চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে মহাসড়কে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে গেছে একটি আলুবোঝাই ট্রাক। এ সময় ঘটনাস্থলে ট্রাকচালক নিহত হয়েছেন। আজ বুধবার ভোরে উপজেলার ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের ছোট কমলদাহ এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চট্টগ্রামমুখী লেনে এই দুর্ঘটনা ঘটে।

নিহত চালকের নাম মো. ইদ্রিস মহাজন (২৪)। তিনি ভোলার লালমোহন থানার গজারিয়া এলাকার সুলতান মহাজনের ছেলে। চোখে ঘুম নিয়ে গাড়ি চালানোর কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে ধারণা পুলিশের।

দুর্ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের একটি দল ইদ্রিস মহাজনের লাশ উদ্ধার করে। জানতে চাইলে মিরসরাই ফায়ার স্টেশনের দলনেতা হায়াতুন্নবী প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাকটি চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিল। ছোট কমলদাহ এলাকার শওকত ফিলিং স্টেশনের সামনে ট্রাকটি উল্টে মহাসড়কের বাইরে পড়ে যায়। তিনি বলেন, দুর্ঘটনার সময় ট্রাক ও আলুর বস্তার নিচে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলে চালকের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর লাশ উদ্ধার করে কুমিরা হাইওয়ে থানা-পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে ফায়ার সার্ভিস।

কুমিরা হাইওয়ে পুলিশের উপপরিদর্শক মো.

ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ধারণা করা হচ্ছে চালক চোখে ঘুম নিয়ে গাড়ি চালানোয় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনাকবলিত ট্রাকটি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। নিহত চালকের পরিবারকে খবর দেওয়া হয়েছে। তারা এলে আইনগত প্রক্রিয়া শেষে লাশ বুঝিয়ে দেওয়া হবে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দ র ঘটন চ লক র

এছাড়াও পড়ুন:

স্মৃতির ভাড়ারে উপচানো শূন্যতা

প্রতিদিন সকালে বিছানা থেকে মাটিতে দুই পা থপ করে নামিয়ে বসে থাকি কিছুক্ষণ। নিজের পা দেখি, বসে বসে দেখতে থাকি। সহসা উঠে দাঁড়াতে ভরসা দিতে চায় না ওরা। একটা জীবনের ভার বয়ে চলেছে যে শরীর, মন, মগজ, স্কন্ধ কিংবা ত্বক, সেই চাপ, যেন প্রতিদিন সকালে চাপ চাপ হয়ে লেগে থাকে চোখে, আঙুলে, নখের ডগায়। শিশুকালের মতো ঘুম ভেঙেই লাফিয়ে ওঠা এখন স্মৃতিতে ঝাপসা, ঘষামাজা কাচের এপাশ থেকে যেমন ওপারের দুনিয়া দেখা সুখের নয়, তেমনি এমন স্থবিরতা নিয়ে শিশুবয়সের চপল স্মৃতি মনে করা কঠিন।

একটা বয়স পরে হয়তো ২০/২৫ বা ১৯ কিংবা ২৩/২৪-এর পর বা হতে পারে আরও পরে, কারও কারও ক্ষেত্রে আরও আগে প্রতিটি দিন যেন প্রতিটি দিনের চেয়ে ভারী হয়ে উঠতে থাকে। আর তেমন রকম একটা জীবনের ওপর দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকালে সেখান থেকে অতীতের সুখগুলো রং হারিয়ে ফিকে হয়ে ওঠে, নস্টালজিক ভালো লাগাটুকু আর কাজ করে না। মচমচে তাজা স্মৃতিরা কষ্টে আর্দ্র হয়ে নেতিয়ে যায়, ছাতা পড়ে পড়ে বিবর্ণ হয়, কালশিটে জমে। মগজের পেঁচালো থকথকে ভাঁজের খাঁজে অহেতুক ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মুখবিহ্বরে নোংরা লালা ঝরায় ফেলে আসা শৈশব। বরং দুঃখগুলো, না পাওয়া বেদনাগুলো, স্বজন–বন্ধুদের অপমানগুলো খানিক হাসায়, ভাবায়। যেসব স্মৃতি একসময় রূঢ়তায় কাঁদিয়েছে, হারিয়েছে আমাকে, এখন মনে হয়, ওটা কোনো হারই ছিল না, কান্নার পেছনের ওই ইগো কবে কখন খসে পড়েছে, যেন মুখোশ ছিল— তার খবর রাখতে দেয়নি রুক্ষ জীবন।

