স্কুল আমাকে একটা আকাশ দিয়েছিল: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
Published: 23rd, June 2025 GMT
আমার ছেলেবেলার স্কুলে গেলে আমি ছোট হয়ে যাই। সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল যে আগের তুলনায় বড় হয়েছে তা নয়। বরং খাটো হয়েই গেছে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী জুটেছে অনেক। মেধাতালিকায় যাদের নাম জ্বলজ্বল করে তারা এখন অন্য ঠিকানার ছাত্র। এমনকি আয়তনেও স্কুলটি সংক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে আগের তুলনায়। সামনের রাস্তাটা এখন আগের চেয়ে প্রশস্ত এবং কর্মব্যস্ত; স্কুলের দেয়াল মনে হয় হেঁটে ভেতরে চলে এসেছে কিছুটা—নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। না, স্কুল বড় হয়েছে বলে আমি ছোট হই না। ছোট হই ভিন্ন কারণে। আমি ছাত্র হয়ে যাই। ক্লাসের, রুমের, বেঞ্চের, মাঠের।
ওই স্কুল আমাকে একদিন একটি আকাশ দিয়েছিল। ব্রাদার লরেঞ্জো আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। ক্লাসের পাঠ্য ইংরেজি উপন্যাস ‘দি ক্লয়েস্টার অ্যান্ড দি হার্থ’–এর নায়ক জেরাল্ড গির্জার পাদরি হয়েছিল, আমরা ব্রাদার লরেঞ্জোর পোশাক-আশাক, হাবভাব, চলাফেরা দেখে অনুমান করার চেষ্টা করতাম তরুণ জেরাল্ড কেমনটি ছিল। সেই ব্রাদার লরেঞ্জো, লোহার সিঁড়ির ঠিক নিচের কামরাটিতে দরজা ঠেলে যিনি ক্লাসে আসতেন এবং হঠাৎ হঠাৎ কাগজ দিয়ে বলতেন লিখতে, আর পরের সপ্তাহে লেখাগুলো যখন ফেরত দিতেন, তখন লাল কালিতে ভয়ংকরভাবে রক্তাক্ত থাকত আমাদের কৃতকর্ম, সেই ব্রাদার লরেঞ্জো, স্কুলে ছোট পাঠাগারটিরও দায়িত্বে ছিলেন।
ছোট্ট স্কুল আমাকে ওই আকাশটা দিল। যে আকাশ আস্তে আস্তে বড় হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। কেবল যে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি করে আকাশ দিল তা নয়। নানাভাবেই দিয়েছে। শিক্ষকেরা দিয়েছেন, দিয়েছে সহপাঠীরা।একেক দিন একেক ক্লাসের জন্য বরাদ্দ ছিল। আমাকে তিনি একটি বই বের করে দিয়েছিলেন। পরিষ্কার বাংলায় বলেছিলেন, ‘এটা একটা ভালো বই’, বলে প্রথম বাক্যটি পড়ে শুনিয়েছিলেন। সেই বই বিভূতিভূষণের ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’। ক্যাথলিক পাদরি হিন্দু হোটেলের নামাঙ্কিত বই পড়তে দিয়েছিলেন আমাকে। ওই বইটি আমার পড়া ছিল না। বিভূতিভূষণের অন্য লেখা পড়েছি। ওটা পড়িনি। আমি রাত জেগে পড়েছিলাম সে বই। মনে হয়েছিল মাটিতে নেই, আকাশে রয়েছি।
ছোট্ট স্কুল আমাকে ওই আকাশটা দিল। যে আকাশ আস্তে আস্তে বড় হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। কেবল যে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি করে আকাশ দিল তা নয়। নানাভাবেই দিয়েছে। শিক্ষকেরা দিয়েছেন, দিয়েছে সহপাঠীরা। শুধু ক্লাসের নয়, ক্লাসের বাইরের সতীর্থরাও, তারা যাদের সঙ্গে নিত্যদিনের দেখা হতো, কিন্তু কথা হতো না.
