Risingbd:
2025-08-13@01:56:35 GMT

নেপালে থামেলের দিনরাত্রি 

Published: 28th, June 2025 GMT

নেপালে থামেলের দিনরাত্রি 

ঘড়ির কাটায় বাংলাদেশ সময় দুপুর একটা বেজে পনেরো মিনিট। নেপাল সময় দুপুর একটা। আমরা আছি নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সকাল বেলা বাংলাদেশ বিমানের বিজি-৭০৭ চেপে হিমালয়কন্যার কাছে এসেছি। আসার অবশ্য কারণও আছে। আমারা এসেছি নেপাল-বাংলাদেশ ইয়ুথ কনক্লেভের অনুষ্ঠানে। 

এয়ারপোর্টে আমাদের নেপালের ঐতিহ্যবাহী টুপি আর উত্তরীয় দিয়ে বরণ করেন অনুষ্ঠানের প্রধান সমন্বয়ক অভিনব দাদা। আমাদের সাথে বাংলাদেশ থেকে আরো অনেকেই উড়াল দিয়ে এসেছেন এই আয়োজনে অংশ নিতে। আমরা একে অন্যের সাথে পরিচিত হলাম। মোবাইলের সিম কিনলাম এয়ারপোর্ট থেকেই। অনুষাঙ্গিক কাজ শেষ করে এবার আমরা চেপে বসলাম চার চাকার বাহনে। সূর্যদেবের উষ্ণ অভ্যর্থনা আমাদের বেশ ভালোই লাগছিল। আসার আগে ভেবেছিলাম খুব ঠাণ্ডা হবে, কিন্তু তেমন মনে হলো না। আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের হোটেল পানে। চলতি পথে আমাদের দেশের মতো  রাস্তায় যানজট পেলাম। ধীর গতিতে চলছিল আমাদের চার চাকার বাহন। সময়ে সাথে সাথে আমরা চলে এলাম থামেলে।  থামেল জায়গাটি আমাদের শাঁখারী বাজার বা লক্ষ্মী বাজারের মতোই। বলা যায় যে কোনো পুরোনো জেলা শহরের বড় বাজার এলাকাটি যেমন, তেমনই। কিন্তু অনেক কালারফুল। পথে পর্যটকে ঠাসা। দেখে মনে হলো অধিকাংশই তারা পশ্চিমা। ছোট ছোট দোকানঘর। হরেক রকম পসরা সাজানো। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। অনুভব করছিলাম থামেল শহরের স্পন্দন। বেশিরভাগ হস্তশিল্পের জিনিস। পিতলের, তামার। পাথর, মাটি, শোলা, কাঠ বিভিন্ন সহজলভ্য উপাদানে তৈরি এসব। হাতের নিখুঁত কারুকাজ, রঙের ছটা, তুলির আঁচড়, ঢালাইয়ের পেটা কাজ প্রভৃতি বিভিন্নভাবে শিল্প সৃষ্টি হয়েছে। 

