশ্বাস দেন।

রাজন মিয়া বলেন, ‘কাজকাম নাই। খিদা তো আর চুপ করে থাহে না। অভাবের সংসারে কোনোরকমে খাইয়া, না খাইয়া থাকতে হয়। সুমির বুকে দুধ না আওনে বাইরে থাইক্কা বাচ্চাদের দুধ কিনতে হয়। ঘরে খাওন নাই, ঋণের চাপ—তাই ভাবছিলাম বাচ্চা দুইটারে পালক দিয়া দিয়াম। সড়ক বিভাগের এক লোক তিন লাখ টাকা কইছিল। কিন্তু পরে আর দেই নাই। বাচ্চাটিরে আমার মায়া লাগে।’

সুমি আক্তার বলেন, ‘সন্তান তো সব মায়েরই বুকের ধন। আমরা বেচছি না। একবার ভাবছিলাম আমার কাছে থাকলে যেহেতু বালা কইরা লালনপালন করতে পারতাছি না, তাই অন্য কারও কাছে দিলে আমার বাচ্চা দুইডা বালা থাকব। পরে বুধবার রাইতে ডিসি স্যার বাড়িত আইয়া কইয়া গেছে, বাচ্চা বেচনের চিন্তা যেন না করি। তিনি সহযোগিতা করছেন এবং করবেন। তাই ওই চিন্তা বাদ দিছি।’ তিনি জানান, ছেলেটির নাম রেখেছেন হোসাইন মিয়া আর মেয়েটির নাম ফাতেমা আক্তার।

সুমি আক্তার আরও বলেন, ‘আমার জামাইয়ের নিজের রিকশা নাই। গ্যারেজে গেলে তাঁরে কেউ রিকশা দেয় না। কেউ ধার দেয় না। প্রত্যেক দিন কাম পায় না। তাই খাওন জোটাতেই অনেক কষ্ট হয়। কোনো সময় ডাইল-আলুর ভর্তা, আবার কোনো সময় খালি লবণ দিয়া ভাত দিই বাচ্চারারে। খিদায় যখন কান্দে, তখন মারি। মারলে কানতে কানতে ঘুমাইয়া পড়ে।’

রাজন মিয়ার প্রতিবেশী মো.

একরাম মিয়া বলেন, ‘রাজন মিয়া এক্কেবারে নিঃস্ব মানুষ। আগের দুইডা বাচ্চার ঠিকমতো লালনপালন করতে পারতাছে না। তাই যমজ দুইটা বাচ্চা বেচনের কথা কইছিল। আমরা না করছি।’

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি শোনার পর আমি সেখানে যাই। কিছু শুকনা খাবার (চাল, ডাল, লবণ, তেল ইত্যাদি), দুই কৌটা দুধ, কিছু চিপস, বিস্কুট ও কিছু নগদ টাকা দেওয়া হয়েছে। অনেক বুঝিয়ে ছয় বছর বয়সী ছেলেটিকে সরকারি শিশু পরিবারে দিয়ে দেওয়ার জন্য রাজি করিয়েছি। বাবা–মা দুজনেই কথা দিয়েছেন, তাঁরা আর বাচ্চা বিক্রির কথা ভাববেন না। ঘরটি মেরামতের জন্য টিন চেয়েছেন, দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। একটি রিকশা চেয়েছেন, তা–ও দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। আশা করি, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা ওই দম্পতির দুঃখভরা জীবনের অবসান ঘটাতে পারব।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সন ত ন ব ক র ন র জন ম র জন ম য পর ব র

এছাড়াও পড়ুন:

মোহাম্মদপুরে বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার ২৯

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কয়েকটি অপরাধপ্রবণ এলাকায় বুধবার দিনভর বিশেষ অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত অভিযোগে ২৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে তিনটি ছুরি, দুটি ধারালো চাকু, দুটি লোহার রড, একটি সাইকেল ও ৩০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করা হয়।

বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে নিয়মিত মামলা, মাদক মামলা, পরোয়ানাভুক্ত আসামি ও বিভিন্ন অপরাধে জড়িত অপরাধী রয়েছে।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন হীরা (১৯), রফিক (২১), আবদুর রহমান (৩৯), নাবিদ হাসান ওরফে চয়ন (২৬), খোকন (৩১), মনসুর (৩৫), জুয়েল (৩২), সানজু (২২), মিলন (৪২), শাওন (৩৬), নোয়াজ শরীফ (২৮), সেলিম (৩৪), আসাদুজ্জামান ওরফে ইমন (২৩), আনোয়ার হোসেন (৩৬), সজল (৩০), বরকত গাজী (২৮), জুয়েল (৩৮), আরমান (৩০), বাদল (৩৮), কোরবান (২৮), নয়ন (২৭), মাসরুফ (২৩), আল আমিন (২৭), রাকিব (১৮), মিলন (২৫), ওয়াজিদ (৩৬), এরশাদ (২৫), ছালাম ওরফে সামাদ (৩৭) ও দিলসার (৩০)।

সম্পর্কিত নিবন্ধ