জুলাই আন্দোলনে শহীদ জাকির হোসেনের স্ত্রী সালমা বেগম জীবনের তাগিদে গৃহপরিচারিকার কাজ করছেন। সামান্য আয়ে কোনোমতে চলছে মা-মেয়ের সংসার। জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার জন্য সালমা বেগমের স্থায়ী কর্মসংস্থানের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

জাকির হোসেনের বাড়ি পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামে। বাবা মৃত মান্নান খান। তিনি ঢাকায় পোশাক তৈরির প্রতিষ্ঠানে সেলাই মেশিন অপারেটরের কাজ করতেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই রায়েরবাগে বোনের বাসায় দুপুরের খাবার শেষে কর্মস্থল কামরাঙ্গীর চরে ফেরার পথে শনির আখরায় গুলিবিদ্ধ হন। ৫ দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর ২৪ জুলাই মারা যান। পরে তার মরদেহ গ্রামের বাড়ি বড় গোপালদীতে দাফন করা হয়। 

এ ঘটনায় পরিবারের একমাত্র উপর্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে  দিশেহারা হয়ে পড়েন জাকিরের স্ত্রী সালমা ও তার অষ্টম শ্রেণীপড়ুয়া কন্যা জিদনী। 

জাকিরের মৃত্যুর পর জুলাই ফাউন্ডেশন এবং জামায়াত ও বিএনপি থেকে তাদের  অর্থ সহায়তা করা হয়েছে। কিন্তু ধার দেনা মেটাতেই সিংহভাগ খরচ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে পরিবার।  

এরপর থেকেই সংসারের খরচ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন সালমা বেগম। বিশেষ করে একমাত্র মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি শঙ্কিত। অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে বাধ্য হয়ে তিনি গৃহপরিচারিকার কাজ বেছে নিয়েছেন। স্থানীয় একটি মহিলা মাদ্রাসায় ২ হাজার টাকা বেতনে কাজ করছেন তিনি। 

সালমা বেগম বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘‘স্বামী মারা যাওয়ার পর আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। কিছু টাকা পেয়েছিলাম। ধার দেনা শোধ করার পর অনেকটাই খরচ হয়ে গেছে। মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে মাদ্রাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ নিয়েছি। তিন বেলা রান্না করে দেওয়ার বিনিময়ে যা পাই এ দিয়ে সংসার চলে না। সরকার যদি আমাকে একটি স্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা করে দিতো তাহলে মেয়েকে নিয়ে অন্তত খেয়েপরে বেঁচে থাকতে পারতাম।’’

পৈত্রিক ভিটা ছাড়া অর্থসম্পদ রেখে যাননি জাকির হোসেন। তার আরো দুই ভাই রয়েছে। ফলে বসতঘর ভাগ হলে যে জায়গাটুকু থাকবে তাতে শুধু মাথাগোজার ঠাঁই হবে বলে জানান সালমা বেগম। 

‘‘আমি আমার বাবার হত্যাকারীদের বিচার চাই,’’ উল্লেখ করে জিদনী (১৪) বলেন, ‘‘আমি দমশিনা সরকারী মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। মা ২ হাজার টাকা বেতনে কাজ করে সংসার আর আমার পড়াশোরার খরচ চালাচ্ছে। আরেকটু বড় হলে কীভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যাবো জানি না। অথচ আজ বাবা বেঁচে থাকলে আমাকে এ নিয়ে ভাবতে হতো না।’’

বড় গোপালদী গ্রামের ষাটোর্ধ্ব হাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘জাকির ভালো ছেলে ছিল। পৈত্রিক ভিটা ছাড়া সে কিছুই রেখে যেতে পারেনি। এখন পরিবারটি একেবারে অসহায়। পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে সরকারের উচিত তার স্ত্রীকে একটি স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়া।’’

একই এলাকার ইসরাত হোসেন বলেন, ‘‘মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে হলেও জাকিরের স্ত্রীকে একটি স্থায়ী কাজ দেয়ার অনুরোধ করছি।’’ 

দশমিনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরতিজা হাসান বলেন, ‘‘জাকিরের স্ত্রীর স্থায়ী কর্মসংস্থানের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। এ ছাড়া সরকারী যে কোনো অনুদান আসলে শহীদ পরিবার হিসেবে তারাই অগ্রাধিকার পাবেন।’’ 

ইমরান//

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর গ হপর চ র ক র ক জ পর ব র ক জ কর সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ঢাকার গৃহকর্মীরা আইনি অধিকার আর কবে পাবেন

