সাহিত্য ও রাজনীতি উভয়ের বিকাশের পূর্বশর্ত জবাবদিহির সংস্কৃতি
Published: 13th, November 2025 GMT
দ্য থার্ড ম্যান চলচ্চিত্রে হ্যারি লাইম চরিত্রে অভিনয় করেছেন অরসন ওয়েলস। ওই চলচ্চিত্রে তাঁর একটি সংলাপ ছিল এমন—‘ইতালিতে বোর্জিয়া পরিবারের শাসনের ৩০ বছরে যুদ্ধ, আতঙ্ক, হত্যা আর রক্তপাত চলেছিল, কিন্তু তারা তৈরি করেছিল মাইকেলেঞ্জেলো ও লেওনার্দো দা ভিঞ্চির মতো শিল্পী আর রেনেসাঁ। অন্যদিকে সুইজারল্যান্ডে ছিল ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ভালোবাসা, ৫০০ বছরের গণতন্ত্র ও শান্তি, অথচ তারা কী সৃষ্টি করল? কুকু ক্লক বা কোকিল ঘড়ি।’
ঔপন্যাসিক গ্রাহাম গ্রিন এই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের সহলেখক ছিলেন। তাঁর ভাষায়, এটি এই চলচ্চিত্রের সেরা সংলাপ। আর তিনি দাবি করেন, সংলাপটি ওয়েলস নিজেই লিখেছিলেন।
এই লাইন আজ এমন একটি ধারণার প্রতীক হয়ে উঠেছে যে দুঃখ, কষ্ট ও সামাজিক অস্থিরতার মধ্য থেকেই জন্ম নেয় শিল্প–সাহিত্য। আমি অবশ্য স্বীকার করব, আমিও একসময় একই মনোভাব নিয়েই এই উক্তি ব্যবহার করেছি।
যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার (ব্রেক্সিট) গণভোটের পরপরই নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক সাক্ষাৎকারে ফিলিপ পুলম্যান, এলিফ শাফাকসহ পাঁচজন লেখক ও শিল্পীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল—ব্রেক্সিট শিল্প-সাহিত্যের ওপর কোন ধরনের প্রভাব ফেলবে। পাঁচজনের মধ্যে চারজনেরই মত ছিল, এটি তাঁদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
আমি তখন দ্য থার্ড ম্যান-এর সেই উক্তিটি উদ্ধৃত করে বলেছিলাম, ব্রেক্সিট ঘিরে এই ক্রান্তিকাল হয়তো ইংরেজি সাহিত্যে এক নতুন স্বর্ণযুগ আনতে পারে। এটি লেখকদের আত্মতুষ্টি ও সম্মতি উৎপাদনের ধারা থেকে বের করে আনবে, যেটা একুশ শতকের ব্রিটিশ সাহিত্যের একটি বড় অংশজুড়ে দেখা যায়।
কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। সাহিত্যের বিকাশের জন্য ইতিবাচক পরিবেশ প্রয়োজন। একটি সুস্থ সাহিত্যচর্চার পরিবেশ সর্বতোভাবেই একটি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত। অবশ্য এমন অনেক সাহিত্যিকের উদাহরণ আমরা দেখতে পাই, যাঁরা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও লিখেছেন। কিন্তু সেগুলো ব্যতিক্রম, সাধারণ নিয়ম নয়।
আরও পড়ুনসবখানেই যখন রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, জবাবদিহি থাকবে কোথায়২১ জুন ২০২৪সেগুলো সামগ্রিক চিত্রকে ক্ষুণ্ন করে না, সেই সামগ্রিক চিত্রটি হলো সাহিত্যের জন্য প্রয়োজন কল্পনার স্বাধীনতার একটি পরিবেশ, এমনকি সেই স্বাধীনতার সীমা বিশেষ কোনো লেখার মাধ্যমে নির্ধারিত না হলেও। আমি এখানে সেই রাজনৈতিক পরিবেশ খতিয়ে দেখতে চাই; কারণ, স্পষ্ট করে বললে সাহিত্যের রাজনৈতিক পরিবেশই হলো একটি মুক্ত সমাজের রাজনৈতিক পরিবেশ।
অবশ্য তার আগে বলে রাখা ভালো—যদি আপনি ইতিমধ্যে ভুলটা ধরতে না পারেন, তাহলে জেনে রাখুন—অরসন ওয়েলস বা তাঁর চরিত্র হ্যারি লাইম বাস্তব তথ্যের দিক থেকে ভুল বলেছিলেন। কোকিল ঘড়ি আসলে সুইজারল্যান্ডে নয়, তৈরি হয়েছিল জার্মানির বাভারিয়া অঞ্চলে।
তা ছাড়া গত ৫০০ বছরে ইউরোপের অস্থিরতার ইতিহাসের মধ্যে সুইজারল্যান্ড কখনোই পুরোপুরি শান্তির দ্বীপ ছিল না। তবু স্বীকার করতেই হবে—এই সংলাপগুলো দারুণ, বিশেষত যখন সেগুলো উচ্চারণ করেন অরসন ওয়েলসের মতো একজন অভিনেতা।
