মার্কিন শুল্কনীতি: যে ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ আমাদের মাথায় নিতেই হবে
Published: 15th, August 2025 GMT
বর্তমান আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক এখন একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে গেছে। বিশ্ববাণিজ্যে প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম। তারা কেবল শুল্কহার বা বাণিজ্যচুক্তির মাধ্যমেই নয়, বরং ভূরাজনৈতিক কৌশল ও প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমেও বৈশ্বিক অর্থনীতির গতিপথ নির্ধারণ করছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রভাব সব সময় অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন নয়; এর পেছনে রাজনৈতিক অগ্রাধিকার, কৌশলগত জোট এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জটিল সমীকরণও কাজ করে।
ভারতের সংবাদ মাধ্যম দ্য হিন্দুতে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি সব সময় বাণিজ্যঘাটতির ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় না; বরং রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দ ও কূটনৈতিক অগ্রাধিকারই প্রভাব ফেলে বেশি।
এ বাস্তবতায় বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির জন্য নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক শুল্কনীতি, ভারতের সঙ্গে তুলনামূলক অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ বাণিজ্যের কৌশল—সবকিছু নিয়ে সমসাময়িক বিশ্লেষণ জরুরি হয়ে পড়েছে।
আরও পড়ুনট্রাম্পের শুল্ক আরোপ, বাংলাদেশের সামনে পথ কী১৬ মে ২০২৫যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি ও শুল্কের বৈষম্য২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যঘাটতি ছিল প্রায় ৪৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ মেক্সিকোর সঙ্গে ঘাটতি ১৭৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন, ভিয়েতনামের সঙ্গে ১২৯ দশমিক ৪ বিলিয়ন, জার্মানির সঙ্গে ৮৭ দশমিক ৯ বিলিয়ন, আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে ৮৭ দশমিক ২, তাইওয়ানের সঙ্গে ৭৬ দশমিক ৪, জাপানের সঙ্গে ৭২ দশমিক ৩ ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ৬৯ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ভারতের তুলনায় এ দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি অনেক বেশি।
তবু ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে আসছিল, যা ডোনাল্ড ট্রাম্প আরও ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে দেন। ফলে বর্তমানে ভারতীয় পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশ। উপরিউক্ত অনেক দেশের ওপর শুল্কহার এর চেয়ে অনেক কম। কেবল চীন (৩০%) ও কানাডা (৩৫%) এই উচ্চহারভুক্ত। এটি প্রমাণ করে, ভারত ও বাংলাদেশের মতো দেশের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বাস্তবতার চেয়ে রাজনৈতিক ও কৌশলগত হিসাব বেশি প্রভাবশালী।
আরও পড়ুনট্রাম্পের শুল্ক এক যুক্তিহীন ও ভয়াবহ উন্মাদনা২৮ জুলাই ২০২৫রাজনীতি বনাম অর্থনীতি: ভারতের অভিজ্ঞতাডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ভারতকে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের অন্যতম বড় ক্রেতা হিসেবে সমালোচনা করেছেন, যদিও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ চলাকালে ইউরোপই ছিল রাশিয়ার সবচেয়ে বড় জ্বালানি আমদানিকারক। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী:
* রাশিয়ার এলএনজি রপ্তানির ৫১ শতাংশ গেছে ইউরোপে
* পাইপলাইনের গ্যাসের ৩৭ শতাংশ গেছে ইউরোপে
* অপরিশোধিত তেলের ৪৭ শতাংশ চীনে, ৩৮ শতাংশ ভারতে, আর মাত্র ৬ শতাংশ গেছে ইউরোপ ও তুরস্কে
এ থেকে বোঝা যায়, শুল্ক আরোপ প্রায়ই রাজনৈতিক কারণে হয়ে থাকে। ভারতের ক্ষেত্রে উচ্চ শুল্ক সত্ত্বেও মার্কিন বাজারে তাদের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়নি; বরং প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি ও কৌশলগত সহযোগিতায় দুই দেশের সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে।
আরও পড়ুনট্রাম্পের শুল্ক উন্মাদনায় এলোমেলো বিশ্ববাণিজ্য১০ এপ্রিল ২০২৫বাংলাদেশের বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জবাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি প্রায় ১২৫ বিলিয়ন ডলার—বাংলাদেশের চেয়ে ২০ গুণ বেশি। তবু ভিয়েতনামের ওপর শুল্ক ২০ শতাংশ, আর বাংলাদেশের ওপর ছিল ৩৫ থেকে ৩৭ শতাংশ। এটি অর্থনৈতিক ঘাটতির অনুপাত নয়, বরং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ‘পারস্পরিক শুল্কনীতি’ অনুযায়ী উচ্চ ঘাটতির দেশগুলোর ওপর শুল্ক আরোপের কথা। কিন্তু বাংলাদেশের ঘাটতি কম হলেও শুরুতে বেশি শুল্ক ধার্য করা হয়েছিল, যা স্পষ্ট বৈষম্য।
বাংলাদেশ মার্কিন কৃষিপণ্য (গম, সয়াবিন, তুলা), এলএনজি, সামরিক সরঞ্জাম ইত্যাদি আমদানি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং ২৫টি বোয়িং বিমান কেনার চুক্তি করে। ৫ বছরের জন্য ৭ লাখ টন গম আমদানির চুক্তিও হয়।
এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র ২০২৫ সালের আগস্ট থেকে বাংলাদেশের শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে, যা প্রস্তুত পোশাকশিল্পের জন্য প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা আনবে।
ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ: এলডিসি থেকে উত্তরণ
বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের পর আর শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে না। এতে আমেরিকান বাজারে প্রবেশ ব্যয়বহুল হবে এবং প্রতিযোগিতা বাড়বে। জিএসপি–সুবিধা বন্ধ হওয়ার পর রপ্তানিকারকেরা আগেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ভবিষ্যতে শুল্ক বেড়ে গেলে পোশাক ও চামড়াশিল্প বড় ধাক্কা খেতে পারে।
