চট্টগ্রাম নগরের নূর নগর হাউজিং সোসাইটি। পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে নগরের সবচেয়ে বড় অস্থায়ী গরুর হাটটি বসে এখানে। হাটের প্রবেশ মুখেই পুলিশের ছাউনি। যেখানে কয়েকজন পুলিশ সদস্য বসে আছেন। আরেকটু এগুতেই ইজারাদারের ছাউনি। সেখানেও কয়েকজন লোক বসে আছেন। এরপরই থেকেই শুরু হয়েছে হাট। বাঁশের খুঁটি ও ত্রিপল দিয়ে বড় ছাউনি তৈরি করা হয়েছে। সেখানে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে গরু বেঁধে রেখেছেন ব্যাপারীরা। তাদের একজন আব্দুর রাজ্জাক। গরুর মুখে খড় তুলে দিচ্ছিলেন তিনি। পাঁচ দিন আগে ১৪টি গরু নিয়ে তিনি এসেছেন কুষ্টিয়া থেকে। এর মধ্যে তিনটি গরুর দাম হেঁকেছেন ১৫ লাখ টাকা। প্রতিটি পাঁচ লাখ টাকা করে। এখনও পর্যন্ত কোনো গরু বিক্রি করতে পারেননি তিনি। জানতে চাইলে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘দেশ অস্থিতিশীল, নানা ঘটনা ঘটছে। পথে বিপদ-আপদের কথা চিন্তা করে আগেভাগে চলে এসেছি। আল্লাহর রহমতে কোনো অসুবিধা হয়নি। আশা করছি, গরুগুলো বিক্রি করে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারব।’
শুধু আব্দুর রাজ্জাক নন, পথের বিপদ নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন আরও অনেক ব্যাপারী। কিন্তু পথে তাদের কাউকে বিপদে পড়তে হয়নি। কোনো চাঁদাবাজি কিংবা হয়রানির শিকার হতে হয়নি বলে জানিয়েছেন তারা। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পশুর হাট ও পশু বহনকারী গাড়ি আটকে চাঁদাবাজি রোধে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পশুর বাজারে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে দু’জন উপ-পুলিশ কমিশনার, একজন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার ও একজন পরিদর্শককে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত রাখা হয়েছে। তাদের মোবাইল নাম্বারও দেওয়া হয়েছে। যে কোনো ধরনের হয়রানিসহ চাঁদাবাজির শিকার হলে তাৎক্ষণিক তথ্য দিতে বলা হয়েছে।
নগরে বসেছে ১৩ পশুর হাট: চট্টগ্রাম নগরে ১৩টি পশুর হাট বসেছে। এর মধ্যে তিনটি স্থায়ী হাট। বাকি ১০টি অস্থায়ী হাট। অস্থায়ী হাটগুলো গত বৃহস্পতিবার বসেছে। স্থায়ী হাটগুলো হলো–সাগরিকা গরু বাজার, বিবিরহাট গরু বাজার ও পোস্তারপাড় ছাগল বাজার। অস্থায়ী হাটগুলোর মধ্যে রয়েছে– নগরের এক কিলোমিটার নূর নগর হাউজিংয়ে কর্ণফুলী পশু বাজার, ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব হোসেন আহম্মদপাড়া সাইলো রোডের পাশে টিএসপি মাঠ, ৩৯ ওয়ার্ডের আউটার রিং রোড সিডিএ বালুর মাঠ, ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যম হালিশহর মুনির নগর আনন্দবাজার সংলঘ্ন রিং রোডের পাশে খালি জায়গা, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর হালিশহর ওয়ার্ডের গলাচিপা পাড়া বারনিঘাটা রোডের পাশে মাঠ, ৪১ নম্বর ওয়ার্ড বাটারফ্লাই পার্কের উত্তরে চেয়ারম্যান মাঠ, ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের চরপাড়া আলমগীর সাহেবের মাঠ, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের বড়পোল এলাকার খালপাড় অস্থায়ী পশু বাজার, সল্টগোলা রেলক্রসিংয়ের পাশে খালি মাঠ ও ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের ধুমপাড়া রেজাউল আমিন মাঠ।
জমে ওঠার অপেক্ষায় হাট: নগরের কর্ণফুলী পশুর হাট। পশুর হাটের ভেতর চিরচেনা সেই জমজমাট পরিবেশ নেই। সারি সারি বাঁশের খুঁটি থাকলেও অনেকগুলোই ফাঁকা। দরদাম নিয়ে কোনো হাঁকডাক নেই। ব্যাপারী থাকলেও ক্রেতার সংখ্যা একেবারেই কম। যে ক’জন এসেছেন তারা ভিড় জমিয়েছেন হাটের বড় আকারের গরুর চারপাশে। কেউ কেউ মোবাইল ফোনে সেই গরুর ছবি তুলে নিচ্ছিলেন। বিক্রেতারা জিলহজের প্রথম শুক্রবার বাজার জমে ওঠার প্রত্যাশা করলেও বৈরী আবহাওয়ার কারণে তা হয়নি। ক্রেতা যেমন কম এসেছে, তেমনি বিক্রেতাও ছিলেন কম।
ভোলার লালমোহন থেকে ১০টা গরু নিয়ে এসেছেন ব্যাপারী মোহাম্মদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘বুধবার রাতে হাটে এসেছি। ভেবেছিলাম আগেভাগে গরু বিক্রি হলে আবার এলাকায় গিয়ে নিয়ে আসবো। কিন্তু এখনো পর্যন্ত একটি গরুও বিক্রি হয়নি। কিন্তু গরুর খাবার ও আমাদের থাকা-খাওয়ার পেছনে প্রতিদিন অনেক টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। কয়েকজন ক্রেতা এলেও তারা কম দামে গরু নিতে চাচ্ছেন। কেনা দামও কেউ মূল্য হাঁকছেন না। আশা করছি কয়েকদিনের মধ্যে বাজার জমে উঠবে।’
চট্টগ্রাম নগরের পশুর হাটগুলোতে শহরের আশপাশের উপজেলার পাশাপাশি কুমিল্লা, নাটোর, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ভোলা, রাজশাহী, নওগাঁও থেকে গরু নিয়ে আসেন ব্যাপারীরা। চট্টগ্রামেও এসব অঞ্চলের গরুর চাহিদা রয়েছে। কুষ্টিয়া, ভোলা ও কুমিল্লা থেকে আসা তিন ব্যাপারী জানান, এবার সড়কপথে নির্বিঘ্ন গরু নিয়ে এসেছেন। কোনো ধরনের বাধাবিপত্তির মুখে পড়েননি।
গরু রাখার জন্য হাটের নির্দিষ্ট অংশ মাটি ভরাট করে উপযুক্ত করে তুলছিলেন আনোয়ারা থেকে আসা ব্যাপারি মো.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গর র হ ট এস ছ ন নগর র
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