অভিনবদা ঘোষণা দিলেন আমরা হোটেলের কাছে চলে এসেছি। এখন গাড়ি থেকে নেমে পদব্রজে যেতে হবে সামান্য পথ। আমরা গাড়ি থেকে নেমে গলির পথে এগিয়ে চললাম। গলির ভেতরে ছোট ছোট দোকান, যার বেশির ভাগই মহিলারা পরিচালনা করছেন। আমরা প্রবেশ করলাম সাতকার হোটেল এন্ড স্পাতে। প্রবেশের পর আমাদের ওয়েলকাম ড্রিংক পরিবেশন করা হলো। মনে হলো আসল তরমুজের স্বাদ।  এরপর আমাদের প্রত্যেকের রুমের চাবি বুঝিয়ে দেওয়া হলো। আমরা অস্থায়ী ডেরায় প্রবেশ করলাম। দ্রুত রিফ্রেশ হয়ে বের হয়ে পড়লাম দুপুরের পেটপূজার জন্য। যদিও নেপাল সময় তখন বিকেল পাঁচটা। আমারা চলে এলাম নেপালি এক খাবার হোটেলে। যার যেমন পছন্দ তেমনি মেন্যু অর্ডার করলেন। আমরা নিলাম নেপালি ভেজ থালি। অল্পসময়ের মাঝেই আমাদের মাঝে খাবার পরিবেশন করা হলো। এক থালাতেই সব অল্পঅল্প করে সাজানো। শাক, আলু ভর্তা, ডাল, বরবটি আলু দিয়ে তরকারি, বাদামের তরকারি, আচার, দই। তার ওপর খাঁটি ঘি দিয়ে গেলেন খাবার পরিবেশনকারী। পেটে চলছিল রাম রাবণের যুদ্ধ। ভদ্রতা না করে খাওয়া শুরু করে দিলাম। খাবার যেন নয়, অমৃত খাচ্ছি! নেপালিদের অথেনটিক খাবারের রেস্টুরেন্ট এটি। নেপালিরা ফ্রেশ রান্না করে, বাসি খাবার রাখে না, উচ্ছিষ্ট খায় না একদমই। বেঁচে যাওয়া খাবার ডিশে থেকে গেলে বা হাতের স্পর্শ ছাড়া বেড়ে নেওয়া হলে তাও উচ্ছিষ্ট বলে ধরে নেন। এ জন্য খাবার আসতে সবখানেই সময় লাগে একটু বেশি। এই অবকাশে নানা রকম গল্পগুজবে কাটলো আমাদের। 

একদল পরিকল্পনা করল নাগরকোট যাবে, কেউ যাবে আবার চন্দ্রগিরি হিল। পেট পূজা শেষ করে আমরা বের হয়ে পড়লাম থামেলের পথেপ্রান্তরে। সূর্যদেব তখন অস্তাচলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সন্ধ্যা ক্রম আসন্ন। পাহাড়ের উপত্যকার শহর। রাত নামে দ্রুত, শহর ঘুমিয়ে পড়ে আগে আগে, তখন জেগে ওঠে অন্যরকম আরেকটি শহর। আমরা পদব্রজে এগিয়ে চলছি।  থামেলের পথেপ্রান্তরে বিভিন্ন ধরনের দোকানের দেখা পাওয়া যায়। কেউ ঠাণ্ডার কাপড় বিক্রি করছেন, কেউবা পিতলের সামগ্রী, কেউ আবার হিমালয় ট্র্যাকিং করার সমগ্রী, আবার কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের চা। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য যা কিছু প্রয়োজন সব কিছুই পাবেন এই থামেলে। আমরা একটি দোকানে প্রবেশ করলাম। দোকানটিতে বড় আকৃতির গৃহসজ্জা সামগ্রী বিক্রি হয়, সবই পিতলের। কিছু নিকেল করা। আমাদের দেশের এলিফ্যান্ট রোডের পিতলের দোকানগুলোর মতোই। অসাধারণ কারুকাজ! দেখলেই কিনতে মনে চাইছিল। পরে ভাবলাম আরেকটু দেখি; অন্য দোকানে আরো ভালো কিছু পাবো হয়তো।

আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম পরের দোকানের দিকে। এবার একটি মেডিটেশন বোল দেখে চোখ আটকে গেলো। মেডিটেশন বোলের শব্দ আপনাকে নিয়ে যাবে এক অনন্য ভুবনে। দামাদামি করে কিনে নিলাম। রাতের গভীরতা বাড়ছে পাহাড়ের উপত্যকার শহরে। আমার ভ্রমণ সঙ্গী বায়না ধরলেন তাকে একটি ধূপদানি কিনে দিতে হবে। শেষপর্যন্ত  একটি ধূপদানি কিনেই ছাড়লেন তিনি। স্তম্ভের মতো, ভেতরের আগরবাতির বাষ্পায়িত সৌরভ বেরিয়ে আসার জন্য স্তম্ভটির গায়ের নকশা জালিকাট করা। ভেতরের আগরবাতির কাঠি দাঁড় করানোর জন্য ছিদ্রের ঘাট করা আছে। সেখানে রেখে কাঠির শীর্ষে আগুন ধরিয়ে স্তম্ভের সদৃশ লম্বাটে ঢাকনাটি বসিয়ে দিলে নকশার কাটা দিয়ে সুবাসিত ধোঁয়া বাইরে আসে। গায়ে বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন পবিত্র চিহ্ন কাঠে নকশা করে তুলি দিয়ে রঙিন করা। বাক্সের ঢাকনাটি খোলা যায়। ঢাকনার গায়ে লম্বালম্বি কাটা। কাটা মুখটি সোনা রঙে রাঙানো। বাক্সের ভেতরে ধাতুর প্লেট বসানো আছে। তার ওপরে ধূপের দড়ির মতো পাকানো সলতে রাখতে হয়। মাথার কাটা ফাক দিয়ে ধূপের ধোঁয়া প্রজ্বালিত হয়ে বেরিয়ে আসে। 

চলতি পথে দেখা হলো আমাদের সাথে আসা নাফিস ভাইয়ের। তিনি পাশের দোকান থেকে খুরপি কিনছেন। খুরপি হলো  ড্যাগারের মতো ছুরি, শেরপারা পাহাড়ে ওঠার সময় বাধা হওয়া গাছের ডালপালা ছাঁটতে হাতে রাখেন। পাশের দোকানে খুরপির বিরাট সম্ভার নেড়েচেড়ে দেখলেন। খুরপি নেপালি আইকনিক স্যুভেনির। খুব সুন্দর কারুকাজ! আমি নাফিস ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম, ফেরার পথে প্লেনে কি নেওয়া যাবে? তিনি বললেন না নিতে দেওয়ার কথা না। এটি তো নেপালের ট্র্যাডিশনাল জিনিস। নেপালের স্মৃতি হিসেবে সাথে নিয়ে যেতেই পারে। যাই হোক শেষ পর্যন্ত সাহস করে নিয়েই ফেললাম। 

আমার এক দোকান থেকে আরেক দোকান পানে এগিয়ে চলছি। রাতের গভীরতা বারার সাথে সাথে দিনের থামেলের চিত্র পরিবর্তিত হতে লাগলো। তখন সে এক অন্য থামেল। বিদেশিদের আনাগোনা বাড়ছে। পাব ও নাইট ক্লাব খুলে গেছে। ক্লাবগুলোর বাইরে মানুষের ভিড়। মিউজিকের উত্তাল তরঙ্গে যে কাউকেই ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। থামেল শহরের পুরোনো অংশ। ঘরবাড়ি অধিকাংশই পুরোনো। আমাদের জমিদার বাড়িগুলোর মতো। ভবনগুলোর প্রধান দরজা কাঠের, নকশা করা। মনে হয় একেকটি রাজবাড়ির প্রবেশদ্বার। এরই রেপ্লিকা স্বর্গের দরজা নামে এখানকার দোকানে বিক্রি হয়। স্থানে স্থানে সমদ্বিবাহু ত্রিভুজের রঙিন কাগজ বা পলিমার দড়িতে ঝুলিয়ে টানানো। কোনো কোনো জায়গায় এর সাথে মরিচবাতি দেওয়া। ছবি বিক্রির দোকানের সামনে গিয়ে আমরা দাঁড়ালাম। বেশির ভাগ ছবিই হিমালয়, হিমালয়ের পাদদেশে জনজীবন, বুদ্ধদেব ও বুদ্ধচক্রের। হিমালয়ে সূর্যোদয়, পাহাড়ে চমরি গাইয়ের দল, পাহাড়ি পরিশ্রমী মানুষের ঋজু চেহারা, তাদের জীবিকার সুকঠিন সংগ্রামের ছবি। ছবি দেখে গা ছমছম করে। জনমানবহীন পাহাড়ে একজন মানুষ গবাদিপশু নিয়ে সাঁকো পার হচ্ছেন। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে চলেছেন। নিচে গভীর খাঁড়ি। পাহাড়ের দুই অংশ যুক্ত আছে একটি মোটা গাছকে শুইয়ে দিয়ে। একহারা গাছের, খুব পরিচিত গাছ হয়তো হবে না, পাহাড়ি জঙ্গলের গাছের গুঁড়ি, আবলুস গাছের মতোই অনেকটা, সেটাই সাঁকো। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সূর্যাস্তে হলদে, কমলা ও সিঁদুর রঙের ব্যবহার ছবিতে আলাদা ঔজ্জ্বল্য যোগ করেছে।