ঢাকা শহরে গৃহকর্মীর সংখ্যা বিস্তর। নগরজীবনের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই শ্রমবাজারও দ্রুত বেড়েছে। তবে এই বাজার সবার জন্য এক রকম নয়। বাড়ির মালিক কোথায় থাকেন আর কতটা আর্থিক সামর্থ্য আছে, তার ওপরই নির্ভর করে কোন ধরনের গৃহকর্মী পাওয়া যাবে।

ঢাকার গৃহকর্মীর বাজারকে মোটামুটি তিন ভাগে ফেলা যায়—গুলশান-বনানী-বারিধারার মতো অভিজাত এলাকা, উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের আবাসিক এলাকা, আর নিম্নমধ্যবিত্তদের মহল্লা। অবশ্য বাস্তবে এ বিভাজন একেবারে খাঁটি নয়, ব্যতিক্রম থাকেই।

এটাও মনে রাখতে হবে, ঢাকার গৃহকর্মীদের বিশাল অংশই নারী। ফলে এই পেশার ভেতর একধরনের নারী-পটভূমি এবং নারীর অভিজ্ঞতা জড়িয়ে আছে।

শহরে গৃহকর্মীরা মূলত তিন ধরনের কাজ করে থাকেন। প্রথমেই আছে সার্বক্ষণিক গৃহকর্মী। তাঁরা মালিকের বাড়িতেই থেকে সারা দিন-সারা রাত কাজ করেন। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা মালিকই করে দেন।

দ্বিতীয় ধরনের কর্মীরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মালিকের বাড়িতে কাজ করে রাতে নিজের বাসায় ফেরেন। তাঁরা সাধারণত পরিবার নিয়ে শহরে বাস করেন।

আর তৃতীয় ধরন হলো, ঠিকে গৃহকর্মী। তাঁরা এক বাড়িতে নির্দিষ্ট সময় ধরে কিছু কাজ করে চলে যান অন্য বাড়িতে। এভাবে দিনে পাঁচ-ছয়টি বাড়িতে কাজ করেন। ঘর ঝাড়পোছ, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, পানি তোলা—এ ধরনের বড় কাজই তাঁরা সামলান। তবে বাঁধা কাজের বাইরে কিছু করার দায় তাঁদের নেই। আর এ ব্যবস্থায় সাধারণত খাওয়াদাওয়ার কোনো সুবিধা থাকে না।

অভিজাত এলাকার শ্রমবাজার

গুলশান, বনানী বা বারিধারার মতো জায়গায় একজন গৃহকর্মী মাসে গড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পান। খাওয়ার ব্যবস্থা নিয়োগকারীরই থাকে। পাশাপাশি কিছু পোশাক-আশাক, হালকা অসুখে ওষুধ, আর যদি সার্বক্ষণিক হন, তবে থাকার জায়গাও দেওয়া হয়। সাধারণত তাঁদের কাজের সময় ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা। সপ্তাহে একদিন ছুটি থাকে, বছরে আরও এক-দুই সপ্তাহ ছুটি মেলে। তবে বড় কোনো অসুখ হলে চিকিৎসার খরচ গৃহকর্মীকেই বহন করতে হয়। কোথাও কোথাও তাঁদের বিনোদনের জন্য আলাদা টেলিভিশনও দেওয়া থাকে।

মধ্যবিত্ত এলাকার শ্রমবাজার

এখানে গৃহকর্মীদের বেতন গড়ে পাঁচ-সাত হাজার টাকা। কাজের শর্তগুলো লিখিতভাবে ঠিক করা হয় না, বরং মৌখিক বোঝাপড়াতেই চলে। সাধারণত দিনে দুবেলা খাবার, বছরে একবার ঈদে নতুন পোশাক, আর একবার গ্রামে যাওয়ার ছুটি থাকে। হালকা অসুখে ওষুধপত্রের ব্যবস্থাও মালিক করে দেন। তবে থাকার জায়গার মান খুব খারাপ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রান্নাঘরের পাশে বা বারান্দায় মাদুর পেতে ঘুমাতে হয়। প্রথম শ্রেণির বাজারের মতো আলাদা ঘর এখানে মেলে না।

নিম্নবিত্ত এলাকার শ্রমবাজার

অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছেন নিম্নবিত্ত পরিবারের গৃহকর্মীরা। তাঁদের অধিকাংশই কিশোর-কিশোরী। মাসিক বেতন সাধারণত দুই-তিন হাজার টাকার বেশি হয় না। ঠিকে কাজ করলে মাসে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা পাওয়া যায়। খাবারের ব্যবস্থা থাকে, শোবারও একটা সাধারণ জায়গা দেওয়া হয়। পোশাকের জন্য মালিকের পরিবারের ছেলে-মেয়েদের পুরোনো জামাকাপড়ই ভাগ্যে জোটে। তবে কিছু পরিবারে দেখা গেছে, তাঁদের জন্য পড়াশোনার সুযোগ করে দেয়।

অর্থনৈতিক দিক থেকে গৃহকর্মীদের জীবন সব সময় একধরনের চাপের মধ্যে থাকে। ঢাকায় কাজ করা অনেক গৃহকর্মীরই পরিবার থাকে শহরেই। তাঁদেরও ছোট ছোট শিশু আছে, কারও সন্তান আবার স্কুলে যায়। গৃহকর্মী যখন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত অন্যের বাড়ির সন্তানদের দেখাশোনা করেন, তখন তাঁর নিজের সন্তানকে দেখবে কে? অনেক ক্ষেত্রেই এ জন্য আলাদা লোক রাখতে হয়, আর সেই খরচ চলে যায় গৃহকর্মীর উপার্জিত সামান্য বেতনের ভেতর থেকেই।

এসব গৃহকর্মীর অর্থনৈতিক অবস্থার যে রূপরেখা আমরা দেখি, তাতে যেমন কিছু ইতিবাচক দিক আছে, তেমনি আছে তীব্র নেতিবাচক বাস্তবতাও। অনেক পরিবার আছে, যারা গৃহকর্মীদের প্রতি আন্তরিক, যত্ন নেয়, সুযোগ-সুবিধা দেয়। সেখানে পুরোনো দিনের সামন্ততান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায় না। কিন্তু তার বিপরীতে বহু পরিবারে এখনো অন্য রকম চিত্র চোখে পড়ে। অনেক সময় মাসান্তে গৃহকর্মীর বেতন দেওয়া হয় না, কখনো আবার এক মাসের বেতন আটকে রাখা হয়, যাতে সে হঠাৎ কাজ ছেড়ে যেতে না পারে।

আরও পড়ুনগৃহকর্মী নির্যাতন: বিজয়ের মাসে পরাজিত তানিয়ারা২৯ ডিসেম্বর ২০২২

সামাজিক দিক থেকেও গৃহকর্মীদের প্রতি অবজ্ঞা কম নয়। অনেকে এখনো তাঁদের নিম্নশ্রেণির মানুষ হিসেবে ভাবেন। অথচ তাঁরা-ও মানুষ, তাঁদেরও অনুভূতি আছে, আর পেটের দায়েই তাঁরা অন্যের দ্বারে কাজ করতে আসেন। কিন্তু সেই মানবিক দিক আমরা সহজেই ভুলে যাই।

খাবারের ক্ষেত্রেও বৈষম্য চোখে পড়ে। অনেক সময় তাঁদের জন্য রাখা হয় গৃহস্থের খাবারের উচ্ছিষ্ট, যেখানে মাছ-মাংস থাকেই না। আলাদা চাল আলাদা রান্নার ব্যবস্থাও প্রায়ই দেখা যায়। বাড়িতে ফলমূল এলে গৃহকর্মীরাই তা কেটে পরিবেশন করেন, অথচ তাঁদের জন্য একটি টুকরাও বরাদ্দ থাকে না। বরং দেখা যায়, ফল বা দই-মিষ্টি নষ্ট হতে শুরু করলে তবেই তাঁদের পাতে দেওয়া হয়। এ যেন আমাদের দয়ার চূড়ান্ত প্রকাশ।

এখনো অনেক পরিবারে গৃহকর্মীদের সঙ্গে আচরণে সামন্ততান্ত্রিক ধারা স্পষ্ট। দেখা যায়, ৫০ বছর বয়সের একজন গৃহকর্মীকে ১৫ বছরের গৃহস্থ–কন্যা ‘তুমি’ বলে ডাকে, অথচ গৃহকর্মীকে তাঁকে ‘আপনি’ বলেই সম্বোধন করতে হয়। কাজ শেষ হয়ে গেলেও বসে থাকার সুযোগ নেই, তখনই নতুন কোনো কাজ খুঁজে বের করে দেওয়া হয়।

গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনাও কম নয়। এই নির্যাতন কখনো শারীরিক, কখনো মানসিক। শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে থাকে মারধর, না খাইয়ে রাখা, এমনকি গুরুতর আঘাত দেওয়া পর্যন্ত। এর শিকার হয় মূলত কিশোর-কিশোরী গৃহকর্মীরা, যাঁদের অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে মালিকেরা হাত বাড়ান। মানসিক নির্যাতনও তেমনি বহুমুখী—বাড়ি যেতে না দেওয়া, বারবার চুরির সন্দেহ করা, বেতন আটকে রাখা, সামান্য ভুলের জন্য জরিমানা করা বা বেতন কেটে নেওয়া—সবই তাঁদের প্রতিদিনের বাস্তবতা।

