দুই যুগে ২৭ বার আগুন লেগেছে। পুড়েছে শত একর বনভূমি। সব ঘটনা সুন্দরবন পূর্ব বিভাগে। শনিবার সকালে কলমতেজী টহল ফাঁড়ি সংলগ্ন এলাকায় লাগা আগুন গতকাল রোববার দুপুরে নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে সকালে অন্য এলাকায় ধোঁয়া দেখা গেছে। সর্বশেষ পাওয়া খবরে জানা গেছে, চাঁদপাই রেঞ্জের একুশের ছিলা-শাপলার বিল এলাকায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে।

বনরক্ষী ও স্বেচ্ছাসেবকরা কলমতেজী থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে একুশের ছিলা-শাপলার বিল এলাকায় ছুটে যান। দুপুর ১টা থেকে আগুন লাগা স্থানে ফায়ার লাইন তৈরি শুরু করেন।

তবে নতুন করে লাগা আগুনের স্থানে ফায়ার সার্ভিস, বন বিভাগ ও স্বেচ্ছাসেবকরা পৌঁছলেও পানি ছিটানো শুরু করতে পারেননি। ঘটনাস্থল থেকে খালের দূরত্ব প্রায় আড়াই কিলোমিটার। দুর্গম এবং গাছপালা জড়ানো থাকায় পাইপ টানতে বেগ  পেতে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিস ও বনরক্ষীদের।

বাগেরহাট ফায়ার সার্ভিস কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) সাকরিয়া হায়দার বলেন, ‘বাগেরহাট, শরণখোলা, মোরেলগঞ্জসহ পাঁচটি ইউনিট সুন্দরবন সংলগ্ন ভোলা নদীতীরে অবস্থান করছে।’

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মোহাম্মদ নূরুল করিম বলেন, কলমতেজীর আগুন গতকাল দুপুর সোয়া ১২টায় নিভেছে। আনুমানিক ৩-৪ একর বনের গাছপালা ছাই হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা যায়নি। তবে নতুন করে যে আগুন লেগেছে, সেখানে বনরক্ষীরা পৌঁছেছেন। ফায়ার লাইন তৈরিতে কাজ চলছে। যত দ্রুত সম্ভব পাম্পের মাধ্যমে পানি ছিটানো হবে।

সব আগুন পূর্ব সুন্দরবনে

বন বিভাগের তথ্যমতে, দুই যুগের অগ্নিকাণ্ডের সব ঘটনা ঘটেছে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগে ভোলা ও মরা ভোলা নদীসংলগ্ন এলাকায়। ২০০২ সালে চাঁদপাই রেঞ্জের কটকা, একই রেঞ্জের নাংলী ও মান্দারবাড়িয়া, ২০০৫ সালে পচাকোড়ালিয়া, ঘুটাবাড়িয়ার সুতার খাল, ২০০৬ সালে তেরাবেকা, আমুরবুনিয়া, খুড়াবাড়িয়া, পচাকোড়ালিয়া ও ধানসাগর, ২০০৭ সালে পচাকোড়ালিয়া, নাংলী ও ডুমুরিয়া, ২০১০ সালে গুলিশাখালী, ২০১১ সালে নাংলী, ২০১৪ সালে গুলিশাখালী, ২০১৬ সালে নাংলী, পচাকোড়ালিয়া ও তুলাতলা, ২০১৭ সালে মাদ্রাসারছিলা, ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ধানসাগর, ২০২১ সালের ৩ মে শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি, ২০২৪ সালের ৪ মে চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া এবং সর্বশেষ গত শনিবার সকালে কলমতেজী টহল ফাঁড়ি সংলগ্ন এলাকায় আগুন লাগে। দুই যুগের এসব আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ১০০ একর বনভূমি।

আগুন লাগার যত কারণ

বন বিভাগের তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জেলে-মৌয়ালদের ফেলে আসা আগুন থেকে অগ্নিকাণ্ড হয়েছে অন্তত ১৫ বার। তাপদাহের কথা উল্লেখ করা হয়েছে চারবার। মাছ ধরার জন্য চারবার এবং আক্রোশবশত অগ্নিসংযোগের উল্লেখ রয়েছে চারবার।

তবে স্থানীয় ও পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, একশ্রেণির কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ইচ্ছা করে গহিন বনে আগুন ধরিয়ে দেয় অসাধু মাছ ব্যবসায়ীরা। পরে বর্ষা মৌসুমে এসব স্থান প্লাবিত হলে জাল দিয়ে সহজে লাখ টাকার মাছ ধরতে পারে তারা।

সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য

সুন্দরবনের আগুন ‘মানবসৃষ্ট ও পরিকল্পিত’ উল্লেখ করে দীর্ঘদিন ধরে বন বিভাগ ও সরকারকে এ নিয়ে গুরুত্ব দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে পরিবেশবাদী সংগঠন ও বন-সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক নূর আলম শেখ বলেন, ‘সুন্দরবন সংরক্ষিত অঞ্চল হলেও শিকারিসহ মানুষের অবাধ যাতায়াত রয়েছে। মুনাফালোভী মাছ ব্যবসায়ী ও অসৎ বন কর্মকর্তার যোগসাজশে এবং অদক্ষ মৌয়ালদের কারণে বারবার আগুন লাগছে। এর দায়ভার এড়াতে পারে না বন বিভাগ।’

সর্বশেষ আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানে চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) দ্বীপন চন্দ্র দাসকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন– ধানসাগর স্টেশনের স্টেশন কর্মকর্তা বিপুলেশ্বর দাস ও কলমতেজী টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। এসিএফ দ্বীপন সমকালকে বলেন, ‘আমরা আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধান ও বনভূমির ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করব। আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।’


 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স ন দরবন স ন দরবন প র ব ব ভ গ কর মকর ত বন ব ভ গ কলমত জ এল ক য়

এছাড়াও পড়ুন:

সুন্দরবনের নতুন পর্যটন স্পট ‘আলী বান্দা’

পূর্ব সুন্দরবনের নিসর্গঘেরা অভয়ারণ্যে গড়ে তোলা হয়েছে নতুন পর্যটন কেন্দ্র ‘আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার’। সবুজ ম্যানগ্রোভ বনের বুক চিরে, নদীর নোনাজলে ভেসে, প্রকৃতির নীরব সৌন্দর্যে ঘেরা এই কেন্দ্রটি চলতি নভেম্বর মাস থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভ্রমণ করতে পারবেন পর্যটকরা।

পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের আওতাধীন আলী বান্দা এরইমধ্যে ভ্রমণপিপাসুদের দৃষ্টি কেড়েছে। শরণখোলা রেঞ্জ অফিস থেকে ট্রলারযোগে মাত্র ৪০ মিনিটের নৌপথ পেরিয়ে পৌঁছানো যায় সেখানে। 

যাত্রাপথে চোখে পড়ে বনের গভীর সবুজ গাছগাছালি, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাওয়া পাখি, কচুরিপানায় ঢাকা জলাশয় এবং সুন্দরী-গেওয়া গাছের সারি যা পর্যটকদের মোহিত করে।

বন বিভাগ জানিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টারের অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়। এখানে তৈরি হয়েছে ছয়তলা ভবনের সমান উচ্চতার একটি ওয়াচ টাওয়ার, যেখান থেকে সুন্দরবনের বিস্তৃত সবুজাভ দৃশ্য চোখে ধরা পড়ে। 

রয়েছে দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ ফুট ট্রেইল (ওয়াকওয়ে)। পথের দুই পাশে ঘন বনের মাঝে হাঁটলে দেখা যায় প্রকৃতির আসল রূপ। এছাড়া রয়েছে মিষ্টি পানির পুকুর, হরিণ রাখার সেড, জেটি, বিশ্রামাগার, সুভেনিয়ার শপ এবং পর্যটকদের নিরাপত্তায় বনরক্ষী ও স্থানীয় গাইডের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান।

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আলীবান্দা বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোর মানুষের জন্য সবচেয়ে সহজগম্য স্পট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কম সময় ও কম ঝুঁকিতে সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে এখানে। স্থানীয় পর্যটকরা এরইমধ্যে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে।

স্থানীয় বাসিন্দা শাহিন বলেন, “আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার চালু হলে স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে স্থানীয় গাইড, নৌযানচালক, হোটেল ব্যবসায়ী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কর্মসংস্থান বাড়বে। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব পর্যটনের মাধ্যমে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সচেতনতা বাড়বে।”

তবে পর্যটনকেন্দ্রে প্রবেশ ফি নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। আলীবান্দায় প্রবেশের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৪৫ টাকা।

শরণখোলা ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল বয়াতী বলেন, ‘‘আলীবান্দায় প্রবেশ ফি ৩৪৫ টাকা, অথচ একই বনের করমজল পর্যটন পয়েন্টে ফি মাত্র ৪৬ টাকা। অনেকেই আলীবান্দায় যেতে আগ্রহী, কিন্তু ফি বেশি হওয়ায় নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।’’

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “আলীবান্দা এখন প্রায় প্রস্তুত। চলতি মাসেই এখানে হরিণ আনা হবে। বর্তমানে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে স্পটটি। যেহেতু এটি ২০১৭ সালে ঘোষণা করা অভয়ারণ্য এলাকার অন্তর্ভুক্ত, তাই সাধারণ বনাঞ্চলের তুলনায় কিছু বিধিনিষেধ ও প্রবেশ ফি বেশি রাখা হয়েছে। তবে পর্যটকদের দাবির বিষয়টি আমরা সরকারের কাছে জানাব।’’

ঢাকা/শহিদুল/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সুন্দরবনের নতুন পর্যটন স্পট ‘আলী বান্দা’
  • সুন্দরবনের বড় গেছো প্যাঁচা