ভবন ঝুঁকিপূর্ণ, সরবরাহ নেই প্রয়োজনীয় ওষুধ ও জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর। এমন অবস্থায় অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে খুলনার কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্রগুলোর সেবা কার্যক্রমে। উপজেলায় এমন কেন্দ্রের সংখ্যা পাঁচটি। সবক’টি ভবনের দেয়াল ও ছাদে ফাটল ধরেছে। বেরিয়ে পড়েছে রড। যে কারণে স্বাস্থ্যসেবা দিতে জীবনের ঝুঁকি নিতে হচ্ছে কর্মীদের।
উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সূত্র জানায়, কয়রায় পাঁচটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্রে মূলত অন্তঃসত্ত্বা মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। পাশাপাশি সাধারণ চিকিৎসা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ সেবাও পরিচালিত হয়ে থাকে। তবে প্রতিটি কেন্দ্রের ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ না থাকায় সেবাগ্রহীতার সংখ্যা কমে গেছে।
সম্প্রতি সরেজমিন মহারাজপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্রের দুটি ভবনকেই জরাজীর্ণ অবস্থায় দেখা যায়। এগুলো ব্যবহারের পুরোপুরি অযোগ্য। ভবনগুলোর দেয়াল থেকে পলেস্তারা খসে গেছে বহু আগেই। দেখা যায় ভেতরের ইট। এ ছাড়া পিলার ও ছাদে বড় বড় ফাটল। জানালা-দরজা ভেঙে যাওয়ায় সরিয়ে ফেলা হয়েছে প্রয়োজনীয় মালপত্র ও আসবাব। এখন দুই কক্ষের একটি টিনের ঘরে দাপ্তরিক কার্যক্রম চলছে শুধু। ওষুধ না থাকায় রোগীদের ফিরতে হচ্ছে পরামর্শ নিয়ে।
সবুরন নেছা নামের একজন নারীকে পাওয়া যায় সেখানে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ভাঙাচুরা রুমের মধ্যি দীর্ঘ সময় বসে থাকার পর ডাক্তারের মুখের কথা শুনে বাড়ি যাতি হচ্ছে। কোনো ওষুধপথ্য নেই।’
এ কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করেন সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো) নিমাই চন্দ্র মণ্ডল। তাঁর ভাষ্য, এখানে দিনে গড়ে রোগী আসেন ৫০ জন। ভবন দুটি বেহাল হওয়ায় সাধারণ রোগী, মা ও শিশুদের সেবাদান বিঘ্নিত হচ্ছে। প্রায় এক বছর ধরে টিনের দুটি কক্ষে তারা কষ্ট করে সেবা চালিয়ে যাচ্ছেন।
নিমাই চন্দ্র মণ্ডলের ভাষ্য, জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ও ওষুধেরও সংকট আছে। কেবল পরামর্শ দিয়ে বিদায় করেন সেবাগ্রহীতাদের। এতে সেবাগ্রহীতারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। দিনে দিনে রোগী আসা কমছে।
বাগালি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্রের কোয়ার্টারটি বসবাসের অযোগ্য। এই কেন্দ্রের প্রতিটি কক্ষের দেয়াল ও পিলারে ফাটল। এখানে-ওখানে ধসের চিহ্ন। কর্মীরা জানিয়েছেন, ভবনের ছাদে ফাটল থাকায় বৃষ্টির পানি চুইয়ে পড়ে।
মহেশ্বরীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কল্যাণকেন্দ্রে বছরখানেক আগে সংস্কার করা হয়। তবে এরই মধ্যে দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে। মহেশ্বরীপুর কেন্দ্রের দোতলার ছাদে ফাটল দেখা গেছে। এসব কেন্দ্রে সেবা নিতে আসা কয়েকজন নারী বলেন, ভবনের অবস্থা ভালো না হওয়ায় অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়। বেশিক্ষণ বসে থাকাও নিরাপদ মনে করেন না তারা। অনেকেই ভবনের চেহারা দেখে বাড়ি ফিরে যান। সেবা নেওয়া আর হয় না।
তাদের কথার সত্যতা মেলে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শক আমেনা খাতুন ও পারভীন আকতারের বক্তব্যে। আমেনা মহারাজপুর ও পারভীন বাগালি কেন্দ্রে কর্মরত। তারা জানিয়েছেন, ভবনগুলোর বেশির ভাগ কক্ষ ব্যবহার অনুপযোগী। এ কারণে সেবা কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। সেখানকার টয়লেট ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। যে কারণে সেবাগ্রহীতা ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স ব গ রহ ত অবস থ উপজ ল ভবন র
