রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে গত সোমবার বেলা সোয়া একটার দিকে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় পুরো দেশ যখন শোকাহত, তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় মুখোশধারী এক ব্যক্তির ছবি ও পোস্ট।

এই ছবি ও পোস্টের উৎস ‘অ্যানোনিমাস মেইন পেজ’ নামের একটি ফেসবুক পেজ। যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার এক দিন আগে এই পেজে একটি পোস্ট দেওয়া হয়। পোস্টে বলা হয়: ‘একটি স্কুল ভবন ধসে পড়বে, অনেক শিশু মারা যাবে…আমরা এই বিপর্যয়ের বিষয়টি আগে থেকেই জানি।’

ভাইরাল পোস্টের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে নানা জল্পনা-কল্পনা, আর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পেজটির ফলোয়ারের সংখ্যা বেড়ে হয় লাখখানেক।

সোমবার রাতে একই পেজ থেকে বাংলাদেশ নিয়ে প্রচারিত হয় বোমা হামলাসহ কয়েকটি সতর্কতামূলক পোস্ট। এই পোস্টগুলোও মুহূর্তে ভাইরাল হয়। ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এসব জল্পনা–কল্পনা ও ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সূত্র ধরে অ্যানোনিমাস মেইন পেজটি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে অনলাইন ভেরিফিকেশন ও মিডিয়া গবেষণা প্ল্যাটফর্ম—ডিসমিসল্যাব।

ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে এ পেজটি ছাড়াও আরও ২৫টি ফেসবুক পেজ পাওয়া যায়, যেগুলো থেকে বাংলাদেশের বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে একই ধরনের পোস্ট করা হয়।

ফেসবুকের পেজ ট্রান্সপারেন্সি থেকে ডিসমিসল্যাব দেখতে পায়, এসব পেজের অধিকাংশই পরিচালিত হচ্ছে নাইজেরিয়া থেকে। তবে যেসব ব্যক্তির ছবি বা ভিডিও পোস্ট করা হচ্ছে, তারা ভিনদেশি, ভাষাও ভিন্ন।

নাইজেরিয়ার প্রতারক চক্র

নেটওয়ার্কটি নিয়ে আরও অনুসন্ধান করতে গিয়ে ডিসমিসল্যাব নাইজেরিয়াভিত্তিক গণমাধ্যম ‘হিউম্যান অ্যাঙ্গেল’-এর ২০২৪ সালের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন খুঁজে পায়।

প্রতিবেদনটিতে ২৪০টি একই ধরনের ‘অ্যানোনিমাস’-পেজ বিশ্লেষণ করে বলা হয়, এগুলোর পেছনে রয়েছে নাইজেরিয়ার একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র।

নেটওয়ার্কটি আন্তর্জাতিক হ্যাকিং মুভমেন্ট ‘অ্যানোনিমাস’-এর ছদ্মবেশে নিয়মিত ভুয়া তথ্য, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও ভিত্তিহীন অনুমান ছড়িয়ে নতুন ফলোয়ার টানার চেষ্টা করে। আর পরিশেষে নিশ্চিত জয়ের প্রতিশ্রুতিতে বিক্রি করে স্পোর্টস বেটিংয়ের (জুয়া) টিকিট।

ডিসমিসল্যাব বলছে, বাংলাদেশ–সম্পর্কিত ভুয়া ভবিষ্যদ্বাণীর পোস্ট করা কিছু পেজও আছে হিউম্যান অ্যাঙ্গেলের অনুসন্ধানে নথিভুক্ত পেজগুলোর মধ্যে। অর্থাৎ এরা একই প্রতারক নেটওয়ার্কের অংশ।

হিউম্যান অ্যাঙ্গেলের প্রতিবেদন অনুসারে, নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে এ পেজগুলো নিয়মিত নানা ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, ভবিষ্যদ্বাণী ও ভুয়া হ্যাকিংয়ের ভিডিও শেয়ার করে। এরপর তারা দাবি করে, তারা এমন কিছু ‘ফিক্সড ফুটবল ম্যাচ’-এর খবর জানে, যেগুলোর ফলাফল আগেই নির্ধারিত। এবার নিশ্চিত জয়ের প্রতিশ্রুতিতে বিক্রি করা হয় স্পোর্টস বেটিংয়ের টিকিট। সাধারণত প্রতি সপ্তাহে বুধবার ও রোববার এই ম্যাচের টিকিট বিক্রি করা হয়। বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে পেজগুলো বেটিং জিতেছে—এমন ব্যক্তিদের ভুয়া রিভিউ শেয়ার করে।

