আগুনে পুড়েছে সুন্দরবনের ২৫ নম্বর কম্পার্টমেন্টের প্রায় আট একর বনভূমি
Published: 25th, March 2025 GMT
সুন্দরবনের ধানসাগর ক্যাম্পের আওতাধীন বনাঞ্চলে আগুন সম্পূর্ণ নিভেছে। সেখানে আগুন না থাকলেও মঙ্গলবার দুপুরের পরও কয়েকটি স্থানে ধোঁয়া দেখা যায়। তাই ফায়ার আউট ঘোষণা করা হয়নি। পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে বন বিভাগ।
রোববার সকালে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের ধানসাগর টহল ফাঁড়ির ২৫ নম্বর কম্পার্টমেন্ট এলাকায় আগুনের সূত্রপাত।
স্থানীয়ভাবে এলাকাটি তেইশের ছিলা ও শাপলার বিল হিসেবে পরিচিত। শুরু থেকে পানির অভাবে সেখানে আগুন নেভানোর কাজে বেগ পেতে হয় বন বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিসকে। তবে আগুনের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর তা নিয়ন্ত্রণে ভিটিআরটি ও সিপিজি সদস্যদের নিয়ে দ্রুত ফায়ার লাইন কাটা শুরু করে বন বিভাগ। আর নদীতে জোয়ার এলে পাম্প বসিয়ে রোববার রাত থেকে শুরু হয় পানি ছিটানো।
ভাটায় পানি না থায় প্রতিদিনই প্রায় ১৪-১৫ ঘণ্টা পানি ছিটানো যায়নি বনে। তবে যখনই পানি পাওয়া গেছে, সারাক্ষণ পাম্প চালিয়ে নদী থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের দুর্গম বনে তা নিয়ে আগুন নেভাতে কাজ করে গেছে বন বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিস। এভাবে মঙ্গলবার সকালে আগুন নেভানো সম্ভব হয়। তবে এখনো ফায়ার আউট ঘোষণা করা হয়নি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক আবু বক্কর জামান বলেন, ‘সব জায়গায় পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু ধোঁয়া দেখতে পাওয়ায় আজও সারা দিন আমরা আগুনের এলাকাটি পর্যবেক্ষণে রাখি। রাতেও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ চলবে।’
আগুন নিয়ন্ত্রণে শুরুতে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি এবং বন বিভাগের আশপাশের ২০টি অফিসের লোকজন যোগ দেন। তবে কোথাও আর স্পষ্ট আগুন না থাকায় সকাল থেকে ফায়ার সার্ভিস, বন বিভাগ এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যা কমাতে থাকে কর্তৃপক্ষ। সকালেই ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সারা দিন ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট থাকলেও মঙ্গলবার রাতে কাজ করবে দুটি ইউনিট।
ফায়ার সার্ভিসের ডিএডি সাকরিয়া হায়দার বলেন, বনের আগুনের ধরন একটু ভিন্ন। এখানে শুকনো পাতার পুরু আস্তরণ থাকে। ওপরে ভিজিয়ে দিলেও কখনো কখনো নিচে আগুন থাকতে পারে। তাই সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। এ জন্যই দীর্ঘ সময় ধরে পর্যবেক্ষণ।
পুড়ে গেছে প্রায় ৮ একর বন
সুন্দরবনের তেইশের ছিলা এলাকায় আগুন লাগার এক দিন আগে শনিবার সকালে পাশের কলমতেজী বন টহল ফাঁড়ির আওতাধীন স্থানীয়ভাবে টেপার বিল হিসেবে পরিচিত এলাকায় আগুন লাগে। দিনরাত কাজ করে রোববার ওই আগুন যখন প্রায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে, তখনই ড্রোনের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করার সময় ধরা পড়ে পাশের তেইশের ছিলায় নতুন করে লাগা আগুন।
