বাংলাদেশে প্রথম দেখা গেল অ্যান্ডারসেন পাতা-নাক বাদুড়
Published: 26th, June 2025 GMT
গত বছরের পয়লা এপ্রিলে রাতের শেষ বাসে ঢাকা থেকে বান্দরবান পৌঁছাতে প্রায় আটটা বেজে যায়। ফলে কোনোরকমে পড়িমরি করে থানচির উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া দিনের শেষ বাস ধরি। প্রাতঃকর্ম কিংবা নাশতা করা—কোনোটাই করার সুযোগ হলো না। বাসের পেছনের দিকে দুটো সিট পেলাম। সঙ্গে আমার গবেষক ছাত্র অং শৈ নু মারমা। লোকাল বাসের অবস্থা দেখে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লে অং আমাকে
আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে। নীলগিরি পেরিয়ে ডিমের পাহাড়ের পর থেকে রাস্তার বাঁক আর খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে-নামতে চালকের যুদ্ধ দেখে ভয় হলো। গাড়ির হেলপার একটি কাঠের বড় ঠেস বের করে যখন দরজার কাছে রাখল, তখন ভাবনা এল এবার অক্ষত অবস্থায় ঢাকা ফিরতে পারব কি না। খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে গিয়ে গাড়ির ব্রেক ফেল করলে চাকার পেছনে ঠেস দিয়ে গাড়ি খাদে পড়া থেকে রক্ষা করতে হয়। তাই হাতের কাছে রাখা হয় ঠেস দেওয়ার কাঠ।
থানচি পৌঁছি ভরদুপুরে। এপ্রিল মাসের প্রখর রোদ, ভ্যাপসা গরম। বাজারে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসতে শুরু করেছেন। আগে থেকে ঠিক করা স্থানীয় গাইড মংএ নু মারমা আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। থানচি বাজার থেকে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে নেমে নদীর তলায় ‘পানক্ষা নৌকা’য় গিয়ে উঠলাম আমরা। গরম বাতাসের দমকা এসে গায়ে লাগছে। সাঙ্গুর পানি শুকিয়ে একেবারে তলায় গিয়ে ঠেকেছে। ফলে সাঙ্গুর পেটের নানা রঙের ছোট–বড় পাথর ছিপছিপে পানির নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছে।
আমরা যখন তিন্দু পার হয়ে রেমাক্রি পৌঁছাই, তখন সাঙ্গু নদের খাড়া পাহাড়ের আড়ালে বিকেলের সূর্য। মাঝি আমাদের নামিয়ে দিলেন রেমাক্রি বাজারের ওপর। সাঙ্গুর এ অংশে পানি নেই বললেই চলে। তাই মাঝি অনেকটা জোর করে আমাদের নামিয়ে দিলেন। কোনো উপায় নেই, আমরা নেমে হাঁটতে শুরু করলাম। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পানি-পাথর ঠেলে আমাদের গন্তব্যের মারমাপাড়া দৃষ্টিগোচর হলো। ততক্ষণে গায়ে কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই। পাহাড় বেয়ে মারমা পাড়ায় পা রাখতে পারলাম কোনোমতে। পাড়াপ্রধান (কারবারি) মংসাচিং মারমার বাড়িতে আমাদের ঠাঁই হলো। সারারাত ভ্রমণ করে, সারা দিন রোদে পুড়ে, তপ্ত গরমে ঘামে ভিজে বাঁশের উঁচু মাচান দেওয়া ঘরে উঠেই একেবারে সটান শুয়ে পড়লাম। কারবারি বাড়িতে নেই, আছেন শুধু তাঁর স্ত্রী খই ম্রা চিং মারমা। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে পাশের ঝিরির পানিতে গোসল করলাম। দেহে প্রাণ ফিরে এল।
বিশ্রামের পর পরের দিনের গুহা অভিযানের পরিকল্পনা করতে মংএ নু মারমা আমাদের নিয়ে চলল পাশের পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত একটি খুমি পাড়ায়। পাড়া থেকে গাইড ঠিক করে ফিরে এলাম। পরদিন ভোরে খুমি পাড়া থেকে প্রায় দুই ঘণ্টা পাহাড় বেয়ে আমরা পৌঁছালাম এক খাড়া পাহাড়ি খাঁজের চূড়ার কাছাকাছি। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে বাদুড় খাঁজ থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। নাকে বাদুড়ের তীব্র গন্ধ টের পেলাম। কিন্তু পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে নিচে নেমে বাদুড় দেখা অসম্ভব ঠেকল। প্রায় ২৫০ মিটার গভীর খাদ। নিচে নামার কোনো পথ নেই। গাছের সঙ্গে রশি বেঁধে নামতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। অতঃপর খুমি গাইডদের নির্দেশনা দিয়ে পাঠালাম। এই গুহায় ওদের নিয়মিত যাতায়াত আছে। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর ফিরে এল বেশ কয়েকটি বাদুড় নিয়ে। আমরা ফিরে এলাম মারমা পাড়ায়। বাদুড়ের ছবি তুললাম, দেহের মাপ নিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে ল্যাবে বাদুড়ের খুলি প্রস্তুত করে প্রয়োজনীয় মাপজোখ করলাম। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের পর বাদুড়টির নমুনাটি অ্যান্ডারসেন পাতা-নাক বাদুড় হিসেবে শনাক্ত করতে সক্ষম হই। অতঃপর ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত ম্যামালিয়া বিজ্ঞান সাময়িকীতে নিবন্ধ প্রকাশের জন্য প্রেরণ করি।
এই বাদুড়ের ইংরেজি নাম অ্যান্ডারসেনস লিফনোজ ব্যাট, লাতিন ভাষায় হিপোসিডিরোস জেনটিলিস। এটি আকারে বেশ ছোট, ঊর্ধ্ববাহু মাত্র ৪০-৪২ মিলিমিটার লম্বা। তবে দেহের তুলনায় কান বেশ বড়, যা ২০-২২ মিলিমিটার। নাকের ছিদ্রের মাঝে সুগঠিত মাংসল পর্দা দেখে এটি অন্যান্য নিকটাত্মীয় থেকে আলাদা করা যায়। তবে এটি সঠিকভাবে চিনতে হলে এই বাদুড়ের দাঁতের গঠন ও খুলির মাপজোখ নিতে হবে। খুলি লম্বাটে, প্রায় ১৪ মিলিমিটার লম্বা। তুলনামূলকভাবে কর্তন দাঁত লম্বা, সরু। এরা পতঙ্গভোজী বাদুড়। সাধারণত গুহা কিংবা পাথুরে পরিবেশে বাস করে। এর আগে এটি বাংলাদেশে দেখা যায়নি। এর ফলে দেশের বাদুড়ের তালিকায় যোগ হলো আরেকটি নতুন বাদুড়। বাংলাদেশের নাম উঠল এই বাদুড়ের বৈশ্বিক মানচিত্রে।
ড.
এম এ আজিজ, অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
বগুড়ায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা
বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলায় আনোয়ার হোসেন (৩১) নামের রেনেটা লিমিটেডের এক বিক্রয়কর্মীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে। গতকাল বুধবার গভীর রাতে উপজেলার বেতগাড়ী এলাকায় ঢাকা–রংপুর মহাসড়কের পূর্ব পাশে ফটকি সেতুর কাছে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত আনোয়ার হোসেন নওগাঁর মান্দা উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের খোয়াজ উদ্দিনের ছেলে। তিনি শাজাহানপুর উপজেলার সাজাপুর আকন্দপাড়ায় পরিবারসহ ভাড়া থাকতেন। রেনেটা লিমিটেডে তিনি সহকারী পরিবেশন কর্মকর্তা (সহকারী ডিস্ট্রিবিউশন কর্মকর্তা) পদে চাকরি করতেন। তাঁর লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠিয়েছে পুলিশ।
শাজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে, এটি হত্যাকাণ্ড। হত্যাকাণ্ডের কারণ এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। থানায় এখনো হত্যা মামলা হয়নি। হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন ও জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ মাঠে নেমেছে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, রাতে ঢাকা–রংপুর মহাসড়কের পাশে রক্তাক্ত লাশ পড়ে থাকতে দেখে এক পথচারী জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯–এ ফোন দেন। শাজাহানপুর থানা–পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে গিয়ে রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে শেরপুর হাইওয়ে থানা–পুলিশকে জানায়। পরে হাইওয়ে পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাৎক্ষণিক অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হয়, এটি দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু নয়।
হাইওয়ে পুলিশের শেরপুর থানার ওসি আজিজুল ইসলাম বলেন, হাইওয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে মহাসড়কে চলাচলকারী যানবাহনের গতি ও সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হয়, নিহত আনোয়ার হোসেনের শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন আছে। হত্যাকাণ্ড নিশ্চিত হওয়ার পর শাজাহানপুর থানা–পুলিশ লাশটি তাদের হেফাজতে নেয়।