৮ মে আন্তর্জাতিক থ্যালাসেমিয়া দিবস। এ বছরের থিম (প্রতিপাদ্য) হচ্ছে ‘থ্যালাসেমিয়ার জন্য সামাজিক ঐক্য গড়ি, রোগীদের অধিকার নিশ্চিত করি’। বাংলাদেশ গত এক দশকে সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে এবং শিশু মৃত্যুর হার কমেছে। অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (এনসিডিসি) কার্যক্রম এখনো কার্যকরভাবে ধীরগতিতে এগোচ্ছে। জন্মগত রোগ থ্যালাসেমিয়া হিমশৈলের অগ্রভাগের (টিপ অব দ্য আইসবার্গ) মতো, যা এখনো সরকারের এনসিডিসি কর্মসূচির যথাযথ মনোযোগের মধ্যে পড়েনি। বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতির মতো কয়েকটি এনজিও (বেসরকারি সংস্থা) খুব সীমিত পরিসরে থ্যালাসেমিয়া নিয়ে কাজ করছে।

থ্যালাসেমিয়া একটি জন্মগত (জেনেটিক) রক্তরোগ এবং বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বিস্তৃত রোগগুলোর মধ্যে একটি। বিভিন্ন ধরনের থ্যালাসেমিয়া আছে। ২০০৮ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৭ শতাংশ থ্যালাসেমিয়ার বাহক আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক জাতীয় থ্যালাসেমিয়া পরিসংখ্যান-২০২৪ অনুযায়ী, থ্যালাসেমিয়ার বাহক ১১ দশমিক ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মানে হলো ১৭ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ থ্যালাসেমিয়ার বাহক।

ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার থ্যালাসেমিক (অর্থাৎ থ্যালাসেমিয়ার রোগী) শিশু জন্ম নেয়। বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আনুমানিক ৭০ হাজার থেকে ৮০ হাজার। থ্যালাসেমিয়া রোগের এই উচ্চ প্রবণতার কারণ হিসেবে ধারণা করা হয়—(ক) থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে অজ্ঞতা, (খ) পারিবারিক বিবাহের প্রবণতা ও (গ) দুজন বাহকের মধ্যে বিবাহ।

থ্যালাসেমিয়ার বাহকেরা রোগী নয়, তাদের কোনো উপসর্গ থাকে না; তাই তাদের কোনো চিকিৎসা বা খাদ্যতালিকাগত সীমাবদ্ধতার প্রয়োজন নেই। তবে তাদের গুরুত্ব অন্য বাহককে বিয়ে না করার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধের ওপর নির্ভর। কারণ, দম্পতি দুজনেই যখন বাহক হয়, তখন থ্যালাসেমিক শিশুর জন্মের সম্ভাবনা ২৫ শতাংশ (চারটি জন্মের মধ্যে অন্তত একজন শিশু) এবং ৫০ শতাংশ বাহক হওয়ার সম্ভাবনা (চারটি জন্মের মধ্যে দুজন) রয়েছে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অনেক ক্ষেত্রেই সব শিশুই থ্যালাসেমিয়ার রোগ নিয়ে জন্ম নিতে পারে। হিমোগ্লোবিনকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা পর্যন্ত রাখতে নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন করতে হয়। অনেক থ্যালাসেমিয়া রোগী (ই/বিটা এবং থ্যালাসেমিয়া মেজর) ছয় মাস বয়স থেকে সারা জীবনের জন্য ব্লাড-ট্রান্সফিউশন নির্ভরশীল হয়ে থাকে এবং শরীরের অতিরিক্ত আয়রন কমানোর জন্য নিয়মিত চিলেশন করতে হয়।

অনেক ক্ষেত্রে এন্ড্রোক্রাইন জঠিলতা ও অস্টিওপোরোসিস নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন হয়। থ্যালাসেমিয়া ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশনের (টিআইএফ) রিপোর্ট অনুসারে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিশ্বব্যাপী থ্যালাসেমিয়া রোগীদের মধ্যে ১০ শতাংশের কম রোগী সর্বোত্তম সঠিক মানের চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পায়। ২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, অনুমান করা হয়েছিল যে ইতালি ও তুরস্কে ট্রান্সফিউশন-নির্ভর থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার জন্য বার্ষিক খরচ হবে আনুমানিক যথাক্রমে ৩০ হাজার এবং ১৫ হাজার মার্কিন ডলার।

বাংলাদেশে বছরে প্রায় তিন হাজার মার্কিন ডলার (তিন লাখ টাকা) ব্যয় হয়, যা যদিও উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। কিন্তু বেশির ভাই রোগীই নিজের পকেট থেকে ব্যয় করে। সুতরাং থ্যালাসেমিয়া রোগীদের চিকিৎসায় জনস্বাস্থ্য সম্পদের উল্লেখযোগ্য ব্যবহার প্রয়োজন (বার্ষিক প্রায় ২৬ বিলিয়ন)। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা সরকারি হাসপাতালে করা প্রয়োজন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সরকারি হাসপাতাল ও এনসিডিসি এখন পর্যন্ত বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেয়নি।

থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের জন্য কার্যকর ডায়াগনস্টিক ও স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম অপরিহার্য। থ্যালাসেমিয়ার অভিশাপ থেকে জাতিকে বাঁচাতে (ক) বাহক শনাক্তকরণ, (খ) বিয়ের আগে থ্যালাসেমিয়ার পরীক্ষা, (গ) থ্যালাসেমিক প্রিনেটাল টেস্ট (গর্ভাবস্থার ১২-১৬ সপ্তাহের মধ্যে) এবং (ঘ) জেনেটিক কাউন্সেলিং ও সচেতনতা তৈরি করার লক্ষ্যে থ্যালাসেমিয়াকে কমিউনিটি শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত করা জরুরি।

থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে বাংলাদেশে সাইপ্রাসের অভিজ্ঞতা অনুসরণ করা যেতে পারে। সাইপ্রাসে থ্যালাসেমিয়া একটি গুরুতর সমস্যা ছিল (৩৩ শতাংশ বাহক)। ১৯৭৬ সালে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনার কৌশল গ্রহণ করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল (ক) থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত নবজাতক শিশুর জন্ম বন্ধ করা এবং (খ) বিদ্যমান থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য ভালো চিকিৎসা সুবিধা প্রদান করা।

১৯৭৬ সালে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলোকে থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করা শুরু হয়। ১৯৮০ সালে বিবাহপূর্ব স্ক্রিনিং আইন দ্বারা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। ১৯৮৪ সালে প্রিনেটাল টেস্ট শুরু হওয়ার পর থ্যালাসেমিয়া রোগীর জন্মহার হ্রাস পায়। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে মাত্র পাঁচটি থ্যালাসেমিক শিশুর জন্ম হয়েছে। গত পাঁচ বছরে কোনো থ্যালাসেমিক শিশুর জন্ম হয়নি। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের সঠিক চিকিৎসা দেওয়ার ফলে গড় আয়ু বৃদ্ধি পায় এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন ও কাজ করা সম্ভব হয়। ফলে থ্যালাসেমিয়া রোগীরা আর পরিবারের ও সমাজের জন্য বোঝা ছিল না।

বর্তমানে বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা। সরকারের উচিত অবিলম্বে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ ও চিকিৎসার জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা। বিদ্যমান থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার মান (মেডিকেল ও নিরাময়) ব্যবস্থা করা উচিত। পরিকল্পনা এমনভাবে করতে হবে যাতে আগামী পাঁচ বছরে কোনো থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুর জন্ম না হয়। থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের প্রধান পদ্ধতি হলো স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম। প্রাথমিকভাবে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ গ্রুপের জন্য স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম (১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের) অনতিবিলম্বে শুরু করা উচিত।

অধ্যাপক ডা.

এম এ খান হেমাটোলজিস্ট ও ট্রান্সপ্ল্যান্ট ফিজিশিয়ান এবং উপদেষ্টা, বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতি।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক শ শ র জন ম র ব হক র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ডিএসইতে সূচকের উত্থান, সিএসইতে পতন

চলতি সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস রবিবার (১৬ নভেম্বর) ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সূচকের উত্থানের মধ্যে দিয়ে লেনদেন শেষ হয়েছে। কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিক পতনের ফলে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৪ হাজার ৭০০ পয়েন্টের ঘরে নেমেছে। 

এ দিনে আগের কার্যদিবসের চেয়ে ডিএসই ও সিএসইতে টাকার পরিমাণে লেনদেন কমেছে। সাড়ে চার মাস আগের অবস্থানে নেমে এসেছে লেনদেন ও সূচক। ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার এবং মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিটের দাম বাড়লেও সিএসইতে কমেছে।

আরো পড়ুন:

বেক্সিমকো সিকিউরিটিজের সনদ নবায়ন বাতিল

প্রথম প্রান্তিকে প্রাণের মুনাফা কমেছে ১.১৬ শতাংশ

বাজার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অনেক দিন ধরে পুঁজিবাজারে লেনদেনের শুরুতে সূচকের উত্থান দেখা গেলেও লেনদেন শেষে তা পতনে রূপ নেয়। রবিবার সকালে ডিএসইএক্স সূচকের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় লেনদেন শুরু হয়। তবে, লেনদেন শুরুর ১০ মিনিট পর থেকে সূচকের পতন দেখা যায়। এক পর্যায়ে সূচক ৮০ পয়েন্টের বেশি পতন ঘটে। তবে, লেনদেনের শেষ হওয়ার আধা ঘণ্টা আগে সূচক আবার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় ফিরে আসে, যা লেনদেন শেষ হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। কয়েক মাসের ব্যবধানে পুঁজিবাজারে লেনদেন অনেক কমেছে।

ডিএসই ও সিএসই সূত্রে জানা গেছে, দিনশেষে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের চেয়ে ২৯.৪৬ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৪ হাজার ৭৩২ পয়েন্টে।

এদিন ডিএসই শরিয়াহ সূচক ৮.১৬ পয়েন্ট কমে ৯৮৫ পয়েন্টে এবং ডিএস৩০ সূচক ৯.২৭ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৮৬০ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

ডিএসইতে মোট ৩৮৪টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে ২৩৬টি কোম্পানির, কমেছে ১১৩টির এবং অপরিবর্তিত আছে ৩৫টির।

এদিন ডিএসইতে মোট ২৯৮ কোটি ১০ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয়েছিল ৩৮৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট।

অন্যদিকে, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সিএসসিএক্স সূচক আগের দিনের চেয়ে ৫০.৮৬ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৮ হাজার ২৬৮ পয়েন্টে। সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৭৪.৩৭ পয়েন্ট কমে ১৩ হাজার ৩২৬ পয়েন্টে, শরিয়াহ সূচক ৩.৯৬ পয়েন্ট কমে ৮৪০ পয়েন্টে এবং সিএসই ৩০ সূচক ৩৮.৯৮ পয়েন্ট কমে ১২ হাজার ১৩৬ পয়েন্টে অবস্থান করছে।

সিএসইতে মোট ১৪৬টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে ৪৭টি কোম্পানির, কমেছে ৮২টির এবং অপরিবর্তিত আছে ১৭টির।

সিএসইতে ৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয়েছিল ৭ কোটি ২২ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট।

ঢাকা/এনটি/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ডিএসইতে সূচকের উত্থান, সিএসইতে পতন
  • থাইল্যান্ডে চালের দাম ১৫ বছরে সর্বনিম্ন, বিশ্ববাজারে এ বছর কমেছে ১৪%
  • বাঙালি মুসলমান চিন্তার মেরুকরণ