শিল্প খাতে বিশেষত গ্যাসের সংকটজনিত কারণে যেই ঝুঁকি সৃষ্টি হইয়াছে, উহা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। বুধবার প্রকাশিত সমকালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেবল তৈয়ারি পোশাক খাতেই গ্যাস মিলিতেছে চাহিদার ৪০ শতাংশেরও কম। ইহার ফলে এই খাতের ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ঝুঁকির মধ্যে রহিয়াছে। কারখানার চাকা ধুঁকিয়া ধুঁকিয়া ঘুরিবার কারণে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাইতেছে। ব্যয় পোষাইতে না পারিয়া অনেক কারখানা বন্ধ হইয়া গিয়াছে। রপ্তানি আদেশ পালনে বিলম্ব হইবার কারণে বাতিল হইতেছে বহু আদেশ। হ্রাস পাইতেছে রপ্তানি আয়। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলিয়াছেন, গত ফেব্রুয়ারি হইতে এপ্রিলের মধ্যে তিতাস গ্যাস প্রতিদিন শিল্প খাতে ১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হ্রাস করিয়াছে। এহেন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকিলে বস্ত্রকলগুলির উৎপাদন আরও হ্রাস পাইয়া একসময় বন্ধ হইয়াও যাইতে পারে। ইস্পাত কারখানাগুলি দিবসে গ্যাসের চাপ না থাকায় চলিতেছে রাত্রিকালে। ইহাতে ব্যয় দাঁড়াইয়াছে দেড় হইতে দ্বিগুণ। বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সভাপতি ও মুন্নু সিরামিকের ভাইস চেয়ারম্যান মইনুল ইসলাম বলিয়াছেন, এক বৎসরের অধিক কাল ধরিয়া উক্ত খাতেও অনুরূপ ভয়াবহ পরিস্থিতি চলমান। খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পেও উৎপাদন ভয়াবহরূপে ব্যাহত হইতেছে। বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকিয়া থাকিতে ডিজেল ব্যবহার করিয়া উৎপাদন বহাল রাখিতে গিয়া ব্যয় বৃদ্ধির চাপ উদ্বেগজনক পর্যায়ে। স্বাভাবিকভাবেই এই অবস্থায় শিল্পে নূতন গ্যাস সংযোগ প্রায় বন্ধ হইয়া রহিয়াছে। পুরাতন কারখানায় লোড বৃদ্ধির অনুমতিও দুর্লভ হইয়া পড়িয়াছে। মোদ্দাকথা, বিনিয়োগে স্থবিরতা নামিয়া আসিয়াছে, যাহা কর্মসংস্থান-প্রত্যাশীদের জন্য আদৌ সুসংবাদ নহে। উহার ধারাবাহিকতায় বেকারত্ব বৃদ্ধি পাইলে নূতন করিয়া সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা যে অবশ্যম্ভাবী, তাহা বুঝিতে বিশেষজ্ঞ হইতে হয় না।
সত্য, এহেন গ্যাস সংকট রজনীকালেই সৃষ্টি হয় নাই। অন্তর্বর্তী সরকারের উহা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। বিগত সরকারসমূহের ভ্রান্ত নীতির কারণে কয়েক বৎসর ধরিয়াই দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন হ্রাসমান। দেশে এখন দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। মঙ্গলবার পেট্রোবাংলা সরবরাহ করিয়াছে ২৭২ কোটি ঘনফুট গ্যাস। তন্মধ্যে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলি হইতে সরবরাহ হইয়াছে ১৮৮ কোটি ঘনফুট। এলএনজি আমদানি করিয়া ঘাটতি মিটাইবার চেষ্টা হইলেও আন্তর্জাতিক বাজারে বিবিধ কারণে ইহার মূল্যবৃদ্ধি এবং তৎসহিত ডলার সংকট সেই সকল চেষ্টাকে ব্যর্থ করিয়া দিয়াছে। আমদানীকৃত এলএনজি হইতে প্রত্যহ গড়ে ৭৫-৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যায়। তবে ইহা জানাইয়া রাখা প্রয়োজন, সরকার এক প্রকার এধার-কা মাল ওধার এবং ওধার-কা মাল এধার করিয়া গ্যাস সংকট মোকাবিলায় সচেষ্ট। এতদিন শিল্পে গ্যাস সরবরাহ হ্রাস করিয়া বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি করিয়াছিল। এখন শিল্প মালিকদের চাপে বিদ্যুৎ খাতকে বঞ্চিত করিয়া শিল্পে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হইয়াছে। কিন্তু প্রথমত, ইহাতেও শিল্পের গ্যাস সংকটের উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সুরাহা হইবে বলিয়া মনে হয় না। দ্বিতীয়ত, বিদ্যুতে গ্যাস সরবরাহ হ্রাস পাইলে হয় লোডশেডিং বর্তমান অপেক্ষা বৃদ্ধি করিতে হইবে, নতুবা জ্বালানি তৈল ব্যবহার করিয়া বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক রাখিতে গেলে উৎপাদন ব্যয় অত্যধিক বৃদ্ধি পাইবে।
যদি বলা হয়, গ্যাসের ঘাটতি সরকারকে এক প্রকার উভয় সংকটে ফেলিয়াছে, তাহা হইলে নিশ্চয় ভুল হইবে না। অথচ আমাদের বিশ্বাস, যথাসময়ে উদ্যোগ লইলে এই সংকট সম্পূর্ণ নিরসন না হইলেও অন্তত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস করা যাইত। বিগত সরকারের সময় আমরা ডলার সংকটে জ্বালানি তৈল বা এলএনজি আমদানির জন্য আমদানিপত্র খুলিতে সমস্যা হইবার কথা প্রায়শ শুনিতাম। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ অহরহ বলিতেছেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পাইয়াছে, ডলারের প্রাপ্যতাও সহজ হইয়াছে। তবে কেন যথেষ্ট পরিমাণে এলএনজি আমদানি হইল না? যাহাই হউক, সরকারকে অবিলম্বে এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করিতে হইবে যেন শিল্পে গ্যাস সরবরাহ যথেষ্ট হয়, অধিকন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনও পর্যাপ্ত হয়।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গ য স সরবর হ সরবর হ হ ঘনফ ট আমদ ন সরক র হইয় ছ
