‘নো ম্যান্স ল্যান্ডে’ এল পচি খাতুনের মরদেহ, এপার থেকে শেষ দেখা
Published: 26th, September 2025 GMT
কথা ছিল চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার কাজ সেরে আমরা দামুড়হুদা হয়ে তারপর মেহেরপুরের মুজিবনগরে যাব। আশরাফ আলীর নানার বাড়ি সেখানে। রাজহাঁসের ব্যবস্থা হবে। আজকাল সবকিছুতেই হাঁস ঢুকে যায়! আলমডাঙ্গার হারদী বাজারে চায়ের পেয়ালা হাতে নিতে না নিতেই আশরাফ আলীর মুঠোফোন বেজে ওঠে। সেটা ৫ সেপ্টেম্বরের কথা।
আশরাফ আলী স্থানীয় একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি হঠাৎ জোরে জোরে দুবার ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পড়েন। ফোন রেখে বলেন, ‘আমাকে এখনই মুজিবনগর যেতে হবে; পচি বু মারা গেছে।’
সীমান্ত লাগোয়া গ্রামগুলোর মধ্যে প্রাত্যহিক পাস না হোক, আগের মতো বিশেষ পাসপোর্ট ব্যবস্থা থাকলে ক্ষতি কী? এসব পাসপোর্ট দেখিয়েই একে অপরের গ্রামের পচি বুদের দেখে আসার সুযোগ দিলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?পচি খাতুনের বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তিনি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ওপারে নদীয়া জেলার চাপড়া থানার হৃদয়পুরে থাকতেন। সীমান্তের এখন সেদিন নেই। আশরাফ আলীরা এখন চাইলেই ভাইবোনদের দেখতে যেতে পারেন না। তালের পিঠা, হাঁসের মাংস আদান-প্রদানের সেই ছাড় এখন কেউ কাউকে দিচ্ছে না। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ করতে বসে র্যাডক্লিফ নিজের পকেটের কলম দিয়ে যে রেখা টেনেছিলেন, তাতে অনেক অঞ্চলে একই বসতবাড়ির এক অংশ ভারত, অন্য অংশ তৎকালীন পাকিস্তানের ভাগে পড়ে। সেটা আর কেউ বদল করার সাহস করেনি।
ফোন রেখে বলেন, ‘আমাকে এখনই মুজিবনগর যেতে হবে; পচি বু মারা গেছে।’তাড়াহুড়ার সেই ভাগ করার ঘটনায় পচি খাতুনের নানার বাড়ি পড়ে মেহেরপুরের মুজিবনগরের বৈদ্যনাথতলায়। গ্রামটি আবার ঘেরপাড়া নামেও পরিচিত। দাদাবাড়ি চলে যায় ভাগরেখার ওপারে নদীয়ার চাপড়ার হৃদয়পুর গ্রামে। বলতে গেলে পাশাপাশি দুই গ্রাম। ওপারে হৃদয়পুর, এপারে ঘেরপাড়া। এপারের শিরনির গন্ধ ওপারে চলে যায়। আত্মীয়স্বজন শুধু জানে ওখানে ভালোমন্দ রান্না হচ্ছে। হাঁকডাক, কান্নাকাটি সব কানে আসে কান পাতার আগেই। শিরনির গন্ধের দূরত্বে থাকা দুই গ্রামের মানুষের নিজেদের মধ্যে দেখাশোনার কোনো সোজা পথ নেই।
আগে ঘেরপাড়া গ্রামে এলেই মনে পড়ত ১৯৬০ সালে প্রভাতচন্দ্র সেন সম্পাদিত ও প্রকাশিত, চার দশকের বাংলা গান সংকলনটির ২১ পৃষ্ঠায় লেখা গানটির কথা। ‘শিয়ালদহ গোয়ালন্দ আজও আছে ভাই/ আমি যাব আমার দেশে সোজা রাস্তা নাই।’
পাসপোর্ট-ভিসা করে দর্শনা-গেদে দিয়ে পাশের গ্রামে পৌঁছাতে প্রায় এক দিন চলে যায়। এখন চাইলেও ভিসা পাওয়া যায় না সহজে। পচি খাতুন বুঝতে পেরেছিলেন, ‘আল্লার ইশারা’ হয়ে গেছে। তাই খুবই পেরেশান ছিলেন একবার বাংলাদেশের ঘেরপাড়ায় নানাজির বাড়ির দাওয়ার গন্ধ নেওয়ার জন্য। মামাতো-খালাতো ভাইবোনদের গায়ের-হাতের ছোঁয়া নেওয়া।.
অনেকবার শোনা কথা, তবু পুরোনো মনে হয় না। মহররম মাসে পুঁথিপাঠের শ্রোতার অপার মুগ্ধতা নিয়ে শুনতে থাকি আশরাফ আলীর বুজি-বন্দনা, বুজির জন্য তাঁর মাতম। মামা-খালার ছেলেমেয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় হওয়ায় তাঁকে সবাই বুজি বলত; এমনকি পাড়ার সবাই তাঁকে সেই সম্মানই দিত। গুরুজন স্থানীয়দের কাছে পচি খাতুন ছিলেন আদরের ‘বড় বেটি’। এপারে যাঁর বাড়িতেই বিয়েশাদি লাগুক না কেন, বুজি সব সময় ‘চিফ গেস্ট’। তখন সীমান্তের কড়াকড়ি এ অঞ্চলে ছিল না। স্থানীয় লোকজনের অনেকে বলেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে কিছু ‘গুঁজে’ দিলেই চলত।
একাত্তরে ‘বড় বেটি’ সত্যি এক বড় বেটি হয়ে ওঠেন। প্রাণভয়ে এপার থেকে ছুটে যাওয়া প্রায় সবাই হৃদয়পুরে মিয়াবাড়িতে জিরিয়েছেন। রাত কাটিয়েছেন একটা হিল্লে হওয়ার আগে। মিয়াবাড়ির গিন্নি তখন পচি খাতুন। মিয়াবাড়ির চুলা জ্বলত সারা দিন, সারা রাত; চুলার পেছনে ঠায় বসে থাকতেন পচি খাতুন। সব শরণার্থীই যেন তাঁর নানার বাড়ির লোক। মিয়ার গিন্নিকে ভাবি বলে সম্বোধন করার বিধান ছিল না।
পচি খাতুন বলতেন, ‘আমি তোমাগের মেয়ে, ভাবিভুবি না।’ সবাই তাঁকে তাই বুবুই ডাকত। কেউ কেউ শুধু ‘বু’, আবার কেউ বুজি। নানাবাড়িতে জন্ম হয়েছিল পচি খাতুনের। বলতেন, ‘ওপারে আমার নাড়ি পুঁতা আছে।’ মরার আগে একবার তিনি নানার ভিটায় আসতে চেয়েছিলেন। এখনকার পরিস্থিতি সেটা হতে দেয়নি।
একাত্তরে ‘বড় বেটি’ সত্যি এক বড় বেটি হয়ে ওঠেন। প্রাণভয়ে এপার থেকে ছুটে যাওয়া প্রায় সবাই হৃদয়পুরে মিয়াবাড়িতে জিরিয়েছেন। রাত কাটিয়েছেন একটা হিল্লে হওয়ার আগে। মিয়াবাড়ির গিন্নি তখন পচি খাতুন।পচি খাতুন তাই সিদ্ধান্ত দেন, ‘ওদের আমার মরা মুখ না দেখিয়ে দাফনাবি (দাফন করাবি) না। আমার শান্তি হবে না।’ মৃত্যুর পর তাঁর ছেলেমেয়ে, নাতি-পুতিরা বিএসএফ ক্যাম্পের সঙ্গে যোগাযোগ করে পচি খাতুনের শেষ ইচ্ছার কথা জানায়। পত্রপাঠ বিদায়ের আশঙ্কা নিয়েই তারা দেনদরবার করে। অন্তর্বর্তী সরকারের ১১ মাস সময়ের মধ্যে মাসে গড়ে তিনজন (মোট ৩৪ জন) বাংলাদেশিকে গুলি করে মেরেছে বিএসএফ (নিউ এজ, ২৬ জুলাই ২০২৫)। তাই সেই বিএসএফের কাছে মৃত এক প্রবীণ নারীর শেষ ইচ্ছার কী মূল্য আছে! তা ছাড়া ‘পুশ ইনের’ মামলা তো এখন প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা।
পচি খাতুনের কোন পুণ্যের (একাত্তরে হাজার হাজার শরণার্থীকে দুমুঠো গরম ভাত তুলে দেওয়া কি কম পুণ্যের কথা) গুণে জানি না, বিএসএফ রাজি হয়ে যায়। মৃতের শেষ ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখাতে কসুর করে না। বিএসএফের চাপড়া কোম্পানি কমান্ডার মিঠুন কুমার এগিয়ে আসেন। বিএসএফ সদস্যদের সহযোগিতায় ৬ সেপ্টেম্বর পচি খাতুনের মরদেহ আনা হয় সীমান্তের ১২৫ নম্বর মেইন পিলারের কাছে। সেখানে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে কোম্পানি কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকের পর ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’-এ পচি খাতুনের মরদেহ আনার পর মুজিবনগর বিজিবি কোম্পানি কমান্ডার আবুল বাশার একটি উদ্যোগ নেন। বৈদ্যনাথতলা তথা মুজিবনগরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পচি খাতুনের নিকটাত্মীয়দের সুযোগ করে দেন মরদেহের কাছে আসার। প্রায় ২০ মিনিট মরদেহটি সীমান্তে রাখা হয়।
পচি খাতুন বলতেন, ‘আমি তোমাগের মেয়ে, ভাবিভুবি না।’ সবাই তাঁকে তাই বুবুই ডাকত। কেউ কেউ শুধু ‘বু’, আবার কেউ বুজি। নানাবাড়িতে জন্ম হয়েছিল পচি খাতুনের। বলতেন, ‘ওপারে আমার নাড়ি পুঁতা আছে।’ মরার আগে একবার তিনি নানার ভিটায় আসতে চেয়েছিলেন। এখনকার পরিস্থিতি সেটা হতে দেয়নি।শেষ দেখার অধিকার শুধু নিকটাত্মীয়দের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হয়নি। যে শুনেছে বুজির কথা, সে-ই ছুটে এসেছে তাঁকে শেষবারের মতো দেখতে, বিদায় জানাতে। পরে মরদেহ আবার হৃদয়পুরে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। সেদিনের পতাকা বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেন মুজিবনগর বিজিবি কোম্পানি কমান্ডার আবুল বাশার এবং ভারতের পক্ষ থেকে ছিলেন বিএসএফের চাপড়া কোম্পানি কমান্ডার মিঠুন কুমার।
পরে বিজিবি কমান্ডার আবুল বাশার স্থানীয় সংবাদকর্মীদের বলেন, ‘মরদেহ দেখানোর অনুরোধ জানানো হলে বিএসএফ সাড়া দেয়। এ আয়োজনের মাধ্যমে শুধু স্বজনদের নয়, দুই বাহিনীর মধ্যেও আন্তরিকতা তৈরি হয়েছে। আমরা চাই এই আন্তরিকতা আরও গাঢ় হোক, বিকশিত হোক। সীমান্তের কাছাকাছি থাকা দুই পাশের গ্রামের মানুষের একে অপরের সঙ্গে দেখাশোনার একটা সহজ পথ থাকা উচিত।’
রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সমস্যার আগে মিয়ানমারের কাছের গ্রামের মানুষদের আট ঘণ্টার (সকাল-সন্ধ্যা) ছাড়পত্রে সে দেশে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। একই শর্তে মিয়ানমারের নাগরিকেরাও এপারে আসতে পারতেন। এখন সেটা নেই। প্রতিবেশী নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপে বিমানবন্দরে ভিসা পাওয়া যায়, শ্রীলঙ্কার ভিসা ঘরে বসে অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে।
মরদেহ দেখানোর অনুরোধ জানানো হলে বিএসএফ সাড়া দেয়। এ আয়োজনের মাধ্যমে শুধু স্বজনদের নয়, দুই বাহিনীর মধ্যেও আন্তরিকতা তৈরি হয়েছে। আমরা চাই এই আন্তরিকতা আরও গাঢ় হোক, বিকশিত হোক। সীমান্তের কাছাকাছি থাকা দুই পাশের গ্রামের মানুষের একে অপরের সঙ্গে দেখাশোনার একটা সহজ পথ থাকা উচিত।বিজিবি কমান্ডার আবুল বাশারআসলে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বা সার্কের একটা স্বপ্ন ছিল ভিসাপ্রক্রিয়া সহজ করা। ব্রিটিশ বা ঔপনেবিশক শাসনের আগে যে দেশগুলো এক ছিল, সেখানকার মানুষেরা যেন তাদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সহজে দেখা করতে পারে, সে জন্য সহজ যাতায়াতব্যবস্থা থাকা দরকার। যদি তা না থাকে, তাহলে মানুষ অবৈধ এবং বিপজ্জনক পথে হাঁটবে। আগে শুধু ভারত ভ্রমণের জন্য বিশেষ পাসপোর্টের ব্যবস্থা ছিল।
সীমান্ত লাগোয়া গ্রামগুলোর মধ্যে প্রাত্যহিক পাস না হোক, আগের মতো বিশেষ পাসপোর্ট ব্যবস্থা থাকলে ক্ষতি কী? এসব পাসপোর্ট দেখিয়েই একে অপরের গ্রামের পচি বুদের দেখে আসার সুযোগ দিলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে? এ রকম একটা ব্যবস্থা রাখা খুবই কি অসম্ভব স্বপ্ন?
# গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব এসএফ র ম জ বনগর ব যবস থ বড় ব ট বলত ন মরদ হ র একট অপর র
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশ সীমান্তে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় ৩০০ জন
পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) শুরু করেছে ভারতের নির্বাচন কমিশন। এ নিয়ে আতঙ্ক চরমে পৌঁছেছে।
বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় ভারতীয় সীমান্তে জড়ো হচ্ছে শত শত মানুষ। পশ্চিমবঙ্গের বসিরহাট মহকুমার স্বরূপনগর থানা এলাকার হাকিমপুর সীমান্তে এমন ঘটনা দেখা গেছে। বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য শুধুমাত্র এই সীমান্তেই জড়ো হয়েছেন নারী শিশু সহ অন্তত ৩০০ জন বাংলাদেশি নাগরিক।
আরো পড়ুন:
সৌদিতে বাস-ট্যাংকার সংঘর্ষ, ৪২ ভারতীয় হজযাত্রীর মৃত্যুর আশঙ্কা
দিল্লির আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীর সহযোগী গ্রেপ্তার
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে, শহর থেকে বিভিন্ন সময়ে ভারতে অনুপ্রবেশকারী এই বাংলাদেশিরা ফের বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য হাকিমপুর সীমান্তে এসে পৌঁছেছেন। কেউ দালালের মাধ্যমে কেউ আবার নিজেরাই স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এসেছেন সীমান্তে। কিন্তু বিএসএফের বাধায় সীমান্তেই আটকে পড়েছেন এই বাংলাদেশিরা।
আটকে পড়া ব্যক্তিরা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে ভারতে অনুপ্রবেশের পর তারা কলকাতা, দিল্লি, ব্যাঙ্গালুরু থেকে মুম্বাইয়ের মতো শহরে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি ভারত জুড়ে শুরু হওয়া এসআইআরের কারণে জেল ও জরিমানা এড়াতে দেশে তারা ফিরতে চাইছেন।
অফিসিয়াল বিবৃতি জারি না করলেও বিএসএফ সূত্রের খবর, সাম্প্রতিক সময়ে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে এমন ছবি শুধুমাত্র হাকিমপুর সীমান্তের নয়। এই সীমান্তে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের সংখ্যাটা অনেক বেশি। বিএসএফ জানিয়েছে, আটকে পড়া এই বাংলাদেশিদের মানবিক বিবেচনায় গ্রেপ্তার করা হয়নি। তাদের বাংলাদেশি নাগরিকত্বের দাবির স্বপক্ষে নিথিপত্র বিএসএফের ১৪৩ নম্বর ব্যাটালিয়ন খতিয়ে দেখছে। পরবর্তীতে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের ভিত্তিতে আগামী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ঢাকা/সুচরিতা/ফিরোজ