ইজিবাইক-ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে নিরুপায় সরকার, মেয়াদোত্তীর্ণ বাস-ট্রাকও উচ্ছেদ হয়নি
Published: 28th, September 2025 GMT
সড়কের অবৈধ ও মেয়াদোত্তীর্ণ—কোনো যানবাহনই উচ্ছেদ করতে পারছে না সরকার।
এ কাজ করতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার সাড়ে ১৫ বছরে ব্যর্থ হয়েছে। আর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে চেষ্টা চালিয়েছে। তবে তারাও এগোতে পারেনি। ফলে এসব যান সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়াচ্ছে।
সরকারি ভাষ্যমতে, নছিমন, করিমন, ভটভটি, ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা অবৈধ। একই সঙ্গে ২০ বছরের পুরোনো ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান, ২৫ বছরের পুরোনো বাস-মিনিবাসও অবৈধ। এই দুই ধরনের যানবাহনই সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, দেশে বৈধ যানবাহন আছে প্রায় সাড়ে ৬৪ লাখ। বৈধ যানের ২ শতাংশের কম বাস-মিনিবাসসহ গণপরিবহন। এর প্রায় ৪৬ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ বা লক্কড়ঝক্কড়। আর সরকারের বিবেচনায় ‘অবৈধ’ তিন চাকার যানবাহন আছে প্রায় ৭০ লাখ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে চাহিদার তুলনায় গণপরিবহনের স্বল্পতা আছে। আবার যা আছে, তা–ও জরাজীর্ণ। এই প্রেক্ষাপটে কারিগরিভাবে ত্রুটিপূর্ণ তিন চাকার ব্যাটারি ও ইঞ্জিনচালিত রিকশায় ঢাকাসহ সারা দেশ ছেয়ে গেছে। এসব যান বাড়তে দিয়ে এখন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আর ত্রুটিপূর্ণ এই যানগুলো দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে। বাড়ছে প্রাণহানি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে দেশে বৈধ যানবাহন আছে প্রায় সাড়ে ৬৪ লাখ। বৈধ যানের ২ শতাংশের কম বাস-মিনিবাসসহ গণপরিবহন। এর প্রায় ৪৬ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ বা লক্কড়ঝক্কড়। আর সরকারের বিবেচনায় তিন চাকার ‘অবৈধ’ যানবাহন আছে প্রায় ৭০ লাখ।দুর্ঘটনা-প্রাণহানি বাড়াচ্ছেবিআরটিএর তথ্য অনুসারে, গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩ হাজার ৭৪১ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিন চাকার ছোট যানের আরোহী ছিলেন ৭৮৬ জন। অর্থাৎ প্রায় ২১ শতাংশ। এই তিন চাকার যানের মধ্যে নছিমন, করিমন, অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক আছে। সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি—৩২ শতাংশ ছিলেন মোটরসাইকেলের আরোহী।
বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, ২০২৪ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৭ হাজার ২৯৪ জন। এর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হন ২ হাজার ৬০৯ জন। যা মোট নিহতের ৩৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নিহত ১ হাজার ৭২৩ জন ছিলেন তিন চাকার যানবাহনের যাত্রী। যা মোট নিহতের ২৩ দশমিক ৬১ শতাংশ।
বিআরটিএ ও পরিবহন খাতের সূত্রগুলো বলছে, তিন চাকার অবৈধ যানবাহন উচ্ছেদে বরাবরই সোচ্চার বাস-ট্রাক মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। নানা বিষয়ে তাঁদের যত আন্দোলন হয়, তাতে তিন চাকার যানবাহন বন্ধের দাবি থাকে। সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন বৈঠকেও তাঁরা এসব যান বন্ধে কড়া অবস্থান নেন। কিন্তু লক্কড়ঝক্কড় বাস-ট্রাক উচ্ছেদের প্রশ্ন এলে তাঁরা সহযোগিতা করেন না। বরং ধর্মঘট ডেকে উচ্ছেদ অভিযান আটকে দেন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে পুরোনো বাস-ট্রাক উচ্ছেদের উদ্যোগ নিলে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো ধর্মঘটের ডাক দেন। পরে সরকার কিছুটা পিছু হটে।
বিআরটিএর কর্মকর্তারা বলছেন, তিন চাকার ছোট যানসহ ব্যাটারিচালিত রিকশা এখন শহর-গ্রামের সর্বত্র বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এর সঙ্গে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান যুক্ত। তবে এসব যানের সংখ্যাধিক্য ও কারিগরি ত্রুটি দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এসব যানের কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় একটি নীতিমালা করার উদ্যোগ নিয়েছে; কিন্তু এখনো তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ২০১৪ সাল থেকে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের প্রতিটি সভায় মহাসড়কসহ গুরুত্বপূর্ণ সড়কে তিন চাকার যানবাহন চলতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়ে আসছে; কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি।
অভিযান বন্ধ হয়নি। বেশি পুরোনো বাস-ট্রাক আগে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। কম পুরোনোগুলো পর্যায়ক্রমে ধরা হবে। এ ছাড়া যেসব পুরোনো বাস উচ্ছেদ করা হবে, সেগুলোর পরিবর্তে নতুন যানবাহন নামানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য পরিবহনমালিকদের সহজ শর্তে ঋণ ও আমদানিনীতি সংশোধনের বিষয়ে কাজ চলছে।মো.এহছানুল হক, জ্যেষ্ঠ সচিব, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগপুরোনো বাস-ট্রাক সরানো যাচ্ছে না
পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ও সড়ক দুর্ঘটনা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে—এই বিবেচনায় লক্কড়ঝক্কড় বাস রাস্তা থেকে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। গত বছরের শেষ দিকে দুই দফা বৈঠক করে লক্কড়ঝক্কড় বাস সড়ক থেকে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য পরিবহনমালিকদের ছয় মাস সময় বেঁধে দেওয়া হয়।
গত মে মাসে সেই সময়সীমা শেষ হয়। কিন্তু পরিবহনমালিকেরা নিজে থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ বাস-ট্রাক উঠিয়ে নেননি।
সময়সীমা পেরোনোর প্রায় দুই মাস পর গত ২০ জুলাই থেকে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযান শুরু হয়। এর মধ্যে গত ২৮ জুলাই পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতারা এই অভিযান বন্ধের দাবিতে ধর্মঘটের ঘোষণা দেন। পরে অবশ্য সরকারের সঙ্গে একাধিক বৈঠকের পর দাবিদাওয়া মেনে নেওয়ার শর্তে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, ২০ থেকে ৩১ জুলাই অভিযান চালিয়ে মাত্র ৫১টি পুরোনো বাস-ট্রাক জব্দ করে সংস্থাটি। মেয়াদোত্তীর্ণ বাস-ট্রাক রাতে চলাচল করে বেশি। এ জন্য রাতেও অভিযান চালানোর পরিকল্পনা ছিল; কিন্তু পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ধর্মঘটের ঘোষণার পর অভিযান একরকম বন্ধ হয়ে যায়। যদিও ঘোষণা দিয়ে অভিযান বন্ধ করা হয়নি।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০২৩ সালের ১৭ মে বাস-মিনিবাসের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০ বছর। আর ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানসহ মালবাহী যানের বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৫ বছর।
তবে তৎকালীন সরকার সড়ক থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ বাস-ট্রাক উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বাধার মুখে পিছু হটে। তখন এই সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়।
বিআরটিএ ও পরিবহন খাতের সূত্রগুলো বলছে, তিন চাকার অবৈধ যানবাহন উচ্ছেদে বরাবরই সোচ্চার বাস-ট্রাক মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। নানা বিষয়ে তাঁদের যত আন্দোলন হয়, তাতে তিন চাকার যানবাহন বন্ধের দাবি থাকে। সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন বৈঠকেও তাঁরা এসব যান বন্ধে কড়া অবস্থান নেন; কিন্তু পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় বাস-ট্রাক উচ্ছেদের প্রশ্ন এলে তাঁরা সহযোগিতা করেন না।অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ৬ জুন পুরোনো যানবাহনের বয়সসীমার আগের প্রজ্ঞাপনটি বহাল করে। পাশাপাশি এসব যান সড়ক থেকে উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. এহছানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, অভিযান বন্ধ হয়নি। বেশি পুরোনো বাস-ট্রাক আগে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। কম পুরোনোগুলো পর্যায়ক্রমে ধরা হবে। এ ছাড়া যেসব পুরোনো বাস উচ্ছেদ করা হবে, সেগুলোর পরিবর্তে নতুন যানবাহন নামানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য পরিবহনমালিকদের সহজ শর্তে ঋণ ও আমদানি নীতি সংশোধনের বিষয়ে কাজ চলছে।
১০ সেপ্টেম্বর সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের নেতৃত্বে সচিবালয়ে একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে পুরোনো বাসের জায়গায় নতুন বাস নামাতে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত-বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। সহজ শর্তে ঋণের বিষয়ে তাঁরা চূড়ান্ত আশ্বাস না দিলেও বিবেচনায় নেওয়ার কথা জানান বলে বৈঠক সূত্র জানিয়েছে।
বর্তমানে পাঁচ বছরের পুরোনো বাস আমদানি করা যায়। পরিবহনমালিকদের দাবি তা ১২ বছর করা। সরকার সাত বছর করার বিষয়ে চিন্তা করছে বলে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। এই বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একাধিক আলোচনা হয়েছে। এমনকি নতুন ও পুরোনো বাস আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক সংশোধনের বিষয়টিও সরকারের বিবেচনাধীন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব সাইফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পুরোনো বাস-ট্রাক উচ্ছেদে তাঁদের কোনো আপত্তি নেই। তবে হুট করে উচ্ছেদ করলে শূন্যতা তৈরি হবে, ভোগান্তি বাড়বে। তাই নতুন বাস আমদানিতে সরকারের সহজ শর্তে ঋণসহায়তা চাইছেন তাঁরা। ঋণ পেলে পুরোনো বাস আর থাকবে না।
নানা ত্রুটিযুক্ত বিপুলসংখ্যক এসব যানের চলাচল নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ। তবে এই যানবাহনগুলো যেভাবে ছড়িয়েছে, এর সঙ্গে যত সংখ্যক মানুষ যুক্ত রয়েছেন, তা হুট করে বন্ধ করা যাবে না।অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামান, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগঅবৈধ যানের দাপটবিআরটিএ ২০ ধরনের যানবাহনের নিবন্ধন দেয়। গত জুলাই পর্যন্ত নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬৪ লাখ। অন্যদিকে নিবন্ধিত যানবাহনের বাইরে প্রায় ৭০ লাখ তিন চাকার ছোট যানবাহন চলাচল করে। এগুলোকে সরকার অবৈধ হিসেবে বিবেচনা করে। এসব যানের মধ্যে রয়েছে নছিমন, করিমন, আলমসাধু, ভটভটি, ইজিবাইক ও পাখি। সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে ব্যাটারি বা যন্ত্রচালিত রিকশা।
বিভিন্ন ধরনের তিন চাকার অবৈধ যানবাহনের প্রকৃত হিসাব সরকারের কোনো দপ্তরে নেই। বিআরটিএ, যাত্রী অধিকার সংগঠন, পুলিশ ও অন্যান্য অংশীজনের অনুমিত হিসাবমতে, ব্যাটারি-যন্ত্রচালিত তিন চাকার অবৈধ যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে আছে প্রায় ৫০ লাখ। আর ঢাকায় আছে ২০ লাখের মতো।
তিন চাকার এই যানবাহনগুলোর কাঠামোগত ও যান্ত্রিক ত্রুটি রয়েছে বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নানা ত্রুটিযুক্ত বিপুলসংখ্যক এসব যানের চলাচল নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ। তবে এই যানবাহনগুলো যেভাবে ছড়িয়েছে, এর সঙ্গে যত সংখ্যক মানুষ যুক্ত রয়েছেন, তা হুট করে বন্ধ করা যাবে না।
অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামানের সুপারিশ হলো এই যানকে নীতিমালার আওতায় এনে কারিগরিভাবে উন্নয়ন করা যেতে পারে। কোন কোন সড়কে, কতসংখ্যক এই যান চলতে দেওয়া হবে, তার একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা থাকা দরকার।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সড়ক দ র ঘটন প র য় ৭০ ল খ সড়ক পর বহন র উদ য গ ন এসব য ন র দ র ঘটন য় ব আরট এ সরক র র ন ত হয় এ জন য এই য ন বছর র আমদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
গ্রামীণ ব্যাংকের দুই শাখা ও পাঁচ গাড়িতে আগুন, ককটেল হামলায় আহত ২
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা প্রথম মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সাতটি জেলার বিভিন্ন স্থানে যানবাহন ও প্রতিষ্ঠানে আগুন এবং ককটেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। গতকাল রোববার রাত থেকে আজ সোমবার ভোর পর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটে।
এর মধ্যে ঢাকার সাভারে দুটি ও ধামরাইয়ে একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। একই ঘটনা ঘটেছে নারায়ণগঞ্জে। কিশোরগঞ্জে সড়কে গাছ কেটে অবরোধ, গ্রামীণ ব্যাংক ও অ্যাম্বুলেন্সে আগুন দেওয়া হয়েছে। বগুড়ার ধুনটে গ্রামীণ ব্যাংকের শাখায় আগুন দেওয়া হয়েছে। মানিকগঞ্জে ককটেল বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন দুজন। গাজীপুরে গ্রামীণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের নামফলকে আগুন ও ককটেল বিস্ফোরণ হয়েছে। সিলেটে আগুনে পুড়েছে কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
সাভার–ধামরাই
ঢাকার ধামরাই ও সাভার উপজেলায় গতকাল রাতে প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যে দুটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। এ ছাড়া আজ ভোরে সাভারে একটি মিনিবাসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
গতকাল রাত আনুমানিক ১০টার দিকে ধামরাইয়ের ঢুলিভিটা বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত ১০টার দিকে দুটি মোটরসাইকেলে তিনজন ব্যক্তি এসে ডি–লিংক পরিবহনের পার্ক করা একটি বাসের পেছনের জানালা ভেঙে ভেতরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর মোটরসাইকেল নিয়ে দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন পানি ও বালু ছিটিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। খবর পেয়ে ধামরাই ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভায়। আগুনে বাসের ভেতরের অধিকাংশ আসন পুড়ে গেছে।
এর প্রায় আধা ঘণ্টা পর সাভারের বিরুলিয়া বেড়িবাঁধ–সংলগ্ন বটতলা এলাকায় অন্য একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। সাভার মডেল থানার পুলিশ জানায়, রাত সাড়ে আটটার দিকে আলিফ পরিবহনের বাসটি পার্ক করে বাড়িতে খাবার খেতে যান মালিক আমজাদ হোসেন। রাত পৌনে ১১টার দিকে আগুন লাগার খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় আগুন নেভান।
সাভার মডেল থানার বিরুলিয়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আবদুল ওয়াহাব বলেন, পার্ক করা বাসে কে বা কারা আগুন দিয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সাভারের আশুলিয়ায় বেরন এলাকায় সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মিনিবাসে আজ ভোরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে বাসটির অধিকাংশ আসন পুড়ে যায়।
চালক ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গেছে, গতকাল যাত্রী পরিবহন শেষে রাতে আশুলিয়ার বেরন এলাকায় সড়কের পাশে গ্রামীণ পরিবহন নামের মিনিবাস দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। ভোর চারটার দিকে চালকের সহকারী বাসটি ধুয়েমুছে টয়লেটে যান। ফিরে এসে তিনি দেখেন বাসটিতে আগুন জ্বলছে। পরে আশপাশের লোকজন পানি দিয়ে দ্রুত আগুন নিভিয়ে ফেলেন।
আরও পড়ুনবাস ধুয়েমুছে চালকের সহকারী ওয়াশরুমে গিয়েছিলেন, ফিরে দেখেন আগুন জ্বলছে১ ঘণ্টা আগেমানিকগঞ্জ
মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকা ও আশপাশে আধা ঘণ্টার ব্যবধানে তিনটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে দুই রিকশাচালক আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার রাতে মানিকগঞ্জ শহরে এ বিস্ফোরণ ঘটে।
আহত দুই ব্যক্তি হলেন মানিকগঞ্জ পৌরসভার বান্দুটিয়া এলাকার সাগর হোসেন ও বেউথা এলাকার নবীন হোসেন। তাঁদের জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
সদর থানার পুলিশ ও স্থানীয় একাধিক সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল রাত ১০টার দিকে মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ‘অদম্য ৭১’ ভাস্কর্যের সামনে পরপর দুটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় দুর্বৃত্তরা। খবর পেয়ে পুলিশ তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত শুরু করে। এর প্রায় আধা ঘণ্টা পর বাসস্ট্যান্ডের অদূরে পৌর সুপারমার্কেটের সামনে দুর্বৃত্তরা আরও একটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে রিকশাচালক সাগর ও নবীন আহত হন। পরে তাঁদের জেলা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়।
আরও পড়ুনকিশোরগঞ্জে রাতে সড়কে গাছ কেটে অবরোধ, গ্রামীণ ব্যাংক ও অ্যাম্বুলেন্সে আগুন২ ঘণ্টা আগেগাজীপুর
গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার খাড়াজোড়া এলাকায় গ্রামীণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের নামফলকে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। একই সঙ্গে প্রধান ফটকের সামনে ককটেল বিস্ফোরিত হয়েছে। আজ ভোর পৌনে পাঁচটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এরপর ওই এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে খাড়াজোড়ায় গ্রামীণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক অবস্থিত। পুলিশ ও কারখানার নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, প্রতিষ্ঠানের প্রধান ফটকের পাশের নামফলকে ভোর পৌনে পাঁচটার দিকে কয়েকজন দুর্বৃত্ত অগ্নিসংযোগ করে এবং ফটকের সামনে একটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। পরে নিরাপত্তাকর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। এতে নামফলকের কিছু অংশ পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খবর পেয়ে গাজীপুর শিল্প পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে।
আরও পড়ুনমানিকগঞ্জে রাতে আধা ঘণ্টার ব্যবধানে ৩টি ককটেল বিস্ফোরণ, আহত ২৪ ঘণ্টা আগেনারায়ণগঞ্জ
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লায় সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল রাত দুইটার দিকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ইসদাইর এলাকার আয়কর কার্যালয়ের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
বাসটির ভেতর ওই সময় ঘুমিয়ে ছিলেন চালক ও তাঁর সহকারী। তাঁরা তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি টের পাওয়ায় অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন। তাঁদের দাবি, আগুন লাগার পরপরই নিয়ন্ত্রণে আনার ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো গেছে।
বাসে আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগেই নিয়ন্ত্রণে আসে বলে জানান ফতুল্লা মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ঘটনাস্থলসংলগ্ন সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে দুর্বৃত্তদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
আরও পড়ুননারায়ণগঞ্জে গভীর রাতে দাঁড়িয়ে থাকা বাসে আগুন, তাপে চালক জেগে ওঠায় রক্ষা২ ঘণ্টা আগেকিশোরগঞ্জ
কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার শ্রীরামদী এলাকায় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে সড়কের পাশের একটি লিচুগাছ কেটে সড়ক অবরোধ করেন একদল ব্যক্তি। গতকাল রাত দেড়টার দিকে হওয়া এ ঘটনায় কিশোরগঞ্জ-পাকুন্দিয়া সড়কে যানবাহন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে গাছ সরিয়ে সড়ক চলাচলের উপযোগী করে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, গতকাল দিবাগত রাত দেড়টার দিকে হঠাৎ মোটরসাইকেলে করে কয়েক ব্যক্তি শ্রীরামদী এলাকায় প্রবেশ করেন। তাঁরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে সড়কের পাশে থাকা বড় লিচুগাছটি কেটে রাস্তার ওপর ফেলে দেন। এ ঘটনায় মুহূর্তেই সড়ক অচল হয়ে পড়লে বিভিন্ন যানবাহন আটকে যায়।
অন্যদিকে একই রাতে কিশোরগঞ্জ শহরের স্টেশন রোড এলাকায় অবস্থিত গ্রামীণ ব্যাংকের যশোদল শাখায় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে অগ্নিসংযোগ করেন মাস্ক পরা এক ব্যক্তি। ঘটনার সময় পাশের একটি দোকানের সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণ করা ফুটেজে দেখা যায়, মাস্ক পরা এক ব্যক্তি ব্যাংকের নিচতলায় আগুন ধরিয়ে পালিয়ে যান। তবে আশপাশের লোকজন দ্রুত এগিয়ে এসে আগুন নিভিয়ে ফেলায় বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
এদিকে কিশোরগঞ্জ সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অ্যাম্বুলেন্সে অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা। আজ ভোর সাড়ে ৪টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে কিশোরগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে অ্যাম্বুলেন্সটি পুড়ে যায়।
আরও পড়ুনকিশোরগঞ্জে রাতে সড়কে গাছ কেটে অবরোধ, গ্রামীণ ব্যাংক ও অ্যাম্বুলেন্সে আগুন২ ঘণ্টা আগেবগুড়া
বগুড়ার ধুনট উপজেলায় গ্রামীণ ব্যাংকের গোসাইবাড়ী ইউনিয়ন শাখা কার্যালয়ে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। আজ ভোরে গ্রামীণ ব্যাংকের ওই শাখার ভবনের বারান্দায় পেট্রল ঢেলে আগুন দেওয়া হয়। এতে ব্যাংকের বিদ্যুতের সংযোগের তার পুড়ে গিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ ছাড়া বারান্দায় থাকা একটি ব্যানার ও আসবাব পুড়ে যায়।
ব্যাংকের নৈশপ্রহরী শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘রাতে বারান্দায় সতর্ক অবস্থায় ছিলাম। রাত তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার দিকে হঠাৎ বারান্দায় আগুন পাই। দুর্বৃত্তরা পেট্রল ঢেলে আগুন দিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।’
ধুনট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইদুল আলম বলেন, ‘ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে নাশকতাকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।
সিলেট
সিলেটের পাঠানটুলা এলাকায় নবাবী মসজিদের পাশে গতকাল রাত দেড়টার দিকে কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও গাড়ি মেরামতের দোকানে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। এতে বেশ কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও গাড়ি মেরামতের দোকান পুড়ে গেছে। তবে এ ঘটনায় কেউ হতাহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। এটি নিছক দুর্ঘটনা নাকি দুর্বৃত্তদের কাজ, পুলিশ তা খতিয়ে দেখছে।
পুলিশ জানায়, স্থানীয় লোকজন আগুন লাগার ঘটনা দেখতে পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশকে খবর দেন। ফায়ার সার্ভিসের ছয়টি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এলাকাবাসীও আগুন নেভাতে সহায়তা করেন। রাত পৌনে তিনটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছে। যান্ত্রিক বা বিদ্যুতের ত্রুটি থেকে আগুন লাগতে পারে। পুরো বিষয়টি ফায়ার সার্ভিস খতিয়ে দেখছে। ভেতরে কোনো দাহ্য পদার্থ আছে কি না, সেটাও তারা যাচাই করছে। ফায়ার সার্ভিসের মন্তব্যের পর আগুনের কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে।’
(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা।)