‘শূন্য’ রিটার্ন দিলে ৫ বছর পর্যন্ত জেল: এনবিআর
Published: 10th, August 2025 GMT
করদাতারা শূন্য রিটার্ন জমা দিলে তা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এ জন্য করদাতার ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান আছে।
আজ রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ১ জুলাই থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ব্যক্তিশ্রেণির করদাতারা বার্ষিক আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন জমা দেন। সেখানে সারা বছরের আয়-ব্যয়ের তথ্য দিতে হয়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এনবিআর বলেছে, করদাতার প্রকৃত আয়, ব্যয়, সম্পদ ও দায় প্রদর্শন না করে এর কোনো একটি শূন্য অথবা সব কটি তথ্য শূন্য হিসেবে প্রদর্শন করা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ। করদাতার জমা দেওয়া আয়কর রিটার্নে তাঁর আয়, ব্যয়, সম্পদ ও দায়–সম্পর্কিত সঠিক তথ্য প্রদর্শন না করে মিথ্যা বা অসত্য তথ্য প্রদান করলে বর্তমান আয়কর আইনের ৩১২ ও ৩১৩ ধারা অনুসারে করদাতাকে ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড প্রদানের বিধান রয়েছে।
এনবিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘জিরো রিটার্ন’ দাখিল–বিষয়ক কতিপয় ভ্রান্ত ধারণাপ্রসূত পোস্ট এনবিআরের নজরে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এসব পোস্টে রিটার্ন ফরমের সব কটি ঘর ‘শূন্য’ হিসেবে পূরণ করে রিটার্ন জমা দেওয়া যায় বলে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করা হচ্ছে। এসব ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে কোনো কোনো করদাতা তাঁদের আয়কর রিটার্নে আয়, ব্যয়, সম্পদ ও দায়ের বিষয়ে অসত্য ঘোষণা প্রদান করে আসছেন, এমন জানা যায়।
এনবিআর আরও বলেছে, আয়কর আইন অনুসারে ‘জিরো রিটার্ন’ নামে কোনো প্রকার রিটার্ন দাখিলের বিধান নেই। আয়কর আইন অনুসারে একজন করদাতাকে তাঁর প্রকৃত আয়, ব্যয়, সম্পদ ও দায় অবশ্যই সঠিকভাবে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করতে হবে।
এনবিআরের মতে, একজন করদাতার আয়, ব্যয়, সম্পদ বা দায়সংক্রান্ত বিষয়ে রিটার্নে সঠিক ঘোষণা প্রদান করা একজন করদাতার নাগরিক ও আইনি দায়িত্ব। করদাতার প্রকৃত আয়ের পরিমাণ আইনানুযায়ী করযোগ্য না হলে তাঁকে কোনো কর পরিশোধ করতে হবে না। তবে কর প্রদেয় না হলেও সঠিক তথ্য-উপাত্ত প্রদর্শন না করে শূন্য আয়, ব্যয়, সম্পদ ও দায় দেখিয়ে জিরো রিটার্ন দাখিল করার কোনো সুযোগ আয়কর আইনে নেই।
এনবিআর বলেছে, সব করদাতা দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আয়কর রিটার্নে প্রকৃত আয়, ব্যয়, সম্পদ ও দায় প্রদর্শন করে দেশের উন্নয়নে গর্বিত অংশীদার হবেন। একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত প্রতারণামূলক জিরো রিটার্নের ফাঁদে পা না দিয়ে নিজেকে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড থেকে সুরক্ষিত রাখবেন।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরের ১৭ লাখের মতো করদাতা অনলাইনে রিটার্ন দেন। তাঁদের মধ্যে ৭০ শতাংশ করদাতা কোনো কর দেননি। তবে রিটার্ন দিয়েছেন।
বর্তমানে ১ কোটি ১২ লাখ কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) আছেন। তাঁদের মধ্যে বছরে ৪০ লাখের মতো করদাতা রিটার্ন দেন। চলতি অর্থবছর থেকে সব করদাতাকে অনলাইনে রিটার্ন জমা দিতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আয়কর র ট র ন আয়কর আইন কর র ট র ন করদ ত র এনব আর
এছাড়াও পড়ুন:
এ গ্যাদা, এবার আমার সিরিয়াল
সপ্তাহের রোববার ও বুধবার আমাদের স্কুলের মাঠে হাট বসে। দুপুর গড়িয়ে গেলেই শুরু হতো কাঁচা বাজারের ব্যবসায়ীদের হাঁকডাক। সময়ের সঙ্গে স্কুল মাঠে ব্যস্ততা বাড়ত। দুই হাটের দিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত পাঠদান চলত। জানুয়ারি মাসের এমন এক রোববারের হাটের দিন আমার জীবনের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হলো।
মাত্র কদিন হলো উচ্চমাধ্যমিকের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পা রেখেছি। পাঠ্যবই, শিক্ষকদের নিয়ে নতুন কৌতূহল। নতুন বইয়ের গন্ধ তখনো মনোমুগ্ধকর। এমন এক সকালে আমাদের গণিত শিক্ষক ইয়াকুব আলী স্যার হঠাৎ এলেন ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের ক্লাস নিতে। উত্তম কুমার স্যার সেদিন আসেননি। যে কারণে ইয়াকুব স্যারের আগমন। এখন মনে পড়লে বুঝি, ভাগ্যিস সেদিন উত্তম স্যার আসেননি। কেন সেই ঘটনা বলছি।
ইয়াকুব স্যার এসেই জানতে চাইলেন, ‘আজকে রুটিনে কী পড়ানো হবে?’ আমরা সবাই একসঙ্গে বলে উঠলাম, স্যার, আজ প্যারাগ্রাফ পড়ানোর দিন। সিলেবাসে অনুযায়ী সেদিন ছিল ‘দ্য নিউজপেপার’ প্যারাগ্রাফ বা অনুচ্ছেদ। স্যার শুরুতেই বললেন, ‘তোমরা কে কে খবরের কাগজ পড়ো?’ দেখা গেল একজন বাদে সবাই না সূচক মাথা নাড়ল। পত্রিকা, আমাদের বাজারের বেশ কয়েকজনকে মাঝেমধ্যে পড়তে দেখলেও তখনো আমি কোনো পত্রিকা সেই অর্থে পড়িনি। অতটা গুরুত্ব দিইনি। কখনো পত্রিকায় নায়িকাদের ছবি ছাপা হলে সেটা দেখতাম, এই যা। পারিবারিকভাবেও পত্রিকা পড়ার চল খুব একটা ছিল না। সময়টা ২০০০ সাল।
তখন স্যার পত্রিকা পড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে বললেন। কেন জীবনে বড় হওয়ার জন্য নিয়মিত পত্রিকা পড়া দরকার, সেটা বোঝালেন। জীবনের ভালো কিছু করার কৌতূহল ছিল। যে কারণে আমার কাছে সেদিনই মনে হলো পত্রিকা তাহলে পড়তে হবে। এবার স্যার জানালেন, পারলে প্রথম আলো পত্রিকা পড়তে পারো। এই পত্রিকায় দেশ–বিদেশের সবচেয়ে ভালো, নির্ভরযোগ্য খবর ছাপায়। সেই প্রথম শুনলাম প্রথম আলো পত্রিকার নাম। অজপাড়াগাঁয়ের কে এই পত্রিকাটি পড়েন, খোঁজা শুরু করি।
আমার গ্রামের বাড়ি পাবনা জেলার আটঘড়িয়া থানার একদন্ত বাড়ইপাড়া গ্রামে। আমার স্কুলের নাম আশরাফ উচ্চবিদ্যালয়। শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে। যেতে হয় বেশির ভাগ কাঁচা পথ পেরিয়ে। সেই শহর থেকে একজন বয়স্ক হকার সাইকেল চালিয়ে আসতেন গ্রামে পত্রিকা দিতে। বিভিন্ন এলাকায় পত্রিকা দিয়ে বিকেল চারটার দিকে আসতেন আমাদের শিবপুর বাজারে। সেখানে বেশির ভাগই চলত করতোয়া নামে একটি পত্রিকা। কিন্তু প্রথম আলো তখনো কেউ রাখেন না। অবশেষে সেই হকারের কাছে একদিন জানতে চাইলাম, প্রথম আলো পত্রিকা কে রাখেন? শুনে বেশ অবাক হয়ে গেলেন। জানতে চাইলেন, ‘তুমি প্রথম আলো পড়তে চাও।’ আমি তাঁকে আগ্রহের কথা জানালাম। তিনি আমাকে পত্রিকার একটি কপি হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটাই প্রথম আলো। তুমি পড়তে থাকো। আর আমার সাইকেল দেখে রেখো। আমি বিএসসি স্যারকে একটি পত্রিকা দিয়ে আসি।’ শাহাবুদ্দিন বিএসসি স্যার আমাদের গণিতের শিক্ষক ছিলেন। তিনিও পাবনার আঞ্চলিক একটি পত্রিকা পড়তেন। নাম আজ আর মনে নেই।
সেই প্রথম আমার প্রথম আলো পত্রিকা দেখা ও পড়া। তারপর হকারের সঙ্গে বেশ খাতির জমে গেল। কিন্তু সমস্যা একটাই, পত্রিকাটি পড়ার জন্য ১০ মিনিট সময় পাওয়া যায়। এতে মন ভরে না। এর মধ্যেই একদিন খুশির খবর শোনালেন। জানালেন, আমাদের বাজারের এক পাশে এখন থেকে নিয়মিত প্রথম আলো পত্রিকা রাখা হচ্ছে। কোনো একটি উদ্যোগে সেখানে বেশ কটি পত্রিকা রাখা হতো। হাতের কাছে প্রথম আলো পাওয়া যাবে ভেবে মনটা আনন্দ নেচে উঠল।
আমাদের বাজারের ইছামতি নদী ঘেঁষে একটি ছোট দোকানের পাশে পত্রিকা পড়ার ব্যবস্থা হলো। সেখানে নিয়মিত পত্রিকা দেখি। কিন্তু সমস্যা একটাই। আমি ছিলাম পত্রিকা পড়ার দলে বলা যায় সবার ছোট। যে কারণে প্রথম আলো হাতে নিলেই দেখা যেত বয়সে বড়রা এসে বলতেন, ‘প্রথম আলোটা কার কাছে দেখি’—এই বলে নিয়ে নিতেন।
একসময় প্রথম আলো পড়াটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। কিন্তু সিরিয়াল ধরে পড়ার সময় মেলানো কঠিন হয়ে যায়। কারণ, চারটার পরে পত্রিকা দিয়ে যেতেন। সেই সময়ে অনেকেই আমার মতো অপেক্ষায় বসে থাকতেন। অপেক্ষায় থাকতে হতো কখন আমার পত্রিকা পড়ার পালা আসে। এভাবে কখনো কখনো সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। তখনো ছোট দেখে অনেকে বলতেন, ‘গ্যাদা, বাড়ি যাও। রাত হয়ে গেছে।’ সবাই জানত আমাদের বাড়ি অনেকটা দূরে। ঝোপঝাড় পেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আমার কাছে এটাই মনে হতো, পত্রিকা আমাকে পড়তেই হবে। প্রথম আলো না পড়লে আমি জীবনে বড় কিছু হতে পারব না।
যে কারণে ভয় উপেক্ষা করে কখনো কখনো সন্ধ্যার পরও অপেক্ষা করতাম পত্রিকা পড়তে। তারপরই পথচারি খুঁজে তার পিছু নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটতাম। কখনো কাউকে না পেলে ভয় নিয়ে বাড়ি ফিরতে হতো। তখন বাড়ি এসে লবণ দিয়ে পানি খেয়েছি এমন ঘটনাও বহুবার ঘটেছে। বাজারে বাবার দোকান ছিল, কখনো বাবার সঙ্গেও আসা হতো। কিন্তু বাবার সঙ্গে আসার অপেক্ষায় থাকলে অনেক রাত হতো। যে কারণে বহুবার পত্রিকা পড়ার জন্য সিরিয়াল ব্রেক করেছি। দেখা গেল কেউ একজন পড়া শেষ করলেই দ্রুত প্রথম আলো হাতে নিয়ে পড়া শুরু করতাম। তবে বেশির ভাগই শুনতে হতো, ‘এ গ্যাদা, এবার আমার সিরিয়াল।’ তখন মুখ কালো করে পত্রিকাটি দিয়ে দিতে হতো। প্রথম আলোর শুরু থেকে সবচেয়ে ভালো লাগত তারকাখচিত বিনোদন পাতা। এখন ভাবতে বেশ গর্ব লাগে। সেই বিনোদন পাতার একজন কর্মী আমি।
মো. মনজুরুল আলম, নিজস্ব প্রতিবেদক, কালচার অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট