পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি জেলেনস্কি, বৃহস্পতিবার তুরস্কে বৈঠক
Published: 12th, May 2025 GMT
রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধে ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি বলেছেন, আমি বৃহস্পতিবার তুরস্কে পুতিনের জন্য অপেক্ষা করব।
জেলেনস্কি বলেন, হত্যাকাণ্ড দীর্ঘায়িত করার কোনো মানে হয় না। আমরা আগামীকাল থেকে একটি সম্পূর্ণ এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতি আশা করছি, যা কূটনীতির জন্য প্রয়োজনীয় ভিত্তি তৈরি করবে। ভলোদিমির জেলেনস্কি সোমবার থেকে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও বৃহস্পতিবার তুরস্কে ইউক্রেনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি হন। এতে আশার আলো দেখছেন বিশ্বনেতারা। খবর-রয়টার্স
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ঘোষণা দিয়েছেন, তারা পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে প্রস্তুত। তিনি আগে যুদ্ধবিরতি, পরে আলোচনা চান। দু’পক্ষকে আলোচনায় বসাতে প্রস্তুত থাকার কথা জানিয়েছে তুরস্কও। নতুন পোপ লিও রোববার তাঁর প্রথম বার্তায় বিশ্বের প্রধান শক্তিগুলোকে আর যুদ্ধ না করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এর আগে ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির ওপর চাপ তৈরি করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ স্যোশালে দেওয়া এক পোস্টে পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে জেলেনস্কির প্রতি এই চাপ তৈরি করেন তিনি। ওই পোস্টে ট্রাম্প বলেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের সঙ্গে কোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তি চান না। এর পরিবর্তে তিনি বৃহস্পতিবার তুরস্কে সরাসরি সাক্ষাতে রক্তবন্যার অবসানে আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। রুশ প্রেসিডেন্টের এই প্রস্তাবে ইউক্রেনের তাৎক্ষণিকভাবে রাজি হওয়া উচিত।
ট্রাম্প বলেন, ইস্তাম্বুলে সাক্ষাতে আলোচনায় কোনো চুক্তির সম্ভাবনা আছে কিনা, তারা অন্তত তা বুঝতে পারবেন। আর যদি না থাকে, তাহলে ইউরোপীয় নেতারা এবং যুক্তরাষ্ট্র জানতে পারবে আসলে কোন পরিস্থিতিতে আছে বিষয়টি এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে। ইউক্রেন আদৌ পুতিনের সঙ্গে কোনও চুক্তি করবে কিনা, আমি এখন সেটি নিয়ে একটু সন্দেহ করছি। কারণ পুতিন এখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার বিজয় উদযাপন নিয়েই ব্যস্ত-যে যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া জেতা সম্ভব হতো না, মোটেই না। এখনই সাক্ষাৎ করুন।
ভ্লাদিমির পুতিনও ইউক্রেনের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কোনো বিলম্ব ছাড়াই, ১৫ মে'র মধ্যেই একটি আলোচনা শুরু হওয়া উচিত। আমরা সিরিয়াস আলোচনা চাই। সংঘাতের মূল কারণ উপড়ে ফেলতে এবং একটি দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই শান্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া শুরু করতে চাই শনিবার গভীর রাতে ক্রেমলিন থেকে দেওয়া বিরল এক ভাষণে এ কথা বলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমার ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁসহ ইউরোপীয় নেতারা ইউক্রেন সফর করে রাশিয়াকে ৩০-দিনের শর্তহীন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সম্মত হওয়ার আহ্বান জানানোর পর পুতিন এমন প্রস্তাব দেন। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বিষয়টি নিয়ে মস্কো চিন্তা করবে বলে জানিয়েছিলেন। তবে তিনি সতর্ক করে বলেছিলেন, কোনো ধরনের চাপ দেওয়া হবে নিতান্তই অর্থহীন।
