ইসলামের ইতিহাসে নারী চরিত্রগুলো কেবল গৃহস্থালির ছায়ায় সীমাবদ্ধ ছিল না; তারা ছিলেন জ্ঞানের আলোকবর্তিকা, সমাজের স্তম্ভ এবং জীবনের সূক্ষ্ম শিল্পের শিক্ষক। সাওদা বিনতে যামআ (রা.) তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

তিনি ছিলেন নবীজি (সা.)-এর স্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক, কিন্তু তার জীবনীতে লুকিয়ে আছে এক অসাধারণ গুণ: আলোচনা ও সমঝোতার কৌশল। খাদিজা (রা.

)-এর পর তিনিই নবীজির দ্বিতীয় স্ত্রী, যিনি মক্কায় তাঁর সঙ্গে বাস করেছেন। তার জীবন ছিল ত্যাগ, ধৈর্য এবং বুদ্ধিমত্তার মিলন, যা আজকের নারীদের জন্য একটি জীবন্ত উদাহরণ।

তাঁর জীবন ছিল ইমান এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ভালোবাসায় ভরা। তিনি সাকরান বিন আমর (রা.)-এর স্ত্রী ছিলেন, যিনি সহাবী এবং হাবশায় দ্বিতীয় হিজরতের সঙ্গী। সাকরানের মৃত্যুর পর তিনি বিধবা হয়ে যান—কেউ বলেন হাবশায়, কেউ বলেন মক্কায় ফিরে।

বয়স চলে যাচ্ছে, তবু তিনি বিবাহের কথা ভাবতেন না; তাঁর জীবন ছিল ইবাদত এবং নবীজির প্রতি ভালোবাসায় মগ্ন। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা ভিন্ন।

আরও পড়ুনদাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে মহানবী (সা.) এর স্ত্রী০৭ জানুয়ারি ২০২৫

খাদিজার মৃত্যুর পর খাওলা বিনতে হাকিম আল-আসাদিয়া (রা.) নবীজির কাছে এসে বলেন, “আল্লাহর রাসুল, আপনার কন্যাদের দেখাশোনা করার জন্য কাউকে বিয়ে করুন। সাওদার মতো সৎ নারী কেউ নেই। তিনি আপনার কন্যাদের ভালো করে দেখবেন”।

মহানবী খাওলাকে বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে সাওদার কাছে পাঠান। সাওদা (রা.) প্রথমে বিশ্বাস করেননি, কিন্তু খাওলার কথায় সম্মত হন। ১০ হিজরিতে তাদের বিবাহ হয়। (জাওয়ামিউল হাদিস, দারুন নাফায়িস, বৈরুত, ১৪১৮ হি./১৯৯৮ খ্রি., পৃষ্ঠা: ১২৩)

হিজরতের পর সাওদা (রা.) মদিনায় নবীজির সঙ্গে বাস করেন। খাদিজার পর তিনিই প্রথম স্ত্রী যাঁর সঙ্গে মহানবী মক্কায় বাস করেছেন। হিজরতের পর আয়েশা (রা.)-এর সঙ্গে মহানবীর বিবাহ হয়।

সাওদা নিজেকে আয়েশার সঙ্গে তুলনা করেননি—তিনি জানতেন আয়েশার স্থান এবং তাঁর বাবা আবু বকর (রা.)-এর মর্যাদা। তিনি স্বেচ্ছায় বাড়ির দায়িত্ব আয়েশাকে দিয়ে দেন এবং বলেন, “আমি তোমার অনুসরণ করব।”

এভাবে তিনি নবীজির সন্তুষ্টি এবং আয়েশার সম্মান অর্জন করেন এবং এভাবে প্রথম আলাপে তিনি বোঝাপড়ার মাধ্যমে সকলের সন্তুষ্টি অর্জন করেন। (জাওয়ামিউল হাদিস, দারুন নাফায়িস, বৈরুত, ১৪১৮ হি./১৯৯৮ খ্রি., পৃষ্ঠা: ১৩৪)।

আরও পড়ুনরাসুল (সা.)–এর স্ত্রী ছিলেন জুওয়াইরিয়া (রা.)১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

হাফসা বিনতে উমর, যায়নাব বিনতে জাহশ এবং উম্মে সালামা (রা.)-এর বিবাহের পর সাওদা নিজেকে অন্যদের সঙ্গে হিসাব করে দেখেন, তাঁর বয়স বেশি, চলাফেরায় ভারী, সৌন্দর্য বা বুদ্ধিতে তিনি অন্যদের সমান নন। মহানবী (সা.) তাঁর অবস্থা বুঝে তাঁকে তালাকের প্রস্তাব দেন।

