রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আক্রমণের মুখে বিবিসি
Published: 13th, November 2025 GMT
পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে বিবিসির মহাপরিচালক টিম ডেভির পদত্যাগ করা একটি বড় ধাক্কা। এটি এমন সময়ে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ে শূন্যতা তৈরি করল, যখন নেতৃত্বের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। ডেভি জোর দিয়ে বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত একান্তই তাঁর নিজের; বোর্ড, ডানপন্থী রাজনীতিক ও সংবাদমাধ্যমের সমন্বিত আক্রমণে নেতৃত্ব দেওয়া অনেকেই এটি প্রত্যাশা করেনি। এখন ডেভি ও বিবিসি নিউজের সিইও ডেবোরাহ টারনেস—উভয়ের পদত্যাগ দেখিয়ে দিল, চাপ প্রয়োগ করলে ফল পাওয়া যায়।
সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় হলো, এই পুরো ঘটনা শুরু হয়েছিল মাত্র এক সপ্তাহ আগে, যখন টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত হলো মাইকেল প্রেসকটের তৈরি ১৯ পাতার একটি ‘বিধ্বংসী নথি’। প্রেসকট একজন সাবেক রাজনৈতিক সাংবাদিক, যিনি তিন বছর বিবিসির বাহ্যিক উপদেষ্টা ছিলেন। ওই নথিতে অভিযোগ করা হয়, বিবিসি প্যানোরামা ট্রাম্পের এক ভাষণকে এমনভাবে সম্পাদনা করেছে, যেন মনে হয় তিনি ৬ জানুয়ারির দাঙ্গাকারীদের সমর্থন করছেন; বিবিসি আরবি সার্ভিস হামাসপন্থী দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দিচ্ছে এবং বিবিসির কিছু এলজিবিটিকিউ কর্মী যৌনতা ও লিঙ্গ–সংশ্লিষ্ট কাভারেজে অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তার করছে।
আরও পড়ুনআস্থার সংকটে বিবিসি১৫ নভেম্বর ২০১২টেলিগ্রাফ লিখেছে, বিবিসির নীরবতাই ‘গুরুতর সমস্যার প্রমাণ’। এরই মধ্যে বিবিসি সাংবাদিক নিক রবিনসনকে আক্রমণ করে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের দেওয়া ‘বিস্ফোরণধর্মী মন্তব্য’ মেইল অন সানডের শিরোনাম হয় এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেস সেক্রেটারি বিবিসিকে বলেন ‘১০০ শতাংশ ভুয়া সংবাদ’।
বিবিসির নির্দিষ্ট সংবাদ কাভারেজে ভুল বা ব্যর্থতার অভিযোগ ও গত এক সপ্তাহে নিজেদের যুক্তি তুলে ধরতে বিবিসির অদ্ভুত অক্ষমতা বা অনিচ্ছাকে কিছুটা সরিয়ে রাখা যাক। আসল সমস্যা হলো, এগুলো একটি রাজনৈতিক অভিযানের অংশ, যার লক্ষ্য হলো বিবিসিকে বিভ্রান্ত করা এবং দুর্বল করা; এটি একটি শিক্ষণীয় উদাহরণ যে কীভাবে সত্য ও নিরপেক্ষতার চেষ্টা করা সাংবাদিকতাকে আক্রমণ করে অচল করা যায়, বিশেষ করে যখন তথ্যবিকৃতি ও প্রচারের সাগরে সবাই ডুবে আছে।
প্রেসকট ভূমিকার শুরুতেই বলেছেন, তিনি কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না এবং তাঁর মতামত ‘কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বহন করে না’। অথচ তাঁর প্রতিটি সমালোচনাই আসে প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধে ‘সাংস্কৃতিক যুদ্ধের’ মতো রাজনীতি থেকে।
আরও পড়ুনসাংবাদিকতা ক্ষমতাকেন্দ্রের মুখপাত্র নয়, জনগণের কণ্ঠস্বর৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তিনি ‘আশ্চর্য’ হয়েছেন কেন ট্রাম্প ও ৬ জানুয়ারির বিদ্রোহ নিয়ে ঘণ্টাব্যাপী প্যানোরামা ডকুমেন্টারির পর ট্রাম্পের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে নিয়ে ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ’ আরেকটি অনুষ্ঠান হয়নি। নিরপেক্ষতা নিয়ে বহুদিন কাজ করা একজন আমাকে বলেছেন, এটি নিরপেক্ষতার সম্পূর্ণ ভুল–বোঝাবুঝি, এমন ব্যাখ্যা যেটির কারণে একসময় জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকারকারীদেরও মঞ্চে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।
প্রেসকট আরও অভিযোগ করেন যে বিবিসি ‘বর্ণবাদ’ সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে বেশি প্রচার করে। অথচ তিনি নিজেই যেসব উৎস উল্লেখ করেন, সেগুলো তাঁর নিরপেক্ষতার দাবি দুর্বল করে। এটি বলার অর্থ এই নয় যে বিবিসির কোনো ভুল নেই। অন্ততপক্ষে প্যানোরামা ডকুমেন্টারিতে ট্রাম্পের ভাষণের একটি খারাপ এবং বিভ্রান্তিকর সম্পাদনা ছিল, যা অগ্রহণযোগ্য। বিবিসি এ বিষয়ে ক্ষমা চাইবে বলে জানা গেছে, এটাই যথেষ্ট হওয়া উচিত ছিল।
কঠিন সময় চলছে বিবিসির জন্য। দশকের বেশি সময় ধরে লাইসেন্স ফি কমানোর পর এখন তারা চার্টার নবায়নের আলোচনায় যাচ্ছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপও বাড়ছে। বিবিসির বিরুদ্ধে ট্রাম্পের মামলার হুমকি আসে এমন এক প্রেক্ষাপটে, যখন যুক্তরাষ্ট্রে তিনি বড় বড় বাণিজ্যিক সম্প্রচারমাধ্যমকে সামান্য অভিযোগের ভিত্তিতে বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করেছেন। বিবিসিকে অবশ্যই সরকারের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে স্বাধীন থাকতে হবে—কিন্তু তা করতে হলে তাদের প্রয়োজন সবার আস্থা বজায় রাখা। ডেভি তাঁর পদত্যাগপত্রে বিবিসিকে রক্ষা করার আবেদন জানান। মনে হচ্ছে, এই আবেদন ইতিমধ্যে দেরিতে এসেছে।