এছাড়াও পড়ুন:
হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রভাব এবং কৌশলগত করণী
বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত হরমুজ প্রণালী। একদিকে পারস্য উপসাগর, অন্যদিকে ওমান উপসাগর। সরু এই জলপথ দিয়েই বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের প্রায় এক-চতুর্থাংশ পরিবাহিত হয়। প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ২২ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এই প্রণালী দিয়ে পরিবাহিত হয়। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক পথ যদি একদিনের জন্যও বন্ধ হয়ে যায়, তবে তার অভিঘাত ছড়িয়ে পড়বে মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে বিশ্বের তেল-গ্যাস আমদানিকারক অন্যান্য দেশেও। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল, আমদানি-নির্ভর দেশও এর ব্যতিক্রম হবে না।
হরমুজ প্রণালী ইরানের দক্ষিণ তীরে এবং ওমানের উত্তরে অবস্থিত, যার প্রশস্ততা মাত্র ৩৯ কিলোমিটার। এই জলপথ দিয়েই সৌদি আরব, কুয়েত, বাহরাইন, কাতার, ইরাক ও ইরানের বিশাল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল ও তরল প্রাকৃতিক গ্যাস ( এলএনজি) জাহাজে করে রপ্তানি হয়। বিশ্ববাজারে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানির প্রভাব এতটাই বেশি যে এই রুটে সামান্য বিঘ্ন ঘটলেও তেলের দাম আকাশচুম্বী হতে পারে।
বাংলাদেশে মোট জ্বালানি চাহিদার একটি বড় অংশ মেটানো হয় আমদানি করা তেলের মাধ্যমে। সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বেশ কিছু দেশ থেকে আমরা জ্বালানি তেল আমদানি করি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই তেল আসে হরমুজ প্রণালী অতিক্রম করে। অন্যদিকে, এলএনজি আমদানির বিষয়টিও যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। অর্থাৎ হরমুজ প্রণালীতে যদি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় বা জাহাজ চলাচল ব্যাহত হয়, তবে তা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলবে।
হরমুজ প্রণালী বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশের জ্বালানি তেলের দামের উপর প্রভাব পড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে গেলে বাংলাদেশে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। সরকার হয়ত তেল-গ্যাসে ভর্তুকি বাড়িয়ে তাৎক্ষণিকভাবে দাম স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে বাজেটের উপর চাপ বাড়বে। দ্রব্যের পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পেলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও বাড়তে শুরু করবে। শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হবে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দেবে এবং কৃষিখাতেও সেচ সমস্যার কারণে ফলন হ্রাস পেতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ হচ্ছে তৈরি পোশাক খাত। এই খাতের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল যেমন, পেট্রোলিয়াম-নির্ভর কৃত্রিম ফাইবার, কেমিক্যালস ইত্যাদি আমদানি হরমুজ প্রণালী অতিক্রম করে আসে। জ্বালানি সংকট দেখা দিলে উৎপাদন ব্যাহত হবে, ফলে রপ্তানি আদেশ বাতিল হতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রায় আয় কমে যাবে, যা সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ প্রবাসী শ্রমিক