দুই ছেলের লাশের অপেক্ষায় রোজ নদীর পাড়ে বসে থাকেন মা
Published: 7th, November 2025 GMT
ছুঁয়ে দেখা হয়নি দুই সন্তানের মরদেহ। সন্তানকে শেষবারের মতো ‘বাবা’ বলে ডাকার ভাগ্যও হয়নি। বাবা-মায়ের কাছে সন্তানের লাশ পৃথিবীর সবথেকে ভারী হয়। শেষ স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সেই ভারটুকুও বহন করতে না-পারার আক্ষেপ নিয়ে নিজের মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনছেন হনুফা বেগম।
হানুফা বেগমের বাড়ি বরগুনার মাঝের চড়ে। তিনি স্বামী পরিত্যক্তা বৃদ্ধা। দুই সন্তান হারিয়ে সাগরের গর্জনের থেকেও ভারী হয়ে উঠেছে তার দীর্ঘশ্বাস। তিনি জানেন না ছেলেরা আর কখনো ফিরবে কিনা। তবুও নিয়ম করে প্রতিদিন নদীর তীরে বসে থাকেন ছেলেদের ফেরার আশা নিয়ে। নিষ্পলক তাকিয়ে থাকেন শূন্যপানে।
২০১১ সালে বড় ছেলে ফোরকান গভীর সাগরে মাছ শিকারে গিয়ে ট্রলার ডুবে নিখোঁজ হন। সাত বছর পর ২০১৮ সালে মেজো ছেলে বিল্লালও হয় একই দুর্ভাগ্যের শিকার। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই হারিয়ে যান তিনি সাগরের নীল অতলে।
হনুফা বেগম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘‘একে একে দুই ছেলে সাগরে মাছ শিকারে গিয়ে ট্রলার ডুবে নিখোঁজ হয়েছে। এখনো প্রতিদিন ছেলেদের অপেক্ষায় সাগর পাড়ে বসে থাকি। মানুষ আমাকে ‘পাগল’ বলে, কিন্তু মায়ের মন তো মানে না। আমি জানি ওরা বেঁচে নেই। কিন্তু বিশ্বাস তো হয় না।’’
তিনি আঁচলে চোখ মুছে বলেন, ‘‘মাঝের চড়ের আবাসনে থাকি। এখানে সবাই গরিব। পেটের ক্ষুধা মেটাতে আবাসনের সেই গরিবদের ঘরে কাজ করি। তাদের টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নাই, তাই কাজের বিনিময়ে খাবার দেয়।’’
হনুফা বেগমের প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা জানান, যে মায়ের মুখে খাবার তুলে দিতে গিয়ে দুই ছেলে ট্রলার ডুবে মারা গেছে, এখন সেই মা ভাঙাচোরা আবাসনে থেকে অর্ধাহার-অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন।
প্রতিবেশী মিলন হাওলাদার বলেন, ‘‘হনুফা বেগম খুব মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। চারদিকে উন্নয়নের গল্প শুনি কিন্তু আমাদের জীবনের কোন উন্নয়ন নেই। এই চড়ে অন্তত ৩০ জেলে নিখোঁজ হয়েছেন। সবার পরিবারেই এমন অভাব।’’
২০১৮ সালে সাগরে নিখোঁজ হন খোকন, আলতাফসহ অনেকেই। আলতাফের স্ত্রী খাদিজা বলেন, ‘‘দুই সন্তান রেখে গেছেন স্বামী। ওদের লেখাপড়া তো দূরের কথা, আমরা তিন বেলা খাবার খেতেও পারি না।’’
চড়ের বাসিন্দা ও নিখোঁজ জেলে খোকনের চাচা জলিল সিকদার বলেন, ‘‘অনেকে পরে অর্ধগলিত লাশ পেলেও, আমরা পাইনি। ফলে তাদের জানাজা-দাফনেরও সুযোগ পাইনি।’’
চারদিকে বিষখালী নদীবেষ্টিত মাঝের চড়ের জেলেরা বলছেন, এই চড়ের মানুষের জীবনের কোন মূল্য নেই। তারা সাগরে যান অথচ জেলে কার্ড নেই। তাই সরকারের কোন সুযোগ-সুবিধা তারা পান না।
এ বিষয়ে বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ মহসীন রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘‘হনুফা বেগমের তথ্য আমার জানা ছিল না। আপনাদের মাধ্যমে খোঁজ পেয়ে আমি তথ্য নিয়ে জানলাম তার দুই ছেলে নিখোঁজ। কিন্তু তাদের জেলে কার্ড ছিল না এবং মৃত্যুসনদ নাই। তাই সরকারের সহায়তার আওতায় আনা কঠিন। তবে, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা চেষ্টা করব হনুফা বেগম ও মাঝের চড়ের নিখোঁজ জেলেদের স্বজনদের পাশে দাঁড়ানোর।’’
ঢাকা/ইমরান//
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব গম র সন ত ন
এছাড়াও পড়ুন:
বাবার ঐতিহ্য ধরে রাজনীতিতে এসে ফরিদপুরে বিএনপির মনোনয়ন পেলেন দুই নারী
বাবার ঐতিহ্যের পথ ধরে বিএনপির রাজনীতিতে এসেছিলেন শামা ওবায়েদ ও নায়াব ইউসুফ। দুজনই পেয়েছেন দলের মনোনয়ন। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় ৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ঢাকায় বিএনপির কার্যালয়ে ২৩৭ জনের মনোনয়ন ঘোষণা করেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এর মধ্যে নারী ১০ জন।
ফরিদপুরের চারটি সংসদীয় আসনের মধ্যে বোয়ালমারী, আলফাডাঙ্গা ও মধুখালী নিয়ে গঠিত ফরিদপুর-১ আসন বাদে বাকি তিনটি সংসদীয় আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে বিএনপি। ঘোষিত তালিকা অনুযায়ী নগরকান্দা ও সালথা উপজেলা নিয়ে গঠিত ফরিদপুর-২ আসনে শামা ওবায়েদ এবং ফরিদপুর সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত ফরিদপুর-৩ আসনে নায়াব ইউসুফকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
বাবার গণতান্ত্রিক আচরণ ও নীতি সব সময় আমাকে প্রভাবিত করেছে। বাবার জীবন ছিল মানুষের জন্য। নিজের কথা কখনো ভাবেনি। আমি সন্তান হিসেবে তাঁর রেখে যাওয়া কাজগুলো সম্পাদন করতে চাই।শামা ওবায়েদমানুষের সঙ্গে আছি এবং থাকব। মানুষ কী চায়, সে লক্ষ্যে কাজ করব। ফরিদপুরকে একটি মডেল জেলা করা আমার লক্ষ্য।নায়াব ইউসুফমনোনয়ন পাওয়া দুই নারীর মধ্যে নায়াব ইউসুফ নতুন মুখ। তিনি কেন্দ্রীয় মহিলা দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। নায়াব ইউসুফ জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী না হলেও ২০১৮ সালের নির্বাচনে বাবা সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির সাবেক সহসভাপতি প্রয়াত চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের ডামি হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। পরে অবশ্য বাবার সমর্থনে নিজের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। সেই থেকে তাঁর রাজনীতি শুরু।
অন্যদিকে শামা ওবায়েদ বিএনপির সাংগঠনিক বিভাগ ফরিদপুরের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০৮ ও ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। শামা ওবায়েদ বিএনপির সাবেক মহাসচিব মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কে এম ওবায়দুর রহমানের মৃত্যুর পর রাজনীতিতে পদার্পণ করেন।
অবশ্য আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মনোনয়ন পাওয়ার আগে থেকেই এই দুই নারী এলাকার রাজনীতিতে সক্রিয়। প্রতিনিয়ত নিজ নিজ এলাকায় সভা সমাবেশ করে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে কে এম ওবায়দুর রহমান ফরিদপুর-২ আসন থেকে পাঁচবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে চারবার নির্বাচিত হন। এর মধ্যে একবার (১৯৭৩) আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এবং তিনবার (১৯৭৯, ১৯৯৬ ও ২০০১) বিএনপির প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে তিনি জনতা পার্টির প্রার্থী হিসেবে জাহাজ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হন।
ওবায়দুর রহমান একাধিকবার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অনেকবার কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। ৬৬ বছর বয়সে ২০০৭ সালের ২১ মার্চ মৃতুবরণ করেন ওবায়দুর রহমান। শামা ওবায়েদ বলেন, ‘বাবা বৃহত্তর ফরিদপুরের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন। তিনি আপাদমস্তক গণতান্ত্রিক ছিলেন। গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন। বহুবার জেল খেটেছেন। ওনার জীবন গেছে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। তারপরও সব সময় নিজের এলাকার মানুষের সঙ্গে ছিলেন। তাঁদের চাকরিসহ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। নগরকান্দার যা উন্নয়ন, এর ৯০ শতাংশ তার হাত ধরে হয়েছে।’
শামা ওবায়েদ বলেন, ‘বাবার গণতান্ত্রিক আচরণ ও নীতি সব সময় আমাকে প্রভাবিত করেছে। বাবার জীবন ছিল মানুষের জন্য। নিজের কথা কখনো ভাবেনি। আমি সন্তান হিসেবে তাঁর রেখে যাওয়া কাজগুলো সম্পাদন করতে চাই। বাবার আদর্শ নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। বাবা জাতীয়তাবাদের আদর্শের মানুষ শহীদ জিয়া, খালেদা জিয়াকে আদর্শ হিসেবে নিয়েছিলেন। সেই জায়গা থেকে আমি কাজ করে যেতে চাই।’
অন্যদিকে নায়াব ইউসুফের বাবা চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ বিএনপির প্রার্থী হিসেবে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ১৯৭৯ সালে। তার আগে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না তিনি। মোট সাতটি নির্বাচনে তিনি অংশ নিয়েছিলেন, যার মধ্যে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে পাঁচবার। এর মধ্যে ১৯৭৯, ১৯৯১, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ও ১২ জুন এবং ২০০১ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরাজিত হন ২০০৮ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে। জোট গঠনের কারণে ২০০৮ সালে তিনি মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কলস মার্কা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে পরাজিত হন। ২০১৮ সালে পরাজিত হন বিএনপির প্রার্থী হিসেবে। ৮০ বছর বয়সে ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বরে মারা যান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ।
নায়াব ইউসুফ বলেন, তাঁর বাবা এ আসন থেকে পাঁচবার এমপি হয়ে তিনবার মন্ত্রী হয়েছেন। জিয়াউর রহমানের হাত ধরে তিনি বিএনপির রাজনীতি করেছেন এবং বিএনপিকে শক্তিশালী করেছেন। তাঁর বাবা ফরিদপুরে মেডিকেল কলেজ করেছেন। বিভিন্ন চরে দাদা ও বড় বাবার নামে যেসব স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন, তার জন্য মানুষ শিক্ষিত হয়েছে।
নায়াব ইউসুফ জানান, তিনি শিক্ষা, যোগাযোগ ও এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়নে জোর দেবেন। দলের কাজ তারেক রহমানের নির্দেশে করে যাবেন। তিনি বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে আছি এবং থাকব। মানুষ কী চায়, সে লক্ষ্যে কাজ করব। ফরিদপুরকে একটি মডেল জেলা করা আমার লক্ষ্য।’