এ অবস্থায় আমাদের কয়েকটি বিষয়ের ওপর জোর দিতে হবে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ–নির্ভরতা কমিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে নতুন বাজার তৈরি করতে হবে। অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদার করা করতে হবে; প্রয়োজনে টিফার আওতায় নতুন আলোচনা শুরু করতে হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় বৈষম্যমূলক শুল্কের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে হবে। উন্নত প্রযুক্তি, টেকসই উৎপাদন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সহায়তা, তরুণ মেধা কাজে লাগাতে হবে।রাজনীতি না অর্থনীতি?প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র কি কেবল বাণিজ্যঘাটতির ভিত্তিতে শুল্ক নির্ধারণ করে, নাকি ভূরাজনৈতিক হিসাব বেশি গুরুত্বপূর্ণ? ভিয়েতনাম বা জাপানের সঙ্গে উচ্চ ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও কম শুল্ক, আবার ভারতের মতো দেশের ক্ষেত্রে উচ্চ শুল্ক এবং বাংলাদেশের তুলনামূলকভাবে কম ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও বেশি শুল্ক—সবই প্রমাণ করে, অর্থনীতির পেছনে রাজনৈতিক কারণ কাজ করছে।
বাংলাদেশের শিক্ষা হলো—বাণিজ্য এখন শুধু অর্থনৈতিক বিষয় নয়; কূটনৈতিক সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা চুক্তি, প্রযুক্তি সহযোগিতা ও রাজনৈতিক অভিমুখই শুল্কনীতিকে প্রভাবিত করছে। তাই বাংলাদেশের প্রয়োজন দূরদর্শী নীতি, বাণিজ্যিক বিচক্ষণতা ও আন্তর্জাতিক ফোরামে সক্রিয় উপস্থিতি।
এ অবস্থায় আমাদের কয়েকটি বিষয়ের ওপর জোর দিতে হবে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ–নির্ভরতা কমিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে নতুন বাজার তৈরি করতে হবে। অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদার করা করতে হবে; প্রয়োজনে টিফার আওতায় নতুন আলোচনা শুরু করতে হবে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় বৈষম্যমূলক শুল্কের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে হবে। উন্নত প্রযুক্তি, টেকসই উৎপাদন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সহায়তা, তরুণ মেধা কাজে লাগাতে হবে।
এম এম মাহবুব হাসান ব্যাংকার, উন্নয়ন গবেষক ও লেখক
E-mail: [email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র শ ল ক আর প র জন ত ক ব স তবত ক টন ত দশম ক র ওপর ইউর প
এছাড়াও পড়ুন:
পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারীদের জন্য সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র: আনিসুজ্জামান
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, “বাংলাদেশের পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র, যেখানে টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য সীমাহীন সুযোগ বিদ্যমান। বিশ্বের অনেক দেশে গণ–অভ্যুত্থান কিংবা আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের পর অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। তবে বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে অনেকটাই ব্যতিক্রম।”
বুধবার (১৩ আগস্ট) রাজধানীর একটি হোটেলে ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ লিমিটেড আয়োজিত ‘ফরেন ইনভেস্টরস সামিট ২০২৫' এ প্রধান বক্তা হিসেবে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তনের পরও জিডিপিতে তেমন প্রভাব পড়েনি।বরং মূল্যস্ফীতি উল্টো হ্রাস পেয়েছে।”
আরো পড়ুন:
‘নির্বাচনের খবরে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন’
মার্জিন ঋণ নিয়ে গুজব, পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক পতন
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর শক্তিশালী ও সুশাসিত পুঁজিবাজার গড়ার জন্য কাজ করছে। ‘তিন শূন্য’: শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্য অর্জন করা এই আমাদের প্রচেষ্টা।”
পুঁজিবাজারের বিশাল সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, “এটি বিনিয়োগের জন্য একটি আকর্ষণীয় ক্ষেত্র। সরকার এমন একটি টেকসই পুঁজিবাজার গঠনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যেখানে দেশি ও বিদেশি উভয় ধরনের বিনিয়োগকারীই আস্থার সঙ্গে বিনিয়োগ করতে পারবেন।”
সম্মেলনে অন্য বক্তারা বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য শুধু বাজারের স্থিতিশীলতাই যথেষ্ট নয়, বরং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, স্বচ্ছতা এবং দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত সমর্থনও জরুরি। বৈশ্বিক বিনিয়োগের মানচিত্রে বাংলাদেশ বর্তমানে একটি ‘উদীয়মান সীমান্ত বাজার' যা কার্যকর নীতি ও কৌশলগত পরিকল্পনার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী বিনিয়োগ গন্তব্যে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে।
সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য দেন ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসানুর রহমান।বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএসইসি কমিশনার মোহাম্মদ মহসিন চৌধুরী, ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান মেহেরিয়ার এম হাসান, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) পিএলসির চেয়ারম্যান মোমিনুল ইসলাম এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) পিএলসির চেয়ারম্যান এ কে এম হাবিবুর রহমান।
সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও প্রতিষ্ঠাতা ড. এম মাসরুর রিয়াজ। প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার মো. সাইফউদ্দিন, কনটেক্সচুয়াল ইনভেস্টমেন্ট এলএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকাও হিরোসে এবং এশিয়া ফ্রন্টিয়ার ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেডের ফান্ড ম্যানেজার রুচির দেশাই।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম।
সম্মেলনে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী, নীতিনির্ধারক এবং বাজার বিশেষজ্ঞরা দেশের পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেন।
ঢাকা/এনটি/এসবি