বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত হরমুজ প্রণালী। একদিকে পারস্য উপসাগর, অন্যদিকে ওমান উপসাগর। সরু এই জলপথ দিয়েই বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের প্রায় এক-চতুর্থাংশ পরিবাহিত হয়। প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ২২ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এই প্রণালী দিয়ে পরিবাহিত হয়। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক পথ যদি একদিনের জন্যও বন্ধ হয়ে যায়, তবে তার অভিঘাত ছড়িয়ে পড়বে মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে বিশ্বের তেল-গ্যাস আমদানিকারক অন্যান্য দেশেও। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল, আমদানি-নির্ভর দেশও এর ব্যতিক্রম হবে না।

হরমুজ প্রণালী ইরানের দক্ষিণ তীরে এবং ওমানের উত্তরে অবস্থিত, যার প্রশস্ততা মাত্র ৩৯ কিলোমিটার। এই জলপথ দিয়েই সৌদি আরব, কুয়েত, বাহরাইন, কাতার, ইরাক ও ইরানের বিশাল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল ও তরল প্রাকৃতিক গ্যাস ( এলএনজি) জাহাজে করে রপ্তানি হয়। বিশ্ববাজারে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানির প্রভাব এতটাই বেশি যে এই রুটে সামান্য বিঘ্ন ঘটলেও তেলের দাম আকাশচুম্বী হতে পারে।

বাংলাদেশে মোট জ্বালানি চাহিদার একটি বড় অংশ মেটানো হয় আমদানি করা তেলের মাধ্যমে। সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বেশ কিছু দেশ থেকে আমরা জ্বালানি তেল আমদানি করি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই তেল আসে হরমুজ প্রণালী অতিক্রম করে। অন্যদিকে, এলএনজি আমদানির বিষয়টিও যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। অর্থাৎ হরমুজ প্রণালীতে যদি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় বা জাহাজ চলাচল ব্যাহত হয়, তবে তা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলবে।

হরমুজ প্রণালী বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশের জ্বালানি তেলের দামের উপর প্রভাব পড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে গেলে বাংলাদেশে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। সরকার হয়ত তেল-গ্যাসে ভর্তুকি বাড়িয়ে তাৎক্ষণিকভাবে দাম স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে বাজেটের উপর চাপ বাড়বে। দ্রব্যের পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পেলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও বাড়তে শুরু করবে। শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হবে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দেবে এবং কৃষিখাতেও সেচ সমস্যার কারণে ফলন হ্রাস পেতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ হচ্ছে তৈরি পোশাক খাত। এই খাতের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল যেমন, পেট্রোলিয়াম-নির্ভর কৃত্রিম ফাইবার, কেমিক্যালস ইত্যাদি আমদানি হরমুজ প্রণালী অতিক্রম করে আসে। জ্বালানি সংকট দেখা দিলে উৎপাদন ব্যাহত হবে, ফলে রপ্তানি আদেশ বাতিল হতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রায় আয় কমে যাবে, যা সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ প্রবাসী শ্রমিক কাজ করেন। এই দেশগুলোর অর্থনীতিও মূলত জ্বালানি রপ্তানির উপর নির্ভরশীল। হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে তেল রপ্তানি ব্যাহত হবে, ফলে ওইসব দেশে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে পারে। ফলস্বরূপ প্রবাসী কর্মীদের ছাঁটাই, নতুন নিয়োগ বন্ধ কিংবা বেতন কমানোর মতো ঘটনা ঘটতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এটি হবে এক আঘাত। কারণ রেমিট্যান্স দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে বড় অবদান রাখে।

জ্বালানি সংকটের কারণে সরকারকে বিকল্প উৎসের সন্ধান করতে হবে, যা হবে তুলনামূলক ব্যয়বহুল। পাশাপাশি ডলার সঙ্কট আরও প্রকট হতে পারে। আমদানি ব্যয় বেড়ে গেলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। গরিব ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনে বাড়বে ভোগান্তি।

হরমুজ প্রণালী ঘিরে যে ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তা আমাদের মতো আমদানি-নির্ভর দেশের জন্য এক গভীর সতর্কবার্তা। ভবিষ্যতের জ্বালানি সংকট বা বৈশ্বিক সরবরাহ বিঘ্নের মতো পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে এখন থেকেই কিছু বাস্তবভিত্তিক ও দূরদর্শী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এসব উদ্যোগ শুধু সাময়িক প্রতিকারে নয়, দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও সহায়ক হবে।

প্রথমত, আমাদের জোর দিতে হবে বিকল্প জ্বালানি উৎসে বিনিয়োগে। নবায়নযোগ্য শক্তি, বিশেষ করে সৌর ও বায়ু শক্তির সম্ভাবনা বাংলাদেশে যথেষ্ট বেশি। কেন্দ্রীয় ও ব্যক্তিপর্যায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমদানিনির্ভরতা কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব।

দ্বিতীয়ত, জাতীয় পর্যায়ে জ্বালানি মজুতের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বর্তমানে আমাদের জ্বালানি মজুত সীমিত সময়ের চাহিদা পূরণে সক্ষম। ভবিষ্যতে যেন অন্তত এক থেকে দুই মাসের চাহিদা পূরণ করা যায়, সে অনুযায়ী রিজার্ভ গড়ে তোলার লক্ষ্যে পরিকল্পনা নিতে হবে।

তৃতীয়ত, তেল ও গ্যাস আমদানির ক্ষেত্রে একক উৎস নির্ভরতা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই প্রয়োজন বহুমাত্রিক সরবরাহ চুক্তি। মধ্যপ্রাচ্যের পাশাপাশি মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, রাশিয়া কিংবা আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গেও কৌশলগত জ্বালানি চুক্তি করতে হবে, যাতে একটি অঞ্চলে অস্থিরতা দেখা দিলে অন্য উৎস দিয়ে সরবরাহ চালু রাখা যায়।

চতুর্থত, আমাদের বন্দর ও নৌবাণিজ্য অবকাঠামো আরও শক্তিশালী করতে হবে। সম্ভাব্য সরবরাহ ব্যাঘাত বা বিকল্প আমদানি রুটের প্রয়োজন দেখা দিলে যেন দ্রুত সাড়া দেওয়া যায়, সে জন্য পায়রা, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। পাশাপাশি বিকল্প নৌপথ ও জাহাজ চলাচলের নিরাপত্তা জোরদার করাও গুরুত্বপূর্ণ।

হরমুজ প্রণালীর গুরুত্ব এতটাই বেশি যে বিশ্ব অর্থনীতিতে একে ‘জ্বালানির লাইফলাইন’ বলা হয়। এই লাইফলাইন দুই একদিনের জন্য বন্ধ হলেও বিশ্বের বড় অর্থনীতিগুলো কেঁপে উঠবে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। তাই এখন থেকেই কৌশলগত চিন্তা, বাস্তবভিত্তিক প্রস্তুতি এবং বহুমুখী পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে আমাদের জ্বালানি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিতে যে আগুন জ্বলছে, তার ধোঁয়া আমাদের ঘরেও আসতে পারে।

লেখক: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক এবং যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

তারা//

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর সরবর হ র জন য ব য হত আম দ র ব কল প ন র ভর আমদ ন

এছাড়াও পড়ুন:

জ্বালানি তেলের দাম এখন বাড়বে না: জ্বালানি উপদেষ্টা

মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত পরিস্থিতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেছেন, জ্বালানি সরবরাহ ব্যাহতের বিষয়টি নির্ভর করবে যুদ্ধ কত দিন চলে তার ওপর। স্বল্প মেয়াদে জ্বালানির ব্যবস্থা করা আছে। আপাতত বিশ্ববাজারে দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে জ্বালানি তেলের দাম এখন বাড়বে না। বিপিসির মুনাফা থেকে সমন্বয় করা হবে।

আজ মঙ্গলবার রাজধানীর বিদ্যুৎ ভবনে এক চুক্তি সই অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ভর্তুকিও বাড়বে না, জ্বালানি তেলের দামও বাড়ানো হবে না। এ ছাড়া আমদানিতে নিয়মিত সাশ্রয় করা হচ্ছে। গত সপ্তাহেও একটি দরপত্রে ২১ কোটি টাকা সাশ্রয় করা হয়েছে।

এর আগে চুক্তি সই অনুষ্ঠানে মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, জ্বালানি নিরাপত্তা গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতে অনেক ভর্তুকি, এটা আর বাড়ানো যাবে না। তাই খরচ কমাতে হবে। ইতিমধ্যে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করা হয়েছে।

অনুষ্ঠানে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, বেসরকারি খাত দীর্ঘ সময় ধরে নানা চ‍্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। সারা বিশ্বে এখন সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমছে। তবে বিদ‍্যমান বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ বাড়ছে। তাই যাঁরা এ দেশে আছেন, তাঁদের আরও বিনিয়োগে উৎসাহী করতে হবে। এর পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগকারীদের উৎসাহী করার চেষ্টা করে যেতে হবে।

লাফার্জহোলসিমের সঙ্গে গ্যাস বিক্রয় চুক্তি করেছে সিলেটের গ্যাস বিতরণ সংস্থা জালালাবাদ গ্যাস পিএলসি। এ চুক্তির অধীনে সুনামগঞ্জের ছাতকে তাদের সিমেন্ট কারখানায় গ্যাস সরবরাহ করবে জালালাবাদ। চুক্তি অনুসারে বিইআরসির নির্ধারিত হারে গ্যাসের দাম পরিশোধ করবে লাফার্জ। চুক্তিতে সই করেন লাফার্জহোলসিম পিলসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইকবাল চৌধুরী ও জালালাবাদের মহাব্যবস্থাপক (কোম্পানি সচিবালয়) জিতেন্দ্র কুমার দাস।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নাগরপুর বাজারে ‘পলিথিনমুক্ত’ পরিবেশ গড়তে জেলা প্রশাসকের উদ্যোগ
  • মাসল গেইন বা পেশি গঠনের জন্য কেমন খাবার খাবেন
  • মধ্যপ্রাচ্য আর হয়তো ইসরায়েলের ছকে চলবে না
  • সম্মেলন নয়, কৌশলের লড়াই জাতীয় পার্টির দুই পক্ষে
  • ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে ‘শান্তি’ এবং যুক্তরাষ্ট্র
  • জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা নেই: ফাওজুল কবির
  • এক জাহাজেই আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৬৮ কোটি টাকা
  • জ্বালানি তেলের দাম এখন বাড়বে না: জ্বালানি উপদেষ্টা
  • ইরান-ইসরায়েল সংঘাত: বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চেতনা ও করণীয় কী হবে