পুঁজিবাজারে আস্থা ফিরতে পারে যেভাবে
Published: 22nd, February 2025 GMT
মাঝে মাঝে কিছুটা ঝলকানি দিলেও বাংলাদেশের পুঁজিবাজার বস্তুত দুই যুগ ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। আমরা বেশির ভাগ সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতার দিকেই আঙুল তুলেছি, মাঝে মাঝে ব্রোকার-ডিলারদের দায়ী করেছি। খুব কম প্রতিবেদনই বাজারের অতিরিক্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী নির্ভরতা আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের স্বল্পতা নিয়ে বলেছে। কম কথা হয়েছে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনের ভূমিকা নিয়েও। প্রায়ই মনে হয়, আমাদের কর্তাদের মধ্যে পুঁজিবাজারের গুরুত্ব নিয়েও রয়েছে সংশয়। স্থানীয় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর বেশির ভাগ ব্রোকারেজ হাউসের মালিকানা চাইলেও নিজের উৎপাদনশীল বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে আনতে একেবারেই অনীহ।
পুঁজিবাজারের উন্নয়নে ভালো কোম্পানির তালিকাভুক্তি বাড়ানোর বিষয়টি সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে আছে সুশাসন আর জবাবদিহি, যা না থাকলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে ভরসা পান না। পুঁজিবাজার প্রায়ই অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। শেয়ারদর কারসাজির মাধ্যমে সূচকের অস্বাভাবিক ওঠানামা পরিলক্ষিত হয়। দীর্ঘ মেয়াদে সূচক নিম্নগামী হয়ে যায়। দুঃখজনকভাবে, আমাদের দেশের পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানির শেয়ারের বেশ ঘাটতি রয়েছে। নেই নিয়ম-নীতির পরিপালনও।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকিং খাতে দুর্দশা, উচ্চ সুদহারের মতো সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিরাজমান সংকটের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা তৈরি হয়েছে। তারও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ব্যবসা ও মুনাফা কমেছে। কেউ কেউ লোকসানের মধ্যেও পড়েছে। অর্থনীতির এমন দোদুল্যমান অবস্থায় ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারের পরিবর্তে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে উচ্চসুদের এবং নিরাপদ প্রতীয়মান বন্ডের দিকে ঝুঁকছেন, যা পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট তৈরি করেছে।
সামগ্রিকভাবে পুঁজিবাজারকে নিয়ে এক প্রকার অনিশ্চয়তায় ভুগছেন অংশীজন। অনেকেই এরই মধ্যে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করেছেন। অনেকেই নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না। কমেছে বিদেশি ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগও। অথচ পুঁজিবাজারের জন্য বিদেশি বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশি বিনিয়োগের ওপর ভিত্তি করেই একটি স্থানীয় বা আঞ্চলিক পুঁজিবাজার বৈশ্বিক হয়ে ওঠে। ২০২৪ সালে দেশের পুঁজিবাজারের মোট লেনদেনে বিদেশিদের অংশগ্রহণ ১ দশমিক ২২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, ফ্লোর প্রাইস, নীতির ধারাবাহিকতার অভাব, ভালো শেয়ারের অপ্রাচুর্য, বিনিময় হারের অস্থিরতা ও সুশাসনের ঘাটতির কারণে বিদেশিরা দেশের পুঁজিবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। পাশাপাশি অদক্ষ ব্যবস্থাপনায় এটি অপরিণতই থেকে গেছে। এখান থেকে অর্থ সংগ্রহে দীর্ঘসূত্রতা ও কার্যকর বন্ড মার্কেটের অনুপস্থিতি উদ্যোক্তাদের পুঁজিবাজারবিমুখ করছে। যে কারণে এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে প্রায় সব সূচকেই আমাদের পুঁজিবাজারের অবস্থান সবার নিচে।
পুঁজিবাজারের গতিশীলতা বাড়াতে হলে জরুরি ভিত্তিতে সরকারের কিছু দৃশ্যমান কার্যক্রম হাতে নিতে হবে, যা বিনিয়োগকারীদের কিছুটা হলেও আশ্বস্ত করবে। বর্তমান সংকট কাটিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের পুঁজিবাজার টেকসই হবে– এমন বার্তা বিনিয়োগকারীদের দেওয়া প্রয়োজন।
গেল আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের মতো পুঁজিবাজারেও অবাধ লুটতরাজ হয়েছে। অসংখ্য দুর্বল ও প্রায় অস্তিত্বহীন কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করে পুঁজিবাজারের বোঝা বাড়ানো হয়েছে। লাগামহীন কারসাজির মাধ্যমে দুর্বল মৌলভিত্তির, জাঙ্ক কোম্পানির শেয়ারের দাম ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। ফ্লোর প্রাইস আরোপ, ঘন ঘন সার্কিট ব্রেকারের ঊর্ধ্বসীমা ও নিম্নসীমা বেঁধে দেওয়া ইত্যাদি কৃত্রিম ব্যবস্থায় বাজারের শোচনীয় অবস্থা ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। আবার বিভিন্ন সময়ে শেয়ার কারসাজিতে অভিযুক্ত অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো বিচার ও শাস্তির পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এভাবে মূলত বিগত সরকার পুঁজিবাজারকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।
এমন এক পরিস্থিতিতে যখন অভ্যুত্থানের মুখে বিগত সরকারের পতন ঘটে এবং অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়, তখন অনেক অংশীজনের মনেই পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা জন্মায়। সেই প্রত্যাশার প্রতিফলনও দেখা যায় পুঁজিবাজারের প্রধান সূচকে। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপর কয়েকদিন সূচক ও লেনদেনে ঊর্ধ্বগতি দেখা গিয়েছিল। তা দীর্ঘায়িত হয়নি। এমনকি ছয় মাস অতিবাহিত হলেও সরকারের দিক থেকে কার্যকর পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। বিশেষ করে পুঁজিবাজারে কোম্পানির তালিকাভুক্তি ও শেয়ারদর কারসাজি প্রতিরোধে কাঠামোগত সংস্কারের শক্তিশালী কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
পুঁজিবাজার সংস্কারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পক্ষ থেকে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হলেও এখন পর্যন্ত এর কোনো প্রতিবেদন আমরা দেখিনি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, প্রতিবেদন জমার পর এতে যেসব সুপারিশ উঠে আসবে, সেগুলোরও যথাযথ বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কম।
পত্রিকান্তরে জানা গিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সার্বিক সূচক ডিএসইএক্সের অবস্থান ছিল ৫ হাজার ৯২৫ পয়েন্টে। সেদিন এক্সচেঞ্জটিতে লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। এর পর থেকে পুঁজিবাজারের সূচক ও লেনদেন ক্রমেই নিম্নমুখী। দুই সপ্তাহ আগে ডিএসইএক্স সূচক ৫ হাজার ১৭৯ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এ সময়ে সূচকটি ৭৪৬ পয়েন্ট হারিয়েছে। তখন ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৪৩০ কোটি টাকা। এক্সচেঞ্জটিতে সর্বশেষ ৫০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছিল গত বছরের ৩ ডিসেম্বর। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত লেনদেনের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা স্পর্শ করেনি।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারের জরুরি ভিত্তিতে ভালো কোম্পানির তালিকাভুক্তি বাড়ানোর বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক। এতে বিনিয়োগকারীদের মাঝে স্বল্প সময়ে ইতিবাচক বার্তা দেওয়া সম্ভব হবে। গত ১৬ বছরে যেসব কোম্পানি পুঁজিবাজারে এসেছে, তার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এরই মধ্যে দুর্বল কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে যেমন তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নিতে হবে, তেমনি এর বিপরীতে ভালো কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করা আবশ্যক। নতুন নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধান এ ব্যাপারে আশাবাদও ব্যক্ত করেছেন। আমি মনে করি, ব্যাংকের ঋণ প্রদানকে যেমন তাদের পুঁজির সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়, তেমনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রাতিষ্ঠানিক ঋণগ্রহীতাদের ঋণের সর্বোচ্চ পরিমাণকেও তাদের কোম্পানির পুঁজির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দিতে পারে। তাহলে তারা তাদের নতুন অর্থায়নের জন্য পুঁজিবাজারে যেতে অনেকটা বাধ্য হবে।