ছবিগুলোর দাম একটু বেশিই মনে হলো। দাম দিয়ে কিনলেও আপনি ঠকবেন না। কারণ একটি চিত্রকর্মের সাথে অন্যটির তফাৎ দৃশ্যমান। আমরা একটি বুদ্ধচক্র কিনলাম। কাপড়ের ওপর অঙ্কিত। দোকানি বোর্ডের শক্ত রোলের মধ্যে ছবিটি ঢুকিয়ে সুন্দর প্যাকেট করলেন। একজন শিল্পী পাশে কাজ করছিলেন। ক্যানভাসে তিনি আঠা ব্রাশ করে তাতে একটি ২০-৩০ ইঞ্চি মাপের পাতলা টিস্যুর মতো কাগজ পেস্ট করে শুকিয়ে একটি রাফ টেকচার তৈরি করেছেন আগেই। সেটার ওপরে মাউন্টেইন ট্র্যাকিংয়ের ছবি আঁকছেন।

আমরা এগিয়ে চললাম এবার অ্যারোমার দোকানে। হাতে তৈরি অনেক ধরনের সাবানের দেখা পেলাম। গন্ধও খুব ভালো, তবে দাম একটু বেশি মনে হলো। পর্যটক এলাকা বলে হয়তো দাম একটু বেশিই। গোট মিল্কের সাবান কিনালাম। গোট মিল্কের সাবানে মেঘের মতো অতিমোহনীয় পেলব ফেনা হয় অল্পতেই। পাশের দোকান থেকে সানন্দা তার বন্ধুদের জন্য হাতির দাঁতের তৈরি চাবির রিং কিনতে লাগলো। দামে সস্তা দেখে বেশ কয়েকটি চাবির রিং কিনলো সানান্দা। কারণ নেপালে আসার আগেই সবাই আবদার করেছে তাদের জন্য গিফট আনতে হবে। অনেক সময় ধরে পথে পথে আছি তাই এবার পেটে কিছু দেওয়া প্রয়োজন। ঢুকে পড়লাম কফি সপে। চলতি পথে একজন কফিশপের নাম সাজেস্ট করেছিলেন, খুঁজে পেতে একটু বেগ পেতে হলো। বাংলাদেশের টাকার চেয়ে নেপালি রুপির বিনিময় মূল্য কিছুটা কম। তাই অনেক কিছু কেনাকাটায় খুব কষ্ট মনে হয় না। নেপালি কফি, রেগুলারভাবে তৈরি করা। নেসক্যাফের মতো এত মিহি না, তলানিতেও থেকে যায়, সম্পূর্ণ দ্রবীভূত হয় না। আমার কফি শেষ করে বের হলাম আবার।  