২.সম্প্রতি ঢাকায় খোলা স্থানে আমার একটি বক্তৃতা ছিল। হঠাৎ বৃষ্টি নামায় সবাই ঘরের মধ্যে চলে যান প্রশ্নোত্তর পর্বের জন্য। আর সেই সুযোগে প্রশ্নোত্তর পর্বটি আরও ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতায় রূপ নেয়।
একপর্যায়ে আমি শ্রোতাদের একটি প্রশ্ন করেছিলাম। আমার উপলব্ধি ছিল, বাংলাদেশ একনায়ককে উৎখাত করেছে এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকারকে দায়িত্ব দিয়েছে, যার বেশির ভাগ সদস্যই ঢাকার উদারনৈতিক এনজিও ঘরানার মানুষ।
আমি শ্রোতাদের জিজ্ঞাসা করলাম, তাঁরা কি এখন সত্যিই স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছেন এবং তাঁদের মতপ্রকাশ করতে পারছেন? অবশ্যই ‘না’। সবাই মাথা নেড়ে সায় দিলেন এবং সেই ঘনিষ্ঠ পরিবেশে একটি সুরই প্রতিধ্বনিত হলো। তাঁরা মুক্তভাবে কথা বলতে পারছিলেন না।
যখন ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়, তখন স্বভাবতই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রয়োগের কথাটি ঘুরেফিরে আসে। এটা স্পষ্ট, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে একটি স্বৈরাচারী সরকার এ ধরনের ক্ষমতা প্রয়োগের ওপরই জোর দিয়েছে।
শেখ হাসিনার সরকার কোনো রাখঢাক না করেই এবং নির্লজ্জভাবে নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কঠোরভাবে সীমিত করেছে—কখনো কঠোর আইন প্রণয়ন করে, কখনো গুন্ডা বাহিনী ও অনুগত পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করে।
বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত ‘পলিটিকস অব লিটারেচার’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য রাখছেন জিয়া হায়দার রহমান। ১১ নভেম্বর ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: চলচ চ ত র র জন ত ক ক পর ব শ স ব ধ নত র একট অবশ য
এছাড়াও পড়ুন:
সাহিত্য ও রাজনীতি উভয়ের বিকাশের পূর্বশর্ত জবাবদিহির সংস্কৃতি
দ্য থার্ড ম্যান চলচ্চিত্রে হ্যারি লাইম চরিত্রে অভিনয় করেছেন অরসন ওয়েলস। ওই চলচ্চিত্রে তাঁর একটি সংলাপ ছিল এমন—‘ইতালিতে বোর্জিয়া পরিবারের শাসনের ৩০ বছরে যুদ্ধ, আতঙ্ক, হত্যা আর রক্তপাত চলেছিল, কিন্তু তারা তৈরি করেছিল মাইকেলেঞ্জেলো ও লেওনার্দো দা ভিঞ্চির মতো শিল্পী আর রেনেসাঁ। অন্যদিকে সুইজারল্যান্ডে ছিল ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ভালোবাসা, ৫০০ বছরের গণতন্ত্র ও শান্তি, অথচ তারা কী সৃষ্টি করল? কুকু ক্লক বা কোকিল ঘড়ি।’
ঔপন্যাসিক গ্রাহাম গ্রিন এই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের সহলেখক ছিলেন। তাঁর ভাষায়, এটি এই চলচ্চিত্রের সেরা সংলাপ। আর তিনি দাবি করেন, সংলাপটি ওয়েলস নিজেই লিখেছিলেন।
এই লাইন আজ এমন একটি ধারণার প্রতীক হয়ে উঠেছে যে দুঃখ, কষ্ট ও সামাজিক অস্থিরতার মধ্য থেকেই জন্ম নেয় শিল্প–সাহিত্য। আমি অবশ্য স্বীকার করব, আমিও একসময় একই মনোভাব নিয়েই এই উক্তি ব্যবহার করেছি।
যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার (ব্রেক্সিট) গণভোটের পরপরই নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক সাক্ষাৎকারে ফিলিপ পুলম্যান, এলিফ শাফাকসহ পাঁচজন লেখক ও শিল্পীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল—ব্রেক্সিট শিল্প-সাহিত্যের ওপর কোন ধরনের প্রভাব ফেলবে। পাঁচজনের মধ্যে চারজনেরই মত ছিল, এটি তাঁদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
আমি তখন দ্য থার্ড ম্যান-এর সেই উক্তিটি উদ্ধৃত করে বলেছিলাম, ব্রেক্সিট ঘিরে এই ক্রান্তিকাল হয়তো ইংরেজি সাহিত্যে এক নতুন স্বর্ণযুগ আনতে পারে। এটি লেখকদের আত্মতুষ্টি ও সম্মতি উৎপাদনের ধারা থেকে বের করে আনবে, যেটা একুশ শতকের ব্রিটিশ সাহিত্যের একটি বড় অংশজুড়ে দেখা যায়।
কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। সাহিত্যের বিকাশের জন্য ইতিবাচক পরিবেশ প্রয়োজন। একটি সুস্থ সাহিত্যচর্চার পরিবেশ সর্বতোভাবেই একটি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত। অবশ্য এমন অনেক সাহিত্যিকের উদাহরণ আমরা দেখতে পাই, যাঁরা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও লিখেছেন। কিন্তু সেগুলো ব্যতিক্রম, সাধারণ নিয়ম নয়।
আরও পড়ুনসবখানেই যখন রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, জবাবদিহি থাকবে কোথায়২১ জুন ২০২৪সেগুলো সামগ্রিক চিত্রকে ক্ষুণ্ন করে না, সেই সামগ্রিক চিত্রটি হলো সাহিত্যের জন্য প্রয়োজন কল্পনার স্বাধীনতার একটি পরিবেশ, এমনকি সেই স্বাধীনতার সীমা বিশেষ কোনো লেখার মাধ্যমে নির্ধারিত না হলেও। আমি এখানে সেই রাজনৈতিক পরিবেশ খতিয়ে দেখতে চাই; কারণ, স্পষ্ট করে বললে সাহিত্যের রাজনৈতিক পরিবেশই হলো একটি মুক্ত সমাজের রাজনৈতিক পরিবেশ।
অবশ্য তার আগে বলে রাখা ভালো—যদি আপনি ইতিমধ্যে ভুলটা ধরতে না পারেন, তাহলে জেনে রাখুন—অরসন ওয়েলস বা তাঁর চরিত্র হ্যারি লাইম বাস্তব তথ্যের দিক থেকে ভুল বলেছিলেন। কোকিল ঘড়ি আসলে সুইজারল্যান্ডে নয়, তৈরি হয়েছিল জার্মানির বাভারিয়া অঞ্চলে।
তা ছাড়া গত ৫০০ বছরে ইউরোপের অস্থিরতার ইতিহাসের মধ্যে সুইজারল্যান্ড কখনোই পুরোপুরি শান্তির দ্বীপ ছিল না। তবু স্বীকার করতেই হবে—এই সংলাপগুলো দারুণ, বিশেষত যখন সেগুলো উচ্চারণ করেন অরসন ওয়েলসের মতো একজন অভিনেতা।
২.সম্প্রতি ঢাকায় খোলা স্থানে আমার একটি বক্তৃতা ছিল। হঠাৎ বৃষ্টি নামায় সবাই ঘরের মধ্যে চলে যান প্রশ্নোত্তর পর্বের জন্য। আর সেই সুযোগে প্রশ্নোত্তর পর্বটি আরও ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতায় রূপ নেয়।
একপর্যায়ে আমি শ্রোতাদের একটি প্রশ্ন করেছিলাম। আমার উপলব্ধি ছিল, বাংলাদেশ একনায়ককে উৎখাত করেছে এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকারকে দায়িত্ব দিয়েছে, যার বেশির ভাগ সদস্যই ঢাকার উদারনৈতিক এনজিও ঘরানার মানুষ।
আমি শ্রোতাদের জিজ্ঞাসা করলাম, তাঁরা কি এখন সত্যিই স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছেন এবং তাঁদের মতপ্রকাশ করতে পারছেন? অবশ্যই ‘না’। সবাই মাথা নেড়ে সায় দিলেন এবং সেই ঘনিষ্ঠ পরিবেশে একটি সুরই প্রতিধ্বনিত হলো। তাঁরা মুক্তভাবে কথা বলতে পারছিলেন না।
যখন ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়, তখন স্বভাবতই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রয়োগের কথাটি ঘুরেফিরে আসে। এটা স্পষ্ট, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে একটি স্বৈরাচারী সরকার এ ধরনের ক্ষমতা প্রয়োগের ওপরই জোর দিয়েছে।
শেখ হাসিনার সরকার কোনো রাখঢাক না করেই এবং নির্লজ্জভাবে নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কঠোরভাবে সীমিত করেছে—কখনো কঠোর আইন প্রণয়ন করে, কখনো গুন্ডা বাহিনী ও অনুগত পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করে।
বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত ‘পলিটিকস অব লিটারেচার’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য রাখছেন জিয়া হায়দার রহমান। ১১ নভেম্বর ২০২৫