অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশ ১৬ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন ‘ভূমিকম্পে’ কাঁপছিল। শেখ হাসিনা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ সরকারের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি কথাটি বলেন। 

বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের নিবন্ধ এভাবেই শুরু হয়। ‘আফটার দ্য রেভল্যুশন, বাংলাদেশ ইজ হোপিং টু রিফর্ম’ শীর্ষক নিবন্ধে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান, শেখ হাসিনার পতন, অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগসহ নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। ২০২৪ সালের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয় শেখ হাসিনার সরকার।

ক্ষুদ্র ঋণের পথিকৃৎ ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী ড.

মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, যা ধ্বংস হয়ে গেছে, তার সবকিছু ঠিক করার চেষ্টা করছেন তিনি। 

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান বলেন, ‘আমরা সঠিক পথে এগোচ্ছি; জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। আমরা আশাবাদী।’ 

নিবন্ধে বলা হয়, এ আশাবাদই এখন প্রয়োজন। শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে তাঁর শাসনামলের বাড়াবাড়ির নানা চিত্র সামনে আসছে। গত বছর প্রকাশিত এক শ্বেতপত্রে অভিযোগ করা হয়, শেখ হাসিনার শাসনামলে বছরে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার পাচার করা হয়েছিল। হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ ও গণহত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। অবশ্য তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
 
আবারও ক্ষমতার এমন অপব্যবহার যাতে না হয়, সে জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরের সব দলই গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছে। তবে অভ্যুত্থানের ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও বড় ধরনের পরিবর্তন আনা সহজ হচ্ছে না।
 
শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরপরই এ প্রক্রিয়া শুরু হয়। গত সেপ্টেম্বরে ড. ইউনূস নির্বাচন, বিচার ব্যবস্থা, সংবিধানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য সুপারিশ দিতে কমিশন গঠন শুরু করেন। এ কমিশনগুলোতে রয়েছেন সুশীল সমাজ ও একাডেমিক অঙ্গনের বিশেষজ্ঞরা। এসব কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার আরেকটি কমিশন (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) গঠন করে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এ পর্যন্ত ১৬৬টি সুপারিশ একত্র করেছে। সেগুলোকে নথিবদ্ধ করে মতামতের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠিয়েছে। 

ড. ইউনূস জানান, এ পর্যন্ত ৩৫টি রাজনৈতিক দল মতামত দিয়েছে। এ ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে একটি ‘জুলাই সনদ’ তৈরি করবে, যা নির্বাচন আয়োজনের পথ সুগম করবে এবং একটি ‘নতুন বাংলাদেশে’র সূচনা করবে। কিন্তু ঐকমত্যে পৌঁছানোটা জটিল বিষয়। প্রথমত, কোন কোন কমিশন থাকা উচিত, তা নিয়েই রাজনীতিক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে মতানৈক্য আছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য একটি কমিশন থাকা উচিত ছিল। অনেকে শিক্ষা খাত নিয়ে অবহেলার অভিযোগ তুলেছেন।

সবচেয়ে বড় বিতর্ক তৈরি হয়েছে বিলম্বে গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ঘিরে। নারীদের আরও বেশি অধিকার দিতে এ কমিশনের সুপারিশে ইসলামী উত্তরাধিকার আইনে পরিবর্তনের প্রস্তাব দেওয়া হয়, যার বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ করেছে ইসলামপন্থি দলগুলো।

তথাপি সংস্কার কমিশনের সঙ্গে জড়িতরা আশাবাদী। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত কিছু পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগের জন্য একটি স্বাধীন প্রক্রিয়া। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপের দ্বিতীয় পর্ব গত ১৫ মের পর যে কোনো দিন শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। তবে আগামী আগস্টের মধ্যে একটি সনদ চূড়ান্ত হওয়ার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী অধ্যাপক আলী রীয়াজ।

যদি এ সময়সূচি অনুযায়ী সবকিছু এগোয়, তাহলে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। অধ্যাপক ইউনূস দৃঢ়ভাবে বলেছেন, ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে (তিনি নির্বাচনে অংশ নেবেন না)। তবে এ বিলম্বের কিছু মূল্য ইতোমধ্যেই গুনতে হচ্ছে। 

অন্তর্বর্তী সরকার মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংক ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করেছে। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুর্বলই রয়ে গেছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতিও নাজুক। এক জরিপে দেখা গেছে, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংই মনে করেন, সরকার পরিবর্তনের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাস্তায় বিক্ষোভ-প্রতিবাদ।

বিক্ষোভকারীদের সবচেয়ে সাধারণ দাবি, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া। গত ১২ মে নির্বাচন কমিশন (ইসি) আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করে। যে কোনো নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করে ইসি। আওয়ামী লীগের প্রতি ব্যাপক বিরূপ মনোভাব থাকা সত্ত্বেও দলটির এখনও কিছুটা সমর্থন রয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ আরাফাত জোর দিয়ে বলেন, দলটির প্রতি ‘জনগণের ম্যান্ডেট’ ছিল। কিন্তু ‘জিহাদিরা’ সহিংসতার মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছে। তারা ‘বাংলাদেশে নিজেদের ন্যায্য স্থান পুনরুদ্ধারের জন্য লড়বেন’। 

নিবন্ধে বলা হয়, ক্ষমতার বাইরে থাকলেও আওয়ামী লীগ এখনও দেশজুড়ে অস্থিরতা সৃষ্টিতে সক্ষম হতে পারে।


 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন র জন ত ক সরক র র ন বন ধ র জন য ক ষমত আওয় ম ইউন স

এছাড়াও পড়ুন:

নির্বাচন বিলম্বিত বা না হওয়ার জন্য পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাওয়া হচ্ছে: সালাহউদ্দিন আহমদ

জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা যাঁরা বলছেন, তাঁরা একটি উদ্দেশ্য সামনে রেখেই এমনটি বলছেন বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।

বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘যাঁরা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচনের কথা বলছেন, তাঁদের একটি উদ্দেশ্য আছে। যাঁরা স্থানীয় সরকার নির্বাচন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে চান, তাঁদের একটি উদ্দেশ্য আছে। হয় নির্বাচন বিলম্বিত করা, না হয় বাংলাদেশে নির্বাচন না হওয়া। এটা তাঁদের উদ্দেশ্য হতে পারে। তবে এ দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ আছে।’

আজ শনিবার বিকেলে ‘জিয়াউর রহমান: যুদ্ধের ময়দান থেকে রাষ্ট্রের প্রধান’ শীর্ষক একটি স্মারক প্রকাশনা ও আর্কাইভ উন্মোচন অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দিন আহমদ এ কথা বলেন। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক (ব্রেইন)।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসমাবেশ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘সংস্কার এবং বিচার চলমান প্রক্রিয়া। তারা পিআর পদ্ধতিতে নিম্নকক্ষ, তথা জাতীয় সংসদের নির্বাচন চায়। সেটা তাদের রাজনৈতিক অবস্থান। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় এবং ঐকমত্য কমিশনে যা আলোচনা হয়েছে, পিআর পদ্ধতির নির্বাচন বিষয়ে ঐকমত্য পাইনি।’

বাংলাদেশে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচনের ইতিহাস নেই উল্লেখ করে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আনুপাতিক নির্বাচন এ দেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। যেখানে প্রযোজ্য, সেখানেও অনেক জটিল অবস্থা। এমন নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আসনের ভোটাররা জানবেন না, কে তাঁদের এমপি হবেন। এমপিদের কাছে তাঁরা যে যাবেন, নির্ধারিত কোনো ব্যক্তিকে খুঁজে পাবেন না।’

দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ স্থানীয় নির্বাচনের জন্য নয়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সংগ্রাম করেছেন উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে এ দেশে যাতে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ হয়। সেই রাষ্ট্র বিনির্মাণ করতে পারব সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে, যদি নির্বাচিত সরকার গঠিত হয়।’

এ কথা বলার আগে অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রমের সমালোচনা করে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সংস্কারের এখন এমন অবস্থা হয়েছে, আমি মাননীয় উপদেষ্টাকে (সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা) বলছিলাম, একটা কবিতাই লিখে ফেলেন, হে সংস্কার তোমাকে পাওয়ার জন্য, আর কতকাল আলাপ-আলোচনা করিলে, খানাপিনা খাইলে এই সংস্কার কার্যক্রম শেষ হবে।’

সবাইকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব মেনে নিতে হবে, এই যদি নিয়ত হয়, তাহলে কি ঐকমত্য হবে—প্রশ্নে রাখেন সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘আমরা আলোচনা করছি। কাছাকাছি আসছি। জাতির জন্য যেটা মঙ্গল হবে, সেটা আমরা ধারণ করছি। এভাবেই আমরা সংস্কারের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাব।’ তিনি আরও বলেন, ‘তারা (অন্তর্বর্তী সরকার) এই সংস্কার এমনভাবে করতে চাচ্ছে, সংবিধানে এমন সংস্কার ঢুকাব, কেউ যাতে বিলুপ্ত করতে না পারে। এটা তো বাইবেল নয়, ধর্মগ্রন্থ নয়। আমরা এমন সংস্কার করব, যে সংস্কার ১০-২০ বছর পরে নতুন প্রজন্মের হাত ধরে নতুন চাহিদার ভিত্তিতে আবার পরিবর্তন হতে হবে। এটাই নিয়ম।’

আরও পড়ুনপুরোনো রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি জিইয়ে রাখার চেষ্টা সহ্য করা হবে না: চরমোনাই পীর১ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পিআর পদ্ধতির উচ্চকক্ষ মেনে নিতে আহ্বান ৬০ নাগরিকের
  • সংস্কার প্রশ্নে দলগুলোর ঐকমত্য নিয়ে সংশয়
  • মৌলিক সংস্কারের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোকে একাত্ম হওয়ার আহ্বান এনসিপির
  • আলোচনার অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়: আলী রীয়াজ 
  • সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রসঙ্গে আলোচনা হয়েছে, ঐকমত্য হয়নি: আলী রিয়াজ
  • সাংবিধানিক নিয়োগে এনসিসির পরিবর্তে নতুন কমিটির প্রস্তাব ঐকমত্য কমিশনের
  • জুলাইয়ের মধ্যেই জাতীয় ঐকমত্যের সনদ হতে পারে: আলী রীয়াজ
  • আলোচনার অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়, জুলাইয়ে ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে শঙ্কা: আলী রীয়াজ
  • টেবিলের আলোচনায় মাঠে চাপ, লক্ষ্য বিএনপি
  • নির্বাচন বিলম্বিত বা না হওয়ার জন্য পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাওয়া হচ্ছে: সালাহউদ্দিন আহমদ