স্বাধীনতা থেকে শর্তমালা: রিকশাচালকদের জন্য সাতটি নতুন শর্ত
Published: 7th, November 2025 GMT
নতুন প্রস্তাবিত বিধিমালা—সিটি করপোরেশন এলাকায় তিন চাকার স্বল্পগতির ব্যাটারিচালিত রিকশা (ই-রিকশা) চলাচল বিধিমালা ২০২৫—ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জন্য সাতটি শর্ত নির্ধারণ করেছে।
রিকশা চালানো বাংলাদেশের শহুরে অর্থনীতিতে অন্যতম সহজ আয়ের মাধ্যম, যা শুধু অতিদরিদ্র মানুষের জন্য নয়, বরং বেকারত্ব ও অনেক দিন টাকার অভাবে থাকা শিক্ষিত তরুণদের বেঁচে থাকার জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসংস্থানের জায়গা।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ধারণা করছে, দেশে প্রায় ৬০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে। এই চালকেরা নিজেদের আয়ে পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণ করেন এবং একই সঙ্গে এই খাতের সঙ্গে যুক্ত প্রস্তুতকারক, মেরামতকারক ও পরিবহনকর্মীদের জীবিকা সচল রাখেন।
কোস্টাল লাইভলিহুড অ্যান্ট এনভাইরনমেন্টাল অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (সিএলইএএন)-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ব্যাটারিচালিত রিকশা খাত—উৎপাদন, ব্যাটারি বাজার, সার্ভিসিং, চলাচলসহ—সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ৯৭,৬২৫ কোটি টাকার অর্থনৈতিক অবদান রাখে। রাস্তার নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বৃদ্ধি এবং এর ওপর নির্ভরশীল রিকশাচালকদের জীবিকা রক্ষার জন্য একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়নের আলোচনা দীর্ঘদিন ধরে চলমান।
তবে আলোচিত খসড়া আইনগুলোর মধ্যে এই বিধিমালাটি কেবল দেশের সিটি করপোরেশন এলাকাগুলোর জন্য প্রযোজ্য। এই বিধিমালার লক্ষ্য হলো খাতটিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা, যাত্রী ও সড়ক নিরাপত্তা বাড়ানো এবং ব্যবহৃত ব্যাটারি পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণে পরিবেশগত মান নিশ্চিত করা। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য দরিদ্র রিকশাচালকদের ওপর প্রয়োজনের অতিরিক্ত শর্তের বোঝা চাপানো হলে, এই খাতে প্রকট নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
বিধিমালার উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে এর তড়িঘড়ি প্রণয়নপ্রক্রিয়া এবং কঠোর কিছু বিধান অনেকের মনেই প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত পক্ষ হচ্ছে রিকশাচালকেরা। বিধিমালায় রিকশাচালকদের জন্য কমপক্ষে সাতটি শর্ত নির্ধারিত হয়েছে—পাঁচ বছর পরপর নবায়নযোগ্য লাইসেন্স, অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ, পড়তে ও লিখতে পারা, শারীরিক সক্ষমতা ও চোখের দৃষ্টির সনদ, ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা বিমা, কোনো গুরুতর ট্রাফিক বা ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড না থাকা এবং ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর।