সাওদা (রা.) চমকে উঠেন—তিনি নিজেকে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করতেন না, কিন্তু নবীজির স্ত্রী হিসেবে থাকার গৌরব ছাড়তে চান না। এক রাতে নবীজি তাঁর কাছে থাকেন। তখন তিনি তাঁর হাত ধরে বলেন, “আল্লাহর রাসুল, আমার পুরুষদের প্রতি আকর্ষণ নেই, কিন্তু আমি চাই আপনার স্ত্রীদের মধ্যে আমি থাকি। আমাকে ফিরিয়ে নিন।”

নবীজি সম্মত হন। কেউ বলেন, এই ঘটনায় সুরা নিসার আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে: “আর যদি কোনো নারী তার স্বামীর কাছ থেকে বিমুখতার ভয় করে, তাহলে তাদের মধ্যে সমঝোতা করতে কোনো সমস্যা নেই। সমঝোতাই উত্তম।” (সুরা নিসা, আয়াত: ১২৮)।

সাওদা (রা.) বুঝেছিলেন যে, তাঁর বয়স এবং চলাফেরার সমস্যা নবীজির জন্য বোঝা হয়ে উঠতে পারে। তিনি তালাকের পরিবর্তে তার সময়গুলো আয়েশা (রা.)-কে দান করে দেন। এতে তিনি আয়েশার সম্মান এবং নিজের মর্যাদা রক্ষা করেন।

এটি ছিল তাঁর দ্বিতীয় জয়—নিজের অধিকার ত্যাগ করে সকলের সন্তুষ্টি অর্জন।

সাওদা (রা.)-এর জীবন আমাদেরকে শেখায় যে, দাম্পত্য জীবন কেবল অনুভূতির ওপর নির্ভর করে না, বরং লাভ-ক্ষতির ভারসাম্য বজায় রাখাও গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুনআয়েশা (রা.) রাগ করলে নবীজি (সা.) কী করতেন১২ জুন ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এর স ত র আয় শ র স র জ বন আল ল হ ব স কর স কর ন নব জ র

এছাড়াও পড়ুন:

উম্মুল মুমিনীন সাওদা বিনতে যামআ (রা.) 

ইসলামের ইতিহাসে নারী চরিত্রগুলো কেবল গৃহস্থালির ছায়ায় সীমাবদ্ধ ছিল না; তারা ছিলেন জ্ঞানের আলোকবর্তিকা, সমাজের স্তম্ভ এবং জীবনের সূক্ষ্ম শিল্পের শিক্ষক। সাওদা বিনতে যামআ (রা.) তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

তিনি ছিলেন নবীজি (সা.)-এর স্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক, কিন্তু তার জীবনীতে লুকিয়ে আছে এক অসাধারণ গুণ: আলোচনা ও সমঝোতার কৌশল। খাদিজা (রা.)-এর পর তিনিই নবীজির দ্বিতীয় স্ত্রী, যিনি মক্কায় তাঁর সঙ্গে বাস করেছেন। তার জীবন ছিল ত্যাগ, ধৈর্য এবং বুদ্ধিমত্তার মিলন, যা আজকের নারীদের জন্য একটি জীবন্ত উদাহরণ।

তাঁর জীবন ছিল ইমান এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ভালোবাসায় ভরা। তিনি সাকরান বিন আমর (রা.)-এর স্ত্রী ছিলেন, যিনি সহাবী এবং হাবশায় দ্বিতীয় হিজরতের সঙ্গী। সাকরানের মৃত্যুর পর তিনি বিধবা হয়ে যান—কেউ বলেন হাবশায়, কেউ বলেন মক্কায় ফিরে।

বয়স চলে যাচ্ছে, তবু তিনি বিবাহের কথা ভাবতেন না; তাঁর জীবন ছিল ইবাদত এবং নবীজির প্রতি ভালোবাসায় মগ্ন। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা ভিন্ন।

আরও পড়ুনদাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে মহানবী (সা.) এর স্ত্রী০৭ জানুয়ারি ২০২৫

খাদিজার মৃত্যুর পর খাওলা বিনতে হাকিম আল-আসাদিয়া (রা.) নবীজির কাছে এসে বলেন, “আল্লাহর রাসুল, আপনার কন্যাদের দেখাশোনা করার জন্য কাউকে বিয়ে করুন। সাওদার মতো সৎ নারী কেউ নেই। তিনি আপনার কন্যাদের ভালো করে দেখবেন”।

মহানবী খাওলাকে বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে সাওদার কাছে পাঠান। সাওদা (রা.) প্রথমে বিশ্বাস করেননি, কিন্তু খাওলার কথায় সম্মত হন। ১০ হিজরিতে তাদের বিবাহ হয়। (জাওয়ামিউল হাদিস, দারুন নাফায়িস, বৈরুত, ১৪১৮ হি./১৯৯৮ খ্রি., পৃষ্ঠা: ১২৩)

হিজরতের পর সাওদা (রা.) মদিনায় নবীজির সঙ্গে বাস করেন। খাদিজার পর তিনিই প্রথম স্ত্রী যাঁর সঙ্গে মহানবী মক্কায় বাস করেছেন। হিজরতের পর আয়েশা (রা.)-এর সঙ্গে মহানবীর বিবাহ হয়।

সাওদা নিজেকে আয়েশার সঙ্গে তুলনা করেননি—তিনি জানতেন আয়েশার স্থান এবং তাঁর বাবা আবু বকর (রা.)-এর মর্যাদা। তিনি স্বেচ্ছায় বাড়ির দায়িত্ব আয়েশাকে দিয়ে দেন এবং বলেন, “আমি তোমার অনুসরণ করব।”

এভাবে তিনি নবীজির সন্তুষ্টি এবং আয়েশার সম্মান অর্জন করেন এবং এভাবে প্রথম আলাপে তিনি বোঝাপড়ার মাধ্যমে সকলের সন্তুষ্টি অর্জন করেন। (জাওয়ামিউল হাদিস, দারুন নাফায়িস, বৈরুত, ১৪১৮ হি./১৯৯৮ খ্রি., পৃষ্ঠা: ১৩৪)।

আরও পড়ুনরাসুল (সা.)–এর স্ত্রী ছিলেন জুওয়াইরিয়া (রা.)১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

হাফসা বিনতে উমর, যায়নাব বিনতে জাহশ এবং উম্মে সালামা (রা.)-এর বিবাহের পর সাওদা নিজেকে অন্যদের সঙ্গে হিসাব করে দেখেন, তাঁর বয়স বেশি, চলাফেরায় ভারী, সৌন্দর্য বা বুদ্ধিতে তিনি অন্যদের সমান নন। মহানবী (সা.) তাঁর অবস্থা বুঝে তাঁকে তালাকের প্রস্তাব দেন।

সাওদা (রা.) চমকে উঠেন—তিনি নিজেকে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করতেন না, কিন্তু নবীজির স্ত্রী হিসেবে থাকার গৌরব ছাড়তে চান না। এক রাতে নবীজি তাঁর কাছে থাকেন। তখন তিনি তাঁর হাত ধরে বলেন, “আল্লাহর রাসুল, আমার পুরুষদের প্রতি আকর্ষণ নেই, কিন্তু আমি চাই আপনার স্ত্রীদের মধ্যে আমি থাকি। আমাকে ফিরিয়ে নিন।”

নবীজি সম্মত হন। কেউ বলেন, এই ঘটনায় সুরা নিসার আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে: “আর যদি কোনো নারী তার স্বামীর কাছ থেকে বিমুখতার ভয় করে, তাহলে তাদের মধ্যে সমঝোতা করতে কোনো সমস্যা নেই। সমঝোতাই উত্তম।” (সুরা নিসা, আয়াত: ১২৮)।

সাওদা (রা.) বুঝেছিলেন যে, তাঁর বয়স এবং চলাফেরার সমস্যা নবীজির জন্য বোঝা হয়ে উঠতে পারে। তিনি তালাকের পরিবর্তে তার সময়গুলো আয়েশা (রা.)-কে দান করে দেন। এতে তিনি আয়েশার সম্মান এবং নিজের মর্যাদা রক্ষা করেন।

এটি ছিল তাঁর দ্বিতীয় জয়—নিজের অধিকার ত্যাগ করে সকলের সন্তুষ্টি অর্জন।

সাওদা (রা.)-এর জীবন আমাদেরকে শেখায় যে, দাম্পত্য জীবন কেবল অনুভূতির ওপর নির্ভর করে না, বরং লাভ-ক্ষতির ভারসাম্য বজায় রাখাও গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুনআয়েশা (রা.) রাগ করলে নবীজি (সা.) কী করতেন১২ জুন ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