আমরা হেঁটে হেঁটেই আসতাম স্কুলে। ঝাঁক বেঁধে এগুলো থেকে বের হতো কেউ, ওপাশের রাস্তা থেকে কেউবা। যেন শোভাযাত্রা চলেছে একটা। ফেরার পথে আবার নামিয়ে দিয়ে দিয়ে আসা, ঘাটে ঘাটে ভেড়া, লঞ্চের মতো।
কারও কারও গাড়ি ছিল। আটচল্লিশে ঢাকা শহর পূর্ব বাংলার রাজধানী। আর কারও না হোক মন্ত্রীদের তো গাড়ি থাকার কথা। আনোয়ারুল আমিনের পিতা মন্ত্রী ছিলেন, আনোয়ার আমাদের সহপাঠী ছিল, কিন্তু তাকে গাড়িতে চড়ে স্কুলে আসতে দেখিনি। বাসে চড়েই আসত সে...
প্রস্তুতিটা চলছিল। আমার বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আহমদ ছিল, স্কুলে আমি যার সঙ্গে পড়েছি, স্কুল থেকে যখন কলেজ খোলা হলো তখনো পড়েছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, যদিও এক বিষয়ে নয়, ইংল্যান্ডে গিয়েও যার সঙ্গে দেখা হয়েছে, সেই গিয়াসউদ্দিন, একাত্তরে যে শহীদ হয়েছে, স্কুলে যে বয়স্কাউট ছিল। স্কাউটদের যে মটো তার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘প্রস্তুত থেকো’। পেছনে তাকিয়ে দেখি, আমরা তরুণেরা প্রস্তুত হচ্ছিলাম, নতুন নতুন সুযোগ গ্রহণের জন্য...
আরও পড়ুনব্রিটিশ আমল থেকে অভিনয় করছেন বাংলাদেশের এই অভিনেতা, চেনেন তো?২৫ মে ২০২৪লেখাপড়ার ব্যাপারে অদম্যরূপে উৎসাহী আমার পিতা আসলে একজন বন্দী মানুষ ছিলেন। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা যে লেখাপড়া যা হওয়ার মিশনারিদের স্কুলেই হয়। সে তুলনায় জেলা স্কুলই বলো কিংবা কলেজিয়েট স্কুল, কোনোটাই কিছু নয়। নতুন শহরে বদলি হয়ে এলে প্রথমেই মিশনারিদের স্কুল খুঁজতেন। ঢাকাতে আমরা এসেছি পাকিস্তান হওয়ার পর। এখানে এসেও তিনি মিশনারিদের স্কুলেই নিয়ে গেলেন প্রথমে, আমাদের দুই ভাইকে।
ব্রাদার জুড ছিলেন হেডমাস্টার। কী একটা টেস্টের যেন ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। অন্য কিছু মনে নেই, পিতার উদ্বেগাকুল মুখটিই ছাড়া। আমি ভর্তি হব, আমার ছোট ভাই ভর্তি হবে এবং ভর্তি না হতে পারলে মহা সর্বনাশ হয়ে যাবে। এ রকমের একটা উৎকণ্ঠা ছিল আমার পিতার মুখে। সৌভাগ্য, আমরা ভর্তি হতে পেরেছিলাম।
আকাশটা ছিল আন্তরিকতার, নিরবচ্ছিন্ন ঐতিহ্যের এবং মৈত্রীর। মৈত্রীর বিষয়টার একটি দিক ছিল বিশেষভাবে লক্ষ করার। সেটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।যখন ম্যাট্রিক পাস করলাম, ঠিক ম্যাট্রিক নয়, হাইস্কুল পরীক্ষা বলা হতো যাকে, বন্ধুরা তখন সবাই ছুটছে ঢাকা কলেজে কিংবা জগন্নাথে, তিনি তখনো আমাকে স্কুলেই রেখে দিলেন কলেজে ভর্তি করার নাম করে। স্কুলের নতুন কলেজ তখন স্কুলেই বসত, প্রত্যুষে। তখন মনে হয়নি, এখন দেখি তিনি উপকার করেছিলেন। অন্যত্র গেলে কী পেতাম জানি না, কিন্তু ওই স্কুলে এবং পরে কলেজে গিয়ে আমি একটি আকাশ পেয়েছিলাম।
আকাশটা ছিল আন্তরিকতার, নিরবচ্ছিন্ন ঐতিহ্যের এবং মৈত্রীর। মৈত্রীর বিষয়টার একটি দিক ছিল বিশেষভাবে লক্ষ করার। সেটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। স্কুল খ্রিষ্টানদের; ছাত্ররা ছিল মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিষ্টান। শিক্ষকদের অধিকাংশই হিন্দু। কয়েকজন খ্রিষ্টান, মুসলমান একজন—আরবির। যে বিরোধ নিয়ে হিন্দুস্তান-পাকিস্তানের সৃষ্টি, তার কোনো ছাপ স্কুলে দেখিনি।
আরও পড়ুনস্ত্রীরোগের অগ্রদূত চিকিৎসক টি এ চৌধুরীর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল যে ঘটনা০৯ মার্চ ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ক ল আম ক আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে শান্তির পথ হবে না: ট্রাম্প-পুতিনকে ইউরোপীয় নেতাদের সতর্কবার্তা
ট্রাম্প-পুতিন আগামী সপ্তাহের শীর্ষ বৈঠক নিয়ে ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তাঁদের আশঙ্কা, সম্ভাব্য চুক্তিতে ইউক্রেনকে তার ভূখণ্ডের একটি বড় অংশ ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হতে পারে।
এ উদ্বেগ থেকে গতকাল শনিবার রাতে ইউরোপীয় নেতারা ট্রাম্পের প্রতি রাশিয়ার ওপর চাপ আরও বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
তিন বছর ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের পথ খুঁজে পেতে আগামী শুক্রবার আলাস্কায় বৈঠকে বসবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ওই বৈঠকে যোগ দিতে চাইছেন। ইউক্রেন ও ইউরোপের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সতর্ক করে বলা হয়েছে, কিয়েভকে অবশ্যই আলোচনার অংশ করতে হবে।
গত শুক্রবার পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের ঘোষণা দেওয়ার সময় ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘উভয় পক্ষের মঙ্গলের জন্য কিছু ভূখণ্ড অদলবদল করতে হবে।’ এ বিষয়ে তিনি বিস্তারিত আর কিছু বলেননি।
পরদিন গতকাল শনিবার জেলেনস্কি সতর্ক করে বলেন, শান্তি কেনার জন্য তাঁর দেশ রাশিয়াকে কোনো ভূখণ্ড ছেড়ে দেবে না।
ট্রাম্প-পুতিন শীর্ষ বৈঠকের দিন ঘোষণার পর নিজেদের অবস্থান ঠিক করতে গতকাল শনিবার যুক্তরাজ্যে বৈঠক করেন কিয়েভের মিত্রদেশগুলোর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টারা। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের প্রতিনিধিরা।সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জেলেনস্কি লেখেন, ‘ইউক্রেনীয়রা দখলদারের কাছে নিজেদের ভূমি দেবে না। আমাদের স্বার্থবিরোধী যেকোনো সিদ্ধান্ত, আর ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে নেওয়া যেকোনো সিদ্ধান্ত হবে শান্তির বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত।’
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে ফোনালাপে জেলেনস্কি ইউক্রেনের মিত্রদের প্রতি টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠায় ‘স্পষ্ট পদক্ষেপ’ নেওয়ার আহ্বান জানান।
গতকাল রাতে এক যৌথ বিবৃতিতে ইউরোপীয় নেতারা বলেন, সক্রিয় কূটনীতি, ইউক্রেনকে সহায়তা ও রুশ ফেডারেশনের ওপর চাপ সৃষ্টি—এ তিনটিকে মিলিয়ে একটি যৌথ পদ্ধতিই শুধু রাশিয়ার অবৈধ যুদ্ধের অবসান ঘটাতে সফল হতে পারে।
ইউরোপের নেতারা ট্রাম্পের প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ইউক্রেনকে সমর্থন অব্যাহত রেখে, পাশাপাশি রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিধিনিষেধ আরোপ ও তা বজায় রেখে তাঁরা ট্রাম্পকে যুদ্ধ বন্ধে কূটনৈতিকভাবে সাহায্য করতে প্রস্তুত।
ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, পোল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ফিনল্যান্ড এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন এ যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি