শেখ হাসিনা সরকারের আমলেই প্রথমবার বন্দর পরিচালনার ভার বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেটা ১৯৯৭ সাল। চট্টগ্রামে কর্ণফুলীর মোহনায় বেসরকারি বন্দর নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিল মার্কিন প্রতিষ্ঠান স্টিভিডোর সার্ভিসেস অব আমেরিকা (এসএসএ)।

এ নিয়ে একটি চুক্তি করার ব্যাপারে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার ও এসএসএ। কিন্তু চুক্তিটি অসম ও দেশের স্বার্থপরিপন্থী উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে তখন আন্দোলনে নেমেছিলেন সরকারি দলেরই স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী।

প্রথম দফায় ৯৯ বছর এবং পরবর্তীকালে নবায়ন সাপেক্ষে আরও ৯৯ বছর মোট প্রায় ২০০ বছরের জন্য চুক্তিটি করতে যাচ্ছিল তত্কালীন সরকার। এই দীর্ঘ সময়সীমার জন্য ইজারা না দিলে এসএসএর পক্ষে বন্দর পরিচালনায় বিনিয়োগ সাশ্রয়ী নয় বলেও প্রচারণা হচ্ছিল বিভিন্ন মহল থেকে। অনেকটা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেই শ্রমিক-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে দলের নীতিনির্ধারকদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন মহিউদ্দিন। 

আরও পড়ুনযে কারণে চট্টগ্রামে বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগ দরকার২২ ঘণ্টা আগে

প্রতিরোধের মুখে নবায়নের শর্তটি বাদ দিয়েই ৯৯ বছর থেকে সুড় সুড় করে ৩০ বছরে নেমে আসতে রাজি হয়েছিল মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি। এতে তখন একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল আমাদের কাছে। হয় এই নীতিনির্ধারক মহলের কারও লাভালাভের ব্যাপার জড়িত ছিল এর সঙ্গে, নয়তো চুক্তি সম্পাদনের আগে দর–কষাকষির ব্যাপারে তাঁরা ছিলেন অযোগ্য। আন্দোলনের মুখে চুক্তি করা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় সরকার। অন্যদিকে উচ্চ আদালতের রায়ও যায় চুক্তির বিপক্ষে।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালটি (এনসিটি) ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দুবাইভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার ব্যাপারে ‘দৃঢ় প্রত্যয়’ ব্যক্ত করার পর ১৯৯৭ সালের সেই ঘটনা মনে পড়ে গেল। এবারও যথারীতি বন্দরের শ্রমিকেরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন।

দুবাইভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ডকে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালটি (এনসিটি) ব্যবস্থাপনার ভার দিলে তাতে শ্রমিকদের চাকরি হারানোর মতো তাত্ক্ষণিক ক্ষতি তো হবেই, উপরন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা নিয়ে আলোচনা তৈরি হওয়া ডিপি ওয়ার্ল্ডকে এই টার্মিনাল তুলে দিলে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কথাও মাথায় রাখতে বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার কথাটি যখন বারবার আসছে, তখন তথ্য হিসেবে এ কথা উল্লেখ করা হয়তো বাহুল্য নয়, চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালটির বার্ষিক ১০ লাখ একক কনটেইনার টার্মিনাল ওঠানো-নামানোর লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও গত বছরই এ টার্মিনালে জাহাজ থেকে ১২ লাখ ৮১ হাজার কনটেইনার ওঠানো-নামানো হয়েছে।

ইতিমধ্যে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা বন্দরকে বিদেশি অপারেটরের হাতে তুলে দেওয়ার বিপদ সম্পর্কে যুক্তি তুলে ধরেছেন। পূর্ব আফ্রিকার দেশ জিবুতি তাদের বন্দর পরিচালনার ভার সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএআই) প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে তুলে দিয়ে কী রকম গ্যাঁড়াকলে পড়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত চুক্তি বাতিল করেও যে তাদের জাল থেকে এখনো বেরোতে পারেনি, সেই তথ্যও তুলে ধরেছেন তাঁরা। 

কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার এসব তথ্য-উপাত্ত ও সতর্কবার্তা কানে তুলতে নারাজ। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সবচেয়ে বড় উপায় দেখছেন বন্দর তথা দেশের ‘হৃৎপিণ্ড’ প্রসারিত করার মধ্যে। সেই প্রসার-প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ হয়তো এনসিটিকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় তুলে দেওয়া। তিনি প্রথমদিকে বলেছেন, যারা এতে রাজি হবে না, তাদের বুঝিয়ে রাজি করাতে হবে। কিন্তু তাঁর উদ্দীপনামূলক বক্তৃতার পরও রাজি করানো গেল না বলে সম্ভবত তিনি ধৈর্য হারিয়েছেন এবং নম্রভাষী মানুষটি বিরোধিতাকারীদের ‘প্রতিহত’ করার মতো কঠোর ও অগণতান্ত্রিক শব্দও উচ্চারণ করেছেন।

আরও পড়ুনবিদেশি কোম্পানিকে বন্দর ব্যবস্থাপনার ইজারা দেওয়ার ঝুঁকিগুলো কী১৪ জুন ২০২৫

দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার কথাটি যখন বারবার আসছে, তখন তথ্য হিসেবে এ কথা উল্লেখ করা হয়তো বাহুল্য নয়, চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালটির বার্ষিক ১০ লাখ একক কনটেইনার টার্মিনাল ওঠানো-নামানোর লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও গত বছরই এ টার্মিনালে জাহাজ থেকে ১২ লাখ ৮১ হাজার কনটেইনার ওঠানো-নামানো হয়েছে।

বিনিয়োগের অর্থের অভাব বিদেশি অপারেটরকে ডেকে আনার আরেকটি কারণ হতে পারত। কিন্তু ২০০৭ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিলের প্রায় ৪৭০ কোটি টাকা ব্যয় করে এই টার্মিনাল নির্মাণ করে। অবকাঠামোগত নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার পর একাধিক বিদেশি কোম্পানি নিজস্ব বিনিয়োগে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্থাপন করে টার্মিনালটি পরিচালনার আগ্রহ প্রকাশ করে।

বন্দর কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক দরপত্রও আহ্বান করেছিল। সেই দরপত্রটি বাতিল করা হয়েছিল। এরপর প্রায় সাত বছর পর বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে দুই হাজার কোটি টাকা খরচ করে গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয় করে এনসিটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলে।

বিরাট বিনিয়োগের পর দেশীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় যখন এনসিটি লাভজনক অবস্থায় রয়েছে, তখন একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে এটিকে তুলে দেওয়ার প্রয়োজন কেন পড়ল, সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে জবাই করার গল্পটির অন্তর্নিহিত নীতিবাক্যটি হয়তো এখানে মোক্ষম উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।

সম্প্রতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের সমন্বয়ে একটি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মঞ্চ হয়েছে। ‘চট্টগ্রাম বন্দর ইজারা দেওয়ার অস্বচ্ছ ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী তত্পরতার’ বিরুদ্ধে রোডমার্চ হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে তাদের পক্ষ থেকে। আশা করছি, সরকার ‘পথের দাবি’কে আমলে নেবে। ১৯৯৭ সালে মার্কিন প্রতিষ্ঠান এসএসএর প্রস্তাব ও সেই অসম চুক্তির পরিণতির কথা এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও সাহিত্যিক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সরক র এনস ট

এছাড়াও পড়ুন:

ইরানি সিনেমার কবি আব্বাস কিয়ারোস্তামি মুমিত আল রশিদ

আব্বাস কিয়ারোস্তামি—আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ নামগুলোর একটি। একাধারে একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা, প্রযোজক, কবি, চিত্রনাট্যকার, চিত্রগ্রাহক ও আলোকচিত্রী। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২২ জুন শুভ্র তুষারের বুনো সৌন্দর্যের আলবোরর্জ পর্বতমালার পাদদেশে গ্রীষ্মের প্রথম দিনে তেহরানে জন্মগ্রহণ করেন। দার্শনিক কবি ওমর খৈয়াম পরবর্তী পাশ্চাত্যে সবচাইতে বেশি জনপ্রিয়—কিয়ারোস্তামি।

