বাল্টিক অঞ্চলের প্রতিরক্ষায় ন্যাটো আসলেই কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ? রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গত সপ্তাহে এস্তোনিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘন করে যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে সেই প্রশ্ন পরোক্ষভাবে সামনে এনেছেন।

ন্যাটোর প্রকাশ্য অবস্থানটা স্পষ্ট। ৩২ রাষ্ট্রের এই জোট তাদের ভূখণ্ডের প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষা করবে। সেই প্রতিশ্রুতিরই প্রদর্শন দেখা যাচ্ছে রাশিয়ার সীমান্তঘেঁষা এস্তোনিয়ার টাপা সামরিক ঘাঁটিতে। এস্তোনিয়া ভাষায় টাপার অর্থ হচ্ছে ‘হত্যা’। একসময় এটি ছিল সোভিয়েত বিমানঘাঁটি। এখন এটি এস্তোনিয়ার সেনাবাহিনী এবং ব্রিটিশ নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর একটি বড় ঘাঁটি।

গত সপ্তাহে আমি যখন টাপা সফরে গিয়েছিলাম, তখন সেখানে ব্রিটেনের রয়্যাল ট্যাংক রেজিমেন্টের সৈন্যরা সদ্য পৌঁছেছে। ফ্রান্সের একটি ছোট ইউনিটও ঘাঁটিটিতে অবস্থান করছে। চ্যালেঞ্জার-২ যুদ্ধট্যাংক, আর্চার কামানব্যবস্থা, গ্রিফন সাঁজোয়া যানসহ শক্তিশালী অস্ত্রশস্ত্রের মজুত সেখানে রয়েছে। ব্রিটিশ, ফরাসি ও এস্তোনিয়ান সেনাদের একটির একীভূত কমান্ড কাঠামো রয়েছে এবং রাশিয়া যদি কখনো এস্তোনিয়া আক্রমণ করে, তবে তারা একসঙ্গে লড়াইয়ে নামবে।

আরও পড়ুনপুতিন না ট্রাম্প— কে কাকে আসলে ফাঁদে ফেলছেন১৩ আগস্ট ২০২৫

টাপা ঘাঁটির সেনারা পূর্ণমাত্রার রুশ আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য প্রশিক্ষিত। কিন্তু পশ্চিমা কৌশলবিদেরা মনে করেন, রাশিয়া সম্ভবত ধাপে ধাপে এগোবে। ছোট ছোট অভিযান চালিয়ে ন্যাটোর প্রতিক্রিয়া ও ঐক্য পরীক্ষা করবে। এস্তোনিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘন ক্রেমলিনের সেই বড় পরিকল্পনারাই অংশ। কেননা, কয়েক দিন আগেই একগুচ্ছ রুশ ড্রোন পোল্যান্ডের আকাশসীমায় অনুপ্রবেশ করেছিল। ন্যাটোর যুদ্ধবিমান কয়েকটি ড্রোন ভূপাতিত করে। এরপর ন্যাটো তার পূর্ব সীমান্তে আরও বিমান মোতায়েন করে।

এই সপ্তাহের শেষ দিকে ন্যাটো এ বিষয়ে তাদের করণীয় ঠিক করতে আলোচনায় বসবে। জোটের কোনো কোনো সদস্য মনে করেন, ভবিষ্যতে রুশ বিমান ন্যাটোর আকাশসীমায় ঢুকলেই সেটিকে ভূপাতিত করা উচিত। কিন্তু অন্যরা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, এটি বিপজ্জনক উত্তেজনা সৃষ্টি করবে।

রাশিয়া সম্ভবত ধীরে ধীরে উসকানির মাত্রা বাড়াবে, যাতে ন্যাটোর ভেতরের বিভেদটা পরীক্ষা করা যায়। দীর্ঘদিন ধরে একটি বিষয় আলোচিত হয়ে আসছে, রুশ সেনারা বাল্টিক অঞ্চলের কোনো দেশে প্রবেশ করতে পারে, সম্ভবত সেখানকার রুশ বংশোদ্ভূতদের রক্ষার অজুহাতে।

ন্যাটো যেমন অনিশ্চয়তার মুখোমুখি, রাশিয়াও তেমন দ্বিধায়। ট্রাম্প এতটাই অস্থিরমতি যে আন্তর্জাতিক সংকটে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা কারও পক্ষেই অনুমান করা সম্ভব নয়। অনেকেই ভেবেছিলেন, তিনি কখনো ইরানে বিমান হামলায় অনুমোদন দেবেন না। অথচ এ বছর শুরুর দিকেই তিনি সেটিই করেছেন।

ক্রেমলিনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো এটা প্রমাণ করা যে ন্যাটোর পারস্পরিক নিরাপত্তার অঙ্গীকার বা আর্টিকেল ফাইভ কাজের কিছু নয়। রাশিয়া যদি তা করতে পারে, তবে তারা ন্যাটোর সম্মিলিত শক্তির মুখোমুখি না হয়েই একের পর এক ইউরোপের ছোট দেশগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করে যাবে।

মস্কোর এই জুয়ার চালের কেন্দ্রে রয়েছে ওয়াশিংটনের সমর্থন নিয়ে সৃষ্টি হওয়া অনিশ্চয়তা। ইউরোপে ন্যাটোর সামরিক সক্ষমতার প্রায় ৪০ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া। এর মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রও রয়েছে। বাল্টিক অঞ্চলে মার্কিন সেনারাও মোতায়েন রয়েছেন।

কিন্তু রাশিয়া যদি কখনো এস্তোনিয়া বা ন্যাটোর অন্য কোনো সদস্যদেশে বড় আকারের হামলা চালায়, তখন ট্রাম্প কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবেন—সে বিষয়ে অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। লিথুয়ানিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্যাব্রিয়েলিয়াস ল্যান্ডসবার্গিস আমাকে বলেছিলেন, ‘যদি অনুপ্রবেশ ও হামলা হয়…পুতিন কী আশা করতে পারেন? আমেরিকার ষষ্ঠ নৌবহর বাল্টিক সাগরে আসবে, নাকি আলাস্কায় বৈঠকের ডাক আসবে?’

আরও পড়ুনপুতিন যে দুই জায়গায় ট্রাম্পকে পাত্তা দেন না২৯ মে ২০২৫

ট্রাম্প প্রশাসন ও বাল্টিক মিত্রদের মধ্যে ভেতরে–ভেতরে টানাপোড়েন রয়েছে। ইউরোপীয় পররাষ্ট্রনীতির ‘এস্তোনিয়ানাইজেশন’ নিয়ে ওয়াশিংটন অভিযোগ করেছে। ইইউর বর্তমান পররাষ্ট্রনীতির প্রধান কায়া কাল্লাস এস্তোনিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় এই অভিযোগ। ট্রাম্প প্রশাসনের কিছু অংশ মনে করেন, বাল্টিক নেতারা পুতিনবিরোধী অবস্থানের ক্ষেত্রে অতি আক্রমণাত্মক। সম্প্রতি পেন্টাগনের এক বৈঠকে তাদের ‘আদর্শিক’ বলে অভিযুক্তও করা হয়। অন্যদিকে বাল্টিক দেশগুলোও যুক্তরাষ্ট্রকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে না।

রাশিয়ার আগ্রাসন মোকাবিলায় বড় ইউরোপীয় দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি ধারাবাহিক। তবে এই দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের ধারণায় আতঙ্কিত। এর প্রমাণ হলো, ইউরোপীয় ‘নিশ্চয়তা বাহিনী’ গঠন নিয়ে দ্বিধা। এই বাহিনীকে ইউক্রেনে মোতায়েন করা তখনই সম্ভব, যদি পেছনে আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতা থাকে।

ন্যাটো যেমন অনিশ্চয়তার মুখোমুখি, রাশিয়াও তেমন দ্বিধায়। ট্রাম্প এতটাই অস্থিরমতি যে আন্তর্জাতিক সংকটে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা কারও পক্ষেই অনুমান করা সম্ভব নয়। অনেকেই ভেবেছিলেন, তিনি কখনো ইরানে বিমান হামলায় অনুমোদন দেবেন না। অথচ এ বছর শুরুর দিকেই তিনি সেটিই করেছেন।

আরও পড়ুনপোল্যান্ডে ড্রোন পাঠিয়ে ন্যাটোকে কী বার্তা দিলেন পুতিন১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাল্টিক সংকটে যুক্তরাষ্ট্র যদি নিরপেক্ষ থেকেও যায়, তবু ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও কানাডার সেনারা সেখানে মোতায়েন রয়েছে। যুদ্ধের অঙ্গীকারও তারা করেছে। পোল্যান্ড ও ফিনল্যান্ডের মতো দেশ, যাদের যথেষ্ট সামরিক শক্তি রয়েছে, তারা ভালো করেই জানে, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়ার ভাগ্য তাদের নিজেদের নিরাপত্তার সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এই দেশগুলোও সম্ভবত বাল্টিক দেশগুলোর পাশে দাঁড়াবে।

ন্যাটোর পূর্ব সীমান্তের প্রতিরক্ষা পরীক্ষায় নামা পুতিনের জন্য হবে ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ এক জুয়াখেলা। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, পুতিন যে এমন বেপরোয়া জুয়া খেলতে সক্ষম, সেটা বিশ্ব ২০২২ সালেই জেনে গেছে।

গিদিয়ন র‍্যাচম্যান ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের পররাষ্ট্রবিষয়ক কলামিস্ট

ফিন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র এস ত ন য় র ন শ চয়ত পরর ষ ট পর ক ষ ইউর প

এছাড়াও পড়ুন:

ফিলিপাইনে আঘাত হেনেছে সুপার টাইফুন ফাং ওয়াং, নিহত ২

ফিলিপাইনে আঘাত হেনেছে শক্তিশালী টাইফুন ফাং ওয়াং। এতে দুজনের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ৯ লাখের বেশি মানুষকে।

রোববার রাতে আঘাত আগে ঘূর্ণিঝড়টিকে ‘সুপার টাইফুনে’ উন্নীত হয়। দেশটির আবহাওয়া সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ফাং ওয়াংয়ের কেন্দ্রের কাছাকাছি ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটার (১১৫ মাইল) বেগে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো গতি পৌঁছাচ্ছে ঘণ্টায় ২৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত।

ফিলিপাইনের সরকারি আবহাওয়া সংস্থা বলেছে, ফাং ওয়াংয়ের অগ্রভাগ দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় দ্বীপ লুজনের অরোরা প্রদেশে স্থানীয় সময় রোববার রাত ১১টার পর আঘাত হানে। এখন সেটি লুজনের আরও উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

আরও পড়ুনফিলিপাইনের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে ঘূর্ণিঝড় ফাং ওয়াং, সরিয়ে নেওয়া হলো ১ লাখ লোক১৫ ঘণ্টা আগে

এর আগে দিনভর উপকূলীয় অরোরা প্রদেশে উদ্ধারকারী দলগুলোর সদস্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাসিন্দাদের নিরাপদ উঁচু জায়গায় চলে যেতে বলেছেন। বিভিন্ন এলাকায় সকাল থেকে প্রবল বৃষ্টিপাত হচ্ছে।

কিছুদিন আগে আরেকটি শক্তিশালী টাইফুন ‘কালমায়েগি’তে ফিলিপাইনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। মৃত্যু হয় অন্তত ২০৪ জনের, নিখোঁজ হন ১০৯ জন। গত শুক্রবার ঘূর্ণিঝড়টিতে ভিয়েতনামেও পাঁচজন মারা যান।

সম্পর্কিত নিবন্ধ