এর বাইরে সুশাসন নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। সংশ্লিষ্টদের মতে, বাজার কারসাজি প্রতিরোধে কমিশনের উদ্যোগ অনেক দুর্বল। বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত অনিয়ম ও কারসাজির দায়ে ৭০০ কোটি টাকার বেশি জরিমানা করা হলেও বাজারে এখনও স্বস্তি আসছে না।
এটিও সত্য, অভিনব ও অপরাপর সমপর্যায়ের বা প্রতিযোগী দেশের মতো বাজার সংস্কার না করে শুধু কমিশন বদলে বা দু-একজনের বিচার করে আমাদের পুঁজিবাজারের সম্যক সম্ভাবনা আদায় করা যাবে না। সামগ্রিক রাজনৈতিক সুশাসনের বিষয়টিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সরক র র ক ত কর দ র বল আম দ র ব যবস অবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
কোটিপতি হলেও পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ করেন তিনি
পর্যাপ্ত অর্থ সঞ্চয় করতে পারলেই আমাদের অনেকে কায়িক পরিশ্রম ছেড়ে দেন। আরাম-আয়েশে জীবন কাটান। কিন্তু সবাই তা করেন না। এমন একজন জাপানের কোইচি মাতসুবারা। ৫৬ বছর বয়সী এই জাপানি নাগরিকের বার্ষিক আয় প্রায় ৩ কোটি ইয়েন (প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা) হওয়া সত্ত্বেও তিনি এখনো নিয়মিত পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করেন।
মাতসুবারা সপ্তাহে তিন দিন, প্রতিদিন চার ঘণ্টা করে কাজ করেন। তিনি সরকারি পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন। এ কাজের অংশ হিসেবে তাঁকে ছোটখাটো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করতে হয়।
এ কাজ থেকে মাতসুবারা মাসে ১ লাখ ইয়েন (প্রায় ৮২ হাজার ৬৪ টাকা) আয় করেন, যা টোকিওর গড় বেতনের তুলনায় অনেক কম। তারপরও তিনি এ কাজ করেন। কারণ, তিনি এটাকে শারীরিক সক্রিয়তা ও মানসিক প্রশান্তির উপায় হিসেবে দেখেন।
মাতসুবারা ছোটবেলা থেকেই সঞ্চয়ী ছিলেন। মাধ্যমিকের পর তিনি একটি কারখানায় মাসে ১ লাখ ৮০ হাজার ইয়েন (প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা) বেতনে কাজ শুরু করেন। খরচ বাঁচিয়ে কয়েক বছরে প্রায় ৩০ লাখ ইয়েন (২৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা) সঞ্চয় করে তিনি প্রথম স্টুডিও ফ্ল্যাট কিনেছিলেন।
পরে বাড়ি কেনার ঋণ আগেভাগে পরিশোধ করে ধীরে ধীরে আরও ফ্ল্যাট কেনেন এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেন মাতসুবারা। এখন টোকিও ও এর শহরতলিতে তাঁর সাতটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যার সবই ভাড়া দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করেছেন।
ধনবান হলেও মাতসুবারা সাদাসিধে জীবন যাপন করেন। এখনো তিনি সস্তা ফ্ল্যাটে থাকেন, নিজের খাবার নিজে বানান, নতুন জামাকাপড় কেনেন না, সাধারণ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন এবং প্রধানত সাইকেলে চলাচল করেন। তাঁর জীবনদর্শন—‘প্রতিদিন কিছু না কিছু করার আশা করি, সুস্থ থাকতে চাই এবং নিজেকে নিয়ে চিন্তা করতে চাই।’
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে মাতসুবারাকে ‘অদৃশ্য কোটিপতি’ বলে উল্লেখ করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর গল্প ছড়িয়ে পড়েছে। জাপানে ধনীদের এমন সাধারণ জীবনধারা অস্বাভাবিক নয়। দেশটিতে সাদাসিধে জীবনযাপন অনেকের মধ্যে দেখা যায়।