বাংলাদেশে গৃহকর্ম খাতকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত হিসেবে দেখা হয়। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীরা যেসব অধিকার ও সুবিধা ভোগ করেন, গৃহকর্মীরা সেসব থেকে বঞ্চিত হন। এতে পুরো খাতটি ভঙ্গুর ও অরক্ষিত অবস্থায় রয়ে গেছে। কোনো সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামো না থাকায় বিশেষত শিশু ও নারী গৃহকর্মীরা নানা ধরনের বঞ্চনা, নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।

উৎসব-আনন্দের সময় নতুন কাপড় দেওয়ার বদলে গৃহকর্মীদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় গৃহস্থ পরিবারের ছোটদের পুরোনো জামাকাপড়। এতে যে তাঁদের ভেতরে কষ্ট জমে, সেটা কেউ ভাবে না।

সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো যৌন নিপীড়ন। এটি কখনো হয়রানি, কখনো আবার ধর্ষণ পর্যন্ত গড়ায়। অনেক সময় গৃহকর্তারাই এ ধরনের অপরাধে জড়িত থাকেন। গৃহকর্মীরা ভয় বা বাধ্যতার কারণে কারও কাছে মুখ খুলতে পারেন না। গৃহকর্ত্রীকে বললেও উল্টো দোষারোপ করা হয় তাঁদেরই। ফলে এই নির্যাতনের বেশির ভাগ ঘটনাই চাপা থেকে যায়। সংবাদমাধ্যমের তথ্য বলছে, ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশে অন্তত তিন শ গৃহকর্মী নির্যাতন ও সহিংসতার কারণে প্রাণ হারিয়েছেন।

আরও পড়ুনগৃহকর্মী শিশু মৌসুমীর মৃত্যু এবং মৃণাল সেনের ‘খারিজ’০৬ জুন ২০২২

বাংলাদেশে গৃহকর্মীদের নিরাপত্তা ও স্বার্থরক্ষার জন্য ২০১৫ সালে ‘গৃহকর্মীদের সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি’ প্রণয়ন করা হয়। এই নীতিতে তাঁদের কাজের পরিবেশ, কল্যাণ, নিয়োগকর্তা-গৃহকর্মীর সম্পর্ক, ন্যায্য মজুরি, সুযোগ-সুবিধা, অবসর, এমনকি শিশুশ্রম থেকে সুরক্ষার বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু বড় দুর্ভাগ্য হলো, এই নীতি বাধ্যতামূলক নয়। তাই কার্যত গৃহকর্মীরা দেশের শ্রম আইন থেকে বাইরে থেকে যাচ্ছেন এবং আইনি সুরক্ষা পাচ্ছেন না।

বাংলাদেশে গৃহকর্ম খাতকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত হিসেবে দেখা হয়। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীরা যেসব অধিকার ও সুবিধা ভোগ করেন, গৃহকর্মীরা সেসব থেকে বঞ্চিত হন। এতে পুরো খাতটি ভঙ্গুর ও অরক্ষিত অবস্থায় রয়ে গেছে। কোনো সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামো না থাকায় বিশেষত শিশু ও নারী গৃহকর্মীরা নানা ধরনের বঞ্চনা, নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।

এই বাস্তবতায় ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জাতীয় নারী গৃহকর্মী ইউনিয়ন’। এটিই ছিল প্রথম উদ্যোগ, যেখানে গৃহকর্মীরা শ্রমিক সংগঠনের ছাতার নিচে একত্র হন। বর্তমানে সংগঠনটি ঢাকা শহরের ২৪টি এলাকায় সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। তাদের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে গোষ্ঠী সভা আয়োজন, গৃহকর্মীদের জন্য নৈশবিদ্যালয়ের ব্যবস্থা ও বিভিন্ন ধরনের সহায়তা।

আরও পড়ুনগৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতি কি ফাইলেই থাকবে?১৬ মার্চ ২০২১

