তিন মোটরসাইকেলের ছোট কাফেলা থামল মেহেরপুরের এক নাম না-জানা বিলে। দিনের শেষ গন্তব্যে বিকেলের আলো তখনো তেজীয়ান। মনে হচ্ছিল গল্পের তেপান্তরের মাঠে এসে পড়েছি। সারা দিনে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার পেরিয়ে আমরা ছুটেছি এই রকম এক বিল থেকে আরেক বিলে—হারিয়ে যেতে বসা এক ছোট বুনো বিড়ালকে বোঝার ও বাঁচানোর অভিযানে। সে আমাদের জলাভূমির মেছো বিড়াল।
পানকৌড়ি সংরক্ষণ ক্লাবের ১০ বছর ধরে চালানো নিরলস-নীরব প্রচেষ্টায় চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর এখন ‘মেছো বিড়ালের স্বর্গভূমি’ নামে সারা দেশে পরিচিত। তাদের সহায়তা করছে আরণ্যক ফাউন্ডেশন। বিল-খামারের মাঝে এই বিড়াল কীভাবে টিকে আছে আর মানুষই–বা কী ভাবছে, তাই নিয়ে কাজ করছি।
বিলের মাঝখানে ছোট খামার। চারপাশে ধানি জমি। চারপাশের শুকনো জমিজুড়ে মেছো বিড়াল-বনবিড়ালের পায়ের ছাপ। খামারের দেখভালের দায়িত্বে থাকা মানুষটি একসময় মেছো বিড়াল মারতেন। পানকৌড়ি সংরক্ষণ ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা বখতিয়ার হামিদসহ অন্যদের চেষ্টায় তিনি এখন মেছো বিড়াল রক্ষায় নিয়োজিত। বুনো প্রাণীদের কিছু হলেই পানকৌড়িকে জানান। এখানে আমরা একটি ক্যামেরা ট্র্যাপ বসালাম।
মেছো বিড়াল দক্ষিণ এশিয়ার জলাভূমির এক অনন্য বাসিন্দা। গড় ওজন ৫ থেকে ১৬ কেজি—না অনেক বড়, না একেবারে ছোট। বাসার বিড়ালের মতো নয়, এরা জলপ্রেমী প্রাণী। পানিতে সাঁতার কাটা, মাছ ধরা, জলচর পাখি শিকার—সবই এদের দৈনন্দিন আচরণ। ব্যাঙের মতো জালযুক্ত পা, ছোট লেজ আর খয়েরি-হলুদ শরীরে ছোট কালো ছোপ—এই চেহারাই এদের আলাদা করে। কিন্তু এই ছোপই যেন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের জন্য। গ্রামীণ জনপদে এদের দেখা গেলেই মানুষ ভাবে, ‘বাঘ বেরিয়েছে’। ভয় বা ভুল ধারণা থেকে অনেক সময় প্রাণ হারায় এই নিরীহ প্রাণী। ফেসবুকে প্রায়ই দেখা যায়, ‘মেছো বাঘ’ ধরার বা মারার পোস্ট। অথচ তারা বাঘ নয়, আমাদের জলাভূমির ভারসাম্য রক্ষাকারী এক গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি। বন বিভাগের এক পোস্টারে দেখলাম, প্রতিটি মেছো বিড়াল জীবদ্দশায় ইঁদুর খেয়ে ৫০ লাখ টাকার ফসল রক্ষা করে। মেছো বিড়ালদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে প্রয়োজন গবেষণা, যাতে উঠে আসবে আরও চমকপ্রদ তথ্য।
ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে পেরোলেই নব্বইয়ের দশকের জলাভূমিবিধৌত বাংলাদেশ কেমন ছিল, তার আঁচ পাওয়া যায়। বিস্তীর্ণ বিল-বাঁওড় আর পাড়ের নলবনগুলোতে আমাদের ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী আর পাখি এখনো বেশ আছে। তবে বছর দুই আগেও পদ্মার দক্ষিণের জেলাগুলোয় মেছো বিড়ালেরা শুধু বেঘোরে মারা পড়ত। নতুন হওয়া মাওয়া হাইওয়েতে পড়ে থাকা মৃত মেছো বিড়াল ছিল নিত্যসংবাদ। তখন কিন্তু দেখার মতো কেউ ছিল না। ২০০৫ থেকে ২০২১ সালে শুধু চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরেই ৫০টির বেশি মেছো বিড়ালের মৃত্যুর খবর সংবাদপত্রে এসেছে। ২০২১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত তিন বছরে প্রায় সমানসংখ্যক মেছো বিড়ালের মৃত্যুসংবাদ এসেছে। কোথাও তাকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, কোথাও পড়েছে গাড়ির নিচে। কিছু বাচ্চাকে মায়ের কাছ থেকে আলাদা করে খাঁচায় পোরা হয়েছিল চিত্তবিনোদনের নামে।
চুয়াডাঙ্গার বিরান বিলে ক্যামেরা ট্র্যাপে ধরা পড়া মেছো বিড়াল.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জল ভ ম
এছাড়াও পড়ুন:
পাখি তাড়াতে কত কী করা হলো, তবু তারা এলাকা ছাড়েনি
পাখিদের তাড়ানোর জন্য গাছ কেটে ফেলা হয়েছিল। হত্যা করা হয়েছিল প্রায় ৮০টি পাখি। বন বিভাগ এই ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করেছিল। তার মধ্যে পাখির আবাসস্থল ধ্বংসের আনুমানিক ক্ষতি এক কোটি টাকা ও পরিবেশের আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দুই কোটি টাকা। এই ক্ষতির জন্য আদালতে মামলাও করা হয়েছিল।
চার বছর আগে এ ঘটনা ঘটেছিল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে। তারপরও পাখিরা হাসপাতাল ছাড়েনি। প্রজনন মৌসুমে শামুকখোল পাখিরা আসে। আরও থাকে পানকৌড়ি ও নিশিবক।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে দীর্ঘদিন ধরে শামুকখোল পাখিরা প্রজনন মৌসুমে বাসা বাঁধে। বাচ্চা ফুটিয়ে তারা আবার চলে যায়। নিশিবক ও পানকৌড়ি প্রায় সারা বছরই থাকে। ২০২০ সালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পাখির বিষ্ঠায় পরিবেশ নষ্টের অজুহাতে কিছু গাছের ডালপালা কেটে দিয়েছিল।
এ ঘটনার পর পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো প্রতিবাদ করে। এরপর হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেছিলেন, হাসপাতালের পরিবেশ ও পাখি নিয়ে মানুষের আবেগ, এই দুটি বিষয়কে সমন্বয় করেই তিনি কাজ করবেন। পাখির যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখবেন।
২০২১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের সামনে ড্রেন নির্মাণের জন্য একটি অর্জুনগাছ কাটা হলে উড়তে না শেখা শতাধিক পাখির ছানা মাটিতে পড়ে যায়। কিছু পাখি মারা যায়। আর কিছু পাখির ছানা জবাই করে নিয়ে যান শ্রমিক ও রোগীর স্বজনেরা। এর প্রতিবাদ জানিয়ে রাজশাহী, নাটোর ও নওগাঁয় পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে।
এত অত্যাচারের পরও পাখিরা হাসপাতাল ছাড়েনি। এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আমিনুজ্জামান মো. সালেহ রেজা বলেন, শামুকখোল খুব বাছাই করা গাছে বাসা বাঁধে। তারা প্রথমেই নিরাপত্তা বিবেচনা করে। যেখানে মানুষের ভিড় বেশি, সেখানে মানুষ পাখিদের বিরক্ত করে না—এটা তারা বুঝে গেছে। আবার বাসা বানানোর উপকরণ ও খাবারের উৎস সহজলভ্য কি না, সেটাও তারা বিবেচনায় রাখে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার মোশাররফ হোসেন ২০০৪ সাল থেকে এই হাসপাতালে কর্মরত। তিনি বলেন, আগে শামুকখোল পাখিগুলো রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের গাছগুলোয় থাকত। ২০১৮ সালে সেসব গাছ কাটা হলে তারা হাসপাতাল এলাকায় চলে আসে। এর আগে হাসপাতল এলাকায় অনেক কাক থাকত। পাখির বিষ্ঠার কারণে রোগীদের ভোগান্তি হতো। এ কারণে হাসপাতাল এলাকার গাছের ডালপালা ছেঁটে দেওয়া হয়েছিল। তারপরও পাখিরা হাসপাতাল এলাকা ছেড়ে যায়নি।
গাছ কাটা ও পাখি হত্যার ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করে রাজশাহী বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের পক্ষ থেকে আদালতে মামলা করা হয়েছিল। বন্য প্রাণী পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির ২০২১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহী চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। সেই মামলায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বিবাদী করা হয়েছিল।
এ বিষয়ে বন্য প্রাণী পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির প্রথম আলোকে বলেন, মামলাটির এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
কয়েক দিন আগে হাসপাতাল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতাল চত্বরের ন্যাড়া জারুলগাছগুলোতেও পাখিরা একেবারে গাদাগাদি করে বাসা তৈরি করেছে। পাখিগুলো গায়ে গা লাগিয়ে বসে আছে। হাসপাতালের সামনের সড়ক বিভাজকের ছোট ছোট গাছেও পাখিরা ভিড় করে আছে। গাছগুলো এত ছোট, যে কেউ চাইলেই পাখিদের ছুঁতে পারবে, কিন্তু সেদিকে পাখিদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
পাখির বাসার নিচেই আছে একাধিক খাবারের দোকান। স্থানীয় এক দোকানি বলেন, হাসাপাতাল এলাকায় যাঁরা থাকেন বা আসেন, তাঁদের অন্যদিকে তাকানোর সময় থাকে না। কেউ ব্যস্ত ব্যবসা নিয়ে, কেউ আসেন রোগী নিয়ে। পাখি দেখতে কেউ আসেন না। পাখির বাসা ভাঙার সময় কারও নেই।