ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বা ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা শুনলে থমকে যেতে হয়, মনে হয়—কে উনি? তাঁকে কি চিনি? জানি? কিন্তু সচেতন ও শিক্ষিত বাঙালি মাত্রই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বললেই তাঁকে জানেন। চোখের সামনে ভেসে ওঠে গায়ে চাদর জড়ানো একটি দৃঢ় মুখ। সেকালে, মানে উনিশ শতকে সংস্কৃত কলেজের যেসব শিক্ষার্থী পরীক্ষায় একটি নির্ধারিত মানদণ্ড অর্জন করতেন, তাঁদের মানের শ্রেণি অনুযায়ী নানা উপাধি দেওয়া হতো। এর মাঝে একটি উপাধি ‘বিদ্যাসাগর’। এই উপাধি যাঁরা পেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে—নীলকমল বিদ্যাসাগর, রাজীবলোচন বিদ্যাসাগর, প্রাণকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর, হরানন্দ বিদ্যাসাগর, হরিহর বিদ্যাসাগর, শশিশেখর বিদ্যাসাগর, কালীপ্রসন্ন ঘোষ বিদ্যাসাগর, শিবনাথ শাস্ত্রী বিদ্যাসাগর অন্যতম। কিন্তু ইতিহাস তাঁদের কৃতিত্ব মনে রাখেনি।

সব নাম ছাপিয়ে যাঁর কৃতিত্ব বাঙালি মনে রেখেছে, যাঁর কাছে বাঙালি নানাভাবে ঋণী, যাঁকে বাঙালি একমাত্র বিদ্যাসাগর হিসেবে চিনেছে, তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ১৮৩৯ সালে সংস্কৃত কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি দেয়। তাঁর উদ্দেশে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ শিরোনামের সনেটে লিখেছিলেন—

বিদ্যাসাগর উপাধি যাঁরা পেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে—নীলকমল বিদ্যাসাগর, রাজীবলোচন বিদ্যাসাগর, প্রাণকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর, হরানন্দ বিদ্যাসাগর, হরিহর বিদ্যাসাগর, শশিশেখর বিদ্যাসাগর, কালীপ্রসন্ন ঘোষ বিদ্যাসাগর, শিবনাথ শাস্ত্রী বিদ্যাসাগর অন্যতম।

‘বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেম-কান্তি অম্লান কিরণে।
কিন্তু ভাগ্য-বলে পেয়ে সে মহা পর্ব্বতে,
যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
গিরীশ। কি সেবা তার সে সুখ-সদনে!—
দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
দীর্ঘ-শিরঃ তরু-দল, দাসরূপ ধরি;
পরিমলে ফুল-কুল দশ দিশ ভরে;
দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
নিশায় সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!’

আমাদের এই অবমানিত দেশে ঈশ্বরচন্দ্রের মতো এমন অখণ্ড পৌরুষের আদর্শ কেমন করিয়া জন্মগ্রহণ করিল, আমরা বলিতে পারি না।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বাঙালির এই কৃতী পুরুষ বিদ্যাসাগর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘.

..দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রে প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব...’ তাঁর সেই পৌরুষ ও অক্ষয় মনুষ্যত্ব নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে নানা গল্প-কাহিনি-কথা। তাঁর সৃষ্টি ও কর্ম তাঁকে বাঙালির কাছে কিংবদন্তি করে তুলেছে। তাঁর জন্মের ২০৫ বছর পেরিয়ে এসেও তাই তিনি অমলিন। তাঁর মাতৃভক্তি, মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে উত্তাল দামোদর নদী সাঁতরে পেরিয়ে আসা চিরস্মরণীয়। আমাদের বর্ণপরিচয়ের ইতিহাসের হাতেখড়িও তো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাত ধরেই। বাংলা গদ্যের আজকের যে রূপ, যতি চিহ্নের ব্যবহারে সার্থক প্রয়োগ, সেখানেও তো বিদ্যাসাগরের অবদান। বাঙালি নারীর সম্মান, তাঁদের মাথা উঁচু করে বাঁচার লড়াই, যখন পৃথিবীর পাঠশালায় নিজেকে বোঝার আগেই একটি শিশুকে মেনে নিতে হচ্ছে অকাল বৈধব্য। আর তার ছুঁতোয় জীবন্ত পুড়িয়ে মারার অমানবিতা, সেখান থেকে তাঁদের বেঁচে থাকার লড়াই, সত্যিকার মানুষ হিসেবে পরিচয়ের সূচনাও তো বিদ্যাসাগরের হাত ধরেই।

তাঁর পোশাক ছিল ধুতি, চাদর আর চটি। এই পোশাক কখনো তিনি ত্যাগ করার কথা ভাবেননি। বাংলার ছোটলাট হ্যালিডে সাহেব এ দেশের মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য উদ্যোগী হয়ে আলোচনার জন্য মাঝেমধ্যে বিদ্যাসাগরকে ডেকে পাঠাতেন। কিন্তু নিজস্ব পোশাকের বাইরে সাহেবি পোশাকে যেতে ছিল তাঁর আপত্তি। সেটা জানানোর পর ছোটলাট আশ্বস্ত করেছিলেন, ‘পণ্ডিত যে পোশাকে আসতে চান, সেই পোশাকে আসবেন।’

আবার তাঁর চটি নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে নানা গল্প। এশিয়াটিক সোসাইটির দ্বাররক্ষী তাঁকে ‘বাড়ির বাইরে চটিজুতো খুলে ঢুকতে হবে’—বলায় আর কখনো সেমুখী হননি। বরং ফিরে এসে চিঠি লিখে প্রতিবাদ করেছিলেন। এ বিষয়ে তখনকার ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকা লিখেছিল, ‘বিদ্যাসাগরের মতন একজন পণ্ডিতের প্রতি যখন এইরূপ ব্যবহার, তখন এশিয়াটিক সোসাইটিতে আর কোনো পণ্ডিত যাইতে চাহিবেন না।’

মাইকেল লিখছেন, ‘আমার সহকর্মী বাবু মূর্তিলাল চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে তোমার কাছে যাব। তুমি এক বোতল শেরি আনিয়ে রেখো।’ বিদ্যাসাগরের কাছে মদ আনিয়ে রাখার বায়না! এ-ও কি সম্ভব? সে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেই সম্ভব হয়েছিল। কারণ, তিনি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’র মতো মহাকাব্যের রচয়িতা।

আবার বিদ্যাসাগরকে লেখা মাইকেল মধুসূদন দত্তের একটি দুর্লভ চিঠিতে জানা যায়—মাইকেল লিখছেন, ‘আমার সহকর্মী বাবু মূর্তিলাল চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে তোমার কাছে যাব। তুমি এক বোতল শেরি আনিয়ে রেখো।’ বিদ্যাসাগরের কাছে মদ আনিয়ে রাখার বায়না! এ-ও কি সম্ভব? সে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেই সম্ভব হয়েছিল। আর বিদ্যাসাগরও বন্ধুর প্রতি উদার ছিলেন। কারণ, তিনি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’র মতো মহাকাব্যের রচয়িতা।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জীবদ্দশায় যেমন সমালোচিত হয়েছিলেন, তেমনি মৃত্যুর পরও। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়েছেন। তাঁকে নিয়ে তখনকার সমাজের উঁচুতলার মানুষ সমালোচনা করতে ছাড়েননি। তাঁর বিধবাবিবাহবিষয়ক ‘প্রথম পুস্তক’টি ছাপা হলে দেশের হিন্দুসমাজে তৈরি হয় তুমুল বিরোধিতা। রক্ষণশীলরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন, বিদ্যাসাগরকে নানাভাবে হেনস্তা করতে মেতে ওঠেন। বহুবিবাহ বিষয়ে দ্বিতীয় পুস্তক ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার’ প্রকাশের পর এই পুস্তকের তীব্র সমালোচনা করে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বঙ্গদর্শন’-এর ১২৮০ বঙ্গাব্দের আষাঢ় (১৮৭৩ সাল) সংখ্যায় ‘বহুবিবাহ’ শিরোনামের প্রবন্ধে লেখেন। আবার বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ প্রথা চালুর বিরুদ্ধে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে সূর্যমুখীর মুখের সংলাপে লিখেছিলেন, ‘আর একটা হাসির কথা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে নাকি বড় পণ্ডিত আছেন, তিনি আবার একখানি বিধবা বিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবার বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত, তবে মূৰ্খ কে?’

