‘পাখি ভুনা এক হাফ...টাকা’। বেশ কয়েক বছর আগে এই শিরোনামে প্রথম আলোতে একটি খবর ছাপা হয়েছিল। খবরটি সিলেটের ছিল। তখন সারা দেশের হোটেলগুলোয় পাখির মাংস বিক্রির একই চিত্র ছিল।

বন বিভাগের পদক্ষেপের কারণে হোটেলগুলোয় এমন খোলামেলাভাবে পাখির মাংস বিক্রি হতে আর দেখা যায় না। যদিও সিলেটে কী অবস্থা জানা নেই। হোটেলে বিক্রি হয় না বলে রাজশাহীতে পাখি ধরা, মারা ও বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়নি। বিশেষ করে বিষটোপ দিয়ে প্রতিদিন পরিযায়ী পাখি মেরে গোপনে বিক্রি করা হচ্ছে। সমাজের একশ্রেণির মানুষ, যাঁরা কি না নিজেদের অভিজাত মনে করেন, তাঁরা হোটেলে দুই টাকা বেশি দিয়েই পাখির মাংস খেতেন। এখন তাঁরা গোপনে বাসায় বসে কিনছেন। তাঁদের সরবরাহ করছেন পাখিশিকারিরা।

তবে চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষক্রিয়ায় পাখির মাংস ক্ষারে পরিণত হয়। এই মাংস জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিষে এই মাংসের আমিষের গুণাগুণও নষ্ট হয়ে যায়। এই মাংস খাওয়া আর না–খাওয়া সমান।

আরও পড়ুনইবনে সিরিনের স্বপ্নব্যাখ্যা, অন্ধশিকারি ঘুঘু আর নির্মম মনুষ্যত্ব১১ এপ্রিল ২০২৪

আর বন বিভাগ বলছে, বন্য পাখি থেকেই বার্ড ফ্লু ছড়ায়। তারা কি জেনেশুনেই খাচ্ছেন, নাকি সাতপাঁচ না ভেবেই এই বিষ গিলছেন।

রাজশাহীর পদ্মা নদীতে প্রতিবছর শীতের শুরুতেই পরিযায়ী পাখিরা চলে আসে। এই চর একসময় পরিযায়ী পাখিদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছিল। সারা দেশ থেকে এমনকি দেশের বাইরে থেকেও পাখিপ্রেমীরা ক্যামেরা নিয়ে ছুটে আসেন রাজশাহীর পদ্মায় পাখি দেখার জন্য।

যে পাখিটি দেশের কোথাও দেখা যায়নি, সেটা রাজশাহীতে দেখা যায়। এমন অনেক ঘটনা আছে। প্রায় এক ডজন নতুন পাখিও দেখা গেছে রাজশাহীতে। এদের পাখিবিশেষজ্ঞরা নতুন নাম রেখেছেন।

শীত শেষে পাখিরা আবার ফিরে যায়। এই শীতের সুযোগের জন্য ওত পেতে থাকেন পাখিশিকারিরা। পাখি মারার সহজ হাতিয়ার হয়ে উঠেছে বিষটোপ। তারা ভোররাতে মাছের পেটের মধ্যে বিষ ঢুকিয়ে দিয়ে পদ্মার চরে ছিটিয়ে দিয়ে জাল নিয়ে অপেক্ষা করেন। পাখিরা এই মাছ খেয়ে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ঢলে পড়ে। তখন শিকারি এসব পাখি ধরে জবাই করে তাঁদের নির্ধারিত ক্রেতাদের কাছে গোপনে সরবরাহ করেন।

ধরে নিচ্ছি, শিকারি লিটন সরকারেরা হয়তো আইনের তোয়াক্কা করেন না, কিন্তু আমরা? আমরা কি লিটন সরকারের মারা পরিযায়ী পাখির মাংস কিনে তাঁর সহযোগী হচ্ছি না। যদি আইনও ভঙ্গ করতে চাই, প্রাণের মায়া কি আমাদের নেই? টাকা দিয়ে বিষটোপে মারা পাখি কিনে নিজের শরীরের রোগব্যাধিকে আমন্ত্রণ জানাব? এটা কি পাখি শিকারের নামে মানুষ শিকার নয়?

গত ৯ জানুয়ারি এক পাখিশিকারির বাড়িতে বন বিভাগের কর্মীরা অভিযান চালিয়ে ৯টি চখচখি জব্দ করেন। কিন্তু তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়ে শিকারি পালিয়ে যান। হাতেনাতে ধরতে পারলে ভ্রাম্যমাণ আদালতে তাঁদের শাস্তি দিতে পারতেন। কিন্তু অভিযানে পাখিশিকারিরা মোটেও ভয় পান না। তাঁরা প্রতিদিন বিষটোপ দিয়ে পাখি শিকার করতেই থাকেন।

২৮ জানুয়ারি ভোরে বন বিভাগের কর্মকর্তারা নৌ পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে ছদ্মবেশ ধারণ করে লিটন হোসেন (৪০) নামের একজন পাখিশিকারিকে ধরে ফেলেন। তাঁর কাছ থেকে চারটি পাখি উদ্ধার করা হয়। তাঁর মধ্যে তিনটি তিলি হাঁস ও একটি পিয়ং হাঁস। ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাঁর তিন দিনের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

ওই দিন দুপুরে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা খবর পান বিষটোপে মরা আরও পাখি চরে পড়ে আছে, নদীর পানিতেও ভেসে যাচ্ছে। এই খবর পেয়ে ছুটে যান পদ্মা নদীতে। তাঁরা একটি ইগল, ভুবনচিল ও বিভিন্ন প্রজাতির মোট ৪১টি মৃত পরিযায়ী হাঁস উদ্ধার করে সন্ধ্যায় বন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করেন।

৩০ জানুয়ারি দণ্ডপ্রাপ্ত শিকারি লিটনে হোসেনের কারাবাসের তিন দিন পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, হাসিমুখে কারাগার থেকে বের হয়ে এসেই তিনি আবার বিষটোপ নিয়ে বাড়ির পাশের পদ্মা নদীতে নেমে পড়বেন। হয়তো নৌ পুলিশ, বন বিভাগ, স্বেচ্ছাসেবী সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে নতুন কৌশলে লিটন হোসেনেরা পাখি শিকার করতেই থাকবেন। তাই বলে কি আমরা সেই পাখি কিনব। মাংস খাব?

বিষটোপ দিয়ে মারা পাখির মাংস খাওয়া উচিত কি না, তা বৈজ্ঞানিকভাবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মো.

জালাল উদ্দিন সরদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বললেন, বিষটোপ খাওয়ার পরে শরীরের রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে পাখি মারা যায়। পাখির শরীরের মাংস তখন ক্ষার হয়ে যায়। এর খাদ্যগুণ নষ্ট হয়ে যায়। আমিষ গুণাগুণ আর থাকে না। এই মাংস জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। এই মাংস কিছুতেই খাওয়া উচিত নয়।

রাজশাহী বন বিভাগের বন্য প্রাণী পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, বন্য পাখি থেকেই বার্ড ফ্লু ছড়ায়। এই জন্য সচেতনভাবেই বন্য প্রাণী ধরা বা এর মাংস খাওয়া বিপজ্জনক। তা ছাড়া বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২–এর ধারা ৬(১) অনুযায়ী, ‘বন্য প্রাণী শিকার করা দণ্ডনীয় অপরাধ, যার সর্বোচ্চ শাস্তি ১ বছর কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।’

ধরে নিচ্ছি, শিকারি লিটন সরকারেরা হয়তো আইনের তোয়াক্কা করেন না, কিন্তু আমরা? আমরা কি লিটন সরকারের মারা পরিযায়ী পাখির মাংস কিনে তাঁর সহযোগী হচ্ছি না। যদি আইনও ভঙ্গ করতে চাই, প্রাণের মায়া কি আমাদের নেই? টাকা দিয়ে বিষটোপে মারা পাখি কিনে নিজের শরীরের রোগব্যাধিকে আমন্ত্রণ জানাব? এটা কি পাখি শিকারের নামে মানুষ শিকার নয়?

আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ প্রথম আলোর রাজশাহীর নিজস্ব প্রতিবেদক

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ল টন সরক র র বন ব ভ গ র বন য প র ণ পর য য় র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

কোটিপতি হলেও পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ করেন তিনি

পর্যাপ্ত অর্থ সঞ্চয় করতে পারলেই আমাদের অনেকে কায়িক পরিশ্রম ছেড়ে দেন। আরাম-আয়েশে জীবন কাটান। কিন্তু সবাই তা করেন না। এমন একজন জাপানের কোইচি মাতসুবারা। ৫৬ বছর বয়সী এই জাপানি নাগরিকের বার্ষিক আয় প্রায় ৩ কোটি ইয়েন (প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা) হওয়া সত্ত্বেও তিনি এখনো নিয়মিত পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করেন।

মাতসুবারা সপ্তাহে তিন দিন, প্রতিদিন চার ঘণ্টা করে কাজ করেন। তিনি সরকারি পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন। এ কাজের অংশ হিসেবে তাঁকে ছোটখাটো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করতে হয়।

এ কাজ থেকে মাতসুবারা মাসে ১ লাখ ইয়েন (প্রায় ৮২ হাজার ৬৪ টাকা) আয় করেন, যা টোকিওর গড় বেতনের তুলনায় অনেক কম। তারপরও তিনি এ কাজ করেন। কারণ, তিনি এটাকে শারীরিক সক্রিয়তা ও মানসিক প্রশান্তির উপায় হিসেবে দেখেন।

মাতসুবারা ছোটবেলা থেকেই সঞ্চয়ী ছিলেন। মাধ্যমিকের পর তিনি একটি কারখানায় মাসে ১ লাখ ৮০ হাজার ইয়েন (প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা) বেতনে কাজ শুরু করেন। খরচ বাঁচিয়ে কয়েক বছরে প্রায় ৩০ লাখ ইয়েন (২৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা) সঞ্চয় করে তিনি প্রথম স্টুডিও ফ্ল্যাট কিনেছিলেন।

পরে বাড়ি কেনার ঋণ আগেভাগে পরিশোধ করে ধীরে ধীরে আরও ফ্ল্যাট কেনেন এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেন মাতসুবারা। এখন টোকিও ও এর শহরতলিতে তাঁর সাতটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যার সবই ভাড়া দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করেছেন।

ধনবান হলেও মাতসুবারা সাদাসিধে জীবন যাপন করেন। এখনো তিনি সস্তা ফ্ল্যাটে থাকেন, নিজের খাবার নিজে বানান, নতুন জামাকাপড় কেনেন না, সাধারণ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন এবং প্রধানত সাইকেলে চলাচল করেন। তাঁর জীবনদর্শন—‘প্রতিদিন কিছু না কিছু করার আশা করি, সুস্থ থাকতে চাই এবং নিজেকে নিয়ে চিন্তা করতে চাই।’

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে মাতসুবারাকে ‘অদৃশ্য কোটিপতি’ বলে উল্লেখ করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর গল্প ছড়িয়ে পড়েছে। জাপানে ধনীদের এমন সাধারণ জীবনধারা অস্বাভাবিক নয়। দেশটিতে সাদাসিধে জীবনযাপন অনেকের মধ্যে দেখা যায়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