এবারে আমরা একটি চায়ের দোকানে প্রবেশ করলাম। দোকানদার আমাদের বিভিন্ন ধরনের চায়ের সমাহার দেখালেন। লেমন টি, জিঞ্জার টি, গ্রিন টি, ইয়গি টি, হোয়াইট টি, রেগুলার টি- কি সুন্দর ফ্লেভার! আমরা বেশ কয়েক প্যাকেট কিনে  নিলাম। নেপালের পাহাড়ে উৎপন্ন সেরা চা নাকি এটাই। এবার আমরা ঘুরতে ঘুরতে আরেকটি দিকে চলে এলাম। এখানে পাব, ডান্সবার, নাইট ক্লাবের ছড়াছড়ি। সাহেব-মেমদের আনাগোনা বেশি। নানা ভাষার মানুষের উচ্ছ্বাসভরা আলোচনার টুকরো কানে আসে। জার্মান, সুইডিশ, নরওয়েজিয়ান ভাষাভাষী অনেক বেশি। এই এলাকাটি অনেক বেশি আলোকোজ্জ্বল, গানের জোর আওয়াজ ভেসে আসে বাইরেও। নেই কোন বিশৃঙ্খলা যে যার মত আনন্দ ফুর্তিতে মেতে আছে। দারিদ্র্য এবং অবকাঠামোগতভাবে আমাদের চেয়ে পিছিয়ে পড়া একটি দেশ হলেও নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীতে আমাদের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে তারা। এই শহরে পর্যটকের অভাব নেই। বিশেষ করে থামেলে তো বিদেশিই বেশি। সেই বিদেশি পর্যটকের মধ্যে তরুণী, বৃদ্ধা, সুন্দরী, অসুন্দরী সব রকম নারীই আছেন। পোশাকও তাদের বিচিত্র রকম। শর্টস, স্লিভলেসও পরছেন তারা দেদার। কিন্তু শিশু, কিশোর, তরুণ, প্রৌঢ় কোনো বয়সের কোনো অবস্থানের নেপালি পুরুষই তাদের প্রতি কটাক্ষ, ইশারা, ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য, মুগ্ধতা কিছুই প্রকাশ করছে না। তারা নির্বিকার। আমি শুধু ভাবছিলাম প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্ষতবিক্ষত একটি দেশ অথচ সেই দেশের রাজধানীতে নারীরা কত স্বাধীন, কর্মচঞ্চল। 

রাতের গভীরতা বাড়ছে আর প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরে পাচ্ছে রাতের থামেল। পরের দিন নতুন গন্তব্য পথে যেতে হবে তাই দেরি না করে আমরা ফিরে গেলাম হোটেল পানে। 

তারা//

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর আম দ র শ ষ কর স ন দর র জন য র ওপর ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

রোহিঙ্গাদের সিম দিতে চায় সরকার

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বৈধভাবে সিম পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে তাদের অনেকের কাছেই বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বিভিন্ন মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের সিম রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে নিরাপত্তা প্রশ্নে উদ্বেগ রয়েছে সরকারের। এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বৈধভাবে সিম ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবছে অন্তর্বর্তী সরকার।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসেই রোহিঙ্গাদের সিম ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে অপারেটরদের সঙ্গে বৈঠকও হয়েছে।

মিয়ানমারে অত্যাচারের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। দেশে এখন ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে। তাদের সিম ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে সেখানে অবৈধভাবে দুই দেশেরই সিম ব্যবহার হচ্ছে। রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরকেন্দ্রিক বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী অবৈধভাবে দেশি অপারেটরের সিম ব্যবহার করে এবং মিয়ানমারের সিম ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালে রোহিঙ্গাদের সিম দেওয়ার চিন্তা করে তৎকালীন সরকার। সে সময় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টেলিটক সিম ব্যবহারের আলোচনা হয়েছিল। যদিও পরে বিষয়টি আর এগোয়নি।

এখন অন্তর্বর্তী সরকার রোহিঙ্গাদের সিম দেওয়ার বিষয়ে ভাবছে। গত সোমবার বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) চার মোবাইল অপারেটরের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সিম দেওয়ার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিটিআরসি ও অপারেটর সূত্রমতে, ২৫ আগস্ট প্রধান উপদেষ্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের রোহিঙ্গা শিবিরে যাওয়ার কথা। ওই তারিখের মধ্যে প্রাথমিকভাবে কিছু সিম দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে।