জীবন আমার কঠিনই ছিল বরাবর। আর পাঁচটা মানুষের চেয়ে অন্য রকম। অন্য রকম মানে অনেক বেশি সাধারণ, প্রয়োজনের তুলনায় যতটা সাধারণ হলে মাথা তুলে প্রশ্ন করা যায় না, যতটা সাধারণ হলে ‘না’ বলা যায় না, ঠিক ততটা সাধারণ। যে জীবন অনেক বেশি সাধারণ কিন্তু সাক্ষী হতে হয়, সয়ে নিতে হয়, মেনে নিতে বা মানিয়ে নিতে হয় অস্বাভাবিক সব ঘটনাবলি। উচ্ছিষ্ট নোংরা সব অভিজ্ঞতার নখর পড়েছে জীবনের ঘাড়ে, লেলিহান জিব চেটে নিয়েছে ঘেয়ো ত্বক। অনেক অনেককাল চোখের তারায় তারায় সেই সব ক্ষত দগদগ করে জেগে ছিল। জেগে ছিল পুঁজে ভরা সেসব ক্ষত, কতকাল ঘুমের ঘোরে, অঙ্কের ক্লাসে কিংবা গরমে মুড়ির টিন বাসে ঘরে ফেরার সময় অকারণ চোখের সামনে হাত নেড়ে দুঃস্বপ্নের সেই সব ভনভন মাছি তাড়িয়েছি। কে দেখেছে? যে দেখেছে, পাগল ভেবেছে হয়তো। আর যে দেখেনি, দেখেনি।

এক লবডঙ্কা শৈশব শেষে কৈশোর কেটেছে এক টোল পড়া কপোলের প্রেমে, ডায়েরির পাতা ভরে যেত হৃদয়ের দোয়াতকালিতে। যত্ন করে লিখেই গেছি, একমনে, নিষ্ঠায়। বিভোর হয়ে ভাবতাম, চাইতাম অক্ষরগুলো কেউ বুকে বয়ে বেড়াক। সেগুলোকে নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে দেব, এমন দম আমার ছিল না। অথচ স্কুলের সিনিয়র শাফায়াত ভাইয়ের চিঠির দূতিয়ালি করতে বাধ‍্য হয়েছি দিনের পর দিন। স্কুলে শাফায়াত ভাইয়ের কিছু পছন্দ না হলেই পুকুরপাড়ে শিমুলগাছের পেছনে বসত সালিস। অদ্ভুত সব শাস্তির আয়োজন করে, ভিকটিমকে হীনম্মন্য করে সবার সামনে হাস্যস্পদ করে তুলতে শাফায়াত ভাইয়ের জুড়ি নেই। এগুলো করে শাফায়াত ছোটবড় সবার সমীহ আদায় করে নিত। অনেকে তো শাফায়াত গ‍্যাংয়ের সদস্য হবার জন্য মরিয়া ছিল। শিক্ষকেরাও ওদের সঙ্গে পেরে ওঠেন না। যেন ত্রাস। আমাকে হয়ে উঠতে হলো শাফায়াত ভাইয়ের ডাকপিয়ন। ‘না’ বলার সুযোগ নেই। শাফায়াত ভাইয়ের সালিসি নিপীড়নের কাছে টিসি খাওয়া বাপের শাসানি তুচ্ছ মনে হতো। তা ছাড়া মাস্তানি না করে যদি কেবল চিঠি পৌঁছে দিয়েই এমন ক্ষমতাবান মানুষের কাছে বিশেষ হয়ে ওঠা যায়, তবে কে আর সামান্য হতে চায়। শাফায়াত ভাই মানে দুর্বার সাহস আর পৌরুষ। আর প্রতিটা সালিস যেন একেকটি অ্যাকশন সিনেমা। ছাত্ররা দম আটকে দাঁড়িয়ে থাকে, ভাই কী বলবে, তা শোনার জন্য। ছোট–বড় কিংবা সমবয়সী—সব পৌরুষপূজারি ছাত্র হাততালিতে ফেটে পড়ে ভাইয়ের দাপট দেখে আর দেখে ভিকটিম কী করে আসল পুরুষের কাছে নেতিয়ে পড়ে।

তারপরও আমাদের কখনো কখনো মনে হয়, একটু যেন বাড়াবাড়িই হয়ে যাচ্ছে। তবু কেউ কোনো দিন প্রতিবাদ করেছি, এমনটা হয়নি। আমাদের চোখ ঠিকরে পড়ত ভয়ে, একটা খুব সাধারণ ছেলে হয়তো সে সুদর্শন বা সুদর্শন নয়, হয়তো এই বয়সেই সে কিছুটা কাব‍্যিক হয়ে উঠেছে অথবা বয়ঃসন্ধির দোষে গলাটা একদম খটখট করছে, সেই রকম অতি কাছের কোনো এক ছেলের অসহায় ভঙ্গি, ভয়ার্ত চোখ আর কাতর চোখ দর্শককে যা দিতে পারে, তা আসলে যেকোনো থ্রিলারের চেয়ে বেশি কিছু হয়ে ওঠে।

সেই রকম এক ঘটনার পর কমলদা চলে গেল। সাত দিনের মাথায়! স্কুলের যে মেয়ে ওকে চেয়েছিল, রিমি, সে আজ কোথায় আছে, কে জানে! কমলদা যখন ঘরের দেয়ালে ‘I quit’ লিখছিল, তখন কি আমাদের দেঁতো মুখ, আমাদের হাসি ওর ঘরের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল! আমার কেবলই মনে পড়ে, রিমির হৃদয়ের অক্ষরগুলো কমলদা বুকপকেটে বয়ে বেড়াত, কোনো পরোয়া করত না!

কমলদার ও রকম চলে যাবার পর, প্রথমে ফেসবুক সরব হলো, তার তালে তালে মিডিয়া। শাফায়াত ভাইরা কিছুদিন লুকিয়ে ছিল। তারপর সব কখন কীভাবে যেন ঠিকঠাক হয়ে গেল। একসময় রিমির মা–বাবা বদলি হয়ে চলে গেল। শহরে আবার বর্ষা এল, জারুল ফুটল, ডিমলার মোড় রাতের বৃষ্টিতে ছাতিমের গন্ধে পাগল হয়ে গেল। শরতে ক্ষীণাঙ্গিনীর পার কাশফুলে ছেয়ে গেল। সারা শহরের বাতাসে কাশফুলের বীজ ফেটে চৌচির হয়ে ঘুরে বেড়ায়; ভালো–মন্দ, সুন্দর–অসুন্দর ভেদাভেদ না করেই কারও গায়ে, জামায় বা মাথায় এসে দম নেয়।

আজ এত বছর পরও মনে হয়, কী এক বেকার জীবন আমি যাপন করেছি সেই দিন বা তারও আগে থেকে। কখনো মাথা তুলে দাঁড়াইনি। কোনো দিন বলিনি, তুমি ভুল আর কাজটা অন্যায়। সবাই একত্রে অন্যায় করলেও, যেটা অন্যায়, সেটা যে অন্যায়ই, কেন কখনো বলিনি বা বলতে পারিনি? আমার ভেতরের সাহসটাকে আমি কখনো বড় করে তুলতে পারিনি কেন?

আমার মতন অন্তঃসারশূন্য মানুষ কি এসব প্রশ্নের নাগাল পায়? এই সংসারে আমি আসলে কখনো হিরো হয়ে উঠতে পারিনি। সিনেমায় যেমনটা দেখায় অথবা অন্তত আমার বন্ধু রাজনের মতো! পার্টি করে কনস্ট্রাকশনের সাইট ঘুরে ঘুরে চাঁদা তুলে পশ্চাদ্দেশে একটা মোটরসাইকেল নিয়ে ভটভট করে মফস্‌সলের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে পারিনি কখনো? কলেজের ক‍্যানটিনে বন্ধুবান্ধব নিয়ে চা খেয়ে, বিড়ি ফুঁকে বাকির খাতায় নাম লিখিয়ে আবার ক‍্যানটিন বয়কে কড়কড়ে ৫০ টাকার নোট দিয়ে দুস্থ শিশুর চোখের বিস্ময় কিনতে পারিনি কখনো? নির্বিষ ঢোঁড়া সাপের মতন একটা মানুষ আমি, যেন এই সংসারে আছি, আবার নেইও। বাজার থেকে মাছের সঙ্গে মিলিয়ে সবজি কিনতে শেখেনি যে মানুষ, ঠিকমতো চোখে চোখ রেখে কথা বলতে শেখেনি যে মানুষ, শেখেনি কোন জামার সঙ্গে কোন রঙের প‍্যান্ট পরতে হয়। ক‍্যাম্পাসে গিটার বাজিয়ে আসর জমিয়ে গাইতে পারা, গলা কাঁপিয়ে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করে স্লোগান দেওয়া, নিদেনপক্ষে কবিতা লিখে একটু ভারী গলায় নবীনবরণে আবৃত্তি—সেসব কিছুই ঘটেনি যার জীবনে! আরও পরে জানা গেল, ভাইভা বোর্ডে একের পর এক পাল্টা প্রশ্নের জবাবে চার–ছয় কী করে হাঁকাতে হয়, সে–ও এক অজানা বিস্ময় হয়ে থেকে যাবে আমার কাছে। তবু প্রাপ্তির ঝুলি আমার কেমন ভারী হয়ে উঠেছিল! পোয়াতি নারী যেমন গর্ভভারে নুয়ে পড়ে, তোমাকে পেয়ে আমিও কি তেমনই নুইয়ে পড়িনি?

কী এক টান টান উত্তুঙ্গ প্রেম তবু এসেছিল আমার জীবনে! আবার এরপর কী এক ভয়ার্ত দাম্পত্য দেখতে হলো! কী করে এঁটো হয়েছি, ছোট হয়েছি—আমি—যে আনত চোখকে সলাজ ভেবেছি, সেই একই চোখ, তার দৃষ্টিতে পাথর হয়েছি আমি কত শতবার। কত শতবার আমাকে পাথর করে দিয়েছে তার চোখ। যেন সাক্ষাৎ মেডুসা সে! কারা যেন আমার ঘুমন্ত কানে ক্রমাগত বলে গেছে—বহুবার হাজারবার। ঘুমন্ত কানে চিক্কণ সর্পিল বিষ ঢেলেছে কারা, যেন সে সাক্ষাৎ মেডুসা! পুঁজের মতো ঘিনঘিনে কথা কানে কানে বলে গেছে কারা যেন! তার চুলের ভাঁজে ভাঁজে কিংবা বিনুনির আড়বাঁধনে লুকিয়ে আছে সর্পিল শাবকেরা। সেই সব কুচক্রী বিষ ভয় দেখিয়ে গেছে শুধু, যেন তার কাছে গেলে, যেন তার চুলের ঘ্রাণের টানে নিশ্বাস সমান দূরত্বে চলে এলেই জেগে উঠবে শতসহস্র লালিত সর্পিল শাবক। যে বুকের পলি জন্মাতে পারে কুসুমকলি, যেখানে ঘুমিয়ে থাকে শূক ও সারি, সে জমিন ঊষর আজ, কার দোষে কে–ই বা জানে!

নপুংশক! কেবল নপুংশক বলে বলে দায় চাপিয়ে সরে গেছে সে, সেই গ্লানি কাঁটা বিছিয়েছে ঘরের করিডরে, দরজার বাইরে পাপোশে, সিঁড়ি, অন্ধকার গ‍্যারেজ, গ‍্যারেজ পেরিয়ে চিপা গলি, গলিতে সার সার রিকশা—যেন বৃহৎ এই বুভুক্ষু অজগর গিলে নেবে সবই। এমনকি বারান্দা, জানালার গ্রিলে কাঁটা, আর ষড়যন্ত্রের ফিসফাস বলে চলে, জানো, সাক্ষাৎ মেডুসা সে! কতকাল সূর্য দেখিনি, তারা গুনিনি আমি; চাঁদের চিক্কণ হওয়া, গোল হওয়া, আধখান হওয়া কত দিন, কত্ত দিন দেখিনি আমি! শুধু মগজে কিসের ফিসফিসানি, মৃদু মৃদু ঢেউ, মৃদু ফিসফাস, জানো, সাক্ষাৎ মেডুসা সে! সাক্ষাৎ!