বন বিভাগ বলছে, সুন্দরবনে আগুন লাগা পাশাপাশি দুটি এলাকাই বনের ২৫ নম্বর কম্পার্টমেন্টের আওতাধীন। কলতেজী ও ধানসাগর—দুই এলাকাতেই চার একরের মতো বনভূমি পুড়েছে। তবে স্থানীয় লোকজনের দাবি, আগুনে ওই এলাকার ১০ একরের বেশি বনাঞ্চল পুড়ে গেছে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নূরুল করিম বলেন, ‘আজ (মঙ্গলবার) বিকেলেও দুই এক জায়গায় ধোঁয়া মিলেছে। যার কারণে আজও রাতে আমরা পানি ছিটাব। বুধবার সকালেও পর্যবেক্ষণ করা হবে। এর পরে নির্ধারণ করা হবে কখন ফায়ার আউট ঘোষণা করা হবে।’
আগুনে বনের কী পরিমাণ এলাকা পুড়েছে, সে বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরে নিশ্চিত করে বলা যাবে জানান নূরুল করিম। তিনি আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা, কলমতেজী এলাকায় তিন থেকে চার একর এবং ধানসাগর এলাকায় চার একরের মতো পুড়ে থাকতে পারে। ফায়ার আউট ঘোষণার পর তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করবে।
দুটি আগুনের ঘটনায় বন বিভাগ সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বনসংরক্ষক (এসিএফ) দীপন চন্দ্র দাসকে প্রধান করে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগুনে পোড়া বনে প্রধানত বলাগাছই বেশি। অল্প কিছু সুন্দরী ও বাইনগাছ ছাড়া বলা বা বলই আর লতাগুল্মজাতীয় গাছই বেশি দেখা যায়। আগুনে এসব গাছের প্রায় সবই শুকিয়ে গেছে। বলাগাছ থেকে এরই মধ্যে পাতা শুকিয়ে ঝরে পড়ছে। গোড়া পুড়ে যাওয়াতে বাইন, সুন্দরীর মতো বড়গুলোও একটু বাতাসে বা বৃষ্টিতে হেলে পড়তে পারে, বলছে বন বিভাগের স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা।
বন বিভাগের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) ইমরান আহমেদ বলেন, মঙ্গলবার সকালে পুরো এলাকার কোথাও আগুনের চিহ্ন ছিল না। দুপুরের আগে নতুন করে কয়েকটি স্থানে ছোট ছোট ধোঁয়া দেখা যায়। তাই আরও দীর্ঘ সময় ধরে পর্যবেক্ষণ চলবে
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বন ব ভ গ র স ন দরবন এল ক য়
এছাড়াও পড়ুন:
এক দশকে ১ লাখ হেক্টর বনভূমি কমেছে
দেশে এক দশকে বনভূমি হ্রাস পেয়েছে ১ লাখ ১ হাজার হেক্টর, যা ঢাকা শহরের আয়তনের প্রায় সাড়ে তিন গুণ। গত এক দশকে দেশ থেকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির গাছ।
সারা দেশে বনাঞ্চলে যে পরিমাণ গাছ আছে, গ্রামাঞ্চলে গাছের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। তবে গ্রামে গাছের ঘনত্ব কম। আর বন উজাড় বেশি হয়েছে পার্বত্যাঞ্চলে। সেখানে একমুখী প্রজাতির ফসল চাষের প্রসার ও সড়ক সম্প্রসারণের কারণে বন উজাড় হচ্ছে।
বনের সার্বিক চিত্র জানতে ২০২৪ সালে বন অধিদপ্তরের করা জাতীয় বন জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জরিপটি প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, উপদেষ্টা, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়২০১৫ সালে জাতীয় বন জরিপে বন আচ্ছাদনের পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ, সেটি এখন কিছুটা হ্রাস পেয়ে ১২ দশমিক ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বন জরিপে দেশে বনভূমি আছে ১৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর। আগের বন জরিপে যেটির পরিমাণ ১৮ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর।
জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।’
‘জীববৈচিত্র্য রক্ষা, অবক্ষয়িত বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা’র আহ্বান জানিয়ে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৭২ সালে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক দিবসের মর্যাদা দেয়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ফাওয়ের তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিকভাবে বন উজাড়ীকরণের হার ১ দশমিক ১ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে সেটি ২ দশমিক ৬ শতাংশ।
বন অধিদপ্তরের ২০টি দল মাঠপর্যায়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করে ২০২৪ সালের মার্চে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তাদের তথ্য সংগ্রহ শেষ হয়। উপকূলীয় বন, শালবন, সুন্দরবন, পার্বত্যাঞ্চল ও গ্রামীণ এলাকায় মোট ১ হাজার ৮৫৮টি নমুনা প্লটের ভিত্তিতে এ জরিপের ফলাফল নির্ধারণ করা হয়েছে।
জরিপে দেশে প্রতি হেক্টরে গাছের ঘনত্ব পাওয়া গেছে ১১৭টি। সবচেয়ে বেশি গাছের ঘনত্ব আছে সুন্দরবনে। এখানে গাছের ঘনত্ব প্রতি হেক্টরে ৭০২টি। বনাঞ্চলের চেয়ে গ্রামীণ এলাকায় গাছের ঘনত্ব কম হলেও মোট গাছের পরিমাণ বেশি। গ্রামীণ এলাকায় মোট গাছের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি।
২০১৫ সালের বন জরিপে গাছের সংখ্যা ছিল ১৬৯ কোটি। সাম্প্রতিক জরিপে সেটা কিছুটা কমে হয়েছে ১৫৭ কোটি। গত এক দশকে হ্রাস পাওয়া গাছের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। জরিপে সারা দেশে ৩২৬টি গাছের প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৪২টি প্রজাতি পাওয়া গেছে পার্বত্যাঞ্চলে। সুন্দরবনে পাওয়া গেছে ২২ প্রজাতির গাছ। এর আগে বন জরিপে (২০১৫) ৩৯০ প্রজাতির গাছ শনাক্ত করেছিল বন অধিদপ্তর। গত এক দশকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির বৃক্ষ।
কেন কমছে পার্বত্যাঞ্চলের বন
২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ডারউইন ইউনিভার্সিটি পরিচালিত এক গবেষণায় পার্বত্যাঞ্চল বাংলাদেশের মোট বন আচ্ছাদনের ৪০ শতাংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে দ্রুত প্রসার ঘটছে অর্থকরি ফলের চাষ (হর্টিকালচার) ও একমুখী প্রজাতির বনায়ন (মনোকালচার), যেমন রাবারবাগান।
জানতে চাইলে জাতীয় বন জরিপের সঙ্গে যুক্ত থাকা বন অধিদপ্তরের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (সদ্য অবসরপ্রাপ্ত) জহির ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বৈধ ও অবৈধভাবে বন উজাড় হয়ে আসছে। এখানে একদিকে বন উজাড় হচ্ছে, অন্যদিকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কারণে বনায়ন করা যায় না। যার কারণে এখানে বনভূমি হ্রাস পাওয়ার পরিমাণ বেশি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক কামাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বন বিভাগ কিছু করতে পারে না। পাহাড়িরা কিছু গামার আর সেগুনগাছের বাগান করেন। পুরো পার্বত্য অঞ্চলে সড়ক সম্প্রসারণ হয়েছে গত কয়েক দশকে। যেমন সীমান্ত রোড হয়েছে।
কামাল হোসাইন বলেন, এ ছাড়া এখানে বিনোদনকেন্দ্র ও রিসোর্টের সংখ্যা বাড়ছে। এটা একটা দিক। অন্যদিকে অনেক প্রভাবশালী এখন ড্রাগন, কাজু ও আমের চাষ করছেন প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে। এ অঞ্চলের বনের ওপর বহুমুখী চাপের কারণে এখানে বনাঞ্চল হ্রাস পাওয়ার হার অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশি।
কামাল হোসাইন আক্ষেপ করে বলেন, ‘কেউ বনকে ভালোবাসে না। মানুষের লোভের শিকার হয়েছে এখানকার প্রাকৃতিক বন। এটাই আমাদের সর্বনাশ করেছে।’