কাজ করেন। এই দেশগুলোর অর্থনীতিও মূলত জ্বালানি রপ্তানির উপর নির্ভরশীল। হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে তেল রপ্তানি ব্যাহত হবে, ফলে ওইসব দেশে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে পারে। ফলস্বরূপ প্রবাসী কর্মীদের ছাঁটাই, নতুন নিয়োগ বন্ধ কিংবা বেতন কমানোর মতো ঘটনা ঘটতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এটি হবে এক আঘাত। কারণ রেমিট্যান্স দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে বড় অবদান রাখে।
জ্বালানি সংকটের কারণে সরকারকে বিকল্প উৎসের সন্ধান করতে হবে, যা হবে তুলনামূলক ব্যয়বহুল। পাশাপাশি ডলার সঙ্কট আরও প্রকট হতে পারে। আমদানি ব্যয় বেড়ে গেলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। গরিব ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনে বাড়বে ভোগান্তি।
হরমুজ প্রণালী ঘিরে যে ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তা আমাদের মতো আমদানি-নির্ভর দেশের জন্য এক গভীর সতর্কবার্তা। ভবিষ্যতের জ্বালানি সংকট বা বৈশ্বিক সরবরাহ বিঘ্নের মতো পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে এখন থেকেই কিছু বাস্তবভিত্তিক ও দূরদর্শী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এসব উদ্যোগ শুধু সাময়িক প্রতিকারে নয়, দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও সহায়ক হবে।
প্রথমত, আমাদের জোর দিতে হবে বিকল্প জ্বালানি উৎসে বিনিয়োগে। নবায়নযোগ্য শক্তি, বিশেষ করে সৌর ও বায়ু শক্তির সম্ভাবনা বাংলাদেশে যথেষ্ট বেশি। কেন্দ্রীয় ও ব্যক্তিপর্যায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমদানিনির্ভরতা কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, জাতীয় পর্যায়ে জ্বালানি মজুতের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বর্তমানে আমাদের জ্বালানি মজুত সীমিত সময়ের চাহিদা পূরণে সক্ষম। ভবিষ্যতে যেন অন্তত এক থেকে দুই মাসের চাহিদা পূরণ করা যায়, সে অনুযায়ী রিজার্ভ গড়ে তোলার লক্ষ্যে পরিকল্পনা নিতে হবে।
তৃতীয়ত, তেল ও গ্যাস আমদানির ক্ষেত্রে একক উৎস নির্ভরতা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই প্রয়োজন বহুমাত্রিক সরবরাহ চুক্তি। মধ্যপ্রাচ্যের পাশাপাশি মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, রাশিয়া কিংবা আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গেও কৌশলগত জ্বালানি চুক্তি করতে হবে, যাতে একটি অঞ্চলে অস্থিরতা দেখা দিলে অন্য উৎস দিয়ে সরবরাহ চালু রাখা যায়।
চতুর্থত, আমাদের বন্দর ও নৌবাণিজ্য অবকাঠামো আরও শক্তিশালী করতে হবে। সম্ভাব্য সরবরাহ ব্যাঘাত বা বিকল্প আমদানি রুটের প্রয়োজন দেখা দিলে যেন দ্রুত সাড়া দেওয়া যায়, সে জন্য পায়রা, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। পাশাপাশি বিকল্প নৌপথ ও জাহাজ চলাচলের নিরাপত্তা জোরদার করাও গুরুত্বপূর্ণ।
হরমুজ প্রণালীর গুরুত্ব এতটাই বেশি যে বিশ্ব অর্থনীতিতে একে ‘জ্বালানির লাইফলাইন’ বলা হয়। এই লাইফলাইন দুই একদিনের জন্য বন্ধ হলেও বিশ্বের বড় অর্থনীতিগুলো কেঁপে উঠবে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। তাই এখন থেকেই কৌশলগত চিন্তা, বাস্তবভিত্তিক প্রস্তুতি এবং বহুমুখী পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে আমাদের জ্বালানি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিতে যে আগুন জ্বলছে, তার ধোঁয়া আমাদের ঘরেও আসতে পারে।
লেখক: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক এবং যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক
তারা//