আমি চিৎকার করে উঠি, আমি পালাতে চাই, পালাতে চেয়েছি কতবার। কতবার তোমার কাছে যেতে চেয়েছি, এত কাছে যেখানে নিশ্বাস সমান দূরত্ব, এত কাছে যেখানে দিলের ধুকপুকানি শোনা যায়, তোমার চুলের ধূপ ধূপ গন্ধ ঢুকে যায় নাসারন্ধ্রে আর কষে লাথি মেরে আমাকে আমূল জাগিয়ে তোলে। তোমার চোখের সজলতায় ডুবে ডুবে বারবার ভেসে ওঠা যায়। তলিয়ে যেতে চেয়েছি কতবার আমি তোমার মধ্যে। পারিনি। দুহাতে কান চেপে এগোই আর মগজে তার আসে, সাবধান, সাক্ষাৎ মেডুসা সে! তোমার শক্ত চোয়াল, চাহনির ফলা, চুলের ভাঁজে ভাঁজে লালিত শাপেরা জখম করেছে আমায়, তুমি তা জানোনি। আমার হৃদয় পাথর হয়েছে, চৌচির হয়েছে, তুমি জানোনি, প্রস্রবণধারায় যে হৃদয় শীতলতা খুঁজেছিল বারবার, যেখানে ফুটে উঠতে পারত সাদা শতদল; সেইখানটায় তুমি মাথা রাখোনি বলে এই গোটা জীবন আমার ব‍্যর্থ হলো।

আমি যে মরব! মরাকে বড় ভয় হয়, শুনেছি কবরে ঘোর জমাটি আঁধার, অন্ধকারে সাপ পেঁচিয়ে ধরে। এসব ভাবতে ভাবতে বুকের মাঝখান দিয়ে সন্তর্পণে কোনো এক সরীসৃপ ডান থেকে বাঁয়ে চলে যায়। যেন ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে সে। খেয়ে নিচ্ছে আমার ফুসফুস, হৃদয়। নইলে এতটা ভালোবাসাহীন, প্রেমশূন্য কী করে পড়ে আছি আমি মহাকালের মতো। রাত গভীর হলে তিনটা নেংটি ইঁদুর খেলা করে ঘরময়। রাতের এই গভীর কী অসম্ভব কোলাহলময় হয়ে ওঠে ওদের জন্য। একটু দূরে পুরোনো তিনতলা ভেঙে গড়ে উঠছে হাইরাইজ। রাতে কাজের টুংটাং শব্দ, বড় স্পিন ড্রাম এনে মর্টার বানিয়ে চলে ছাদঢালাইয়ের গর্জন, মাথা ফাটিয়ে দেয় আমার। কুচক্রী ফিসফাস মন্ত্রণা নিস্তব্ধ হয় খানিক। ঘুমহীন রাতের জমাটি সরীসৃপ আঁধার ধোঁয়াশা হয়, খানিক স্বস্তি বিলায়।

এ ঘরে আজ কতকাল বন্দী আমি, জানি না। ব‍্যর্থ দাম্পত্যের দায় নিয়ে এ মুখ আমি আর কাউকে দেখাইনি। আমি আকালের মতন একাই হতে চেয়েছি। অথচ এত বছরেও এই একা হওয়াটা এতটুকু সহনীয় হলো না। আজও কী ভয়ানক কঠিন ঠ‍েকে এই শূন্যতা আমার কাছে। কুলসুমের মা সামান্য চাল–ডাল ফুটিয়ে ঘরের সামনে এসে বলে, ‘ঘর মুছমু, বাইরোন!’ বেশির ভাগ দিনই আমি বেরোই না। ঘর–মশারি এমনি পড়ে থাকে, খাবার ডাইনিংয়ে এমনি তোলা থাকে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, কুলসুমের মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরি, বলি, চলো, তোমাকে নিয়েই সংসার করব, সঙ্গে সঙ্গে সেই চিন্তা খারিজ হয়ে যায়। আর কী এক অজানা শঙ্কা দামামা বাজায়। কুলসুমের মা সন্তর্পণে ঘরে ঢুকে ফ‍্যান বন্ধ করতে চাইলে খেঁকিয়ে বিদায় করে দি, ‘ঘর পরিষ্কার করতে হবে না।’ যেন আমার কানে তরল বিষ কেউ ঢেলে দেয়, আমি মহাকাল হয়ে নীল হয়ে চিত হয়ে পড়ে থাকি। আমার ভয় হয় মৃত‍্যুকে অথবা মৃত‍্যুর পরের জীবনকে। মৃত‍্যুর পর সেই একাকী অনন্তকাল শুয়ে থাকায় ভীষণ ভয় আমার। তখন কমলদার কথা মনে হয়, কমলদা যখন ‘I Quit’ লিখল, তার কি এমন ভয় লাগেনি? মানে কিংবা মনে কতটা লাগলে এই ভয়টুকু কিংবা বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষাটুকু ফিকে হয়ে যায়! আমিও তো ২৭ পেরোনোর পর থেকে এই বাড়িটায় রাতদিন একাকী অক্লান্ত শুয়ে আছি যেন এক মৃত লাশ। নিজেকে নিজেই দাফন করে নিয়েছি যেন অনন্তকাল আগে। অবিশ্রান্ত একাকী শুয়ে থাকার এই যে অনুশীলন, এই একই ঘর-বিছানায়, একই অন্ধকারে তবু কোনো দিন একলহমার জন্যও কেন ওই ভয়টুকু পরাজিত হলো না কিংবা বেঁচে থাকবার ওই অত সামান্য বাসনাটুকু দমে গেল না? এসব ভাবতে ভাবতে এই অন্ধকারের আবছায়ায় বুকের মধ‍্য দিয়ে এক সরীসৃপ বাঁ থেকে ডানে সরে যায়। আমার হৃদয় খেয়ে চলে একটু একটু করে, বড় হতে থাকে সে একটু একটু করে। কুলসুমের মা আমার কপালজুড়ে ঘর মুছতে থাকে। ঘর মোছার কাপড় নিংড়ে নেওয়ার কল কল শব্দ আমার কানে না, হৃদয়ে বেজে ওঠে, যেন হৃদয়ের কোনো খাঁজে বেঁচে থাকার এতটুকু বাসনা এখনো বাকি রয়ে আছে। কুলসুমের মা যেন তা–ই নিংড়ে বের করে আনতে আমার কপালজুড়ে ঘর মুছে চলে, নিম্ন মধ‍্যবিত্ত পরিবারের নারীরা যেভাব ফুরিয়ে যাওয়া টুথপেস্টের টিউব থেকে আরও একটু পেস্ট বের করে শিশুর দাঁত মেজে দেয়, তেমনি কুলসুমের মা আসলে ঘর মোছার নাম করে কাপড় নিংড়ায় বা কাপড় নিংড়ানোর নাম করে হৃদয় নিংড়ে আমাকে আরও একটু বাঁচিয়ে রাখতে পারে।

আমার বুকে সরীসৃপ বড় হয়, আমার হৃদয় খেয়ে চলে সে, কপালজুড়ে ঘর মোছে কুলসুমের মা! তবু কেবল তুমি নেই বলে এ জীবন আমার কেমন ব‍্যর্থ হলো! যে মানুষ মাছের সঙ্গে মিলিয়ে সবজি বাজার করতে শেখেনি, শেখেনি চাকরির ভাইভায় কী করে বেতন হাঁকাতে হয়! যে মানুষ অংশ নিয়েছিল তাঁরই মতন আরেকজন মানুষকে সবার সামনে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবার উন্মত্ত খেলায়! সেও তোমাকে পেয়ে কী ভীষণ ন্যুব্জ‍ হয়েছিল পুষ্পভারে নুইয়ে পড়া বৃক্ষশাখার মতন! আবার সেই একই মানুষ কী করে স্পিন ড্রামের শব্দের ভেতর শক্ত আশ্রয় খুঁজে ঘোর অমানিশা সয়ে নেয়? নিজেকে শতবার, শতসহস্রবার প্রশ্ন করে চলি? উত্তর মেলে না, প্রকৃত মৃত মানুষেরা উত্তর দেবেই বা কী করে!

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • স্মৃতির ভাড়ারে উপচানো শূন্যতা