শিশুশিল্পী হিসেবে রুপালি জগতে পা রেখে তামিল সিনেমার শীর্ষ নায়কদের একজনে পরিণত হয়েছেন থালাপাতি বিজয়। সর্বশেষ ‘থালাপাতি ৬৯’ সিনেমার জন্য ২৭৫ কোটি রুপি পারিশ্রমিক নিয়েছেন তিনি। ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকা অবস্থায় ‘তামিলাগা ভেটরি কাজাগম’ (টিভিকে) নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন এই নায়ক।  

শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) তামিল নাড়ুর করুরে তার রাজনৈতিক দলের জনসভা ছিল। সেখানে পদদলিত হয়ে ৪০ জন মারা গেছেন। এখানে ১৬ জন নারী ও ৬ জন শিশু রয়েছে। আরো বহুজন আহত হয়েছেন। এ ঘটনা বিশ্বব্যাপী আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে মৃতদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন বিজয়। কিন্তু এই জনসভায় এত মানুষ কেন মারা গেলেন? চলুন, এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি— 

আরো পড়ুন:

প্রত্যেক নিহতের পরিবার পাবে ২৭ লাখ টাকা: বিজয়

৩ দিনে কত টাকা আয় করল পবন কল্যাণের সিনেমা?

প্রত্যক্ষদর্শীরা ঘটনার কারণ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অনেকে বলেছেন, “বিজয় যখন বক্তব্য শুরু করেন, তখনই বিশৃঙ্খলা শুরু হয়।”  

থালাপাতি বিজয় ও পুলিশ উপস্থিত জনতাকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান। এরই মাঝে মাইকে একটি ঘোষণা শোনা যায়, ৯ বছর বয়সি একটি মেয়ে হারিয়ে গেছে, যার নাম আশমিকা। এই ঘোষণা শোনার পর, বিজয় পুলিশকে সাহায্য করতে অনুরোধ করেন। এরপর বক্তব্য সংক্ষিপ্ত করে মঞ্চ ত্যাগ করেন বিজয়। 

চেন্নাইয়ের একটি আইটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন করুরের বাসিন্দা আর.

কে. নির্মল। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “বিজয় আসার আগ পর্যন্ত জনসভার ভেন্যু স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু হঠাৎ ফ্লাডলাইট বন্ধ হয়ে যায়, এসব লাইট জেনারেটরের সঙ্গে যুক্ত ছিল।” 

পরের ঘটনা বর্ণনা করে আর. কে. নির্মল বলেন, “এরই মধ্যে এক নারী তার হারিয়ে যাওয়া শিশুকে খুঁজতে শুরু করেন। তখনই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষ দিকবিদিক ছোটাছুটি শুরু করেন। আমি কোনোরকমে নিজের জীবন বাঁচাই এবং কয়েকজনকে সাহায্য করি। আমি দেখেছি, কিছু মানুষ গাড়ির নিচে আটকা পড়েছিল।” 

তামিল নাড়ুর প্রাক্তন ক্যাবিনেট মন্ত্রী ভি. সেন্থিলবালাজিকে কটাক্ষ করে মঞ্চে গান করেন বিজয়। সেই সময়ের কথা স্মরণ করে নির্মল বলেন, “যখন বিজয় ‘১০ টাকার মন্ত্রী’ বলে ভি. সেন্থিলবালাজিকে কটাক্ষ করে গান করেন, তখনই উপস্থিত জনতা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। আচমকা পুলিশ লাঠি চালাতে শুরু করে, তখন সবাই ভয় পেয়ে ছুটতে শুরু করে। অনেক মা-বাবারা তাদের কোলের শিশুকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন। পুরো জায়গাটি একেবারে বিশৃঙ্খলায় পরিণত হয়।” 

এআইডিএমকে-এর সাধারণ সম্পাদক এডাপাডি পালানিস্বামী বলেন, “গতকাল ৩৯ জন প্রাণ হারিয়েছে। আমাদের জানানো হয়েছে যে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার কারণে পদদলিত হয়ে এ ঘটনা ঘটেছে।” 

তামিলনাড়ুর ভারপ্রাপ্ত ডিরেক্টর জেনারেল অব পুলিশ জি. ভেঙ্কটরামন বলেন, “তামিলাগা ভেটরি কাজাগম’ (টিভিকে)-কে বিকাল ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তবে দলের সোশ্যাল মিডিয়ায় দুপুর ১২টা থেকেই সমর্থকদের জড়ো হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। বিজয় সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে সমাবেশস্থলে পৌঁছান। তখন তার গাড়ির পেছনে বহু মানুষ ছিলেন। সমাবেশস্থলে বিজয় পৌঁছালে হঠাৎ ভিড় বেড়ে যায়।” 

ঘটনাস্থলে পুলিশের ৫০০ জন সদস্য মোতায়েন করা ছিল। জায়গার বিন্যাস এমন ছিল যে, অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি বলে জানান ভেঙ্কটরামন। পুলিশের এ কর্তা ব্যক্তি বলেন, “পুলিশের কাছে জমা দেওয়া অঙ্গীকারনামা অনুযায়ী, ভিড় নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব আয়োজকদেরও ছিল।” 

পুলিশের একটি সূত্র জানান, বিজয় তার বক্তব্য দেওয়ার সময় জনতা ব্যারিকেডের দিকে ছুটে গেলে সমাবেশের পরিস্থিতি খারাপের দিকে মোড় নেয়। সমাবেশে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ উপস্থিত থাকার প্রত্যাশা ছিল পুলিশ কর্মকর্তাদের। তবে স্থানীয় প্রতিবেদন অনুযায়ী, সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন অন্তত ৬০ হাজার মানুষ। 

তথ্যসূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান টাইমস

ঢাকা/শান্ত

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর উপস থ ত ন ব জয়

এছাড়াও পড়ুন:

স্বৈরতন্ত্র উত্থানের দায় আসলে কাদের

প্রাচীন গ্রিসে ক্ষুদ্র অসংখ্য নগররাষ্ট্র ছিল। সেখানে নগরের অধিবাসীকেই বলা হতো নাগরিক, যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল নাগরিকের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমরা সেই সব ব্যক্তিকে নাগরিক বলব, যাদের আইন প্রণয়ন ও বিচারিক কার্যাবলিতে অংশগ্রহণের ক্ষমতা আছে।’ তাঁর মতে, যে ব্যক্তি নগররাষ্ট্রের শাসনকাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে অক্ষম, তিনি প্রকৃত নাগরিক নন।

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নাগরিককে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে—যেকোনো রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন, রাষ্ট্র প্রদত্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করেন এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য ন্যায়ের সঙ্গে পালন করেন, তাঁকেই নাগরিক বলা যায়। একই সঙ্গে নাগরিককে অবশ্যই অন্য মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন না করার ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে।

প্রতিটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো সৎ, যোগ্য ও নীতিবান নাগরিক। রাষ্ট্রের কাঠামো ও ভবিষ্যৎ নির্ভর করে নাগরিকের চরিত্র ও আচরণের ওপর। তাই রাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন সচেতন নাগরিক—যিনি নিজের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত। এ জ্ঞান ও সচেতনতাই রাষ্ট্রকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে বলা হয় জনগণের অংশগ্রহণে, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের কল্যাণে পরিচালিত শাসনব্যবস্থা; কিন্তু প্রশ্ন হলো যদি জনগণ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অসচেতন থাকেন, তবে কি গণতন্ত্রের প্রকৃত স্বরূপ অক্ষুণ্ণ থাকে? বাস্তবতা হলো নাগরিকের অজ্ঞতা ও উদাসীনতাই স্বৈরতন্ত্রকে জন্ম দেয়।

প্রথমত, যেখানে মানুষ নিজের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞ, সেখানে শাসকগোষ্ঠী সহজেই ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে। ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন—এসব বিষয়ে নাগরিক উদাসীন থাকলে শাসকের জবাবদিহি বিলীন হয়ে যায়, তখন গণতান্ত্রিক কাঠামো টিকে থাকলেও এর প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়।

দ্বিতীয়ত, নাগরিকেরা ভয়, অজ্ঞতা বা উদাসীনতার কারণে যখন অন্যায় ও অনিয়ম মেনে নেন, তখনই স্বৈরতন্ত্র শিকড় গাড়ে। শাসকের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত তারা অন্ধভাবে মেনে নিলে সরকার জবাবদিহি এড়িয়ে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে; কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—শক্তিশালী শাসকের শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয় কেবল তখনই, যখন জনগণ ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। জার্মানি থেকে পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশের অতীত—সবখানেই দেখা যায়, নাগরিক–সচেতনতার অভাবেই স্বৈরতন্ত্রের বিস্তার ঘটেছিল।

তৃতীয়ত, নাগরিক সমাজ দুর্বল হলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শ্রমিক সংগঠন কিংবা নাগরিক সংগঠনগুলোও কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। তখন শাসকেরা সহজেই বিকল্প কণ্ঠরোধ করে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। অর্থাৎ, নাগরিকের নীরবতাই শাসকের জন্য সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্রে পরিণত হয়।

অতএব, স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন নাগরিক শিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতনতা। পরিবার থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে মানুষকে জানতে হবে তাদের অধিকার, কর্তব্য ও রাষ্ট্রের কাছে দাবি করার উপায়। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হতে হবে সত্য প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম, তোষণ বা প্রোপাগান্ডার যন্ত্র নয়। মনে রাখতে হবে—অধিকার চর্চা না করলে অধিকার হারিয়ে যায়। তাই প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য হলো নিজের অধিকার সম্পর্কে জানা ও তা প্রয়োগ করা।

সবশেষে বলা যায়, নাগরিকের অধিকার বিষয়ে অসচেতনতা কোনো ব্যক্তিগত দুর্বলতা নয়; বরং তা রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর। সচেতন নাগরিক সমাজই পারে জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র গড়ে তুলতে আর অসচেতন নাগরিক সমাজই সৃষ্টি করে স্বৈরতন্ত্রের জন্মভূমি।

ইসরাত জাহান

শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘আমরা তখনই বিজয়ী হব, যখন এই লজ্জা বহন করা বন্ধ করব’
  • জনসভায় প্রাণহানির ঘটনা নিয়ে প্রথম প্রতিক্রিয়ায় কী বললেন থালাপতি বিজয়
  • স্বৈরতন্ত্র উত্থানের দায় আসলে কাদের