যেভাবে সিম দেওয়ার ভাবনা

সিম বিক্রির বিদম্যান নীতি অনুযায়ী, ব্যক্তিকে শনাক্তকারী পরিচয়পত্র ও বায়োমেট্রিক প্রয়োজন হয়। যেহেতু রোহিঙ্গাদের সে ধরনের পরিচয়পত্র নেই, তাই তাদের সিম দেওয়ার জন্য বিকল্প উপায় ভাবা হচ্ছে। অপারেটরদের সঙ্গে আলোচনায় বলা হয়, মোবাইল অপারেটররা রোহিঙ্গাদের জন্য একটি ভিন্ন নম্বর সিরিজ রাখবে। জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) কাছে রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন নম্বর রয়েছে। যেটাকে সাধারণত ‘প্রোগ্রেস আইডি’ বলা হয়। সে আইডির বিপরীতে ১৮ বছরের বেশি বয়সীরা সিম পাবেন। ইউএনএইচসিআর সরাসরি এই সিমগুলো পাবে।

সরকারের সঙ্গে চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে ইউএনএইচসিআরের এই ডেটাবেজ সংরক্ষিত থাকবে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) ডেটা সেন্টারে। কিন্তু এই ডেটাবেজ বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শেষ হতে আগামী নভেম্বর পর্যন্ত সময় লাগবে। সূত্র বলছে, যেহেতু সরকারের লক্ষ্য চলতি মাস, তাই সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের অধীনে রোহিঙ্গাদের পাইলট প্রকল্প হিসেবে প্রথম ধাপে ২৫ আগস্টের মধ্যে ১০ হাজার নম্বর বরাদ্দ দেওয়ার আলোচনা হয়েছে।

অপারেটররা তিন ধরনের প্যাকেজ অফার করবে। এই প্যাকেজের খরচ ও সিমের দাম দেবে ইউএনএইচসিআর বা সরকার। নতুন সিম দেওয়ার পর বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে যেসব অবৈধভাবে সিম চলছে, সেগুলো বন্ধ করে দেবে সরকার।

তবে এসবই আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে বলে জানান বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের শনাক্তকরণ একটি বিষয়। এটা নিশ্চিত না হলে সিম সেখানে দেওয়া যাবে না। সরকারের দিক থেকে এই পরিচয় নিশ্চিতকরণের বিষয়টি নিয়ে কথা চলছে।

অপারেটররা যা বলছে

রোহিঙ্গাদের সিম দেওয়ার বিষয়টিকে স্বাগত জানান গ্রামীণফোনের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার (সিসিএও) তানভীর মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বৈধভাবে সিম বিক্রয়ের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই, যা বহু মানুষকে বৈধ উপায়ে সিম ক্রয়ের সুযোগ করে দেবে।’

তবে রবি আজিয়াটার চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বললেন ভিন্ন কথা। তাঁর কথায়, ‘নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সিম কর বাবদ অপারেটররা ইতিমধ্যে বড় অঙ্কের যে বিনিয়োগ এ খাতে করেছে, সেটি অকার্যকর হয়ে পড়বে।’

রোহিঙ্গাদের জন্য সিমের নিবন্ধনের প্রক্রিয়াটি সহজ করার অনুরোধ জানিয়েছেন বাংলালিংকের হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স তাইমুর রহমান। তিনি বলেন, এই অঞ্চলে মোবাইল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের সুযোগ প্রদান সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ বজায় রাখতে সহায়তা করবে।

রোহিঙ্গা শিবিরকে একটি বিশেষায়িত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে প্রযুক্তি নীতিমালা পরামর্শক আবু নাজম মো. তানভীর হোসেন বলেন, এখানে মিয়ানমারের নেটওয়ার্কও সক্রিয়। নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারকে বাইরের দেশের নেটওয়ার্ক সম্পূর্ণভাবে বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। নতুন সিম দেওয়ার আগে আগেরগুলো জব্দ ও নথিভুক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