অধিকারকর্মীদের নির্মম নির্যাতন, মুক্ত হয়ে গ্রিসে গ্রেটা থুনবার্গ
Published: 7th, October 2025 GMT
ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটকের পর ছাড়া পাওয়া ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ নৌবহরের অধিকারকর্মীরা নির্মম নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, আটক থাকা অবস্থায় ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী তাঁদের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে। তাঁদের হাঁটুতে ভর দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা থাকতে হয়েছে। মারধরও করা হয়েছে। তিন দিন তাঁরা কিছু খেতে পাননি। এমনকি শৌচাগারের পানি পান করেও থাকতে হয়েছে।
ইসরায়েলের অবরোধ ভেঙে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় যেতে চেয়েছিলেন এসব অধিকারকর্মী। ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ নামে ৪২টি নৌযানের একটি বহর নিয়ে গাজায় যাওয়ার সময় আন্তর্জাতিক জলসীমা থেকে গত বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার ৪৭৯ জনকে আটক করে ইসরায়েল।
আটক এসব অধিকারকর্মীর মধ্যে গতকাল সোমবার গ্রেটা থুনবার্গসহ আরও ১৭১ জনকে ইসরায়েল ফেরত পাঠিয়েছে। এর আগের তিন দিনে বিভিন্ন দেশের ১৭০ জন অধিকারকর্মীকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। ইসরায়েলে বন্দিদশায় কীভাবে নির্যাতিত হয়েছেন, সেই কথা জানিয়েছেন তাঁরা।
‘সরকারগুলো ন্যূনতম দায়িত্বও পালন করছে না’গতকাল বাংলাদেশ সময় রাত পৌনে ১০টার দিকে গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে পৌঁছান সুইডিশ অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ। এথেন্স আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রেটাসহ অন্য অধিকারকর্মীদের ফুল দিয়ে স্বাগত জানান তাঁদের সমর্থকেরা। সে সময় অনেকের হাতেই ছিল ফিলিস্তিনের পতাকা।
থুনবার্গ বলেন, ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে। তাদের ওপর সত্যিকারের চাপ তৈরি হয়, এমন কিছু করতে হবে। ইসরায়েলকে সহযোগিতার অবসান ঘটাতে হবে। গাজায় গণহত্যা বন্ধে সরকারগুলো তাদের ন্যূনতম দায়িত্বও পালন করছে না বলেও অভিযোগ করেন এই তরুণ অধিকারকর্মী।
গাজায় গণহত্যা বন্ধে বিদ্যমান সব ব্যবস্থাই ব্যর্থ হয়েছে বলে উল্লেখ করেন থুনবার্গ। তিনি বলেন, ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটক নৌবহরের লক্ষ্য ছিল এমন অবস্থান তৈরি, যা তৈরিতে সরকারগুলো ব্যর্থ হয়েছে। তারা তাদের দায়িত্ব পালন করলে এই নৌবহরের প্রয়োজনই ছিল না।
‘শৌচাগার থেকে পানি খেয়েছি’রোববার ইসরায়েল থেকে ইতালির রোমে ফেরেন অধিকারকর্মী চেজারে তোফানি। তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ভয়ংকর ব্যবহার করা হয়েছে।’ ইতালির ইসলামিক কমিউনিটিজ ইউনিয়নের সভাপতি ইয়াসিন লাফরাম বলেন, ‘তারা আমাদের সঙ্গে সহিংস আচরণ করেছে। তারা আমাদের ওপর অস্ত্র তাক করে ছিল।’
ইতালির সাংবাদিক সাভেরিও তোমাসি শনিবার রাতে ফিউমিসিনো বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। মার্কিন বার্তা সংস্থা এপিকে তিনি বলেন, ইসরায়েলি সেনারা আটক অধিকারকর্মীদের ওষুধ দেননি। তাঁদের সঙ্গে ‘বানরের মতো আচরণ’ করেছেন।
সাভেরিও তোমাসি আরও বলেন, প্রহরীরা আটক অধিকারকর্মীদের নিয়ে বিদ্রূপ করছিলেন, হাসাহাসি করছিলেন। এই অধিকারকর্মীদের মধ্যে ছিলেন জলবায়ুবিষয়ক আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি মান্ডলা ম্যান্ডেলা ও কয়েকজন ইউরোপীয় আইনপ্রণেতা।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় ছিলেন মালয়েশিয়ার অভিনেত্রী ও গায়িকা হেলিজা হেলমি ও হাজওয়ানি হেলমি। তাঁরা দুই বোন। ইসরায়েলি সেনারা তাঁদের সঙ্গে ‘বর্বর’ ও ‘নিষ্ঠুর’ আচরণ করেছেন বলে অভিযোগ তাঁদের।
হেলিজা হেলমি বলেন, ‘১ অক্টোবর খেয়েছি। এরপর আজ প্রথম খাচ্ছি। তিন দিন আমি কিছু খাইনি—শুধু শৌচাগার থেকে পানি খেয়েছি।’
‘হাঁটুতে ভর দিয়ে থাকতে বাধ্য করেছে’ইসরায়েলিরা তাঁর জিনিসপত্র ও অর্থকড়ি চুরি করেছেন বলে অভিযোগ করেন ইতালির সাংবাদিক লরেনজো ডি’আগোস্তিনো। তাঁকে শনিবার ইসরায়েল থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তুরস্কের ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে পৌঁছে তিনি এপিকে বলেন, আটক কর্মীদের ওপর কুকুর লেলিয়ে দিয়ে ভয় দেখানো হয়েছে। সেনারা বন্দীদের দিকে বন্দুকের লেজার লাইট তাক করে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছেন।
পাওলো ডি মোনটিস নামের আরেক অধিকারকর্মী নিরাপত্তারক্ষীদের খুবই নিষ্ঠুর আচরণের শিকার হওয়ার অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘তাদের (ইসরায়েলি) দিকে তাকাতে দিত না, সব সময় মাথা নত রাখতে হতো। যখন আমি তাকালাম, তখন একজন লোক এসে আমার গায়ে ধাক্কা দিল এবং মাথার পেছনে থাপ্পড় মারল। তারা আমাদের হাঁটুতে ভর দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করেছে।’
ফ্লোটিলা থেকে আটক হওয়ার পর ছাড়া পাওয়া অধিকারকর্মীরা এর আগে অভিযোগ করেছিলেন, গ্রেটা থুনবার্গকে নির্যাতন করা হয়েছে। গ্রেটাকে মাটিতে টেনেহিঁচড়ে নেওয়া হয়েছে, ইসরায়েলি পতাকায় চুমু খেতে বাধ্য ও মিথ্যা প্রচারণার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা থেকে আটক অধিকারকর্মীদের নির্যাতনের বিষয়ে ইসরায়েল থেকে সাংঘর্ষিক বক্তব্য এসেছে। অধিকারকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ অস্বীকার করেছে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে দেশটির চরম ডানপন্থী জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির অধিকারকর্মীদের সঙ্গে ‘যথোচিত’ আচরণ করায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।
‘ফিলিস্তিনিদের মতোই অত্যাচার করা হচ্ছে’গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা থেকে আটক ১৭১ জন অধিকারকর্মীকে গতকাল গ্রিস ও স্লোভাকিয়ায় ফেরত পাঠানো হয়। তাঁদের মধ্যে গ্রিস, ইতালি, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড, সুইডেন, পোল্যান্ড, জার্মানি, বুলগেরিয়া, লিথুয়ানিয়া, অস্ট্রিয়া, লুক্সেমবার্গ, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, স্লোভাকিয়া, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, যুক্তরাজ্য, সার্বিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের অধিকারকর্মীরা রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২৮ জন ফরাসি নাগরিক, গ্রিসের ২৭ জন, ইতালির ১৫ জন ও সুইডেনের নাগরিক ৯ জন রয়েছেন বলে দেশগুলোর সরকার পৃথক বিবৃতি দিয়ে গতকাল জানায়।
এর আগে গত শুক্রবারই নৌবহর থেকে আটক ইতালির চার নাগরিককে নিজ দেশে ফেরত পাঠায় ইসরায়েল। রোববার বিভিন্ন দেশের ১৩৭ জনকে তুরস্কে পাঠানো হয়। সেখানে ১৪ দেশের নাগরিক ছিলেন। এরপর রোববার ২৯ জনকে স্পেনে ফেরত পাঠানো হয়। তাঁদের মধ্যে স্পেনের নাগরিক ছিলেন ২১ জন। বাকি ৮ জন পর্তুগাল ও নেদারল্যান্ডসের নাগরিক।
নৌবহর থেকে অধিকারকর্মীদের আটক করার পর তাঁদের নির্যাতন করা নিয়ে বিভিন্ন দেশ সমালোচনা করেছে। বিক্ষোভ হয়েছে বিশ্বজুড়ে। আটক অধিকারকর্মীদের সঙ্গে ইসরায়েলের নির্মম আচরণের প্রতিবাদ জানিয়ে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার পক্ষ থেকে গতকাল একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দখল করা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে সেখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে নিয়মিত যেসব পদ্ধতিতে অবমাননামূলক আচরণ ও অত্যাচার চালানো হয়ে থাকে, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা থেকে আটক অধিকারকর্মীদের সঙ্গে একই আচরণ করা হচ্ছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র থ নব র গ আম দ র কর ছ ন গতক ল সরক র ন বহর
এছাড়াও পড়ুন:
মধ্যরাতে বাসা থেকে তুলে নেওয়ার ঘটনা ভয়ের সংস্কৃতিকে আরও শক্তিশালী করছে: টিআইবি
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (এনইআইআর) চালুর সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একজন সাংবাদিক ও মোবাইল ব্যবসায়ী সংগঠনের এক নেতাকে গভীর রাতে তুলে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, যা আইনের শাসন ও মানবাধিকার সুরক্ষার পরিপন্থী বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
আজ বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে টিআইবি বলেছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া মধ্যরাতে বাসা থেকে তুলে নেওয়ার ঘটনা নজরদারি ও ভয়ের সংস্কৃতিকে আরও শক্তিশালী করছে। এ ধরনের জবাবদিহিহীন অভিযান কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার ন্যায় আচরণের পুনরাবৃত্তি এবং সরকারের ঘোষিত মানবাধিকারভিত্তিক সংস্কার প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, এনইআইআর চালুর সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনার পর ওই দুজনকে তুলে নেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিবির ব্যাখ্যায় বলা হয়, ‘তথ্য যাচাইয়ের জন্য’ তাঁদের আনা হয়েছিল। অপর একটি ব্যাখ্যায় বলা হয়, সংবাদ সম্মেলনের আমন্ত্রণপত্রে ‘সভাপতি’ পদবি ব্যবহার এবং ব্যক্তিগত ফোন নম্বর উল্লেখ করার বিষয়টি খতিয়ে দেখতেই সাংবাদিককে ডাকা হয়। টিআইবি এসব পরস্পরবিরোধী বক্তব্যকে মিথ্যাচার আখ্যায়িত করেছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ভিন্নমত দমনে গভীর রাতে কারণ না জানিয়ে বাসা থেকে তুলে নেওয়া, অভিযোগ গোপন রাখা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর বক্তব্যে অসংগতি-কর্তৃত্ববাদী নিপীড়নমূলক চর্চা অব্যাহত রাখার উদ্বেগজনক দৃষ্টান্ত। এ আচরণ শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত নয়, বরং রাষ্ট্র সংস্কারের ওপর জনগণের আস্থাকে ধূলিসাৎ করার ঝুঁকি তৈরি করেছে। অভিযোগ থাকলে আইন অনুযায়ী সমন পাঠানো, স্বাভাবিক সময়ে আইনজীবীর উপস্থিতি নিশ্চিত করে জিজ্ঞাসাবাদ করার বাধ্যবাধকতাকে উপেক্ষা করে গভীর রাতে বাসা থেকে তুলে নেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
ইফতেখারুজ্জামান সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা ও নজরদারি সংস্থার আমূল সংস্কারের দাবি জানিয়ে বলেন, কেবল ব্যক্তি বদল যথেষ্ট নয়; রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার নামে অধিকার হরণের দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি দূর না হলে ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর স্বপ্নপূরণ হবে না।
সরকারি নীতির বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন হলে রাষ্ট্র বিষয়টি জানতে চাইতেই পারে বলে ডিবির এক কর্মকর্তা যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা নিয়েও উদ্বেগ জানিয়েছে টিআইবি। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি নীতি বা আইনের সমালোচনা করা নাগরিক ও অংশীজনদের সাংবিধানিক অধিকার। সমালোচনা বা ভিন্নমতকে নিরাপত্তাঝুঁকি হিসেবে দেখার সুযোগ নেই।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, সংবিধানের ৩৭, ৩৮ ও ৩৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শান্তিপূর্ণভাবে মতামত প্রকাশ, সমাবেশ করা এবং সংবাদ সম্মেলন আয়োজনের পূর্ণ অধিকার নাগরিকদের রয়েছে। এনইআইআর নিয়ে প্রশ্ন তোলাকে আইনগত বা নৈতিকভাবে অপরাধ হিসেবে দেখানোর ব্যাখ্যা সরকারকেই দিতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
টিআইবি মনে করে, এ ঘটনা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার সংকুচিত করার ঝুঁকি তৈরি করেছে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডেরও লঙ্ঘন করছে।