জেন মার্টিনসন সিটি সেন্ট জর্জস–এর ফিন্যান্সিয়াল জার্নালিজমের অধ্যাপক
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
বিমান-ট্রাভেল খাতে সুশাসন নিশ্চিতে দুটি সংশোধনী অধ্যাদেশের অনুমোদ
দেশের বিমান পরিবহন ও ট্রাভেল এজেন্সি খাতে স্বচ্ছতা, সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিতে দুটি খসড়া অধ্যাদেশের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ।
বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট অধ্যাদেশের খসড়া দুটি উপদেষ্টা পরিষদ বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।
আরো পড়ুন:
১৫ নভেম্বরের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেবে কোর কমিটি
পাইলটের ভুলে মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনা: তদন্ত প্রতিবেদন
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসরিন জাহানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। এছাড়া মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সিভিল এভিয়েশন অথরিটি, বাংলাদেশ বেসরকারি বিমান সংস্থা এবং ট্রাভেল এজেন্সি সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে মন্ত্রণালয় জানায়, দেশের আকাশপথে যাত্রী পরিবহনের প্রায় ৮০ শতাংশই অভিবাসী কর্মী। তাই নতুন আইনে অভিবাসী কর্মীসহ সাধারণ যাত্রীদের ন্যায্য অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নত সেবা নিশ্চিত করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
বেসামরিক বিমান চলাচল (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ এর মাধ্যমে ২০১৭ সালের বিদ্যমান আইনে যুগোপযোগী নানা পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রথমবারের মতো ‘যাত্রী সেবা নিশ্চিতকরণ’ শব্দগুচ্ছকে আইনের দীর্ঘ শিরোনাম ও প্রস্তাবনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার মাধ্যমে যাত্রীদের নিরাপত্তা, সুবিধা ও অধিকার সংরক্ষণে আইনি দায়বদ্ধতা তৈরি হয়েছে।
বিদেশি এয়ারলাইনগুলোর জন্য সাধারণ বিক্রয় প্রতিনিধি নিয়োগকে ঐচ্ছিক করা হয়েছে এবং দেশি এয়ার অপারেটরদেরও একই সুযোগ দেওয়া হয়েছে। টিকিট বিক্রিতে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে ডিজিটাল টিকিট বিতরণ ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যা টিকিট ব্লকিং, কৃত্রিম সংকট বা অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবে।
অধ্যাদেশটিতে প্রথমবারের মতো বিমান সংস্থাগুলোর ট্যারিফ দাখিল ও পর্যবেক্ষণের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, টেকসই বিমান জ্বালানি ব্যবহার ও পরিবেশবান্ধব নীতি প্রণয়নের ক্ষমতা যুক্ত করা হয়েছে।
সরকারকে ‘বেসামরিক বিমান চলাচল অর্থনৈতিক কমিশন’ গঠনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে বিমানবন্দরের ফি, চার্জ, রয়্যালটি ও ভাড়ার হার নির্ধারণ করা হবে, ফলে অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা ও ন্যায্য মূল্যনীতি প্রতিষ্ঠিত হবে। নতুন আইনে সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করার পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে—যা দেশের বিমান খাতকে আরও স্মার্ট ও প্রযুক্তিনির্ভর করবে।
অপরদিকে, বাংলাদেশ ট্রাভেল এজেন্সি (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর মাধ্যমে ট্রাভেল ব্যবসায় অবৈধ অর্থ লেনদেন, মানি লন্ডারিং, টিকিট মজুতদারি, প্রতারণা ও রাজস্ব ফাঁকি রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
নতুন অধ্যাদেশে নিবন্ধন সনদ বাতিল বা স্থগিতের ১১ নতুন কারণ যুক্ত করা হয়েছে। অবৈধ টিকিট বিক্রয়, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, অনুমোদনবিহীন লেনদেন, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, তৃতীয় দেশ থেকে টিকিট কেরা-বেচা এবং যাত্রীর তথ্য পরিবর্তনকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।এসব অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা এবং এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। সরকারকে প্রমাণ প্রাপ্তির ভিত্তিতে কোনো ট্রাভেল এজেন্সির নিবন্ধন সাময়িকভাবে স্থগিত বা বাতিল করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তদুপরি, প্রতারণা বা আর্থিক আত্মসাতের ঘটনায় নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারবে।
মন্ত্রণালয় আরো জানায়, এই দুটি অধ্যাদেশ বাস্তবায়িত হলে বিমান পরিবহন ও ট্রাভেল ব্যবসায় শৃঙ্খলা, আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠিত হবে। পাশাপাশি টিকিটের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা, অভিবাসী কর্মী ও সাধারণ যাত্রীদের অধিকার সংরক্ষণ এবং পর্যটন খাতে সুশাসন ও আন্তর্জাতিক মানোন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। ফলে দেশের বিমান পরিবহন ব্যবস্থা হবে আরও আধুনিক, স্বচ্ছ ও যাত্রীবান্ধব।
ঢাকা/আসাদ/সাইফ