এছাড়াও পড়ুন:
থাইল্যান্ডে চালের দাম ১৫ বছরে সর্বনিম্ন, বিশ্ববাজারে এ বছর কমেছে ১৪%
এশিয়াসহ বিশ্বের চালের বাজারে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এশিয়ায় চালের অন্যতম বৃহৎ সরবরাহকারী থাইল্যান্ডে চালের দাম ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। মূলত বাজারে চালের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
থাইল্যান্ডসহ চালের অন্যান্য বড় উৎপাদনকারী দেশ ভারত ও মিয়ানমারে উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ববাজারেও চালের দাম কমছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার খাদ্যসূচক অনুযায়ী, চলতি বছর চালের দাম কমেছে ১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। এমনকি বিশ্ববাজার চালের দাম আগস্ট মাসে আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে। খবর দ্য নেশনের
থাইল্যান্ডে চালের দামের এই নিম্নমুখী প্রবণতা একদম নতুন কিছু নয়, বেশ কয়েক মাস ধরেই এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে দেশটির কৃষিবিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দীর্ঘ সময় ধরে চালের দাম কম থাকায় দেশটির কৃষকেরা ধানের আবাদ কমিয়ে দিতে পারেন।
থাইল্যান্ডে গত বৃহস্পতিবার ৫ শতাংশ খুদযুক্ত চালের দাম দাঁড়ায় টনপ্রতি ৩৩৫ ডলার। আগের সপ্তাহে যা ছিল ৩৩৮ ডলার। থাইল্যান্ডের কৃষি খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত ১৪ বছরে থাই সরকারের জনতুষ্টিমূলক নীতির কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সরকার কৃষকদের সন্তুষ্ট করতে বিভিন্ন ধরনের নিশ্চয়তা দিয়েছে। এসব কর্মসূচিতে প্রায় ৪০ বিালিয়ন বা ৪ হাজার কোটি ডলার ব্যয় হলেও একধরনের নীতিগত ফাঁদ তৈরি হয়েছে। ফলে কৃষকেরা প্রযুক্তি উন্নয়ন, দক্ষতা বাড়ানো কিংবা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো থেকে নিরুৎসাহিত হয়েছেন।
সেই সঙ্গে থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীরা জানান, বর্ষা মৌসুমের শেষ দিকে বাজারে নতুন চালের সরবরাহ এসেছে। এটাও দাম কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। অন্যদিকে ভারত ও মিয়ানমারের মতো প্রতিযোগী দেশগুলো চালের গুণগত মানের উন্নতি করেছে। আধুনিকতা এনেছে উৎপাদনব্যবস্থায়। ফলে তারা কম খরচে ভালো মানের চাল রপ্তানি করতে পারছে। কিন্তু থাইল্যান্ড এখনো ভর্তুকিনির্ভর ব্যবস্থায় আটকে আছে। এ পরিস্থিতিতে দেশটির কৃষকেরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
এফএওর সূচক কমেছেপ্রতি মাসেই খাদ্যমূল্যসূচক করে থাকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। তাতে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছর বিশ্ববাজারে চালের দাম কেমেছে ১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। গত অক্টোবর মাসে চালের মূল্যসূচক নেমে এসেছে ৯৮ দশমিক ৪–এ। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে তা ছিল ১১৩ দশমিক ৬। সেই সঙ্গে ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে চালের মূল্যসূচক ছিল ১২৫ দশমিক ৭। সেই হিসাবে এক বছরে চালের দাম কমেছে ২১ দশমিক ৭ শতাংশ।
চালের দামের এই পতন শুরু হয় ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ চাল রপ্তানিকারক দেশ ভারত ধাপে ধাপে রপ্তানি–নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে শুরু করে তখন। এ ঘটনা চালের বাজারে বড় প্রভাব ফেলে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সব ধরনের চালের মূল্যসূচক ১৩ শতাংশ কমেছে। খবর ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের
অথচ ২০২৪ সালের শুরুতে এর উল্টো চিত্র দেখা গেছে। তখন ভারত একের পর এক রপ্তানি সীমাবদ্ধতা জারি করলে ২০০৮ সালের পর চালের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। বিশ্বজুড়ে ভোক্তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। মানুষের মধ্যে মজুতের প্রবণতা তৈরি হয়। অন্যান্য উৎপাদক দেশেও সুরক্ষাবাদী পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এর পর থেকে চালের দাম কমতে শুরু করে।