২৯ জুলাই ১৮৮৩, ইতালির এক নিভৃত গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন এমন একজন, যাঁর নাম একসময় সারা ইউরোপের রাজনীতিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। বেনিতো মুসোলিনি শুধু ইতালিরই প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না, ফ্যাসিবাদ নামের এক ভয়াল রাজনৈতিক মতবাদের প্রথম রাষ্ট্রীয় রূপদাতা হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন।

বিংশ শতাব্দীর শুরুর উত্তাল সময় মুসোলিনি ইউরোপীয় রাজনীতির এক প্রভাবশালী ও বিতর্কিত চরিত্রে পরিণত হন। যুদ্ধ, একনায়কতন্ত্র, দমন–পীড়ন আর জাতীয়তাবাদে মোড়া তাঁর শাসনব্যবস্থা ইতালিকে যেমন এক নতুন মোড়ে দাঁড় করিয়েছিল, তেমনই বিশ্বরাজনীতিতে এক ভয়ংকর দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছিল।

ইতালির ছোট্ট শহর প্রেদাপ্পিওতে জন্ম নেওয়া এ মানুষটির জন্মদিনে ফিরে দেখা জরুরি, কীভাবে একজন শিক্ষক হয়ে উঠেছিলেন ইতিহাসের অন্যতম ভয়ংকর একনায়ক। তাঁর উত্থান–পতনের গল্প শুধু এক ব্যক্তির নয়, একটি গোটা সমাজ তথা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিবর্তনেরই কাহিনি।

কৃষকের ঘর থেকে রাজনীতির কেন্দ্রে

বেনিতো আমিলকারে আন্দ্রেয়া মুসোলিনি জন্ম নিয়েছিলেন ইতালির উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় প্রেদাপ্পিও শহরের ডোভিয়া এলাকার এক দরিদ্র পরিবারে। বাবা ছিলেন সমাজতন্ত্রী মনোভাবাপন্ন এক কামার, আর মা ছিলেন একজন শিক্ষক। বাবা অ্যান্ড্রেয়া ছেলেকে ছোটবেলা থেকেই রাজনীতি ও বিপ্লবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। নামের মধ্যেই এর ছাপ ছিল। ‘বেনিতো’ নামটি রাখা হয় মেক্সিকোর বিপ্লবী নেতা বেনিতো জুয়ারেজের অনুপ্রেরণায়।

ছোটবেলা থেকেই বেনিতো ছিলেন খ্যাপাটে স্বভাবের, রগচটা ও অগাধ আত্মবিশ্বাসী। পড়াশোনায় মাঝারি হলেও ভাষা আর বক্তৃতায় তাঁর দখল ছিল ঈর্ষণীয়। কিশোর বয়সে তিনি সমাজতন্ত্রী রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং সাংবাদিকতা শুরু করেন স্থানীয় পত্রিকাগুলোয়।

ছোটবেলা থেকেই বেনিতো ছিলেন খ্যাপাটে স্বভাবের, রগচটা ও অগাধ আত্মবিশ্বাসী। পড়াশোনায় মাঝারি হলেও ভাষা আর বক্তৃতায় তাঁর দখল ছিল ঈর্ষণীয়। মাত্র ১০ বছর বয়সে এক সহপাঠীকে ছুরি মারার ঘটনায় স্কুল থেকে বহিষ্কার হন মুসোলিনি।

তবুও ১৮ বছর বয়সে শিক্ষকতার যোগ্যতা অর্জন করে কিছুদিন স্কুলে পড়ান মুসোলিনি। কিন্তু সেই পেশাগত স্থিরতা তাঁর বিপ্লবী চেতনায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পরে রাজনীতির উত্তাল আবহ তাঁকে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে যুক্ত করে। পাশাপাশি সাংবাদিকতা শুরু করেন স্থানীয় পত্রিকাগুলোয়।