শুধু নিজে বিদ্যার সাগর হয়েই নয়, তিনি চেয়েছিলেন, দেশের মানুষের মুক্তি, চেয়েছিলেন নারী মুক্তি ও নারীশিক্ষার বিস্তার। কিন্তু সেই চাওয়ায় তিনি কেবল সমাজ নয়, প্রিয়জনদের কাছ থেকেও বারবার আঘাত পেয়েছেন। তবু তিনি পিছু হটেননি। বরং দৃঢ়তার সঙ্গে, অবিচল থেকেছেন আপন লক্ষ্যে। তাই তাঁর সম্পর্কে শেষ কথা বলতে আশ্রয় নিতে হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। তিনি লিখেছেন, ‘ব্রাহ্মণ পণ্ডিত যে চটিজুতা ও মোটা ধুতিচাদর পরিয়া সর্বত্র সম্মান লাভ করেন, বিদ্যাসাগর রাজদ্বারেও তাহা ত্যাগ করিবার আবশ্যকতা বোধ করেন নাই। তাঁহার নিজের সমাজে যখন ইহাই ভদ্রবেশ, তখন তিনি অন্য সমাজে অন্য বেশ পরিয়া আপন সমাজের ও সেই সঙ্গে আপনার অবমাননা করিতে চাহেন নাই। সাদা ধুতি ও সাদা চাদরকে ঈশ্বরচন্দ্র যে গৌরব অর্পণ করিয়াছিলেন, আমাদের বর্তমান রাজাদের ছদ্মবেশ পরিয়া আমরা আপনাদিগকে সে গৌরব দিতে পারি না। বরঞ্চ এই কৃতকর্মের ওপর দ্বিগুণতর কৃষ্ণকলঙ্ক লেপন করি। আমাদের এই অবমানিত দেশে ঈশ্বরচন্দ্রের মতো এমন অখণ্ড পৌরুষের আদর্শ কেমন করিয়া জন্মগ্রহণ করিল, আমরা বলিতে পারি না।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে, নারী নিহত

ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের মাদারীপুরের রাজৈরে যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের পাশের খাদে পড়ে এক নারী নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ২০ জন। শুক্রবার (৩ অক্টোবর) মধ্যরাতে রাজৈর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় দুর্ঘটনার শিকার হন তারা। 

নিহত নিলুফা ইয়াসমিন নিলা (৩০) বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার রুনসী গ্রামের আবুল বাসারের স্ত্রী।

আরো পড়ুন:

গাজীপুরে ডাম্পট্রাকের ধাক্কায় অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত

অটোরিকশায় ট্রেনের ধাক্কা, মা-মেয়ে নিহত

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কুয়াকাটা থেকে ঢাকার দিকে যাচ্ছিল চন্দ্রা পরিবহনের বাসটি। ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের রাজৈর বাসস্ট্যান্ড পার হওয়ার পর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাসটি সড়কের পাশের খাদে পড়ে যায়।  পরে হাইওয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে নিলার মরদেহ উদ্ধার করে। আহত হন অন্তত ২০ জন। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

মাদারীপুরের মস্তফাপুর হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মিজানুর রহমান জানান, বাস খাদে পড়ার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করা হয়। আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। একজনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। নিহত নারীর মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য মাদারীপুর সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

ঢাকা/বেলাল/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