জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অচলাবস্থা কাটেনি। গতকাল শনিবার এনবিআরসহ দেশের সব শুল্ক-কর কার্যালয়ে দিনভর ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করা হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন শুল্ক-কর কার্যালয় থেকে মার্চ টু এনবিআর কর্মসূচিও পালিত হয়। ফলে চট্টগ্রাম বন্দর, বেনাপোল বন্দর, ঢাকা কাস্টম হাউসসহ দেশের সব কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশনে কাজ হয়নি। এতে এসব জায়গায় শুল্ক-কর আদায় কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।

এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ গতকাল দুপুরে ঘোষণা দিয়েছে, আজ রোববারও চলবে ‘শাটডাউন’ ও ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচি। সরকারের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী আন্দোলনকারীরা। তবে তাঁদের শর্ত হলো আগে এনবিআর চেয়ারম্যানকে অপসারণ করতে হবে। তাঁদের দাবি, বর্তমান এনবিআর চেয়ারম্যান রাজস্ব খাতের এ সংস্কারে তাঁদের (এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারী) উপেক্ষা করছেন। উল্টো আন্দোলনকারীদের দমন–নিপীড়ন করছেন।

এনবিআরে সংস্কার উদ্যোগ বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করে গত ১২ মের পর থেকে আন্দোলন করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ফলে সরকারের হয়ে রাজস্ব আদায়কারী সংস্থাটিতে একধরনের অচলাবস্থা চলছে। এতে সেবায় বিঘ্ন ঘটছে। ভোগান্তি হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এমন অবস্থায় শীর্ষ ১৩টি ব্যবসায়ী সংগঠনের বর্তমান ও সাবেক নেতারা গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে আলোচনার মাধ্যমে রাজস্ব খাতের সংস্কারের পক্ষে অবস্থান তুলে ধরেন। তবে এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবি সমর্থন করেন না বলে জানান তাঁরা।

রাজস্ব আদায়ের কার্যক্রমের সুবিধার্থে চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) শেষ সময়ে সাপ্তাহিক ছুটির দুটি দিন (২১ ও ২৮ জুন) এনবিআর খোলা রাখার ঘোষণা আগেই দেওয়া হয়েছিল। সে হিসেবে গতকাল ছিল অন্য কর্মদিবসের মতোই। কিন্তু সরেজমিনে দেখা যায়, গতকাল সকাল নয়টার পর থেকে এনবিআরে শাটডাউন কর্মসূচি পালন শুরু করেন আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাঁরা নিজ নিজ দপ্তর ছেড়ে প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নেন। এ সময় এনবিআরের সব ফটক বন্ধ করে দেয় এনবিআর কর্তৃপক্ষ। সারা দিন কাউকে ভবনের ভেতরে ঢুকতে দেননি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

কেউ বের হতেও পারেননি। এ কারণে দিনভর এনবিআরের সব সেবা বন্ধ ছিল। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খল রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পুরো এনবিআর প্রায় অবরুদ্ধ করে রাখেন। ছিল জলকামানসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি।

সকাল থেকে এনবিআরের ঢাকা কার্যালয়ের কর্মকর্তাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কর্মকর্তারা রাজধানীর এনবিআর ভবনের সামনে সমবেত হন। দিনভর চলে আন্দোলনকারীদের স্লোগান, চলে নেতাদের বক্তব্য। সারা দিনই এনবিআরের সামনের রাস্তায় যানজট দেখা যায়।

বেলা আড়াইটায় অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা দেয় আন্দোলনরত এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। নতুন কর্মসূচি অনুসারে, আজ এনবিআরসহ সারা দেশের শুল্ক-কর কার্যালয়ে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি চলবে। তবে আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা এ শাটডাউন কর্মসূচির বাইরে থাকবে। এ ছাড়া মার্চ টু এনবিআর কর্মসূচিও চলবে।

সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার বলেন, এনবিআরের বর্তমান চেয়ারম্যানকে দায়িত্বে রেখে সংস্কার করা সম্ভব নয়।

সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেওয়া হয়, আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব পেলে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে প্রস্তুত আছেন আন্দোলনকারীরা। আগামী মঙ্গলবার সরকার যে বৈঠকের কথা বলা হচ্ছে, সেখানেও যেতে আপত্তি নেই। কিন্তু এর আগে এনবিআর চেয়ারম্যানকে অপসারণ করতে হবে।

এদিকে গতকাল রাতে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী ১ জুলাই আমি ওঁদের (আন্দোলনকারী) সঙ্গে বৈঠকের সময় দিয়েছি। তবে শর্ত হলো আন্দোলন প্রত্যাহার করে আসতে হবে। এর আগেও যদি তাঁরা বসতে চান, আমি রাজি আছি। আমি আশা করি, তাঁদের বোধোদয় হবে। দেশের স্বার্থ তাঁদের আগে দেখতে হবে। রাজস্ব আদায় যেন বিঘ্নিত না হয়।’

এনবিআর ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে দুটি বিভাগ করে গত ১২ মে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। উদ্দেশ্য হলো করহার নির্ধারণের মতো নীতিগত কাজ এবং কর আদায়ের কাজ পৃথক রাখা। অর্থনীতিবিদ, গবেষক, ব্যবসায়ীরাও দীর্ঘদিন ধরে রাজস্ব খাত সংস্কারের কথা বলে আসছেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের একটি শর্ত ছিল, রাজস্ব নীতি ও আদায়ের কাজে আলাদা সংস্থা করা।