সমাজতন্ত্র থেকে ফ্যাসিবাদে যাত্রা

মুসোলিনি শুধু রাজনীতিবিদ নন, ছিলেন এক অসাধারণ লেখক ও সাংবাদিক। সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা ছড়িয়ে দিতে তিনি লেখালেখি শুরু করেন। ১৯১১ সালে তিনি ‘আভান্তি!’ নামে মিলানের এক সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার পত্রিকার সম্পাদক হন। এ সময় তিনি জোরালোভাবে শ্রেণিসংগ্রাম ও শ্রমিক অধিকারের পক্ষে অবস্থান নেন।

কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে নাটকীয় পরিবর্তন আসে। তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে ইতালির পুনরুজ্জীবনের জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা জরুরি। এই মতের কারণে তাঁকে সমাজতান্ত্রিক দল থেকে বহিষ্কার করা হয় (১৯১৪ সাল)।

এ সিদ্ধান্তই মুসোলিনির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সমাজতন্ত্র থেকে সরে এসে তিনি নতুন জাতীয়তাবাদী ও যুদ্ধপন্থী মতবাদের দিকে ঝোঁকেন, যা ভবিষ্যতের ফ্যাসিবাদের ভিত্তি গড়ে দেয়।

১৯১৯ সালে বেনিতো মুসোলিনি প্রতিষ্ঠা করেন উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সশস্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন ‘ফ্যাসিও দি কমবাত্তিমেন্তো’। পরে জাতীয় ফ্যাসিবাদী দলে (ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টি বা পিএনএফ) পরিণত হয় এটি। দলের সদস্যদের পরনে ছিল কালো শার্ট, হাতে লাঠি আর মুখে জাতীয় শৃঙ্খলার কথা।

এই ব্ল্যাক শার্টধারীরা বামপন্থী আন্দোলন ও শ্রমিক সংগঠনের বিরুদ্ধে সরাসরি সহিংসতা চালাতেন। গণতন্ত্রকে দুর্বল বলে তাঁরা জাতীয় ঐক্য ও শৃঙ্খলার নামে শাসন প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন। তাঁদের মূল কৌশল ছিল—ভয় দেখানো, মারধর ও হত্যা। একরকম সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে তাঁরা ইতালির রাজনীতিতে ফ্যাসিজমের জন্ম দেন।

মুসোলিনি একটি ‘করপোরেট রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যস্থতায় সব অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। তবে বাস্তবে এ নীতির আড়ালে ছিল সরকারি দমন, বিধিনিষেধ ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার আয়োজন।

১৯২২ সালের অক্টোবরে মুসোলিনি প্রায় ৩০ হাজার ব্ল্যাক শার্টধারী নিয়ে ‘মার্চ অন রোম’ নামের এক বিক্ষোভ শুরু করেন। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে ইতালির রাজা ভিক্টর ইমানুয়েল তৃতীয় সামরিক হস্তক্ষেপ না করে মুসোলিনিকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানান।

এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়েই শেষ হয় ইতালির গণতন্ত্রের অধ্যায়। শুরু হয় একনায়কত্বের যাত্রা। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিলেও দ্রুতই মুসোলিনি নিজের হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩৯ বছর।

একনায়কতন্ত্র কায়েম

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মুসোলিনি দ্রুত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেন। ১৯২৫ সালের পর থেকে তিনি নিজেকে ‘ইল দুচে’ অর্থাৎ ‘দ্য লিডার (নেতা)’ বলে অভিহিত করতে থাকেন। এ পর্যায়ে এসে পার্লামেন্টের ক্ষমতা খর্ব করেন, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেন, গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে আনেন ও বিরোধীদের নির্যাতন–নিপীড়ন শুরু করেন।

এভাবে মুসোলিনি একটি ‘করপোরেট রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যস্থতায় সব অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। তবে বাস্তবে এ নীতির আড়ালে ছিল সরকারি দমন, বিধিনিষেধ ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার আয়োজন।