পুতিন তার বক্তব্যে বলেছেন, তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে আলোচনা হওয়া উচিত বলে যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেটিকে এখনও উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তিনি বলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেন নতুন যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে পারে। এ বিষয়ে রোববার তিনি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোয়ানের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করবেন বলেও জানিয়েছেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স ক ষ ৎ কর ইউক র ন র প রস ত ব
এছাড়াও পড়ুন:
নিভৃতচারী কৃষকের আর্তনাদ কি আমরা শুনছি
কৃষি এবং কৃষকই এ দেশের প্রাণ—এই ধ্রুব সত্যটি নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু বেদনাদায়ক বাস্তবতা হলো, মধ্যস্বত্বভোগী ও কপট ব্যবসায়ীদের কারণে কৃষকের স্বার্থ বরাবরই উপেক্ষিত। নীতিনির্ধারক ও মূলধারার রাজনীতিবিদদের নীরবতা এবং কৃষকের সমস্যা নিয়ে সম্প্রতি জনগুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যকে ‘ট্রল’ করার মতো দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা আমাদের জাতীয় সংবেদনশীলতার অভাবকেই প্রকটভাবে তুলে ধরে।
করোনাকালীন ভয়াবহ সংকটে কৃষি যেভাবে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করে অর্থনীতিকে রক্ষা করেছে, তা আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। অথচ এত কমিশন গঠিত হলেও, কৃষি কমিশন গঠন করা হয়নি। এর মূল কারণ সম্ভবত নিভৃতে কাজ করে যাওয়া কৃষক বা কৃষিশ্রমিকের মূল্য এই সমাজে অনেক সস্তা।
বর্তমানে কৃষি খাত নিয়ে যত আলোচনা—তা সবই যেন নিরাপদ কৃষি, বাণিজ্যিক কৃষি, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ, ভ্যালু চেইন ও উৎপাদন বৃদ্ধিকেন্দ্রিক। প্রধান স্টেকহোল্ডার কৃষক ও তাঁর জীবন-জীবিকার স্বার্থ প্রায়শই থেকে যাচ্ছে অন্তরালে। অন্যান্য পেশাজীবীর মতো কৃষকের কোনো সক্রিয় সংগঠন নেই। চাষাবাদ ফেলে ঢাকা শহরে দাবি আদায়ের আন্দোলনে নামাও তাঁদের পক্ষে অসম্ভব, কারণ তাতে তাঁদের পেটে ভাত জুটবে না।
অথচ কৃষকেরা শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, শারীরিকভাবেও চরম ঝুঁকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ক্যানসারে আক্রান্ত পুরুষ রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পেশায় কৃষক! মাস্ক, গ্লাভস বা রাবারের জুতা চোখে না দেখা, ছেঁড়া গামছা মুখে পেঁচিয়ে বিষাক্ত কীটনাশক স্প্রে করা ভূমিহীন মানুষটা আমাদের কাছে হয়তো ‘কৃষিশ্রমিক’, ‘কৃষক’ নন; কিন্তু খাদ্য উৎপাদনচক্রে তাঁর অবদান সবচেয়ে মৌলিক এবং তাঁর স্বাস্থ্যঝুঁকিও সবচেয়ে বেশি।
সমাজের চোখে ‘কৃষক’ বলতে যখন বিঘার পর বিঘা জমির মালিক, শিক্ষিত বাণিজ্যিক উদ্যোক্তাদের বোঝানো হচ্ছে, তখন প্রান্তিক, নিরক্ষর মানুষগুলোর অস্তিত্ব ও সংগ্রাম প্রায় অস্বীকৃত থেকে যাচ্ছে।
আবার কৃষক ও কৃষির সমস্যা শুধু অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত নয়, এর শিকড় প্রোথিত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাতেও। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বাণিজ্যিক কৃষিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমাদের শিক্ষায় কৃষির নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক দিকগুলো প্রায় উপেক্ষিত।
কৃষকের নিবিড় জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রায়শই অন্ধকারে থাকছে। গান গাইতে গাইতে ধান কাটা, ধান লাগানো বা নবান্ন উৎসব—এসব প্রথা ও রীতিনীতি কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষকের জীবনের আনন্দ, দুঃখ ও শ্রমের প্রকাশ। পাঠ্যক্রমে এসবের অনুপস্থিতি কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে নাগরিকসচেতনতা বৃদ্ধির পথে এক বড় বাধা।আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কৃষির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো আলোচনা বা গবেষণা নেই। কীভাবে নারীর হাত দিয়ে কৃষির সূচনা হয়েছিল—ফসলের বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বপন ও পরিচর্যার প্রথম ধাপগুলোয় নারীর যে ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল, সেই গুরুত্বপূর্ণ নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক দিকগুলো পড়ানো হয় না বললেই চলে।
বাংলার কৃষিকাজে লোকায়ত জ্ঞানের অন্যতম ধারক খনার বচন প্রাসঙ্গিক হলেও আবহাওয়া, ফসল রোপণের সময়, মাটির গুণাগুণ–সম্পর্কিত হাজার বছরের পরীক্ষিত প্রথাগত প্রজ্ঞা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমে স্থান পায় না। এর বদলে শুধু স্থান পায় আধুনিক প্রযুক্তি ও বাণিজ্যিকীকরণের তত্ত্ব।
ধান লাগানো থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ, বীজ সংরক্ষণ, ফসল মাড়াই ও ঝাড়াইয়ের মতো অনেক ধাপে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ বাংলাদেশের কৃষিতে অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বিভিন্ন গবেষণায় এই সত্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে। অথচ এই বিশাল শ্রমশক্তি ও তাঁদের সমস্যা নিয়ে মূলধারার একাডেমিক আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যদিও সস্তা শ্রম আর অধিকার বঞ্চনার মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কৃষিতে নারীর উপস্থিতি বাড়ছে।
কৃষকের নিবিড় জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রায়শই অন্ধকারে থাকছে। গান গাইতে গাইতে ধান কাটা, ধান লাগানো বা নবান্ন উৎসব—এসব প্রথা ও রীতিনীতি কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষকের জীবনের আনন্দ, দুঃখ ও শ্রমের প্রকাশ। পাঠ্যক্রমে এসবের অনুপস্থিতি কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে নাগরিকসচেতনতা বৃদ্ধির পথে এক বড় বাধা।
কৃষির এই বহুমুখী সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু যান্ত্রিকীকরণ আর উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর দিলেই চলবে না। প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী নীতিগত পরিবর্তন।
যা করা যেতে পারে:
ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ: সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ফসল কেনার সরকারি উদ্যোগকে আরও বিস্তৃত ও মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমাতে শক্তিশালী ‘ভ্যালু চেইন’ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ: প্রান্তিক কৃষক ও কৃষিশ্রমিকদের জন্য বিনা মূল্যে মানসম্পন্ন কীটনাশকপ্রতিরোধী মাস্ক, গ্লাভস এবং সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম সরবরাহ করা।
শিক্ষায় কৃষির সাংস্কৃতিক পাঠ অন্তর্ভুক্তিকরণ: উচ্চশিক্ষা ও স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে কৃষির উৎপত্তি, নৃতত্ত্ব, নারীর ভূমিকা, লোকায়ত জ্ঞান (যেমন খনার বচন) এবং কৃষকের জীবন ও সংস্কৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
কৃষিশ্রমিকের স্বীকৃতি: নারীর কৃষিভিত্তিক শ্রমের স্বীকৃতি প্রদান করা। কৃষিশ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী ও স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় আলাদা বরাদ্দ রাখা।
সর্বোপরি নীতিগত সদিচ্ছা এবং কৃষকের ন্যায্য অধিকার ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধিই পারে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার মূল ভিত্তি—নিভৃতচারী কৃষককে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে। কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে প্রত্যেক নাগরিকের সচেতনতা বৃদ্ধি এখন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি।
মো. জুবায়ের ইবনে কামাল অফিসার, জনতা ব্যাংক পিএলসি। প্রাক্তন শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়