হিউম্যান অ্যাঙ্গেলের বিশ্লেষণ করা ২৪০টি পেজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুসারী থাকা ২০টি পেজ যাচাই করেছে ডিসমিসল্যাব। এর মধ্যে চারটিতে বাংলাদেশ–সম্পর্কিত সেই ভুয়া ভবিষ্যদ্বাণীর পোস্টগুলো দেখতে পায় তারা। অর্থাৎ হিউম্যান অ্যাঙ্গেল যে নেটওয়ার্কটি সামনে এনেছে, সেই একই নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ নিয়েও ভুয়া সব ভবিষ্যদ্বাণী প্রচার করেছে।

ভুয়া তথ্য ছড়ানো ছদ্মবেশী ‘অ্যানোনিমাস’

ডিসমিসল্যাব দেখতে পেয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গত ২১ জুলাই প্রথম ‘অ্যানোনিমাস মেইন পেজ’ থেকে একটি পোস্ট ছড়াতে শুরু করে। পোস্টটি করা হয়েছিল উত্তরায় বিমান দুর্ঘটনার এক দিন আগে, ২০ জুলাই।

২১ জুলাই রাত সাড়ে ৮টা থেকে রাত ১১টার মধ্যে মাত্র আড়াই ঘণ্টার ব্যবধানে পেজটির অনুসারীর সংখ্যা ২ লাখ ২০ হাজার থেকে ৩ লাখ ২০ হাজারের ওপরে পৌঁছে যায়। পেজটি থেকে অ্যানোনিমাস আর্কিটেক্ট, অ্যানোনিমাস ওয়েব, অ্যানোনিমাস অ্যাঞ্জেলস ও অ্যানোনিমাস গোস্ট ইত্যাদি কাছাকাছি নামের আরও কয়েকটি পেজ শেয়ার ও ট্যাগ করা হয়। সবগুলো প্রোফাইল ঘুরেই একই ধরনের পোস্ট দেখতে পাওয়া যায়। মূলত এই পাঁচটি পেজের পোস্টই সবচেয়ে বেশি শেয়ার হতে থাকে।

ডিসমিসল্যাব দেখেছে, ২১ জুলাই যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের পর বাংলাদেশ নিয়ে পেজগুলো থেকে একাধিক পোস্ট দেওয়া হয়। পোস্টে বারবার নিজেদের ‘অ্যানোনিমাস’ পরিচয় তুলে ধরে চক্রটি।

বাংলাদেশসংক্রান্ত পোস্টের কি-ওয়ার্ড সার্চ করে হুবহু একই পোস্ট করা আরও অন্তত ২০টি পেজ খুঁজে পায় ডিসমিসল্যাব। তারা বলছে, এ বিষয়টি পেজগুলোর মধ্যে একটি সমন্বিত নেটওয়ার্কের ইঙ্গিত দেয়। এই নেটওয়ার্কের পেজগুলোর নাম ঘুরেফিরে প্রায় একই ধরনের। যেমন অ্যানোনিমাস রিজিয়ন, লর্ডস অব অ্যানোনিমাস, অ্যানোনিমাস লিজনিস্ট, ডার্ক ওয়েব অ্যানোনিমাস, অ্যানোনিমাস কালেকটিভ ইত্যাদি।

ডিসমিসল্যাব বলছে, অধিকাংশ পেজই তৈরি হয়েছে ২০২২ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে। আর তাদের ফলোয়ারের সংখ্যা কয়েক শ থেকে শুরু করে কয়েক লাখ পর্যন্ত। বেশির ভাগ পেজের অ্যাডমিন লোকেশন নাইজেরিয়া, যদিও কয়েকজনের লোকেশন দেখা যায়নি। আবার কিছু ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সাইপ্রাস, যুক্তরাজ্য বা অস্ট্রেলিয়ার ঠিকানাও দেখিয়েছে। সব মিলিয়ে এসব নাম, লোকেশন ও পোস্টের ধরন থেকে বোঝা যায়, এগুলো একে অন্যের ক্লোন বা একই প্রতারণামূলক নেটওয়ার্কের অংশ।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন টওয় র ক র একই ধরন র প স ট কর ন ইজ র য় ফ সব ক র একট একই প

এছাড়াও পড়ুন:

তদবিরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি, ষড়যন্ত্রকারীরা আমার পেছনে লেগেছে: তথ্য উপদেষ্টা

তদবিরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় একটি মহল তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে বলে দাবি করেছেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম।

নিজের বিরুদ্ধে ওঠা তদবির ও লবিংয়ের অভিযোগ নিয়ে সোমবার (২৮ জুলাই) রাত ৩টার দিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “আজকাল অনেকের লেজ কাটা যাচ্ছে বলে, আমার বিরুদ্ধে লেগেছেন।” 

তথ্য উপদেষ্টা দাবি করেন,  তিনি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে কোনো আপস করেননি এবং প্রস্তাব পেয়ে স্পষ্টভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।

আরো পড়ুন:

গোপালগঞ্জে সামরিক অভিযানের ভিডিওটি ভুয়া: বাংলা ফ্যাক্ট

ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন ঢাবি অধ্যাপক

তিনি লেখেন,  “তদবিরের কথা উঠলো যখন, একটা ঘটনা বলি। আমাদের এক বন্ধু একজন ব্যক্তিকে আমার ভাইয়ার সাথে দেখা করায়। বিটিভির একটা টেন্ডারের কাজ করে দিলে তারা পার্সেন্টেজ দিবে এবং জুলাই নিয়ে কয়েকটা দেশে প্রোগ্রামের জন্য হেল্প করবে। আমি জানার পর এটা নিষেধ করে দেই। সদুদ্দেশ্যে হলেও রাষ্ট্রের আমানতের খেয়ানত করা যাবে না। পরবর্তীতে সে টেন্ডারের কাজ ও স্থগিত হয়।”

“সে ব্যক্তি কনভার্সেশন রেকর্ড করে একজন সাংবাদিককে পাঠায়। সে সাংবাদিক যোগাযোগ করলে আমি বলে দিই, ভাই আমরা একাজ করতে দেইনি। আর,  ওই লোক ফাঁসানোর উদ্দেশ্যেই জুলাইয়ের প্রোগ্রামের কথা বলে একাজ করেছে। উনি আমার কথা বিশ্বাস করে আর রেকর্ডটি পাবলিক করেননি। ”

তিনি বলেন, “আজকাল অনেকের লেজকাটা যাচ্ছে বলে, আমার বিরুদ্ধে লেগেছেন। বিভিন্ন দলের কয়েকজন মহারথী এতে জড়িত। সব ষড়যন্ত্রই প্রকাশ পাবে।” প্রথমে নতুন দলের কয়েকজন মহারথী জড়িত লিখলেও কিছুক্ষণ পর তা পরিবর্তন করে  বিভিন্ন দলের লেখেন। 

তিনি আরো লেখেন, “পুনশ্চঃ আমার নিকৃষ্ট শত্রুরাও গত ১২ মাসে আমার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ করলেও দুর্নীতি বা আর্থিক অসঙ্গতির অভিযোগ করেনি। বিভিন্ন দলের মহারথীদের অনেক অসুবিধা হচ্ছে তাতে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব পবিত্র আমানত। হাজারকোটি টাকার চাইতেও ইজ্জত ও রাষ্ট্রের আমানত আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।” 

সংশোধনের বিষয়ে তিনি লেখেন, “বিঃদ্রঃ কয়েকটা বাক্য নিয়ে অযথাই জলঘোলা হচ্ছে, তাই এডিট করে দিলাম। জুলাই কতিপয় লোকের কাছে পলিটিকাল মবিলিটির ল্যডার।একটা না কয়েকটা দলের মহারথীরাই আমার/আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করছেন। কিন্তু, সবার এখন গুজববাজ আর সুবিধাবাদী বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকা দরকার।” 

ঢাকা/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভেনেজুয়েলায় নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে বিরোধীদের প্রতিরোধের ডাক
  • মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ নারীকে হত্যায় বিএনপি নেতা গ্রেপ্তার, পরিবার বলছে ষড়যন্ত্র
  • তদবিরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি, ষড়যন্ত্রকারীরা আমার পেছনে লেগেছে: তথ্য উপদেষ্টা
  • মানবাধিকার লঙ্ঘন না হলে জাতিসংঘের দপ্তরে আপত্তি কেন
  • ফিক্সিং, বিদ্রোহ এবং ষড়যন্ত্রে ভরা ড্রেসিংরুম: পাকিস্তান ক্রিকেটের অস্থির অধ্যায়