পাঁচ বছর পর আরেকটি উদ্যোগ হিসেবে গড়ে ওঠে ‘গৃহকর্মী অধিকার নেটওয়ার্ক’। এখন এর সঙ্গে যুক্ত আছে ২৬টি সংগঠন, যার মধ্যে ১৪টি মানবাধিকার সংগঠন ও ১২টি শ্রমিক ইউনিয়ন। ঢাকা ও টঙ্গী এলাকার প্রায় পাঁচ হাজার গৃহকর্মী এর সদস্য। এই কার্যক্রমে অর্থায়ন করেছে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)।

চমকপ্রদ সব উদ্যোগ থাকলেও আইনগত সুরক্ষা না থাকায় গৃহকর্মীরা এখনো এক অনিশ্চিত বাস্তবতার মধ্যেই বেঁচে আছেন।

বাংলাদেশে গৃহকর্মীদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে যা করা দরকার, তা আইন, অর্থনীতি ও সামাজিক সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত। সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো ২০১৫ সালে প্রণীত ‘গৃহকর্মীদের সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি’কে আইনে রূপ দেওয়া। এতে গৃহকর্মীদের জন্য একটি শক্তিশালী আইনগত ভিত্তি তৈরি হবে। এভাবে সরাসরি সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত হবে, যদিও আইন থাকলেই সব সমস্যা সমাধান হবে না। কিন্তু আইন না থাকলে কোনো নিয়মই বাধ্যতামূলক হবে না এবং ভঙ্গ হলে তার সঠিক প্রতিকারও পাওয়া যাবে না।

আরও পড়ুনতবু সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠাব?১১ জুন ২০১৭

তবে ২০১৫ সালের পর সমাজে অনেক কিছু বদলেছে। তাই আইনীকরণের আগে নীতিটি বর্তমান সময় ও বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে আপডেট করা প্রয়োজন। পাশাপাশি গৃহকর্মীদের সংগঠনগুলোকে আরও শক্তিশালী করা জরুরি। ‘জাতীয় নারী গৃহকর্মী ইউনিয়ন’ ও ‘গৃহকর্মী অধিকার নেটওয়ার্ক’কে বিস্তৃত, কার্যকর ও গতিশীল করতে হবে। এভাবে তারা সব গৃহকর্মীর পক্ষে শক্তিশালী আন্দোলন চালাতে পারবে।

অর্থনৈতিক দিক থেকেও তিনটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম, গৃহকর্মীদের জন্য সঠিক বেতনকাঠামো তৈরি করা এবং সঙ্গে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার নিয়মাবলি নির্ধারণ করা। দ্বিতীয়, গৃহকর্মীদের অবদানকে জাতীয় আয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এতে তাঁদের অর্থনৈতিক অবদান স্বীকৃত হবে এবং সুযোগ-সুবিধার দাবি জোরদার হবে। তৃতীয়, গৃহকর্মী ও গৃহকর্ম বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা জরুরি। তথ্য ছাড়া সচেতনতা তৈরি এবং নীতি প্রণয়ন দুটিই কঠিন হবে। সরকারি নীতিমালা, কৌশল ও পরিকল্পনায় গৃহকর্মের বিষয়টি মনোযোগে রাখতে হবে।

আরও পড়ুনক্ষমা করুন, গৃহকর্মী বোনেরা০১ মে ২০১৭

সামাজিক দিকেও কাজ দরকার। গৃহকর্মীদের মানবাধিকারকে আইন ও নীতিতে সন্নিবিষ্ট করতে হবে। তাঁদের কর্মক্ষেত্র ও বাসস্থানের জীবনযাপনকে গ্রহণযোগ্য শর্তের মধ্যে আনা দরকার। এ ছাড়া তাঁদের সামাজিক অধিকারও নিশ্চিত করতে হবে। আইনগত কাঠামোর মধ্যে অবশ্যই থাকবে নির্যাতনের প্রতিরোধ ও প্রতিকারব্যবস্থা। এই আইন ও নীতিমালার সঙ্গে সামাজিক সচেতনতা ও মানবিক চেতনা বাড়াতে সামাজিক আন্দোলনও জোরদার করতে হবে।

বৈশ্বিকভাবে গৃহকর্মীদের জন্য একটি জাতিসংঘ সনদ রয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ১৮৯তম সনদটি ২০১১ সালে গৃহীত হয়েছে, যা গৃহকর্মীদের জন্য সুগ্রহণযোগ্য কাজের নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু গত বছরের জুন পর্যন্ত বিশ্বের মাত্র ৩৫টি দেশই এটি অনুমোদন করেছে। বাংলাদেশ সনদে সই করেছে, কিন্তু অনুমোদন দেয়নি। তাই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

সেলিম জাহান জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগের ভূতপূর্ব পরিচালক।

সম্পর্কিত নিবন্ধ