শেখ হাসিনা সরকারের আমলেই প্রথমবার বন্দর পরিচালনার ভার বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেটা ১৯৯৭ সাল। চট্টগ্রামে কর্ণফুলীর মোহনায় বেসরকারি বন্দর নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিল মার্কিন প্রতিষ্ঠান স্টিভিডোর সার্ভিসেস অব আমেরিকা (এসএসএ)।

এ নিয়ে একটি চুক্তি করার ব্যাপারে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার ও এসএসএ। কিন্তু চুক্তিটি অসম ও দেশের স্বার্থপরিপন্থী উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে তখন আন্দোলনে নেমেছিলেন সরকারি দলেরই স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী।

প্রথম দফায় ৯৯ বছর এবং পরবর্তীকালে নবায়ন সাপেক্ষে আরও ৯৯ বছর মোট প্রায় ২০০ বছরের জন্য চুক্তিটি করতে যাচ্ছিল তত্কালীন সরকার। এই দীর্ঘ সময়সীমার জন্য ইজারা না দিলে এসএসএর পক্ষে বন্দর পরিচালনায় বিনিয়োগ সাশ্রয়ী নয় বলেও প্রচারণা হচ্ছিল বিভিন্ন মহল থেকে। অনেকটা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেই শ্রমিক-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে দলের নীতিনির্ধারকদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন মহিউদ্দিন। 

আরও পড়ুনযে কারণে চট্টগ্রামে বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগ দরকার২২ ঘণ্টা আগে

প্রতিরোধের মুখে নবায়নের শর্তটি বাদ দিয়েই ৯৯ বছর থেকে সুড় সুড় করে ৩০ বছরে নেমে আসতে রাজি হয়েছিল মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি। এতে তখন একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল আমাদের কাছে। হয় এই নীতিনির্ধারক মহলের কারও লাভালাভের ব্যাপার জড়িত ছিল এর সঙ্গে, নয়তো চুক্তি সম্পাদনের আগে দর–কষাকষির ব্যাপারে তাঁরা ছিলেন অযোগ্য। আন্দোলনের মুখে চুক্তি করা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় সরকার। অন্যদিকে উচ্চ আদালতের রায়ও যায় চুক্তির বিপক্ষে।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালটি (এনসিটি) ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দুবাইভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার ব্যাপারে ‘দৃঢ় প্রত্যয়’ ব্যক্ত করার পর ১৯৯৭ সালের সেই ঘটনা মনে পড়ে গেল। এবারও যথারীতি বন্দরের শ্রমিকেরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন।

দুবাইভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ডকে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালটি (এনসিটি) ব্যবস্থাপনার ভার দিলে তাতে শ্রমিকদের চাকরি হারানোর মতো তাত্ক্ষণিক ক্ষতি তো হবেই, উপরন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা নিয়ে আলোচনা তৈরি হওয়া ডিপি ওয়ার্ল্ডকে এই টার্মিনাল তুলে দিলে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কথাও মাথায় রাখতে বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার কথাটি যখন বারবার আসছে, তখন তথ্য হিসেবে এ কথা উল্লেখ করা হয়তো বাহুল্য নয়, চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালটির বার্ষিক ১০ লাখ একক কনটেইনার টার্মিনাল ওঠানো-নামানোর লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও গত বছরই এ টার্মিনালে জাহাজ থেকে ১২ লাখ ৮১ হাজার কনটেইনার ওঠানো-নামানো হয়েছে।

ইতিমধ্যে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা বন্দরকে বিদেশি অপারেটরের হাতে তুলে দেওয়ার বিপদ সম্পর্কে যুক্তি তুলে ধরেছেন। পূর্ব আফ্রিকার দেশ জিবুতি তাদের বন্দর পরিচালনার ভার সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএআই) প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে তুলে দিয়ে কী রকম গ্যাঁড়াকলে পড়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত চুক্তি বাতিল করেও যে তাদের জাল থেকে এখনো বেরোতে পারেনি, সেই তথ্যও তুলে ধরেছেন তাঁরা। 

কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার এসব তথ্য-উপাত্ত ও সতর্কবার্তা কানে তুলতে নারাজ। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সবচেয়ে বড় উপায় দেখছেন বন্দর তথা দেশের ‘হৃৎপিণ্ড’ প্রসারিত করার মধ্যে। সেই প্রসার-প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ হয়তো এনসিটিকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় তুলে দেওয়া। তিনি প্রথমদিকে বলেছেন, যারা এতে রাজি হবে না, তাদের বুঝিয়ে রাজি করাতে হবে। কিন্তু তাঁর উদ্দীপনামূলক বক্তৃতার পরও রাজি করানো গেল না বলে সম্ভবত তিনি ধৈর্য হারিয়েছেন এবং নম্রভাষী মানুষটি বিরোধিতাকারীদের ‘প্রতিহত’ করার মতো কঠোর ও অগণতান্ত্রিক শব্দও উচ্চারণ করেছেন।

আরও পড়ুনবিদেশি কোম্পানিকে বন্দর ব্যবস্থাপনার ইজারা দেওয়ার ঝুঁকিগুলো কী১৪ জুন ২০২৫

দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার কথাটি যখন বারবার আসছে, তখন তথ্য হিসেবে এ কথা উল্লেখ করা হয়তো বাহুল্য নয়, চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালটির বার্ষিক ১০ লাখ একক কনটেইনার টার্মিনাল ওঠানো-নামানোর লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও গত বছরই এ টার্মিনালে জাহাজ থেকে ১২ লাখ ৮১ হাজার কনটেইনার ওঠানো-নামানো হয়েছে।

বিনিয়োগের অর্থের অভাব বিদেশি অপারেটরকে ডেকে আনার আরেকটি কারণ হতে পারত। কিন্তু ২০০৭ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিলের প্রায় ৪৭০ কোটি টাকা ব্যয় করে এই টার্মিনাল নির্মাণ করে। অবকাঠামোগত নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার পর একাধিক বিদেশি কোম্পানি নিজস্ব বিনিয়োগে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্থাপন করে টার্মিনালটি পরিচালনার আগ্রহ প্রকাশ করে।

বন্দর কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক দরপত্রও আহ্বান করেছিল। সেই দরপত্রটি বাতিল করা হয়েছিল। এরপর প্রায় সাত বছর পর বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে দুই হাজার কোটি টাকা খরচ করে গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয় করে এনসিটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলে।

বিরাট বিনিয়োগের পর দেশীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় যখন এনসিটি লাভজনক অবস্থায় রয়েছে, তখন একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে এটিকে তুলে দেওয়ার প্রয়োজন কেন পড়ল, সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে জবাই করার গল্পটির অন্তর্নিহিত নীতিবাক্যটি হয়তো এখানে মোক্ষম উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।

সম্প্রতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের সমন্বয়ে একটি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মঞ্চ হয়েছে। ‘চট্টগ্রাম বন্দর ইজারা দেওয়ার অস্বচ্ছ ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী তত্পরতার’ বিরুদ্ধে রোডমার্চ হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে তাদের পক্ষ থেকে। আশা করছি, সরকার ‘পথের দাবি’কে আমলে নেবে। ১৯৯৭ সালে মার্কিন প্রতিষ্ঠান এসএসএর প্রস্তাব ও সেই অসম চুক্তির পরিণতির কথা এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও সাহিত্যিক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সরক র এনস ট

এছাড়াও পড়ুন:

২৮ বছর ধরে নিজের টাকায় গাছ লাগান চা-শ্রমিক বিষ্ণু

সময়–সুযোগ পেলেই নিজের বাইসাইকেলের পেছনে চারা ও গাছ লাগানোর সরঞ্জাম নিয়ে এখানে-সেখানে ছোটেন বিষ্ণু হাজরা (৪০)। রাস্তার ধার, ফাঁকা মাঠ, চা–বাগানের আনাচকানাচে রোপণ করেন নানা ধরনের গাছ। এতেই তাঁর আনন্দ। এ কাজে নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করতে দ্বিধাবোধ করেন না তিনি। চা–শ্রমিক পরিবারে জন্ম নেওয়া মানুষটি দারিদ্র্য উপেক্ষা করে বেছে নিয়েছেন পরিবেশ রক্ষার কাজ। ১৯৯৭ সাল থেকে তিনি এ কাজ করে আসছেন।

বিষ্ণু হাজরা মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা–বাগানের বাসিন্দা। তিনি পেশায় চা–শ্রমিক। চা–বাগানে কাজের পাশাপাশি সেখানে ঝালমুড়িও বিক্রি করেন। তাঁর পরিবারে মা-বাবা, স্ত্রী ও দুই ছেলে রয়েছে।

সম্প্রতি এক দুপুরে ভাড়াউড়া চা–বাগানের দুর্গামন্দির প্রাঙ্গণে বিষ্ণুর সঙ্গে দেখা হয়। কয়েকজন তরুণ-যুবককে নিয়ে মন্দিরটির চারপাশে ছোট ছোট গর্ত করছিলেন তিনি। একপর্যায়ে সেখানে রোপণ করছেন জাম, নিম, বট আর কাঠগোলাপের চারা।

আলাপকালে বিষ্ণু বলেন, ‘১৯৯৪ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে শহরের ভিক্টোরিয়া উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হই। আমাদের চা–শ্রমিক পরিবারে অভাব–অনটন লেগেই থাকত। তখন পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনিও করতাম। একদিন মাথায় এলো—যদি কিছু গাছের চারা লাগাই, সেই চারা বড় হলে অনেক টাকায় বেচতে পারব, অর্থকষ্ট কমবে। ১৯৯৭ সালে আমি নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বৃক্ষ’ কবিতাটি পড়ি। সেই কবিতা থেকে বেশ অনুপ্রাণিত হই, গাছের অনেক উপকারিতার কথা জানতে পারি। তখন থেকে টিউশনির টাকার একটি অংশ দিয়ে টুকটাক গাছ লাগানো শুরু করি।’

কয়েকজন তরুণ-যুবককেও সম্পৃক্ত করেছেন বৃক্ষরোপণের কাজে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ২৮ বছর ধরে নিজের টাকায় গাছ লাগান চা-শ্রমিক বিষ্ণু