মুসোলিনির শাসনব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল রাষ্ট্রীয় প্রোপাগান্ডা। শিশুদের জন্য ফ্যাসিবাদী আদর্শে গড়া স্কুল, যুবকদের জন্য মিলিশিয়া আর সংবাদমাধ্যমের জন্য সরকারের গাইডলাইন—সবই ছিল একনায়কের বন্দনায় নিবেদিত। নিজেকে ‘রোমান সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি’ হিসেবে তুলে ধরে তিনি ইতালির জাতীয়তাবাদকে উসকে দেন।

মুসোলিনির এই ফ্যাসিবাদী শাসন ইউরোপের বাক্‌স্বাধীনতার ওপরে ছিল প্রথম বড় আঘাত।

যুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা

মুসোলিনির নেতৃত্বে ইতালি ১৯৩০–এর দশকে আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠে। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই তাঁর সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিচয় দেন। ১৯৩৫ সালে তিনি আবিসিনিয়া (বর্তমান ইথিওপিয়া) আক্রমণ করে জয় করেন এবং জাতিপুঞ্জের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আগ্রাসন চালিয়ে যান।

মুসোলিনির শাসনব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল রাষ্ট্রীয় প্রোপাগান্ডা। শিশুদের জন্য ফ্যাসিবাদী আদর্শে গড়া স্কুল, যুবকদের জন্য মিলিশিয়া আর সংবাদমাধ্যমের জন্য সরকারের গাইডলাইন—সবই ছিল একনায়কের বন্দনায় নিবেদিত। নিজেকে ‘রোমান সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি’ হিসেবে তুলে ধরে তিনি ইতালির জাতীয়তাবাদকে উসকে দেন।

স্পেনের গৃহযুদ্ধে ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিবাদী বাহিনীকেও সমর্থন দেন মুসোলিনি। ধীরে ধীরে তাঁর আদর্শ নাৎসি জার্মানির হিটলারের সঙ্গে মিলতে শুরু করে। ১৯৩৯ সালে হিটলারের সঙ্গে ‘প্যাক্ট অব স্টিল’ নামের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে ইতালিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানির আনুষ্ঠানিক মিত্র করে তোলেন তিনি।

আদর্শিকভাবে নাৎসিবাদের সঙ্গে মুসোলিনির ফ্যাসিবাদের কিছু পার্থক্য থাকলেও উভয় শাসকই কর্তৃত্ববাদ, জাতীয়তাবাদ ও সহিংসতা ব্যবহার করে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।

হিটলার ও মুসোলিনির জোট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুনে ঘি ঢালার কাজ করে।

পতনের শুরু ও করুণ পরিণতি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানির পক্ষে অবস্থান নেওয়া মুসোলিনির জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হয়ে ওঠে। ১৯৪৩ সালে মিত্রবাহিনীর আক্রমণে ইতালির বিভিন্ন এলাকা হাতছাড়া হতে শুরু করে। ইতালির জনগণ ফ্যাসিবাদের প্রতি আস্থা হারান।

মুসোলিনিকে ইতালির রাজার পক্ষ থেকে বরখাস্ত ও গ্রেপ্তার করা হয়। পরে হিটলারের নাৎসি বাহিনী তাঁকে মুক্ত করে পুতুল রাষ্ট্র ‘সলো প্রজাতন্ত্র’ গঠনের পর এর প্রধান বানায়। তবে এ পুতুল রাষ্ট্র স্থায়ী হয়নি।

১৯৪৫ সালের এপ্রিলে মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রার মুখে পালানোর চেষ্টা করেন মুসোলিনি। কিন্তু লাভ হয়নি। লোম্বার্দি অঞ্চলে পার্বত্য পথে পালানোর সময় প্রতিরোধ যোদ্ধারা তাঁকে আটক করেন। ২৮ এপ্রিল প্রেমিকা ক্লারা পেতাচ্চির সঙ্গে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

পরদিন মুসোলিনি ও তাঁর প্রেমিকার মরদেহ মিলান শহরের পিয়াতসালে লোরেতো চত্বরে উল্টো করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এ দৃশ্য একই সঙ্গে যেমন প্রতীকী বিদ্রোহ ও ঘৃণা, তেমনই ইতিহাসের এক নিষ্ঠুরতম রাজনৈতিক সমাপ্তির প্রতীক হয়ে রয়েছে।

বিতর্কিত উত্তরাধিকার

মুসোলিনির উত্তরাধিকার অর্থাৎ তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ, শাসনব্যবস্থা ও ইতালির ইতিহাস ও সমাজে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আজও বিতর্কিত হয়ে আছে। অনেকে তাঁকে আধুনিক ইতালির একজন দৃঢ় নেতৃত্বের নির্মাতা বলে দেখেন। আবার অনেকে মনে করেন, তিনি ছিলেন ইতিহাসের এক ভয়ংকর একনায়ক; যাঁর ভুল সিদ্ধান্তে ইতালিকে ধ্বংসের মুখোমুখি হতে হয়েছিল।

ইতালিতে এখনো কিছু চরম ডানপন্থী দল মুসোলিনির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়। বিশেষ করে তাঁর নাতনি আলেসান্দ্রা মুসোলিনি একসময় ইউরোপীয় পার্লামেন্টে নির্বাচিত হন ডানপন্থী দল থেকে।

ফ্যাসিবাদ: ইতিহাসের শিক্ষা

ফ্যাসিবাদ শুধু একটি রাজনৈতিক মতবাদ নয়। এটি একটি সামাজিক প্রকল্প, যেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, গণতান্ত্রিক চর্চা—সবকিছুই রাষ্ট্রের পূজায় বলি দেওয়া হয়। মুসোলিনি এ মতাদর্শকে নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন।

ইতিহাসের শিক্ষা বলছে, নেতার অন্ধ অনুসরণ, যুদ্ধ ও জাতীয়তাবাদের নামে মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ কখনো একটি জাতিকে উন্নতির পথে নিতে পারে না; বরং তা এগিয়ে নিয়ে যায় ধ্বংসের দিকেই।

{তথ্যসূত্র: দ্য ডকট্রিন অব ফ্যাসিজম, বেনিতো মুসোলিনি; রিচার্ড বসওয়ার্থ, মুসোলিনি: আ বায়োগ্রাফি; ক্রিস্টোফার হিবার্ট, মুসোলিনি: দ্য রাইজ অ্যান্ড ফল অব ইল দুচ; বিবিসি হিস্ট্রি; এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা}

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ সনব যবস থ র র জন ত ক র জন ত র দ র জন য র বয়স সরক র প রথম আদর শ ইউর প

এছাড়াও পড়ুন:

৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে

বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।

আরো পড়ুন:

ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০

বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী

প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন। 

দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।

হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী। 

থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”

 

শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।

লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।

স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, ‍“হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”

রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?” 

থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”

তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”

বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”

ঢাকা/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ২৬ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার: জাতিসংঘ
  • গ্রাহকের কাছে পেয়ারা খেতে চায় জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা
  • গল্পটা এই ক্লাসরুম থেকেই শুরু: ইরফান সাজ্জাদ
  • রাশিয়ায় এক বাঙালি বিপ্লবীর খোঁজে
  • আপনার এত সাহস হয় কী করে, সাংবাদিককে নায়িকা
  • দুবাইয়ে বিকৃত যৌন ব্যবসা চক্রের প্রধানকে চিহ্নিত করল বিবিসির এক অনুসন্ধান
  • মহানবী (সা.)–এর ইন্তেকালের পরে শাসন নিয়ে যা ঘটেছে
  • কুবিতে নতুন ১৮ বিভাগ ও ৪ ইনস্টিটিউট চালুর সুপারিশ
  • সংগীতশিল্পী দীপ মারা গেছেন
  • ৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে