সেই শৈশব থেকে আমরা পুরান ঢাকার বংশাল রোডের বাসায় থাকি। স্কুলে পড়ি পঞ্চম শ্রেণিতে, কাপ্তানবাজার রোডে নবাবপুর সরকারি হাইস্কুলে। সেই স্কুল থেকেই আমরা তিন ভাই ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাস করেছি।
সরদার ফজলুল করিম (১ মে ১৯২৫—১৫ জুন ২০১৪)—আমাদের সরদার ভাইয়ের কথা তখন থেকেই আমরা জানি। আমাদের কাছে সব সময়েই সরদার ভাই একজন আদর্শ মানুষ, এক বিশেষ অনুপ্রেরণার নাম। সেটা সেই কৈশোর-যৌবনে যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে উজ্জ্বল, হৃদয়ের গভীরে সজীব।
সেই পঞ্চাশের দশকে আমাদের পারিবারিক পরিবেশ বামপন্থী রাজনৈতিক ধারায় প্রভাবিত ছিল। যদিও বাবা এসবের ভীষণ বিরোধী ছিলেন। আর যেটা সব সময়েই হয়ে থাকে—আমাদের সব বিষয়ে আম্মার সমর্থন ছিল অকুণ্ঠ।
সেই চল্লিশের দশকে, বিশেষ করে আমার বাবা-কাকাদের বাড়ি নরসিংদীর মনোহরদী থানার পীরপুর, চালাকচরসহ একাধিক গ্রামজুড়ে বামপন্থী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। সেখানে নেতা ছিলেন আন্দামানফেরত কমিউনিস্ট নেতা অন্নদা পাল। সেই স্কুল-কলেজে থাকাকালে আমার কাকারা, যাঁরা অস্থায়ী-স্থায়ীভাবে নানা সময়ে আমাদের বংশালের বাড়িতে এসে থাকতেন, তাঁদের কাছ থেকে সে অঞ্চলের এই বাম ধারার রাজনীতি, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নাম, গণসংগীত ইত্যাদি সম্পর্কে জেনেশুনে আন্দোলিত হতাম। এসবের সূত্রেই কাকাদের কাছ থেকে আমরা সরদার ফজলুল করিমের নাম শুনি। তখনই শুনেছিলাম, বরিশালের সরদার ফজলুল করিম একজন দারুণ ভালো ছাত্র। এমনই দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলেন যে লাইনটানা খাতায় প্রথমে পেনসিল দিয়ে লিখতেন। পরে অন্য কালি দিয়ে লাইনের ফাঁকে ফাঁকে আবার লিখতেন। এভাবে পড়াশোনা করতে হয়েছে তাঁকে।
১৯২৫ সালে বরিশালের আঁটিপাড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ছোটবেলাতেই কৃষিকাজে বাবাকে সাহায্য করেছেন। তরিতরকারি বিক্রি করেছেন বাজারে। ছোটবেলায় নিয়মিত নামাজ পড়তেন, আজান দিতেন। বাড়ির সবাইকে বিষাদ-সিন্ধু পড়ে শোনাতেন। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন গলাচিপায়। বরিশাল জেলা স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভতি৴ হয়ে সেখান থেকেই ম্যাট্রিক পাস করেন। বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে ভতি৴ হলেও সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। এবং বলতে গেলে সংসারের দায়িত্ব নেন। বড় ভাই মউজে আলী ছিলেন আসলে প্রকৃত অভিভাবক।
আমরা শুনেছিলাম, দর্শনশাস্ত্রে বিএ ও এমএ ক্লাসে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন সরদার ফজলুল করিম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ১৯৪২ সালে। পড়তে চেয়েছিলেন ইংরেজি। দর্শনের অধ্যাপক হরিদাস ভট্টাচার্যের বক্তৃতা শুনে দর্শন বিভাগে চলে যান। ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমান ঢাকা কলেজ) থেকেও উচ্চমাধ্যমিকে সারা দেশের মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছিলেন। ইংরেজির অধ্যাপক সরদার ভাইকে ক্লাসে ক্লাসে নিয়ে দেখিয়েছিলেন। ১৯৪০ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাস করেছিলেন এবং পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে সেরা ফল ছিল তাঁর। এমএ পরীক্ষার ফল বের হওয়ার আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে শুরু করেছিলেন। পরে দর্শন বিভাগে দ্রুত ও সহজেই শিক্ষকতার চাকরি হয়ে যায়।
সেই তিরিশের দশকের শেষ ভাগে (১৯৩৯) ঢাকা শহরে প্রগতি লেখক সংঘ গড়ে উঠেছিল। নেতৃত্বে ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্ত, কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত প্রমুখ। উগ্রপন্থীদের হাতে নিহত লেখক সোমেন চন্দও ছিলেন সংগঠক। এর কাজের সঙ্গে সরদার ভাই যুক্ত হয়েছিলেন। আরও যুক্ত হয়েছিলেন কবি সানাউল হক, সাংবাদিক সৈয়দ নূরুদ্দিন, লেখক আবদুল মতিন, অধ্যাপক নাজমুল করিম, বিজ্ঞানী আবদুল্লাহ আল–মুতী শরফুদ্দিন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের রবি গুহ (পরে কলকাতায় চলে যান) প্রমুখ। বিশেষভাবে সক্রিয় ও যুক্ত ছিলেন লেখক ও অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। সরদার ফজলুল করিম তাঁদের সাথি হয়েছিলেন এবং যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন সাহিত্যিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা কর্মকাণ্ডে। এর মধ্যে তেতাল্লিশের মন্বন্তরের সময়ে পুরান ঢাকার নয়াবাজারে লঙ্গরখানায় কাজের অভিজ্ঞতা থেকে সমাজের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে নিজের ভেতরেই সমাজ পরিবর্তনের বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। এভাবেই ধীরে ধীরে সরদার ফজলুল করিম একজন একনিষ্ঠ বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন।
বরিশালের জিলা স্কুলে সরদার ভাইয়ের বন্ধু ছিলেন মোজাম্মেল হক। রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিলেন। পরে সাংবাদিক। আরএসপির (রেভল্যুশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টি) সদস্য ছিলেন। একদিন একটা বই দিয়ে বললেন, তুমি এটা নাও। এক রাতের মধ্যে শেষ করবে। কেউ যেন না জানে। তখন নিষিদ্ধ সেই বইটি ছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পথের দাবী। সরদার ভাই বলেন, সাংঘাতিক বই। তাঁর লেখা থেকে আরও জানতে পারি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ঢাকায় এসে বলেছিলেন, ‘আমি রাজনীতিতে এসেছি পথের দাবী পড়ে।’ সরদার ভাইয়েরও হাতেখড়ি হয় পথের দাবী পড়ে।
আমরা এটাও জেনেছিলাম, ১৯৪৫ সালে সরদার ফজলুল করিম লন্ডনের শিক্ষাবৃত্তি পেয়েছিলেন। মুসলিম কোনো ছাত্রের জন্য এটা নির্দিষ্ট ছিল। বৃত্তিটি ছিল দর্শনে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য। এই বৃত্তির জন্য কলকাতায় রাইটার্স বিল্ডিংয়ে বোর্ডের সম্মুখীন হতে হতো। কলকাতায় গিয়ে সরদার ভাই সে সময়ে কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মুজফ্ফর আহমদ ও নৃপেন চক্রবর্তীর (পরে ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী) সঙ্গে দেখা করে বৃত্তির কথা বললেন।
ঘটনাটা সরদার ভাই তাঁর স্মৃতিকথা সেই সে কাল: কিছু স্মৃতি কিছু কথায় এভাবে লিখেছেন: ‘বিলেত যাব, পাস করে আসব এসব নিয়ে ভাবতাম না। আমি যেই বললাম, “আমি বিলেত যাব”, ওঁরা হাসতে হাসতে ঠাট্টার ছলে বললেন, “আপনি বিলেত যাবেন, আর আমরা এখানে বসে ভেরেন্ডা ভাজব?”’ সরদার ভাইয়ের প্রশ্ন, তাহলে আমাকে কী করতে হবে। ওঁরা বললেন, ‘কাঁথা-কম্বল নিয়ে পার্টি অফিসে চলে আসেন। কী করতে হবে বোঝেন না?’ তো কাঁথা-কম্বল নিয়ে পার্টি অফিসে যাননি, কিন্তু ইন্টারভিউ কার্ড ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। ইতিহাসের অধ্যাপক মাহমুদ হাসান (পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন এবং তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি জাকির হোসেনের ভাই) ওই বোডে৴র সদস্য ছিলেন। ঢাকায় এসে সরদারকে তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘সরদার কেন আপনি গেলেন না? হোয়াই ডিড ইউ নট গো?’ সরদার ভাই বললেন, ‘না, স্যার, আমি দেশ ছেড়ে যেতে আগ্রহী নই।’ মাহমুদ হাসান আশ্চর্য হয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালের শেষে বা ১৯৪৮ সালের শুরুতে ঢাকার কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্য এক সভায় সভাপতিত্ব করবেন সরদার ফজলুল করিম। বক্তা মুনীর চৌধুরী। সভা সদরঘাটের কাছে লেডিস পার্কে। কিন্তু শুরু হতে না হতেই শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের তরুণ নেতা-কর্মীরা লাঠিসোঁটা আর ইটপাটকেল দিয়ে সভা ভেঙে দেন। সরদার ভাই মুনীর চৌধুরীর নাম দিয়েছিলেন ‘কিং অব ওয়ার্ডস’, অর্থাৎ ‘শব্দের রাজা’। সবাই মুনীর চৌধুরীকে ভালোবাসতেন।
পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর পার্টির নির্দেশে ১৯৪৮ সালের মাঝামাঝি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে আত্মগোপনে চলে গেলেন। পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর কমিউনিস্ট পার্টির ওপর নির্যাতন ক্রমেই বাড়ছিল। সারা দেশে নেতা-কর্মীরা গ্রেপ্তার হচ্ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব সরদার ফজলুল করিমের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দিয়ে আত্মগোপনে চলে যেতে বলেন। তিনি সম্মত হলেন। শিক্ষকেরা আশ্চর্য হয়ে গেলেন। সরদার ভাই লিখেছেন, ‘আমি ইউনিভার্সিটি ছেড়ে পার্টির কাজে চলে এলাম। আমি একটা গোবেচারা ছেলে, কমিউনিস্ট নেতারা আমার মতো একটা মুসলমান ক্যাডার পেয়েছে, এটা তাদের জন্য আনন্দের ব্যাপার।’
১৯৪৯ সালে সরদার ভাই পার্টির নেতৃত্বের নির্দেশ মেনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দিলেন। চাকরি ছাড়ার পর খবর পরিবারের কাছে পৌঁছে গেল। সরদার ভাইয়ের বাবা আর বড় ভাই ঢাকায় সিদ্ধেশ্বরীতে ছোট ভগ্নিপতির বাসায় গিয়ে সরদার ভাইকে পেলেন। সরদার ভাই লিখছেন, ‘বাবা তখন বৃদ্ধ মানুষ। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “তুই একটা পাগল। তুই এগুলো কী আরম্ভ করেছিস? তোকে আজ আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। বাড়ি যেতে হবে।”’ তখন তাঁর মনে প্রশ্ন, ‘আমি বন্ধন থেকে কীভাবে মুক্তি পাব।’ ভেবে ঠিক করলেন, বাবা আর বড় ভাই যখন মাগরিবের নামাজ পড়তে বের হবেন, তখন তিনি পালাবেন। এবং সেটাই করলেন।
সরদার ভাই আত্মগোপনে গেলেন। কিন্তু ঢাকায় তাঁর থাকার কোনো জায়গা করা গেল না। সরদার ভাইকে বলা হলো কিছু সময়ের জন্য কলকাতা চলে যেতে। নানা পথ ঘুরে সীমান্ত পেরিয়ে তিনি চলে গেলেন কলকাতায়। সেখানেও থাকার জায়গা পাওয়া কঠিন হলো। কবি আহসান হাবিবের বাসায় থাকার জায়গা হলো। কিন্তু তাঁকে খুঁজতে পুলিশ আহসান হাবিবের বাসায় গভীর রাতে হানা দিল। পুলিশের কাছে খবর ছিল, পূর্ব পাকিস্তান থেকে এক ‘সাংঘাতিক কমিউনিস্ট লিডার’ সরদার ফজলুল করিম লুকিয়ে আছে কলকাতায়। পুলিশ পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে সরদার ভাই সরলভাবে বললেন, নাম ফজলুল করিম। কিন্তু পুলিশ তো খুঁজছে ‘সরদার ফজলুল করিম’ নামে ভয়ংকর এক কমিউনিস্ট নেতাকে। এভাবেই সেই যাত্রায় পার পেয়ে গেলেন সরদার ভাই। তারপর ফিরে এলেন ঢাকায়।
এবার পার্টি নেতৃত্ব সরদার ভাইয়ের আত্মগোপনে থাকার ব্যবস্থা করলেন নরসিংদী জেলার সেই মনোহরদীর গ্রাম পীরপুর ও চালাকচরে। তিনি একাধিক বাড়িতে থেকেছেন। কখনো কখনো গোয়ালঘরে ঘুমাতে হয়েছে। আর খাওয়া বলতে ভাতের সঙ্গে কখনো পুঁটি মাছ, কখনো শুঁটকি ইত্যাদি। কখনো কাঁঠাল খেয়েই সারা দিন শেষ। তার মধ্যেই আনন্দে থাকেন সরদার ভাই। চালাকচর গ্রামটা সরদার ভাইয়ের পছন্দ হয়েছিল। সরদার ভাই কোনো মুসলিম পরিবারে থাকলে নাম হতো মজিদ, আর হিন্দু পরিবারে থাকলে অশোক বা আশীষ। তবে সব মিলিয়ে সরদার ভাই বলেছেন, ‘দ্যাট ওয়াজ আ ভেরি রোমান্টিক লাইফ ফর মি।’
সরদার ভাই চালাকচরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বামপন্থী শিক্ষক আখতারুজ্জামানের কথা লিখেছেন তাঁর স্মৃতিকথায়। তাঁকে আমরা আখতার কাকা বলে ডাকতাম। সেই শৈশবে আমাদের বংশালের বাসায় তিনি আসতেন। মনে পড়ে, গণসংগীত গাইতেন। আমরা উদ্দীপ্ত হয়ে শুনতাম।
এভাবে কয়েক মাস চালাকচরে থাকার পর ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে সরদার ভাইয়ের কাছে বার্তা যায় ঢাকায় যেতে, পার্টির বৈঠকে যোগ দিতে হবে। ঢাকায় এসে উঠলেন তাঁতীবাজারের পার্টির গোপন আস্তানায়। সেটা ছিল সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্তের বাসা। তাঁতীবাজারের সে বাসায় ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির কমিটির বৈঠক শুরু হলো। আলোচনা চলছে। দুপুরের খাবারের পর সবাই বিশ্রাম নিচ্ছেন, এমন সময় পুলিশ বাসায় হানা দিল। বাড়ির দরজা ভেঙে ঢুকে সবাইকে গ্রেপ্তার করল। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা জেলা কমিটির সম্পাদক ফণী গুহ, জ্ঞান চক্রবর্তীসহ কয়েকজন। সন্তোষ গুপ্তকে গ্রেপ্তার করলে তাঁর মা চ্যালাকাঠ দিয়ে পুলিশদের আক্রমণ করেন। তাঁকেও গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।
সরদার ভাই এ–বাড়ি ও–বাড়ির ছাদে ছোটাছুটি করে ধরা পড়লেন। সরদার ভাই সেই যে গ্রেপ্তার হলেন, তারপর ঢাকা জেল থেকে রাজশাহী, সিলেট জেলে আটক থাকলেন। ৫৮ দিনের অনশন, ধর্মঘটসহ একাধিক অনশন ধর্মঘটে অংশ নিলেন। তখন কমিউনিস্ট পার্টির নীতি ছিল ‘সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ’। জেলের ভেতরেও সে ধরনের কিছু কর্মসূচি নেওয়ার চেষ্টা ছিল।
সরদার ফজলুল করিম এবং তাঁর মতো শত শত বামপন্থী ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মী তখন জেলে। এর মধ্যে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন হলো, ধারাবাহিক গণ-আন্দোলন গড়ে উঠল, ২১ দফাভিত্তিক আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, গণতান্ত্রিক দল, নেজামে ইসলামসহ বৃহত্তর যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলো। ১৯৫৪ সালে ওই নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হলো। পূর্ব পাকিস্তানের এ কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে বিজয়ী হলো যুক্তফ্রন্ট। এ কে ফজলুল হক হলেন গভর্নর, আবু হোসেন সরকার হলেন প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী। পরে আবার আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার হলো পূর্ব পাকিস্তানে। প্রায় একই সময়ে কেন্দ্রেও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রিত্বে একাধিক দল মিলে সরকার চলছিল।
১৯৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ধীরে ধীরে রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে শুরু করে। পরে একসঙ্গে অনেকে মুক্তি পেলে মুক্তি পাওয়া কারাবন্দীদের জন্য ঢাকা জেলার কোর্ট মিলনায়তনে একটি সংবর্ধনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ভাবতে ভালো লাগে যে সৌভাগ্যক্রমে আজিজ কাকার সঙ্গে আমিও ছিলাম সে অনুষ্ঠানে। একের পর এক রাজবন্দী সম্পর্কে সুন্দর সাবলীল ভাষায় কথা বলে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন সরদার ফজলুল করিম। সেই প্রথম আমি সামনাসামনি দেখি সরদার ভাইকে। স্পষ্ট মনে আছে যে তিনি সন্তোষ গুপ্তের মায়ের পরিচয় দিতে গিয়ে পুলিশকে চ্যালাকাঠ দিয়ে মারা এবং পরে গ্রেপ্তার হওয়ার সেই ঘটনা খুব উদ্দীপ্ত ভাষায় বর্ণনা করেছিলেন।
সরদার ভাই জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার আগেই পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীদের মধ্যে প্রায় ৩০ জন সদস্য ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও সমর্থক। কমিউনিস্ট পার্টি পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে একজন সদস্যের দাবি জানাল। আওয়ামী লীগ ও অন্যরাও সে দাবি মেনে নেয়। সরদার ফজলুল করিম আওয়ামী লীগের তালিকার প্রার্থী হিসেবে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হন। তখন তো কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ও বেআইনি। পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য হওয়ার পরও পুলিশ ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে আরও অনেকের সঙ্গে সরদার ভাইকেও গ্রেপ্তার করেছিল।
এরপর থেকে নানা দায়িত্বে সরদার ভাই যে ঘটনাবহুল জীবন কাটিয়েছেন, সে গল্প দীর্ঘ। তবে বলতে গেলে সারা জীবনই তিনি আর্থিক সংকটের মধ্যে কাটিয়েছেন। আমরা যখন ভোরের কাগজ-এ কাজ করি, সরদার ভাই অফিসে এসেছেন—কোমর ভেঙে গেছে, হাঁটতে পারেন না, ক্রাচে ভর দিয়ে সিঁড়িতে করে দোতলা বা তিনতলা উঠে এসেছেন। সেসব স্মৃতি এখন মনে হলে চোখ ভিজে যায়। কীভাবে এমন মানুষ হয়ে উঠলেন সরদার ভাই!
আমরা সবাই মিলে সরদার ভাইকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠান করেছিলাম সেগুনবাগিচার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। কী অসম্ভব ভালো একটি বক্তৃতা যে দিয়েছিলেন তিনি! ওইটুকু মাত্র সম্মান তাঁর প্রতি আমরা দেখাতে পেরেছিলাম।
প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে সুযোগ-সময় পেলেই সরদার ভাইয়ের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। কত কিছু জেনেছি, শিখেছি। এ জীবন থেকে সেসব কখনো হারিয়ে যাবে না। আমরা আশা করব, আগামী প্রজন্মও একইভাবে সরদার ফজলুল করিমের লেখালেখি আর জীবনচর্চা থেকে নতুন নতুন উপাদান সংগ্রহ করে নিজেদের যাত্রাপথকে আরও উজ্জ্বল করবেন। প্রগতির পতাকা সামনে নিয়ে চলবেন। তাহলেই সরদার ফজলুল করিমকে যথার্থভাবে স্মরণ করা হবে।
lলেখাটি লেখকের অপ্রকাশিত একটি পাণ্ডুলিপি থেকে নেওয়া হয়েছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ল ন সরদ র ভ ই গ র প ত র কর র জন ত ক কর ছ ল ন হয় ছ ল ন কলক ত য় চ ল কচর ব মপন থ প স কর এক ধ ক র চ কর র জন য আম দ র পর ব র বড় ভ ই বর শ ল কর ম র প রথম সদস য আওয় ম বলল ন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
মঞ্চে আসছে ‘সুড়ঙ্গ’
কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর নাটক `সুড়ঙ্গ' মঞ্চে আনছে নাট্যদল এথিক। নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন মিন্টু সরদার। ২৩ মে শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টায় বাংলাদেশ বাংলাদেশ মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে নাটকটির উদ্বোধনী মঞ্চস্থ করা হবে।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এথিক জানিয়েছে, গুপ্তধন কি সব সময় সবার ভাগ্যে জোটে? গুপ্তধন নিয়ে এক ষোড়শী কন্যার কৌতূহলী ভাবনার জগৎকে তুলে ধরা হয়েছে নাটকে। নাটকের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে ষোড়শী কন্যা রাবেয়াকে ঘিরে। দিন দুয়েক পর রাবেয়ার বিয়ে, হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। রীতিমতো শয্যাগত। ডাক্তার-হেকিম কোনোভাবেই রোগ ধরতে পারে না। ঘটনাটি নাটকীয়তায় মোড় নেয়।
নাটকটির সহযোগী নির্দেশক মনি কাঞ্চন, প্রযোজনা অধিকর্তা রেজানুর রহমান। এথিকের চতুর্দশ প্রযোজনা এটি।
আরও পড়ুনজীবনানন্দ দাশকে নিয়ে ‘কমলা রঙের বোধ’২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাহফুজ আফনান, প্রদীপ কুমার, মনি কাঞ্চন, সুকর্ণ হাসান, আজিম উদ্দিন, রেজিনা রুনি, নাহিদ মুন্না, ঊর্মি আহমেদ, দীপান্বিতা রায়, রুবেল খানসহ আরও অনেকে।
মঞ্চ পরিকল্পনা করেছেন সাইফুল ইসলাম, আলোক পরিকল্পক ঠাণ্ডু রায়হান, আবহ সংগীত করেছেন শিশির রহমান, পোশাক ও রূপসজ্জায় শুভাশীষ দত্ত, কোরিওগ্রাফি করেছেন এম আর ওয়াসেক এবং নাটকের প্রচ্ছদ করেছেন চারু পিন্টু।