এবার ঈদে সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমা তাণ্ডব। শাকিব খান অভিনীত ও রায়হান রাফী পরিচালিত এই সিনেমা ইতোমধ্যে দর্শক ও সমালোচকদের কাছে প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু এই সিনেমার সাফল্যের অন্যতম কারিগর আরাফাত মহসিন। এই সিনেমার আবহসংগীত করেছেন তিনি।
শুধু তাণ্ডব নয়, ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত ইনসাফ সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও করেছেন তিনি। ১৭ বছর ধরে নীরবে নিভৃতে কাজ করা এই তরুণ তুর্কীর সঙ্গে কথা হয় তাঁর স্টুডিও ৫৮–এ।
বেশ কয়েকটি দর্শকনন্দিত সিনেমায় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের কাজ করেছেন। সেই কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে বলুন।
সবসময় ভালো লাগে। কারণ, ঈদ একটি খুশির সময় এবং দেশের মানুষের খুশির সঙ্গে নিজেকে ভাগ করে নেওয়া আসলেই অনেক ভাগ্যের ব্যাপার। এ ছাড়া যখন দেখি মানুষ আমার কাজ পছন্দ করছে, ভালোবেসে গ্রহণ করছে তখন আমি অনুপ্রেরণা পাই এবং আরও ভালো ভালো কাজ করার ইচ্ছা জাগে।
এ পর্যন্ত ক’টি সিনেমায় ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের কাজ করেছেন?
এই পর্যন্ত ৯টি সিনেমায় কাজ করা হয়েছে। ‘আইসক্রিম’, ‘ইতি তোমারই ঢাকা’, ‘দামাল’, ‘সুড়ঙ্গ’, ‘তুফান’, ‘দাগী’, ‘বরবাদ’, ‘ইনসাফ’ ও ‘তাণ্ডব’। ভিন্ন ভিন্ন গল্পের এই সিনেমাগুলোয় কাজ করতে গিয়ে নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি।
ওয়েব সিরিজে কাজ করা হয়েছে?
বেশ কয়েকটি ওয়েব সিরিজ ও ফিল্মে কাজ করা হয়েছে এখন পর্যন্ত। ‘কষ্ট নীড়, ‘মাইনকার চিপা’, ‘ইউটিউমার’, ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি, ‘আধখান আধা মাস্তান’, ‘বোধ’, ‘ব্ল্যাক মানি’, ‘আমলনামা’। এছাড়া ‘বিকেল বেলার পাখি’, ‘মিডল ক্লাস সেন্টিমেন্ট, ‘ইতি মা’ নামের ফিকশনে।
বর্তমান ব্যস্ততা কী নিয়ে?
বর্তমানে কিছু গানের কাজ নিয়ে ব্যস্ততা চলছে। অনেকেই জানে না, আমি নিয়মিত বিজ্ঞাপন নির্মাণ করি। নিজস্ব প্রোডাকশন হাউস ‘সিনকাট পিকচার্স’-এর ব্যানারে কাজগুলো করে থাকি। এছাড়া পরিবার নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি।
‘যাযাবর পাখনা’ দিয়ে নাটকে আপনার কাজ শুরু। এখন কাজ করছেন?
আমার নাটক বা টেলিফিল্মে কাজ শুরু ২০১০ থেকে। শিহাব শাহীনের পরিচালনায় ‘ভালোবাসি তাই’ টেলিফিল্ম দিয়ে যাত্রা শুরু আমার। এর চার বছর পর আসে ‘যাযাবর পাখনা’ শিরোনামের গানটি। সেটি ছিল টেলিফিল্ম রাহাত রহমানের ‘মাংকি বিজনেস’ এর। এছাড়াও ‘অল টাইম দৌড়ের ওপর’ নাটকে ‘ও বন্ধু লাল গোলাপি’ গানটিও সে সময় দর্শক বেশ পছন্দ করে। আপাতত কোনো নাটকের কাজ করা হচ্ছে না।
নতুন অ্যালবাম বা সিঙ্গেলস আসছে কী?
একটু আগে যা বলছিলাম, আমি বেশ কয়েকজন শিল্পীর সঙ্গে একটি কোলাবোরেশন অ্যালবামের প্ল্যান করেছি; যার মধ্যে মৌলিক, ফোক সব ধরনের গান থাকবে। বাউল আবদুর রহমানের কয়েকটি গান করা হয়েছে; যা সময় হলেই প্রকাশ পাবে।
বাংলা সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিককে আপনি অন্যমাত্রায় নিয়ে গেছেন। এক্ষেত্রে কেউ কি আপনার অনুপ্রেরণা জোগায়?
দেশের মানুষই প্রথম আমার অনুপ্রেরণার জায়গা। আমার কাজ মানুষের ভালো লাগলে আমি সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হই। কারণ আমি তাদের জন্যই কাজ করে থাকি। তবুও যাদের কাজ দেখেশুনে বড় হয়েছি তাদের কথা না বললেই নয়। দেশে রবিন ঘোষ, আলাউদ্দিন আলী, আলম খান, সত্য সাহা এবং দেশের বাইরে এ আর রহমান, হ্যান্স জিমার আমার অনুপ্রেরণার জায়গায় সবসময় থাকবেন।
আপনার কাজ দর্শক-শ্রোতা এবং ফিল্ম ক্রিটিকদেরও প্রশংসা কুড়ায়। এক্ষেত্রে আপনার গোপন রহস্য নিয়ে বলুন।
আমার কোনো গোপন রহস্য নেই। গান নিয়েই মেতে থাকি। প্রচুর গান শুনি এবং চুপচাপ নিজের কাজ করে যাই। আর গান তো আনন্দেরই বিষয়; তাই আনন্দ নিয়েই কাজ করেছি, ভবিষ্যতেও করব।
দেশে বা বিদেশে আপনার পছন্দের মিউজিশিয়ান কারা?
অনেকেই। দেশে হাবিব ওয়াহিদ, বাপ্পা মজুমদার, আলাউদ্দিন আলী, সত্য সাহা, বাউল আবদুর রহমান। বিদেশে এ আর রহমান, অরিজিৎ সিং, থমাস নিউম্যান।
আপনার ব্যক্তিগত জীবন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কিছু বলুন।
আমি পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করি। অনেকেই হয়তো জানেন, এপ্রিলে বিয়ে করি রাবা খানকে। এখন মধুর সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। প্ল্যান আছে, খুব শিগগির দেশে এবং দেশের বাইরে ঘুরতে বের হব আমরা দু’জন। যার যার কাজ নিয়ে পরস্পর আলোচনা করি, সমালোচনা করি। এই তো বেশ কেটে যাচ্ছে। এভাবে কাটে যদি দিন কেটে যাক না.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: এই স ন ম র ক জ কর র রহম ন কর ছ ন আপন র পছন দ
এছাড়াও পড়ুন:
নিভৃতচারী কৃষকের আর্তনাদ কি আমরা শুনছি
কৃষি এবং কৃষকই এ দেশের প্রাণ—এই ধ্রুব সত্যটি নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু বেদনাদায়ক বাস্তবতা হলো, মধ্যস্বত্বভোগী ও কপট ব্যবসায়ীদের কারণে কৃষকের স্বার্থ বরাবরই উপেক্ষিত। নীতিনির্ধারক ও মূলধারার রাজনীতিবিদদের নীরবতা এবং কৃষকের সমস্যা নিয়ে সম্প্রতি জনগুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যকে ‘ট্রল’ করার মতো দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা আমাদের জাতীয় সংবেদনশীলতার অভাবকেই প্রকটভাবে তুলে ধরে।
করোনাকালীন ভয়াবহ সংকটে কৃষি যেভাবে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করে অর্থনীতিকে রক্ষা করেছে, তা আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। অথচ এত কমিশন গঠিত হলেও, কৃষি কমিশন গঠন করা হয়নি। এর মূল কারণ সম্ভবত নিভৃতে কাজ করে যাওয়া কৃষক বা কৃষিশ্রমিকের মূল্য এই সমাজে অনেক সস্তা।
বর্তমানে কৃষি খাত নিয়ে যত আলোচনা—তা সবই যেন নিরাপদ কৃষি, বাণিজ্যিক কৃষি, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ, ভ্যালু চেইন ও উৎপাদন বৃদ্ধিকেন্দ্রিক। প্রধান স্টেকহোল্ডার কৃষক ও তাঁর জীবন-জীবিকার স্বার্থ প্রায়শই থেকে যাচ্ছে অন্তরালে। অন্যান্য পেশাজীবীর মতো কৃষকের কোনো সক্রিয় সংগঠন নেই। চাষাবাদ ফেলে ঢাকা শহরে দাবি আদায়ের আন্দোলনে নামাও তাঁদের পক্ষে অসম্ভব, কারণ তাতে তাঁদের পেটে ভাত জুটবে না।
অথচ কৃষকেরা শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, শারীরিকভাবেও চরম ঝুঁকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ক্যানসারে আক্রান্ত পুরুষ রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পেশায় কৃষক! মাস্ক, গ্লাভস বা রাবারের জুতা চোখে না দেখা, ছেঁড়া গামছা মুখে পেঁচিয়ে বিষাক্ত কীটনাশক স্প্রে করা ভূমিহীন মানুষটা আমাদের কাছে হয়তো ‘কৃষিশ্রমিক’, ‘কৃষক’ নন; কিন্তু খাদ্য উৎপাদনচক্রে তাঁর অবদান সবচেয়ে মৌলিক এবং তাঁর স্বাস্থ্যঝুঁকিও সবচেয়ে বেশি।
সমাজের চোখে ‘কৃষক’ বলতে যখন বিঘার পর বিঘা জমির মালিক, শিক্ষিত বাণিজ্যিক উদ্যোক্তাদের বোঝানো হচ্ছে, তখন প্রান্তিক, নিরক্ষর মানুষগুলোর অস্তিত্ব ও সংগ্রাম প্রায় অস্বীকৃত থেকে যাচ্ছে।
আবার কৃষক ও কৃষির সমস্যা শুধু অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত নয়, এর শিকড় প্রোথিত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাতেও। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বাণিজ্যিক কৃষিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমাদের শিক্ষায় কৃষির নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক দিকগুলো প্রায় উপেক্ষিত।
কৃষকের নিবিড় জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রায়শই অন্ধকারে থাকছে। গান গাইতে গাইতে ধান কাটা, ধান লাগানো বা নবান্ন উৎসব—এসব প্রথা ও রীতিনীতি কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষকের জীবনের আনন্দ, দুঃখ ও শ্রমের প্রকাশ। পাঠ্যক্রমে এসবের অনুপস্থিতি কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে নাগরিকসচেতনতা বৃদ্ধির পথে এক বড় বাধা।আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কৃষির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো আলোচনা বা গবেষণা নেই। কীভাবে নারীর হাত দিয়ে কৃষির সূচনা হয়েছিল—ফসলের বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বপন ও পরিচর্যার প্রথম ধাপগুলোয় নারীর যে ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল, সেই গুরুত্বপূর্ণ নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক দিকগুলো পড়ানো হয় না বললেই চলে।
বাংলার কৃষিকাজে লোকায়ত জ্ঞানের অন্যতম ধারক খনার বচন প্রাসঙ্গিক হলেও আবহাওয়া, ফসল রোপণের সময়, মাটির গুণাগুণ–সম্পর্কিত হাজার বছরের পরীক্ষিত প্রথাগত প্রজ্ঞা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমে স্থান পায় না। এর বদলে শুধু স্থান পায় আধুনিক প্রযুক্তি ও বাণিজ্যিকীকরণের তত্ত্ব।
ধান লাগানো থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ, বীজ সংরক্ষণ, ফসল মাড়াই ও ঝাড়াইয়ের মতো অনেক ধাপে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ বাংলাদেশের কৃষিতে অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বিভিন্ন গবেষণায় এই সত্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে। অথচ এই বিশাল শ্রমশক্তি ও তাঁদের সমস্যা নিয়ে মূলধারার একাডেমিক আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যদিও সস্তা শ্রম আর অধিকার বঞ্চনার মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কৃষিতে নারীর উপস্থিতি বাড়ছে।
কৃষকের নিবিড় জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রায়শই অন্ধকারে থাকছে। গান গাইতে গাইতে ধান কাটা, ধান লাগানো বা নবান্ন উৎসব—এসব প্রথা ও রীতিনীতি কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষকের জীবনের আনন্দ, দুঃখ ও শ্রমের প্রকাশ। পাঠ্যক্রমে এসবের অনুপস্থিতি কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে নাগরিকসচেতনতা বৃদ্ধির পথে এক বড় বাধা।
কৃষির এই বহুমুখী সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু যান্ত্রিকীকরণ আর উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর দিলেই চলবে না। প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী নীতিগত পরিবর্তন।
যা করা যেতে পারে:
ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ: সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ফসল কেনার সরকারি উদ্যোগকে আরও বিস্তৃত ও মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমাতে শক্তিশালী ‘ভ্যালু চেইন’ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ: প্রান্তিক কৃষক ও কৃষিশ্রমিকদের জন্য বিনা মূল্যে মানসম্পন্ন কীটনাশকপ্রতিরোধী মাস্ক, গ্লাভস এবং সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম সরবরাহ করা।
শিক্ষায় কৃষির সাংস্কৃতিক পাঠ অন্তর্ভুক্তিকরণ: উচ্চশিক্ষা ও স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে কৃষির উৎপত্তি, নৃতত্ত্ব, নারীর ভূমিকা, লোকায়ত জ্ঞান (যেমন খনার বচন) এবং কৃষকের জীবন ও সংস্কৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
কৃষিশ্রমিকের স্বীকৃতি: নারীর কৃষিভিত্তিক শ্রমের স্বীকৃতি প্রদান করা। কৃষিশ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী ও স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় আলাদা বরাদ্দ রাখা।
সর্বোপরি নীতিগত সদিচ্ছা এবং কৃষকের ন্যায্য অধিকার ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধিই পারে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার মূল ভিত্তি—নিভৃতচারী কৃষককে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে। কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে প্রত্যেক নাগরিকের সচেতনতা বৃদ্ধি এখন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি।
মো. জুবায়ের ইবনে কামাল অফিসার, জনতা ব্যাংক পিএলসি। প্রাক্তন শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়