২০১৬ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী তেহরানে ৩৫তম আন্তর্জাতিক ফজর চলচ্চিত্র উৎসবে কিয়ারোস্তামির ৭৫তম জন্মজয়ন্তীকে কেন্দ্র করে উৎসব থিম হিসেবে ‘বন্ধুর বসত এখানে’ (খনে দুস্ত ইনজাস্ত) চিত্তাকর্ষক বাক্যটি ব্যবহার করে। আয়োজক কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য ছিল কিয়ারোস্তামির ‘খনে দুস্ত কোজাস্ত?’ (Where Is the Friend’s House? ১৯৮৭ খ্রি.) চলচ্চিত্রটির বৈশ্বিক জনপ্রিয়তা অনুধাবন ও অনুরণন।

ইরানি চলচ্চিত্রের মহান কবি আশির দশকের শেষভাগে নির্মাণ করেন বিশ্ববিখ্যাত অমর চলচ্চিত্র খনে দুস্ত কোজাস্ত। এর মাধ্যমে শুধু নিজেরই নন, বিশ্ব দরবারে ইরানি চলচ্চিত্রেরও কদর বাড়িয়ে দেন বহুগুণ। সিনেমাটি বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দারুণ সাড়া ফেলে। বিশ্বের তরুণ পরিচালকদের মধ্যে তুমুল আশা-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে। ইরানের সিনেমার পথচলাও শুরু হয় নতুনভাবে।

আব্বাস কিয়ারোস্তামি আবারও তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন ক্লোজ আপ বা নামায়ে নাজদিক (১৯৯০ খ্রি.) ও মাশক্বে শাব (Homework, ১৯৮৯ খ্রি.) সিনেমা দিয়ে। এ দুটো চলচ্চিত্র প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের আঙিনায়ও তাঁর অনন্য দক্ষতার প্রমাণ বহন করে। চলচ্চিত্র দুটোর বিষয়বস্তুর দিকে তাকালে আমরা দেখব, এতে ফারসি সাহিত্যের অনন্য বৈশিষ্ট্যের একটি দিক ‘রেভায়াত পারদাজি’র সফল প্রয়োগ ঘটানো হয়েছে। রেভায়াত পারদাজি বলতে বোঝায়—গল্পের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট ছকে কথা বলা, লেখা, গান, সিনেমা, টেলিভিশনের কোনো কাজ, কম্পিউটার গেম, আলোকচিত্র, থিয়েটার বা কোনো সিকোয়েন্সে সংঘটিত গল্প অথবা অনাগত ভবিষ্যতের কাল্পনিক কোনো গল্প যা এখনো সংঘটিত হয়নি—এ রকম কিছু। আব্বাস কিয়ারোস্তামি উপর্যুক্ত দুটি চলচ্চিত্রের মধ্যে রেভায়াত পারদাজির অত্যন্ত সফল চিত্রায়ণ করেছেন। তাঁর ক্লোজ আপ চলচ্চিত্র বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছে—বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও সিনেমা-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে অপরিহার্য একটি বিষয় হিসেবেও স্থান করে নিয়েছে।

এই চলচ্চিত্র ফ্রান্সের বিখ্যাত প্রামাণ্য চলচ্চিত্রকার, লেখক ও কবি ক্রিস মার্কার ও স্পেনের চলচ্চিত্রকার লুইস বুনুয়েল এবং অন্যান্য প্রসিদ্ধ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রকারের নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রের মতো দর্শকের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়—নিগূঢ় সত্য কী? বা বস্তুনিষ্ঠ বিষয় কী? অবশ্য সব বাস্তবতা, যুক্তি-দলিল, আধুনিকতার বিবেচনা আমাদের শেষ পর্যন্ত এই ফলাফলে পৌঁছতে সাহায্য করে যে, বিষয়বস্তু হচ্ছে বিশ্বাস। বিশ্বাসের কোন দিকটি ভয়ংকর? বিশ্বাস কি প্রশান্তি দেয়? কোনো মুক্তি বা উপহারের বার্তা দেয়?

অন্যদিকে আব্বাস কিয়ারোস্তামি তাঁর বিখ্যাত চলচ্চিত্র হয়্যার ইজ দ্য ফ্রেন্ড’স হাউস চলচ্চিত্রের ধারাবাহিকতায় প্রায় কাছাকাছি গল্পে নির্মাণ করেন মাশক্বে শাব। ‘আভভালি হা’ ও ‘খনে দুস্ত কোজাস্ত’ চলচ্চিত্র দুটি নির্মাণের মাধ্যমে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণে নতুন দিগন্তের সূচনা করেন কিয়ারোস্তামি। বিশেষ করে, খনে দুস্ত কোজাস্ত নির্মাণ করে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে প্রচুর প্রশংসা ও পুরস্কার অর্জন করেন। গ্রামের সহজ-সরল শিশুদের চিন্তার সুপ্ত বিকাশমান ধারা, একে-অপরের প্রতি ভালোবাসা, উদার দৃষ্টিভঙ্গি, কষ্টসহিষ্ণু জীবনধারা, নির্লোভ জীবনের সবুজ শ্যামল প্রকৃতি দেশকাল ভেদ করে চলচ্চিত্রটির প্রতি দর্শকদের আকৃষ্ট করেছে। উল্লেখ্য, এ ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণের নজির যদিও পূর্বে ছিল না, কিন্তু ‘ইয়েক ইত্তেফাক্বে ছদেহ’ (A Simple Event, ১৯৭৪ খ্রি.) চলচ্চিত্রে ছোট্ট শিশুটির কাস্পিয়ান সাগর-তীরবর্তী এলাকা থেকে মাছের থলে কাঁধে নিয়ে দৌড়ানোর দৃশ্য দেখে, স্কুলের কাজ দেখে, মায়ের প্রতি কর্তব্যবোধ দেখে অনেকেই হয়তো আব্বাস কিয়ারোস্তামির হয়্যার ইজ দ্য ফ্রেন্ড’স হাউস?-এর নায়ক আহমাদের সহপাঠী বন্ধু নেয়ামতযাদেহর কর্তব্যবোধের কারণে বারবার পাহাড়ের একপাশের গ্রাম থেকে অন্যপাশের গ্রামে দৌড়ে ছুটে যাওয়ার কথা স্মরণ করতে পারেন। শুধু কি তাই? ছোট্ট মনের আকুতি-মিনতির এই পার্থিব অর্থকে অনেক বিজ্ঞ চলচ্চিত্র সমালোচক ইহজাগতিক তৃষ্ণা থেকে পরমাত্মার যাত্রার কথাই ইঙ্গিত করেছেন।

হয়্যার ইজ দ্য ফ্রেন্ড’স হাউস চলচ্চিত্রের নামটি ইরানের কবি সোহরাব সেপেহরির (জন্ম ১৯২৮ খ্রি.- মৃত্যু ১৯৮০ খ্রি.) বিখ্যাত কবিতা ‘খনে দুস্ত কোজাস্ত?’ থেকে নেওয়া হয়েছে। তবে চলচ্চিত্রটি নির্মাণের পর লেখক বেহরুজ তাজুর দাবি করেন যে, সিনেমার গল্পটি তাঁর ছোট গল্প ‘চেরা খানম মোআল্লেম গেরিয়ে কার্দ?’ (নারী শিক্ষক কেন কান্না করেছেন?) থেকে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কিয়ারোস্তামি প্রদর্শনীর সময় সিনেমার গল্পটি বেহরুজের গল্প থেকে নেওয়া হয়নি বলে স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন।

সিনেমার পটভূমি, লোকেশন, কলাকুশলী নির্বাচন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আব্বাস কিয়ারোস্তামিকে যিনি সার্বক্ষণিক সঙ্গ দিয়েছেন, সেই কিউমারছ পুর আহমাদি চমকপ্রদ কিছু তথ্য দিয়েছেন। কিউমারছ পুর আহমাদি পরবর্তীকালে সিনেমা ও টেলিভিশন মাধ্যমে ইরানিদের মাঝে মাজিদ নামের নস্টালজিক চরিত্রের রূপায়ণ ঘটিয়েছিলেন। তিনি হয়্যার ইজ দ্য ফ্রেন্ড’স হাউস চলচ্চিত্রের বিহাইন্ড দ্য সিনের বাস্তবচিত্র অঙ্কন করেছিলেন, যা খনে দুস্ত কোজাস্ত নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়। এই সময়ে কিয়ারোস্তামি জেন্দেগি ভা দিগার হিচ (Life, and Nothing More, ১৯৯২ খ্রি.) ও জিরে দেরাখ্‌তনে জেইতুন (Through the Olive Trees, ১৯৯৪ খ্রি.) নামে আরও দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। দুটি চলচ্চিত্রই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে সকলের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়। বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগানো হয়্যার ইজ মাই ফ্রেন্ড’স হোম চলচ্চিত্রের পর এই দুইটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয় গিলান প্রদেশে।

৭০-এর দশকের পূর্বে ইরানের শিশু-কিশোর চলচ্চিত্র যেভাবে যাত্রা শুরু করেছিল, বিপ্লবের পরেও তা অব্যাহত ছিল। এ সময় অসাধারণ সব চলচ্চিত্রকারের আগমন ঘটে। শিশু ও কিশোরদের জন্য অসাধারণ সব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এক্ষেত্রে যিনি বিশ্ব চলচ্চিত্র-অঙ্গনে ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন, তিনি হচ্ছেন আব্বাস কিয়ারোস্তামি। তাঁর আরেকটি বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র হচ্ছে তামে গিলা’ছ (Taste of Cherry, ১৯৯৭ খ্রি.)। চলচ্চিত্রটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য হিসেবেও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়া অন্যান্য সিনেমাগুলোর মধ্যে—জিরে দেরাখতে যেইতুন (Through the Olive Trees, ১৯৯৪ খ্রি.) মেছলে ইয়েক আ’শেক্ব (Like Someone in Love ২০১২ খ্রি.) উল্লেখযোগ্য।

আব্বাস কিয়ারোস্তামি ততদিনে ইরান ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত একজন চলচ্চিত্রকার। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো বিশ্বব্যাপী প্রশংসার জোয়ারে ভাসছিল। এই সময়ে নির্মাণ তিনি করেন বদ ‘ম রা খহাদ বোর্দ’ (The Wind Will Carry Us, ১৯৯৯ খ্রি.), ‘তামে গিলাছ’ (Taste of Cherry, ১৯৯৭ খ্রি.), ‘এবিছি আফ্রিকা’ (ABC Africa, ২০০১ খ্রি.) ও ‘দাহ’ (Ten, ২০০২ খ্রি.)। টেস্ট অফ চেরি এর মধ্যে সবচাইতে দেদীপ্যমান সিনেমা, যেটির মাধ্যমে কিয়ারোস্তামি আবারও বিশ্বজোড়া আলোচিত হন। আব্বাস কিয়ারোস্তামি ফ্রান্স-ইতালিতে নির্মিত ‘কপি বরাবর আছলি’ (Certified Copy, ২০১০ খ্রি.) নিয়ে ২০১০ সালে কান উৎসবে অংশগ্রহণ করেন এবং চলচ্চিত্রটির নায়িকা জুলিয়েট বিনোশ সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেন। এই সিনেমাটির মাধ্যমে একটি যুগের অবসান হয়।

আব্বাস কিয়ারোস্তামিও বিশ্বখ্যাত গায়ক জিম মরিসন, ঔপন্যাসিক অস্কার ওয়াইল্ড, ভিক্টর হুগো, দার্শনিক রুশোর মতো— প্যারিসকে অন্তিম যাত্রার জন্য বেছে নেন। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুলাই প্যারিসেই তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পরও তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোয় ইরানি চলচ্চিত্রের বিস্তৃত এক বেলাভূমির সৌন্দর্য প্রতিনিয়ত সারা বিশ্বের দর্শক, সমালোচক, চলচ্চিত্রপ্রেমীরা অবগাহন করছেন। ৮৫তম জন্মদিনে তেহরানের অদূরে লাভাসানের ছোট্ট মফস্বল শহরে ঘুমিয়ে থাকা এ মহান শিল্পীর প্রতি একরাশ মুগ্ধতা আর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইরানি সিনেমার কবি আব্বাস কিয়ারোস্তামি মুমিত আল রশিদ