আমির খানের হাত ধরে হচ্ছে ১০ জনের অভিষেক
Published: 5th, May 2025 GMT
দীর্ঘ বিরতির পর বড় পর্দায় ফিরছেন বলিউড সুপারস্টার আমির খান। তার পরবর্তী ছবি ‘সিতারে জমিন পার’ ইতিমধ্যেই সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ২০০৭ সালের ব্লকবাস্টার ‘তারে জমিন পার’-এর স্পিরিচুয়াল সিক্যুয়েল হিসেবে তৈরি এই সিনেমার প্রথম পোস্টার অবশেষে প্রকাশ পেল। একই সঙ্গে জানানো হয়েছে ছবিটির মুক্তির তারিখ। এটি মুক্তি পাবে ২০ জুন।
নতুন পোস্টারে আমির খানের সঙ্গে দেখা গেছে ১০ জন নবাগত অভিনেতা। আমির খান প্রোডাকশনস-এর ব্যানারে নির্মিত এই সিনেমার মাধ্যমে বলিউডে অভিষেক হচ্ছে আরুশ দত্ত, গোপী কৃষ্ণ বর্মা, সম্বিত দেশাই, বেদান্ত শর্মা, আয়ুষ ভানসালী, আশীষ পেন্ডসে, ঋষি শাহানি, ঋষভ জৈন, নমন মিশ্র এবং সিমরন মঙ্গেশকর-এর মতো নবাগতদের।
ছবিতে আমির খানের সঙ্গে প্রথমবার জুটিতে দেখা যাবে অভিনেত্রী জেনেলিয়া দেশমুখ-কে। পোস্টার দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এই ছবির মাধ্যমে দর্শকদের জন্য একটি বিশেষ কিছু আনতে চলেছেন আমির।
ছবিটি পরিচালনা করছেন আর এস প্রসন্ন, যিনি এর আগে ‘শুভ মঙ্গল সাবধান’ এবং স্বামী চিন্ময় আনন্দের বায়োপিক ‘অন আ কোয়েস্ট’ পরিচালনা করেছেন।
‘সিতারে জমিন পার’ ছবিতে গান লিখেছেন অমিতাভ ভট্টাচার্য, এবং সুর করেছেন বিখ্যাত সংগীতত্রয় শঙ্কর-এহসান-লয়। চিত্রনাট্য লিখেছেন দিব্যনিধি শর্মা। ছবিটির প্রযোজক হিসেবে রয়েছেন আমির খান, রবি ভাগচন্দকা এবং অপরণা পুরোহিত।
আগামী ২০ জুন হলে গিয়ে সিনেমাটি উপভোগ করতে পারবেন দর্শক। আর পোস্টার প্রকাশের পর থেকে উৎসাহ-উত্তেজনা আরও বেড়ে গেছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
‘এই দেশ আমার কিন্তু আমি এই দেশের নই’
সাইকেল মেকানিক আলীর বয়স ৬৭ বছর। তিনি চার দিন বাংলাদেশে আটক থাকার পর ৩১ মে ভারতের আসামে নিজের বাড়িতে ফেরেন। যে বাংলাদেশে তিনি আটক ছিলেন এই দেশটি সম্পর্কে জন্ম থেকে শুধু ‘একটি গালির মতো’ শব্দ হিসেবেই শুনে এসেছেন।
আলীর এক সপ্তাহের দুঃসহ অভিজ্ঞতা শুরু হয় গত ২৩ মে। সেদিন আসামের মরিগাঁও জেলার কুইয়াদাল গ্রামের ভাড়া বাড়ি থেকে তাকে আটক করে পুলিশ। রাজ্য সরকার সে সময় ‘ঘোষিত বিদেশি নাগরিকদের’ বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছিল।
আসাম চা উৎপাদনকারী রাজ্য হিসেবে জনপ্রিয়। সেখানে প্রতিবেশী অঞ্চল থেকে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বসবাস বহু বছর আগ থেকেই। ফলে আদিবাসী আসামি ভাষাভাষী জনগণের সঙ্গে জাতিগত ও ভাষাগত উত্তেজনা দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। এই উত্তেজনা আরো বেড়ে যায় ২০১৬ সালে। তার দুবছর আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) প্রথমবারের মতো আসামে ক্ষমতায় আসে। প্রায় ৩ কোটি ১০ লাখ জনসংখ্যার এই রাজ্যে এক-তৃতীয়াংশই মুসলিম।
আরো পড়ুন:
প্রাক্তন অভিনেত্রী সানা খানের মা মারা গেছেন
সেঞ্চুরিতে ১৫ বছরের পুরনো রেকর্ড ছুঁলেন ডাকেট, বৃষ্টির চোখ রাঙানি
আলী হচ্ছেন সেই ৩০০ জনের একজন, যাদের মে মাস থেকে বাংলাদেশে ‘পুশব্যাক’ বা সীমান্ত দিয়ে ঠেলে পাঠানো হয়েছিল। এই সংখ্যাটি দিয়েছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। চলতি মাসের শুরুতে রাজ্য বিধানসভায় তিনি বলেন, “এই পুনর্গমন প্রক্রিয়া আরো জোরদার করা হবে। রাজ্যকে রক্ষা করতে হলে আমাদের আরো সক্রিয় এবং আগ্রাসী হতে হবে।”
নীল আকাশের নিচে যেন নরক
সীমান্তে ঠেলে পাঠানোর সেই করুণ অভিজ্ঞতা শোনালেন আলী। ২৩ মে পুলিশ আটক করার পর আলীকে নিয়ে যাওয়া হয় আসামের গোয়ালপাড়া জেলার মাতিয়া বন্দিশিবিরে। এটা ভারতের সবচেয়ে বড় ‘অবৈধ অভিবাসী’ আটক কেন্দ্র। এটা আলীর ভাড়া বাড়ি থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে।
তিন দিন পর ২৭ মে ভোরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) আলীসহ ১৩ জনকে একটি ভ্যানে করে নিয়ে যায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে। এরমধ্যে পাঁচজন নারীও ছিলেন।
আলী বলেন, “বিএসএফ আমাদের জোর করে অন্য দিকে ঠেলে পাঠাতে চাইছিল, কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও স্থানীয়রা জানালেন, তারা আমাদের নেবেন না, কারণ আমরা ভারতীয়।”
এরপর শুরু হয় তাদের বিভীষিকাময় অপেক্ষা। আলীর ভাষায়- ভারত ও বাংলাদেশের মাঝখানে সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ডে খোলা মাঠের মধ্যে হাঁটুপানি আর কাদায় দাঁড়িয়ে তারা টানা ১২ ঘণ্টা পার করেন, না ছিল খাবার, না ছিল আশ্রয়।
এ ঘটনার ভাইরাল ছবিতে দেখা যায়, আলী কাদায় বসে আছেন, ভ্রু কুঁচকানো মুখে পেছনে তাকিয়ে আছেন; চোখে আতঙ্ক আর অসহায়তা। সেই অভিজ্ঞতা আলী এভাবেই বর্ণনা করেন, “নীল আকাশের নিচে আমরা নরক দেখেছি। আমরা আমাদের জীবনকে চোখের সামনে ফিকে হতে দেখেছি।”
ভারতে ফেরার চেষ্টা করলে বিএসএফ সদস্যরা তাদের হুমকি দেন। “আমরা কান্নাকাটি করে বলেছিলাম আমাদের যেন না ঠেলা হয়, তখন তারা রাবার বুলেট ছুঁড়ে মেরেছে,” বলেন আলী।
৫০ বছর বয়সি রহিমা বেগম। তাকেও একইভাবে আসামের গোলাঘাট জেলা থেকে ভ্যানে তোলা হয়েছিল। তিনি এখনো দুঃস্বপ্নের মতো সেই মুহূর্তগুলো ভুলতে পারেন না।
আলজাজিরাকে তিনি বলেন, “আমি যখন দৌড়ে বাংলাদেশের দিকে যেতে চেয়েছিলাম, বিজিবি আমাকে পিটিয়েছে। আর বিএসএফ বলেছে, যদি ওপারে না যাই, তাহলে গুলি করে মারবে।”
‘অবৈধ বাংলাদেশি’ বলে মুসলিমদের ঠেলে পাঠানো হচ্ছে সীমান্তে
বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে এমন ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ ঘোষিত মুসলিমদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং কীভাবে তাদের সীমান্তে ফেলে আসা হচ্ছে, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে আসামজুড়ে।
এ ঘটন নিয়ে স্থানীয় পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ করেন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রৌমারী শহরের সাংবাদিক জিতেন চন্দ্র দাস। তিনি আলজাজিরাকে জানান, তিনি নিজ চোখে দেখেছেন বিএসএফ সদস্যরা কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ও গুলি ছোড়েন এবং ‘ভারতীয় নাগরিকদের’ সীমান্তের এপারে পাঠানোর জন্য বাধ্য করার চেষ্টা করেন।
তিনি বলেন, “বিএসএফ চার রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে আকাশে, যাতে তারা ভয় পেয়ে সীমান্ত পার হয়।”
তবে ২৭ মে বিএসএফ এক বিবৃতিতে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে জানায়, তারা শুধু “বাংলাদেশি নাগরিকদের অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করতে বাধা দিয়েছে।”
স্থানীয় বাংলাদেশি গ্রামবাসী এবং বিজিবির সিনিয়র কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে ওই উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সমাধান হয়। এরপর বিজিবি সদস্যরা আলীকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের এক সীমান্ত পয়েন্টে পৌঁছে দেন, সেখান থেকে তিনি জঙ্গল পেরিয়ে ১০ ঘণ্টার যাত্রায় বাড়ি ফেরেন।
৩১ মে আসামভিত্তিক দ্যা সেন্টিনেল পত্রিকা এক প্রতিবেদনে জানায়, বিএসএফ বিজিবির কাছ থেকে ৬৫ জন সন্দেহভাজন ভারতীয় নাগরিককে গ্রহণ করে।
যেসব মুসলিমকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, তাদের কয়েকজন আলজাজিরাকে জানান, বিজিবি তাদের সীমান্তে রেখে চলে গেলে অন্তত ১০০ জন নিজেরাই দেশে ফিরে আসেন। বেশিরভাগ প্রত্যাবর্তনকারী জানান, সীমান্ত পেরোনোর পর সাদা পোশাক পরা কিছু লোক তাদের গ্রহণ করে এবং পরে একটি ফাঁকা সড়কে নামিয়ে রেখে চলে যায়।
কাশ্মীরের পহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর আসামে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ বিতাড়নের অভিযানটি নতুন করে জোর পায়। হামলাকারীদের পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল বলে দাবি করা হয়। ফলে দেশজুড়ে মুসলিমবিরোধী মনোভাব আরো উস্কে দেয়।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি বিভাগের অধ্যাপক অপূর্বানন্দ আলজাজিরাকে বলেন, “পহেলগামে হামলা বিজেপিকে বাংলাভাষী মুসলিম বা রোহিঙ্গাদের মতো সংবেদনশীল মুসলিম গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ করে দেয়।”
তিনি বলেন, “ভারতে বিজেপি সরকারের অধীনে মুসলিম পরিচয় মানেই সন্ত্রাসবাদের প্রতিচ্ছবি। সরকার বাংলাভাষী মুসলিমদের ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ হিসেবে বিবেচনা করে।”
আসামের বিরোধী দলগুলো এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ, এই ‘বিদেশি শনাক্তকরণ’ অভিযান মূলত মুসলিমদের লক্ষ্য করেই পরিচালিত হচ্ছে।
কংগ্রেস নেতা দেবব্রত শইকীয়া আলজাজিরাকে বলেন, “সরকার শুধু মুসলিমদেরই মাতিয়া বন্দিশিবির থেকে ঠেলে দিচ্ছে।”
তবে বিজেপির মুখপাত্র মনোজ বরুয়া ধর্মীয় পক্ষপাতের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “হিন্দু অনিবন্ধিত অভিবাসীদের বাংলাদেশে পাঠানো হয় না, কারণ তারা সেখানে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হতে পারেন।”
আসামের পরিস্থিতি
ব্রিটিশ আমল থেকেই আসামে জাতিগত ও ধর্মীয় উত্তেজনা বিরাজমান। ১৯শ শতকে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা আসামের পার্বত্য এলাকাগুলোতে চা-বাগান গড়ে তোলে। ফলে ওই সময়ে বাংলা ভাষাভাষী হিন্দু ও মুসলিম উভয় শ্রমিকদের অভিবাসন ঘটে। তাদের অনেকেই এসেছিলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারত ছাড়ার পর উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে গঠিত হয় ভারত ও পাকিস্তান। পরে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। এখন বাংলাদেশের সঙ্গে আসাম রাজ্যের প্রায় ২৬০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে।
আসাম কর্তৃপক্ষ নাগরিকত্ব যাচাইয়ের জন্য একটি শেষ তারিখ নির্ধারণ করেছে, সেটি হলো ২৪ মার্চ ১৯৭১ সাল; অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার আগের দিন। বাংলা ভাষাভাষী হাজার হাজার বাসিন্দাকে প্রমাণ করতে বলা হয়েছে, তারা ওই তারিখের আগেই আসামে প্রবেশ করেছিলেন। এটি প্রমাণ করতে পারলেই কেবল ভারতীয় নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি মিলবে।
এই নাগরিকত্ব নির্ধারণের কাজগুলো পরিচালনা করে আসামের বিশেষ ‘বিদেশি ট্রাইব্যুনালগুলো’, যেগুলো আধা-আদালত হিসেবে কাজ করে। এসব ট্রাইব্যুনাল অনেক সময় সরকারি কাগজপত্রে ছোটখাটো বানান ভুল বা তথ্যগত অসামঞ্জস্যতার ভিত্তিতে কাউকে ‘বিদেশি’ ঘোষণা করে।
২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, এসব ট্রাইব্যুনাল ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ এবং ‘ইচ্ছামতো কাজ করে’।
সেই বছরই প্রকাশিত হয় আসামের চূড়ান্ত জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি)। এটা তৈরি হচ্ছিল বহু বছর ধরে, তথাকথিত ‘অবৈধ’ বাসিন্দাদের শনাক্ত করার উদ্দেশ্যে। এনআরসি করে প্রায় ২০ লাখ বাসিন্দাকে নাগরিকের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়, যাদের মধ্যে আনুমানিক ৭ লাখ মুসলিম। এনআরসি তালিকা প্রকাশের পর এই মুসলিমদের অনেককেই বন্দিশিবিরে পাঠানো হয়।
আলীর নাম নাগরিকের তালিকায় থাকলেও ২০১৩ সালে মরিগাঁও জেলার একটি ট্রাইব্যুনাল তাকে বিদেশি ঘোষণা করে। কারণ হিসেবে বলা হয়, তার বাবার নাম ‘সামত আলী’, কোনো নথিতে ‘চামত আলী’ এবং কোনোটিতে বা ‘চাহমত আলী’ লেখা।
এই রায়ের পর আলী নাগরিকত্ব হারিয়ে ফেলেন এবং টানা দুই বছর কাটান একটি বন্দিশিবিরে। ২০১৪ সালে আসাম হাইকোর্ট ওই রায় বহাল রাখেন। আলী জানান, তিনি এতটাই দরিদ্র যে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার সামর্থ্যও নেই তার।
‘আমাকে বাংলাদেশি বানিয়ে দিল’
বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে দেওয়া অনেক মুসলিমের নাগরিকত্বসংক্রান্ত মামলা এখনো আদালতে বিচারাধীন।
মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মাও স্বীকার করেছেন, তার সরকার কূটনৈতিক উপায়ে ‘কয়েকজনকে বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে এনেছে, যাদের মামলা আদালতে চলমান ছিল।’
তাদেরই একজন শোনা বানু। বারপেটা জেলার বুড়িখামার গ্রামের এই বাসিন্দাকে ২৭ মে বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে দেওয়া হয়।
৫৯ বছর বয়সি শোনা বানু আলজাজিরাকে বলেন, “কখনো ভাবিনি, যে দেশে আমি জন্মেছি, আমার বাবা-মা আর দাদা-দাদিরাও জন্মেছেন, সেই দেশই আমাকে বাংলাদেশ সীমান্তে পাঠাবে। তারা আমাকে বাংলাদেশি বানিয়ে দিল। অথচ আমি বাংলাদেশকে চোখে দেখেছি একবারই; যখন সেটা নো ম্যানস ল্যান্ড থেকে মাত্র ১০ মিটার দূরে ছিল।”
মরিগাঁও জেলার মিকিরভেটা গ্রামের এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক খায়রুল ইসলাম বলেন, “আমাকে জোর করে বাংলাদেশে পাঠানো যেন মৃত্যুদণ্ডের মতো ছিল।”
২০১৬ সালে তাকে ‘বিদেশি’ ঘোষণা করা হয়। যদিও তার পরিবার ব্রিটিশ আমলের জমির দলিলসহ নানা প্রমাণ দাখিল করেছিল, যা ছিল তার দাদার নামে নিবন্ধিত। তিনি ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছেন।
ইসলাম বলেন, “নো ম্যানস ল্যান্ডে কাটানো সময় আমার মনে গভীর দাগ কেটে গেছে। শরণার্থীদের চেয়েও আমাদের অবস্থা খারাপ ছিল। আমাদের কষ্ট ও যন্ত্রণা ছিল সবার চোখের সামনে। আমরা ভারতের কাছেও বিদেশি, বাংলাদেশের কাছেও।”
কিন্তু ৫০ বছর বয়সি নিজাম আহমেদের ক্ষেত্রে বিষয়টা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি ছিলেন গোলাঘাট জেলার জামুগুরি চা-বাগান এলাকার একজন ট্রাকচালক এবং সরকারি নথি অনুযায়ী তিনি ভারতীয় নাগরিক। তার নাম এনআরসি অর্থাৎ নাগরিকপঞ্জিতেও রয়েছে। তবু তাকেও নো ম্যানস ল্যান্ডে ফেলে আসা হয়।
নিজামের ছেলে জাহিদ জানান, একটি ভাইরাল ভিডিওতে বিজিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাবাকে দেখার পরই তাকে আটক করা হয়।
জাহিদ বলেন, “আমরা ভারতীয়। আমার দাদা আসামের সেকেন্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নে ছিলেন।”
আলজাজিরা এই দাবির সত্যতা নিশ্চিত করেছে। নিজামের বাবা সেলিম উদ্দিন আহমেদ ১৯৬০ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত রাজ্য পুলিশের সদস্য ছিলেন।
জাহিদ বলেন, “আমার দাদা যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে এই অপমান তাকেই সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিত। একজন পুলিশ সদস্যের ছেলেকেই বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে দেওয়া হলো।”
‘ফিরে এসো না, নয়তো গুলি করব’
শুধু আসামে নয়, বিজেপিশাসিত অন্যান্য রাজ্যেও ‘অবৈধ বাংলাদেশিদের’ তাড়ানোর অভিযান চলছে।
মোদির নিজ রাজ্য গুজরাটের প্রধান শহর আহমেদাবাদের পুলিশ জানিয়েছে, তারা অন্তত ২৫০ জন ‘বাংলাদেশি অভিবাসীকে চিহ্নিত করেছে, যারা এখানে অবৈধভাবে বসবাস করছেন।’
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের বরাতে পুলিশ কর্মকর্তা অজিত রাজিয়ান বলেন, “তাদের দেশ থেকে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।”
এমনকি মহারাষ্ট্রের পুলিশ সাতজন মুসলিমকে ‘বিদেশি’ সন্দেহে আটক করে এবং তাদের বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য বিএসএফর কাছে হস্তান্তর করে। তবে পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসনের হস্তক্ষেপের পর ১৫ জুন তাদের আবার সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে আনা হয়।
বিষয়টি জানান তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য সামিরুল ইসলাম। তিনি পশ্চিমবঙ্গ অভিবাসী কল্যাণ বোর্ডের চেয়ারম্যান।
সামিরুল ইসলাম আলজাজিরাকে বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ এবং অন্যান্য রাজ্য কর্তৃপক্ষ মহারাষ্ট্র পুলিশকে জানিয়েছিল যে এসব ব্যক্তি পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয় নাগরিক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার বা পুলিশকে কিছু না জানিয়ে তাদের বিএসএফর হাতে তুলে দেওয়া হয়।”
মহারাষ্ট্র পুলিশের এই কার্যক্রম প্রসঙ্গে ১৬ জুন কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “শুধু তারা বাংলা ভাষায় কথা বলেন বলে তাদের বাংলাদেশি বলে ধরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
আলজাজিরার সঙ্গে কথা বলা ওই সাত মুসলিমের মধ্যে তিনজন জানান, যখন তারা মহারাষ্ট্র পুলিশের হেফাজতে ছিলেন, তখন তাদের পরিবার এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসন ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণস্বরূপ কাগজপত্র জমা দিয়েছিল।
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বাসিন্দা মিরানুল শেখ এবং নিজামউদ্দিন শেখকে সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ড থেকে ছড়িয়ে পড়া আরেকটি ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়।
৩২ বছর বয়সি মিরানুল শেখ আলজাজিরাকে বলেন, “আমরা বারবার বলেছিলাম আমরা মুর্শিদাবাদ থেকে এসেছি, তবু বিএসএফ আমাদের পেটাতে থাকে। তারা আমাদের গালাগালি করে বলেছিল, ‘ফিরে এসো না, নয়তো গুলি করব।”
আলজাজিরা ১৯ জুন বিএসএফকে এই অভিযোগ নিয়ে ইমেইল পাঠায়, তবে এখন পর্যন্ত তারা কোনো জবাব দেয়নি।
আসামের ‘মিয়া’ মুসলিম
আসামে চলমান ধরপাকড় অভিযানের অংশ হিসেবে পুলিশ ২৫ মে গোলাঘাট জেলার নোয়াজান গ্রাম থেকে বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম আবদুল হানিফকে তার বাড়ি থেকে আটক করে। আটকের কোনো কারণ জানায়নি পুলিশ।
হানিফের বড় ভাই দীন ইসলাম আলজাজিরাকে বলেন, “পুলিশ বলেছিল, দুই দিনের মধ্যেই তাকে ছেড়ে দেবে।”
পূর্ব আসামে বাংলা ভাষাভাষী মুসলিমদের জন্য পুলিশের রাতের অভিযান এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু পুলিশের ভাষায় ‘রুটিন যাচাই’ হিসেবে শুরু হওয়া সেই অভিযানই হানিফকে নিয়ে তার পরিবারকে উদ্বিগ্ন হতে হয়।
দীন বলেন, “আমরা এক থানা থেকে আরেক থানায় গিয়েছি, তার খোঁজ নিতে। কিন্তু পুলিশ আমাদের কিছুই জানায়নি।”
তিনি আরো বলেন, “হানিফকে শেষবার দেখা গিয়েছিল গোলাঘাটের পুলিশ সুপার রাজেন সিংহের অফিসে, এমন একদল লোকের সঙ্গে, যাদের পরে বাংলাদেশ সীমান্তে পাঠানো হয়।”
হানিফের পরিবার জোর দিয়ে বলছে, তিনি কোনোভাবেই বিদেশি নন।
হানিফের ভাই বলেন, “তার বিরুদ্ধে কোনো ট্রাইব্যুনালে মামলাও নেই। তাকে শুধু সন্দেহের বশে তুলে নেওয়া হয়েছে, কারণ আমরা ‘মিয়া’।”
আসামের অসমীয়া জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষাভাষী মুসলিমদের ‘বাংলাদেশি’ ইঙ্গিতে ‘মিয়া’ ব্যবহার করে থাকে।
আলজাজিরা হানিফের বিষয়ে পুলিশ সুপার রাজেন সিংহকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা যায় না।”
হানিফকে রাজেন সিংহের অফিসে দেখেছেন বলে দাবি করা এক স্থানীয় ব্যক্তি আলজাজিরাকে বলেন, “তাদের দলকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল এবং হানিফকে সম্ভবত বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, “মানুষ রাতারাতি নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। সরকারের প্রতিশোধের আশঙ্কায় সবাই। হানিফও হয়তো বাংলাদেশের কোথাও হারিয়ে গেছেন, অনেকের মতো।”
আলজাজিরা স্বাধীনভাবে নিশ্চিত করেছে, গত মাসে যাদের নো ম্যানস ল্যান্ডে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, তাদের অন্তত ১০ জনের অবস্থান এখনো অজানা।
আসামে অন্তত চারটি পরিবার তাদের নিখোঁজ স্বজনদের সন্ধানে আসাম হাইকোর্টে আবেদন করেছে। এই পরিবারগুলোর মধ্যে কমপক্ষে দুটি ‘দেশি সম্প্রদায়ভুক্ত, যাদের আসাম সরকার আদিবাসী মুসলিম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।’
নিখোঁজ সামসুল আলীর ছেলে বক্কার আলী বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম আমরা আদিবাসী মুসলিম, তাই নিরাপদ। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এখানে কোনো মুসলিমই নিরাপদ নয়।”
বক্কার জানান, তার বাবা বর্তমানে বাংলাদেশের পুলিশের হেফাজতে আছেন। বাংলাদেশে ময়মনসিংহ জেলার এক জেল সুপার আমিরুল ইসলাম ১৬ জুন আলজাজিরাকে জানান, আরেকজন বিদেশি নারী দয়জান বিবিও তাদের হেফাজতে আছেন।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনের মুখপাত্র ফয়সাল মাহমুদ আলজাজিরাকে বলেন, “বাংলাদেশ সরকার ভারতের কাছে কূটনৈতিক চ্যানেলে নোট পাঠিয়েছে। সেখানে জানানো হয়েছে, কোনো প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই বিএসএফ লোকজনকে বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে দিচ্ছে।
আলজাজিরা ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করেছে, তবে এখনো তাদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি।
‘টার্গেট করে মুসলিমদের তাড়ানো হচ্ছে’
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর ও কিংস কলেজ লন্ডনের যৌথ পিএইচডি গবেষক এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের বিশ্লেষক অঙ্কুশমান চৌধুরী বলেছেন, আসাম সরকার যাদের ‘অবৈধ অভিবাসী’ বলে সীমান্তে ঠেলে দিচ্ছে, তারা আসলে একটি জবরদস্তি বহিষ্কার প্রক্রিয়ার অংশ।
তিনি আলজাজিরাকে বলেন, “পুশব্যাক বলতে বোঝায়, যেসব অভিবাসী সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশ করতে চাইছেন, তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু এখানে সরকার যা করছে, তা হলো, মানুষদের ধরে এনে জোর করে অন্য দেশে ঠেলে দেওয়া।”
জোরপূর্বক নাগরিকদের অন্য দেশে ঠেকে দেওয়ার প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘পুশইন’।
মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সরকারের এই পদক্ষেপকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ১৯৫০ সালের একটি আইন উদ্ধৃত করেছেন, যা জেলাশাসকদের নির্দিষ্ট কিছু অনিবন্ধিত অভিবাসীকে বহিষ্কারের ক্ষমতা দেয়।
কিন্তু আসামের হাইকোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী ওলিউল্লাহ লস্কর বলেন, “ওই আইন কেবল তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, যারা অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেছেন বা ভিসা শেষ হওয়ার পরও অবস্থান করছেন।”
তিনি বলেন, “এই আইন তাদের জন্য নয়, যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আসামে বসবাস করছেন এবং যাদের হাতে রাজ্য সরকারের দেওয়া নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র রয়েছে।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন স্থানীয় আইনজীবী জানান, এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টে ‘ঘোষিত বিদেশিদের’ আটক নিয়ে শুনানির সময় আসাম সরকার নিজেই জানিয়েছে, যাদের বাংলাদেশের ঠিকানা জানা নেই, তাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়।
সরকার এক হলফনামায় বলেছে , “বিনীতভাবে অনুরোধ করা হচ্ছে যে, সংশ্লিষ্ট দেশের পক্ষ থেকে জাতীয়তা যাচাই ও ভ্রমণের অনুমতি না থাকার প্রমাণ ছাড়া এই বন্দিদের বহিষ্কার করা সম্ভব নয়।”
গত বছর আসাম সরকার পুলিশকে নির্দেশ দেয়, তারা যেন ধর্মীয় সংখ্যালঘু নয়, এমন লোকজনের (মূলত হিন্দুদের), যারা ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে রাজ্যে প্রবেশ করেছে, তাদের ব্যাপারে ট্রাইব্যুনালে কোনো রিপোর্ট না দেয়।
২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন অনুযায়ী, মুসলিমপ্রধান প্রতিবেশী দেশগুলোতে ‘ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার’ এমন অমুসলিমরা যদি ওই তারিখের আগে ভারতে এসে থাকে, তাহলে তারা দ্রুত নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য হবেন। এই বিতর্কিত আইন ভারতে ব্যাপক প্রাণঘাতী আন্দোলনের জন্ম দেয় এবং জাতিসংঘ এটিকে মূলত ‘বৈষম্যমূলক’ বলে আখ্যায়িত করে।
একজন ক্ষুব্ধ আলী বলেন, “আমাদের ভারতীয় প্রমাণ করতে ২০-৩০টা কাগজ দেখাতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশি হিন্দুদের শুধু বলতে হয় তারা হিন্দু; ব্যস, নাগরিকত্ব হয়ে যায়।”
গোলাঘাটে তার বাড়ির সামনে বসে থাকা ৫০ বছর বয়সি বেগম জানান, যে দেশটিকে তিনি নিজের মনে করেন, যেখানে তিনি জন্মেছেন, সেই দেশই তাকে হতাশ করেছে।
তার কণ্ঠে হাহাকার, “এই দেশ আমার, কিন্তু আমি এই দেশের নই।”
[নোট: আরশাদ আহমেদ ও মহিবুল হকের প্রতিবেদনেটি আলজাজিরা প্রকাশ করেছে ২৪ জুন। অনুবাদ করেছেন তানজিনা ইভা।]
ঢাকা/রাসেল