এসব শর্তের কিছু নিরাপত্তার দিক থেকে যুক্তিযুক্ত হলেও, কিছু কিছু নিছক প্রশাসনিক বাড়াবাড়ি, যার বাস্তব সুফল খুবই সীমিত। আনুষ্ঠানিকতা ও মানোন্নয়নের উদ্যোগের আড়ালে লুকিয়ে আছে এই পেশা নিগৃহীত ও অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর আওতার বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি। পাঁচ বছর অন্তর লাইসেন্স নবায়ন, সাক্ষরতা, ব্যক্তিগত বিমা, ও ‘অপরাধমুক্ত’ প্রমাণপত্রের মতো শর্ত কাগজে-কলমে আকর্ষণীয় হলেও বাস্তবে এসবের প্রাসঙ্গিকতা নেই বললেই চলে। যাদের কাছে রিকশা চালানোই সবচেয়ে সহজলভ্য পেশা এবং কার্যকর আয়ের উৎস, এই বিধানগুলো তাদের জন্য নিরাপত্তা নয়, বরং বঞ্চনা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের যন্ত্রে পরিণত হতে পারে।
যাঁরা রিকশা চালান এবং যেসব রাস্তা রিকশাগুলোর জন্য অনুমোদিত, সেই প্রেক্ষাপটে বিধিমালার অনেক শর্তই প্রাসঙ্গিক নয়। নিম্নগতির যানবাহনের জন্য পাঁচ বছর অন্তর লাইসেন্স নবায়ন মূলত প্রশাসনিক ঝামেলা ছাড়া কিছু নয়; একবারের লাইসেন্স বা দুর্ঘটনার রেকর্ড অনুযায়ী শর্তসাপেক্ষ নবায়নই যথেষ্ট। অধিকাংশ ট্রাফিক সংকেতই চিত্রভিত্তিক, তাই পড়ালেখার দক্ষতার বদলে প্রশিক্ষণে চিহ্ন বোঝার সংক্ষিপ্ত ভিজ্যুয়াল পাঠ অন্তর্ভুক্ত করলেই কাজ চলে। ‘অপরাধমুক্ত’ রেকর্ডের প্রমাণ চাওয়া বাস্তবসম্মত নয়, কারণ আমাদের দেশে এ–সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য তথ্যভান্ডার নেই এবং রিকশাচালকদের তা নতুন করে বানাতে হলে নতুন ধরনের হয়রানির সৃষ্টি করবে।
একইভাবে ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা বিমা ভালো উদ্দেশ্যে প্রস্তাবিত হলেও এটি ব্যয়বহুল এবং অধিকাংশ চালকের নাগালের বাইরে। যখন ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেলচালকদের জন্য অপরাধ রেকর্ড ও বিমা বাধ্যতামূলক নয়, তখন রিকশাচালকদের ওপর এটি চাপানো যুক্তিসংগত নয়। শারীরিক সক্ষমতা ও দৃষ্টিশক্তির সনদপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সহজ, স্বল্পমূল্য বা ভর্তুকিযুক্ত ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন, যাতে এটি আরেকটি আর্থিক প্রতিবন্ধকতায় পরিণত না হয়।
তদ্রূপ, রিকশার মালিকদের ওপর আরোপিত নতুন বাধ্যবাধকতার ভার শেষ পর্যন্ত এসে পড়বে চালকদের কাঁধে। রিকশার দাম ও সংশ্লিষ্ট খরচ বাড়লে চালকের দৈনিক জমার পরিমাণও বাড়বে, যা তাঁদের আয় আরও কমাবে। প্রস্তাবিত বিধিমালা অনুসারে নির্দিষ্ট নকশা ও আকার, শুধু দুই যাত্রীর জন্য সিট, নতুন নিবন্ধন এবং বিমার শর্তের কারণে মালিকানার ব্যয় বৃদ্ধি অনিবার্য।
এসবের মধ্যে কিছু নিয়ম চালকদের ওপর অপ্রয়োজনীয় আর্থিক ও প্রশাসনিক চাপ সৃষ্টি করবে। যেমন যাত্রী ও তৃতীয় পক্ষের জন্য বাধ্যতামূলক বিমা একটি অপ্রয়োজনীয় বড় বোঝা। কারণ, এটি চালকদের ওপর এমন খরচের দায় চাপায়, যা তাঁদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এবং দুর্ঘটনা কমানোর জন্য তেমন কোনো ভূমিকা রাখবে না। যদি গাড়ি ও মোটরসাইকেলের মালিকদের জন্য এমন বিমা বাধ্যতামূলক না হয়, তবে নিম্নগতির রিকশার ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ ন্যায়সংগত নয়। তদ্রূপ, এলইডি হেডলাইট সাধারণ বাল্বের চেয়ে ব্যয়বহুল হলেও ধীরগতির শহুরে যান চলাচলে তেমন নিরাপত্তা বাড়াবে না। গতিমাপক যন্ত্র (স্পিড মিটার) ৩০ কিলোমিটার গতিসীমার যানবাহনের জন্য অপ্রয়োজনীয়, বরং অতিরিক্ত খরচ ও রক্ষণাবেক্ষণের চাপ বাড়বে। এই তথাকথিত ‘বিলাসী শর্তগুলো’ দরিদ্র চালকদের আর্থিক চাপ বাড়িয়ে দেবে, অথচ সড়ক নিরাপত্তা উন্নত করতে তেমন কোনো বাস্তব ভূমিকা রাখবে না।