এনবিআরের কর্মকর্তারা দুটি বিভাগ করা নিয়ে তেমন আপত্তি করছেন না। তবে তাঁরা মূলত ওই দুই বিভাগে পদায়নের ক্ষেত্রে রাজস্ব খাতের কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার চাইছেন। সরকার উপযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগের কথা বলছে, যার মাধ্যমে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা যায়।

এনবিআর হলো দেশের সবচেয়ে বড় শুল্ক-কর আদায়কারী সংস্থা। বাজেটের ৮৮ শতাংশের বেশি রাজস্বের জোগান দেয় এনবিআর। আগামী অর্থবছরে বাজেটের ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার মধ্যে এনবিআরকে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অর্থবছরে শেষ মাসে, অর্থাৎ জুনে সবচেয়ে বেশি শুল্ক-কর আদায় হয়। গত বছর জুন মাসে ৫৮ হাজার ৩০১ কোটি টাকা আদায় করেছিল এনবিআর। জুন মাসে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার কোটি টাকা আদায় করেন শুল্ক-কর কর্মকর্তারা। এমন অবস্থায় এক দিন শুল্ক-কর আদায় কার্যক্রম বন্ধ থাকলে শত শত কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়। শুল্ক-কর কার্যালয় বন্ধ থাকলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বিঘ্নিত হয়। এ সময়ে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় শুল্ক-করের টাকা জমা হওয়াই একমাত্র ভরসা।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কর্মসূচির কারণে রাজস্ব খাতে ব্যাপক ক্ষতি হলো, যা অর্থনীতিরও ক্ষতি। কারখানায় পণ্য উৎপাদন হলেও বন্দরে গিয়ে পড়ে থাকছে। জাহাজে উঠতে পারছে না। আবার কাঁচামালসহ পণ্য আমদানি করা হলেও খালাস করা যাচ্ছে না। এতে পণ্য উৎপাদনও বিঘ্নিত হচ্ছে। তিনি বলেন, জুন মাসে রাজস্ব আদায়ের জোয়ার আসে। কিন্তু এ অচলাবস্থার ফলে রাজস্ব আদায়ের ক্ষতি পোষাবে কে?

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র কর মকর ত গতক ল করছ ন অবস থ ব যবস সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

চলতি অর্থবছরে ৫% জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস এডিবির; ৪ কারণে চাপে প্রবৃদ্ধি

চলতি অর্থবছর মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কিছুটা বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এডিবির পূর্বাভাস অনুসারে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ হতে পারে। গত অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন হলো ৪ শতাংশ।

এডিবি আরও বলেছে, তৈরি পোশাক রপ্তানি স্থিতিশীল থাকলেও রাজনৈতিক পরিবর্তন, ঘন ঘন বন্যা, শিল্প খাতে শ্রমিক অস্থিরতা এবং বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই চার কারণে প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে।

আজ মঙ্গলবার এডিবি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক (এডিও) সেপ্টেম্বর সংস্করণ প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

এডিবি আরও বলেছে, চলতি অর্থবছরে ভোগ্যব্যয় বাড়বে। কারণ, রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া আসন্ন নির্বাচনসংক্রান্ত নানা ধরনের খরচের কারণেও ভোগব্যয় বাড়াবে।

বাংলাদেশে এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর হো ইউন জিয়ং বলেন, ‘ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধিনির্ভর করবে ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা বাড়ানো, বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা এবং নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার ওপর। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের বাণিজ্যে মার্কিন শুল্কের প্রভাব এখনো স্পষ্ট নয়। দেশের ব্যাংক খাতের দুর্বলতা অব্যাহত রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য জরুরি।

এডিবির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৬ অর্থবছরের জন্য কিছু ঝুঁকি রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যসংক্রান্ত অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা এবং নীতি বাস্তবায়নের অনাগ্রহ প্রবৃদ্ধির অগ্রগতিতে বাধা হতে পারে। এ জন্য সঠিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বজায় রাখা এবং কাঠামোগত সংস্কার দ্রুততর করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ শতাংশ। এর পেছনে রয়েছে পাইকারি বাজারে সীমিত প্রতিযোগিতা, বাজার তথ্যের ঘাটতি, সরবরাহ শৃঙ্খলে বাধা এবং টাকার অবমূল্যায়ন।

এডিবি বলছে, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হবে ভোগব্যয়, যা শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ ও নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট ব্যয়ের কারণে বাড়বে। তবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি এবং বিনিয়োগকারীদের সতর্ক মনোভাব বিনিয়োগকে মন্থর করতে পারে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানির ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রতিযোগিতা বাড়ায় রপ্তানি খাত এবং এর প্রবৃদ্ধি চাপ বাড়াবে। ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে রপ্তানিকারকদের মূল্য কমাতে হতে পারে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভারতে ১৪ দিনে ২০ কোটি টাকার ইলিশ রপ্তানি
  • ১০ বছরে উৎপাদন বেড়েছে ৪৮%
  • কংগ্রেসে অর্থ বিল নাকচ, সংকটে ট্রাম্প প্রশাসন
  • দুর্গাপূজার আগে ভারতে গেল ১ লাখ ৩০ হাজার কেজি ইলিশ
  • বাজারে এখনো কদর ইনস্ট্যান্ট কফির
  • শুল্কছাড়েও দেশি বিনিয়োগ নেই কনটেইনার পরিবহন খাতে
  • বাণিজ্যিক গাড়ির বিক্রি বাড়ছে
  • চলতি অর্থবছরে ৫% জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস এডিবির; ৪ কারণে চাপে প্রবৃদ্ধি