সার্বিকভাবে প্রস্তাবিত বিধিমালা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রিকশাচালকদের পরিণতি সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছে। বিদ্যমান ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোর বিষয়েও কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা নেই, যা নীতিগতভাবে একটি বড় ঘাটতি। তদুপরি, নির্দেশিকায় একটি যুক্তিসংগত পরিবর্তনকাল (ট্রানজিশনাল পিরিয়ড) নির্ধারণ করা উচিত, যাতে বর্তমান রিকশাগুলো ধীরে ধীরে মানসম্মত নকশায় উন্নীত করা যায়। একইভাবে, ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যবহারযোগ্য সময়সীমা (এক্সপাইরেশন পিরিয়ড) মাত্র পাঁচ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে, যা অযৌক্তিকভাবে কম। মেরামতের মাধ্যমে নিবন্ধন নবায়নের সুযোগ রেখে এই সময়সীমা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, যাতে রিকশার কার্যকালেই মালিকেরা বিনিয়োগের যথার্থ প্রতিফল পেতে পারেন।
অতিরিক্ত ও প্রশাসনিক জটিলতা শিথিল করা গেলে খরচ ও কাগজপত্রের ঝামেলা উভয়ই কমবে। এতে যোগাযোগ খাতের মানোন্নয়ন বা নিরাপত্তা কোনোভাবেই ব্যাহত হবে না; বরং এই জীবিকানির্ভর বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য নিয়মিতকরণ প্রক্রিয়াটি আরও বাস্তবসম্মত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবিক হয়ে উঠবে।
জেমস খকশী কর্মসূচি সমন্বয়কারী
ফাতিমা আরা খান কর্মসূচি সহযোগী বিআইজিডিতে কাজ করেন
খালেকুজ্জামান লিপন আহ্বায়ক, রিকশা, ব্যাটারি রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদ।
মতামত লেখকদের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: চ লকদ র ওপর প রস ত ব ত চ লকদ র জ দ র জন য দ র ঘটন দর দ র ত ম লক র কর ড নব য ন শ চ লক চ লক র চ বছর অপর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
স্বাধীনতা থেকে শর্তমালা: রিকশাচালকদের জন্য সাতটি নতুন শর্ত
নতুন প্রস্তাবিত বিধিমালা—সিটি করপোরেশন এলাকায় তিন চাকার স্বল্পগতির ব্যাটারিচালিত রিকশা (ই-রিকশা) চলাচল বিধিমালা ২০২৫—ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জন্য সাতটি শর্ত নির্ধারণ করেছে।
রিকশা চালানো বাংলাদেশের শহুরে অর্থনীতিতে অন্যতম সহজ আয়ের মাধ্যম, যা শুধু অতিদরিদ্র মানুষের জন্য নয়, বরং বেকারত্ব ও অনেক দিন টাকার অভাবে থাকা শিক্ষিত তরুণদের বেঁচে থাকার জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসংস্থানের জায়গা।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ধারণা করছে, দেশে প্রায় ৬০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে। এই চালকেরা নিজেদের আয়ে পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণ করেন এবং একই সঙ্গে এই খাতের সঙ্গে যুক্ত প্রস্তুতকারক, মেরামতকারক ও পরিবহনকর্মীদের জীবিকা সচল রাখেন।
কোস্টাল লাইভলিহুড অ্যান্ট এনভাইরনমেন্টাল অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (সিএলইএএন)-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ব্যাটারিচালিত রিকশা খাত—উৎপাদন, ব্যাটারি বাজার, সার্ভিসিং, চলাচলসহ—সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ৯৭,৬২৫ কোটি টাকার অর্থনৈতিক অবদান রাখে। রাস্তার নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বৃদ্ধি এবং এর ওপর নির্ভরশীল রিকশাচালকদের জীবিকা রক্ষার জন্য একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়নের আলোচনা দীর্ঘদিন ধরে চলমান।
তবে আলোচিত খসড়া আইনগুলোর মধ্যে এই বিধিমালাটি কেবল দেশের সিটি করপোরেশন এলাকাগুলোর জন্য প্রযোজ্য। এই বিধিমালার লক্ষ্য হলো খাতটিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা, যাত্রী ও সড়ক নিরাপত্তা বাড়ানো এবং ব্যবহৃত ব্যাটারি পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণে পরিবেশগত মান নিশ্চিত করা। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য দরিদ্র রিকশাচালকদের ওপর প্রয়োজনের অতিরিক্ত শর্তের বোঝা চাপানো হলে, এই খাতে প্রকট নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
বিধিমালার উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে এর তড়িঘড়ি প্রণয়নপ্রক্রিয়া এবং কঠোর কিছু বিধান অনেকের মনেই প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত পক্ষ হচ্ছে রিকশাচালকেরা। বিধিমালায় রিকশাচালকদের জন্য কমপক্ষে সাতটি শর্ত নির্ধারিত হয়েছে—পাঁচ বছর পরপর নবায়নযোগ্য লাইসেন্স, অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ, পড়তে ও লিখতে পারা, শারীরিক সক্ষমতা ও চোখের দৃষ্টির সনদ, ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা বিমা, কোনো গুরুতর ট্রাফিক বা ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড না থাকা এবং ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর।
এসব শর্তের কিছু নিরাপত্তার দিক থেকে যুক্তিযুক্ত হলেও, কিছু কিছু নিছক প্রশাসনিক বাড়াবাড়ি, যার বাস্তব সুফল খুবই সীমিত। আনুষ্ঠানিকতা ও মানোন্নয়নের উদ্যোগের আড়ালে লুকিয়ে আছে এই পেশা নিগৃহীত ও অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর আওতার বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি। পাঁচ বছর অন্তর লাইসেন্স নবায়ন, সাক্ষরতা, ব্যক্তিগত বিমা, ও ‘অপরাধমুক্ত’ প্রমাণপত্রের মতো শর্ত কাগজে-কলমে আকর্ষণীয় হলেও বাস্তবে এসবের প্রাসঙ্গিকতা নেই বললেই চলে। যাদের কাছে রিকশা চালানোই সবচেয়ে সহজলভ্য পেশা এবং কার্যকর আয়ের উৎস, এই বিধানগুলো তাদের জন্য নিরাপত্তা নয়, বরং বঞ্চনা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের যন্ত্রে পরিণত হতে পারে।
যাঁরা রিকশা চালান এবং যেসব রাস্তা রিকশাগুলোর জন্য অনুমোদিত, সেই প্রেক্ষাপটে বিধিমালার অনেক শর্তই প্রাসঙ্গিক নয়। নিম্নগতির যানবাহনের জন্য পাঁচ বছর অন্তর লাইসেন্স নবায়ন মূলত প্রশাসনিক ঝামেলা ছাড়া কিছু নয়; একবারের লাইসেন্স বা দুর্ঘটনার রেকর্ড অনুযায়ী শর্তসাপেক্ষ নবায়নই যথেষ্ট। অধিকাংশ ট্রাফিক সংকেতই চিত্রভিত্তিক, তাই পড়ালেখার দক্ষতার বদলে প্রশিক্ষণে চিহ্ন বোঝার সংক্ষিপ্ত ভিজ্যুয়াল পাঠ অন্তর্ভুক্ত করলেই কাজ চলে। ‘অপরাধমুক্ত’ রেকর্ডের প্রমাণ চাওয়া বাস্তবসম্মত নয়, কারণ আমাদের দেশে এ–সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য তথ্যভান্ডার নেই এবং রিকশাচালকদের তা নতুন করে বানাতে হলে নতুন ধরনের হয়রানির সৃষ্টি করবে।
একইভাবে ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা বিমা ভালো উদ্দেশ্যে প্রস্তাবিত হলেও এটি ব্যয়বহুল এবং অধিকাংশ চালকের নাগালের বাইরে। যখন ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেলচালকদের জন্য অপরাধ রেকর্ড ও বিমা বাধ্যতামূলক নয়, তখন রিকশাচালকদের ওপর এটি চাপানো যুক্তিসংগত নয়। শারীরিক সক্ষমতা ও দৃষ্টিশক্তির সনদপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সহজ, স্বল্পমূল্য বা ভর্তুকিযুক্ত ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন, যাতে এটি আরেকটি আর্থিক প্রতিবন্ধকতায় পরিণত না হয়।
তদ্রূপ, রিকশার মালিকদের ওপর আরোপিত নতুন বাধ্যবাধকতার ভার শেষ পর্যন্ত এসে পড়বে চালকদের কাঁধে। রিকশার দাম ও সংশ্লিষ্ট খরচ বাড়লে চালকের দৈনিক জমার পরিমাণও বাড়বে, যা তাঁদের আয় আরও কমাবে। প্রস্তাবিত বিধিমালা অনুসারে নির্দিষ্ট নকশা ও আকার, শুধু দুই যাত্রীর জন্য সিট, নতুন নিবন্ধন এবং বিমার শর্তের কারণে মালিকানার ব্যয় বৃদ্ধি অনিবার্য।
এসবের মধ্যে কিছু নিয়ম চালকদের ওপর অপ্রয়োজনীয় আর্থিক ও প্রশাসনিক চাপ সৃষ্টি করবে। যেমন যাত্রী ও তৃতীয় পক্ষের জন্য বাধ্যতামূলক বিমা একটি অপ্রয়োজনীয় বড় বোঝা। কারণ, এটি চালকদের ওপর এমন খরচের দায় চাপায়, যা তাঁদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এবং দুর্ঘটনা কমানোর জন্য তেমন কোনো ভূমিকা রাখবে না। যদি গাড়ি ও মোটরসাইকেলের মালিকদের জন্য এমন বিমা বাধ্যতামূলক না হয়, তবে নিম্নগতির রিকশার ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ ন্যায়সংগত নয়। তদ্রূপ, এলইডি হেডলাইট সাধারণ বাল্বের চেয়ে ব্যয়বহুল হলেও ধীরগতির শহুরে যান চলাচলে তেমন নিরাপত্তা বাড়াবে না। গতিমাপক যন্ত্র (স্পিড মিটার) ৩০ কিলোমিটার গতিসীমার যানবাহনের জন্য অপ্রয়োজনীয়, বরং অতিরিক্ত খরচ ও রক্ষণাবেক্ষণের চাপ বাড়বে। এই তথাকথিত ‘বিলাসী শর্তগুলো’ দরিদ্র চালকদের আর্থিক চাপ বাড়িয়ে দেবে, অথচ সড়ক নিরাপত্তা উন্নত করতে তেমন কোনো বাস্তব ভূমিকা রাখবে না।
সার্বিকভাবে প্রস্তাবিত বিধিমালা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রিকশাচালকদের পরিণতি সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছে। বিদ্যমান ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোর বিষয়েও কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা নেই, যা নীতিগতভাবে একটি বড় ঘাটতি। তদুপরি, নির্দেশিকায় একটি যুক্তিসংগত পরিবর্তনকাল (ট্রানজিশনাল পিরিয়ড) নির্ধারণ করা উচিত, যাতে বর্তমান রিকশাগুলো ধীরে ধীরে মানসম্মত নকশায় উন্নীত করা যায়। একইভাবে, ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যবহারযোগ্য সময়সীমা (এক্সপাইরেশন পিরিয়ড) মাত্র পাঁচ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে, যা অযৌক্তিকভাবে কম। মেরামতের মাধ্যমে নিবন্ধন নবায়নের সুযোগ রেখে এই সময়সীমা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, যাতে রিকশার কার্যকালেই মালিকেরা বিনিয়োগের যথার্থ প্রতিফল পেতে পারেন।
অতিরিক্ত ও প্রশাসনিক জটিলতা শিথিল করা গেলে খরচ ও কাগজপত্রের ঝামেলা উভয়ই কমবে। এতে যোগাযোগ খাতের মানোন্নয়ন বা নিরাপত্তা কোনোভাবেই ব্যাহত হবে না; বরং এই জীবিকানির্ভর বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য নিয়মিতকরণ প্রক্রিয়াটি আরও বাস্তবসম্মত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবিক হয়ে উঠবে।
জেমস খকশী কর্মসূচি সমন্বয়কারী
ফাতিমা আরা খান কর্মসূচি সহযোগী বিআইজিডিতে কাজ করেন
খালেকুজ্জামান লিপন আহ্বায়ক, রিকশা, ব্যাটারি রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদ।
মতামত লেখকদের নিজস্ব