ইরান যুদ্ধ থামালেও গাজায় নির্বিকার ট্রাম্প
Published: 27th, June 2025 GMT
ইসরায়েল-ইরান সংঘাতে আপাতত যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ায় আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আবারও গাজার দিকে ফিরছে, যেখানে প্রতিদিনই বাড়ছে ফিলিস্তিনি প্রাণহানি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ প্রয়োগ করে সফল হলেও গাজায় ইসরায়েলকে থামাতে কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নিচ্ছেন না। আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক মাইরাভ জোনসেইন বলেন, ‘ট্রাম্প চাইলে নেতানিয়াহুকে থামাতে পারেন। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, তিনি ইসরায়েলকে গাজায় যা ইচ্ছা করার পূর্ণ ছাড় দিয়েছেন।’
এদিকে সহিংসতা আরও বেড়েছে গাজায়। গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৯০ জন। বুধবার প্রাণ গেছে ৪৫ জনের, যাদের অনেকেই ত্রাণ সহায়তা নিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। গাজায় ইসরায়েলি অভিযানে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৫৬ হাজার ১৫৭ ফিলিস্তিনি।
গাজা প্রশাসনের তথ্যমতে, গত চার সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলসমর্থিত ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)’ পরিচালিত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে সহায়তার জন্য গিয়ে ৫৪৯ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৪ হাজারের বেশি। এ ছাড়া নিখোঁজ হয়েছেন ৩৯ জন। এই কেন্দ্রগুলোকে ‘মৃত্যুকেন্দ্র’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে গাজা কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘খাদ্যকে গণহত্যার অস্ত্রে রূপান্তরিত করেছে ইসরায়েল।’
তবে জিএইচএফ দাবি করছে, তারা এখন পর্যন্ত ৪৪ মিলিয়ন খাবার প্যাকেট সহায়তা হিসেবে বিতরণ করেছে। কিন্তু ইউনিসেফসহ অনেক মানবাধিকার সংস্থাই এই ত্রাণ কেন্দ্রগুলোতে শিশুহত্যা এবং মানবিক নীতিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে। সেভ দ্য চিলড্রেন জানিয়েছে, জিএইচএফের খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে হওয়া ১৯টি প্রাণঘাতী হামলার মধ্যে অন্তত ১০টিতে হতাহতদের অধিকাংশই শিশু।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ জানিয়েছে, ইসরায়েলি বোমা হামলা, অবরোধ ও জ্বালানির অভাবে গাজায় প্রায় ধ্বংসের মুখে পড়েছে পানির সরবরাহ ব্যবস্থা। এমনকি পানির সংকটে পড়েছেন ত্রাণ বিতরণসহ বিভিন্ন দায়িত্বে থাকা আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবীরাও। এর ফলে তৃষ্ণায় মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়েছেন হাজার হাজার গাজাবাসী।
এমন অবস্থায় যুদ্ধবিরতি প্রসঙ্গে হামাস জানিয়েছে, কাতার, মিসর ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির চেষ্টা চললেও এখনও কোনো কার্যকর প্রস্তাব পায়নি তারা। ট্রাম্পের দাবি অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতি ‘খুব কাছাকাছি’ হলেও বাস্তবে আলোচনায় কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা।
এএফপি জানায়, অধিকৃত পশ্চিম তীরে দখলদার ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা ক্রমেই বাড়ছে। রামাল্লার উত্তর-পূর্বে কফর মালেক গ্রামে গতকাল দখলদারদের চালানো হামলায় অন্তত তিন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া গুরুতর আহত হয়েছেন আরও কয়েকজন। স্থানীয় সূত্রে আলজাজিরা জানিয়েছে, হামলাকারীরা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পাহারায় ফিলিস্তিনিদের গ্রামটিতে ঢুকে নির্বিচারে গুলি ছোড়ে ও ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে।
একই দিনে জেরিকোর কাছে আল-মালিহাত গ্রামে এবং আল-মিনিয়া গ্রামের কাছে ফিলিস্তিনি যানবাহনে পাথর নিক্ষেপ করে দখলদার ইসরায়েলিরা। এসব হামলার সময়ও ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাদের পাশে ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, ইসরায়েলের এই ‘দ্বৈত ভূমিকা’ যেমন একদিকে সেনা পাহারায় দখলদারদের তাণ্ডব, অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের ওপর দমনপীড়ন পশ্চিম তীরের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে আরও সংকটাপন্ন করে তুলছে।
ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির আবারও গাজায় সব ধরনের মানবিক সহায়তা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানের সঙ্গে সংঘাতে বিরতি নিশ্চিত হওয়ায় এখন ইসরায়েলের নজর আবার পুরোপুরি গাজার হত্যাযজ্ঞে ফিরেছে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল ইসর য় ল র দখলদ র
এছাড়াও পড়ুন:
জাতিসংঘে তীব্র সমালোচনার মুখে ইসরায়েল, গাজা–পরিকল্পনার পক্ষে সাফাই নেতানিয়াহুর
ফিলিস্তিনির গাজা সিটির ‘নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার’ ইসরায়েলি পরিকল্পনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতেরা।
তবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জোর দিয়ে বলেছেন, এ পরিকল্পনাই যুদ্ধ শেষ করার ‘সবচেয়ে ভালো উপায়’।
এক সংবাদ সম্মেলনে নেতানিয়াহু বলেন, পরিকল্পিত সামরিক অভিযান দ্রুত শুরু করা হবে। হামাসের হাত থেকে গাজাকে মুক্ত করা হবে।
ইসরায়েল গাজাবাসীকে অনাহারে রেখেছে—এ অভিযোগ অস্বীকার করেন নেতানিয়াহু। তিনি বলেন, বরং গাজায় থাকা ইসরায়েলি জিম্মিদেরই ‘ইচ্ছাকৃতভাবে অনাহারে’ রাখা হচ্ছে।
এদিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এক জরুরি বৈঠকে ইসরায়েল তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। বৈঠকে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ অন্য দেশ সতর্ক করে বলে, ইসরায়েলের পরিকল্পনাটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ‘লঙ্ঘনের ঝুঁকি’ তৈরি করছে।
পরিকল্পনাটি প্রত্যাহারের আহ্বান জানায় যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, গ্রিস ও স্লোভেনিয়া। দেশগুলো বলেছে, এ পরিকল্পনা ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির ক্ষেত্রে কোনো সহায়তা করবে না; বরং তাঁদের জীবনকে আরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে।
নিরাপত্তা পরিষদের অন্যান্য সদস্যও একই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। চীন বলেছে, গাজার জনগণের ওপর ‘সমষ্টিগত শাস্তি’ অগ্রহণযোগ্য। আর রাশিয়া বিচার-বিবেচনাহীনভাবে সংঘাত বৃদ্ধি নিয়ে সতর্ক করেছে।
জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব মিরোস্লাভ ইয়েনচা বৈঠকে বলেন, এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে গাজায় নতুন একটি বিপর্যয় সৃষ্টি হবে, যা পুরো অঞ্চলে প্রভাব ফেলবে। আরও বাস্তুচ্যুতি, হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের কারণ হবে।
জাতিসংঘের মানবিক কার্যালয়ের কর্মকর্তা রমেশ রাজাসিংহাম বলেন, গাজার খাদ্যসংকট এখন আর শুধু হুমকি নয়, এটি সরাসরি অনাহারে রূপ নিয়েছে।
তবে বৈঠকে ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নেয় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডরোথি শিয়া বলেন, যুক্তরাষ্ট্র নিরলসভাবে জিম্মিদের মুক্তি ও যুদ্ধের অবসানে কাজ করছে। এ বৈঠক সেই প্রচেষ্টাকে অবমূল্যায়ন করছে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, হামাস যদি জিম্মিদের ছেড়ে দেয়, তাহলে যুদ্ধ আজই শেষ হতে পারে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিরাপত্তা পরিষদের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, তারা এ বৈঠককে ব্যবহার করে ইসরায়েলকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করার চেষ্টা করছে। তিনি গণহত্যার বিষয়টিকে স্পষ্টত মিথ্যা বলে দাবি করেন।
গতকাল রোববার নেতানিয়াহুর কার্যালয় জানায়, তিনি পরিকল্পনাটি নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলেছেন।
আরও পড়ুনগাজা সিটি দখলের পরিকল্পনা ইসরায়েলি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন, আন্তর্জাতিক মহলের তীব্র নিন্দা ০৮ আগস্ট ২০২৫অন্যদিকে ইসরায়েলজুড়ে হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে সরকারের এ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দেখিয়েছেন। তাঁদের আশঙ্কা, এ পরিকল্পনা জিম্মিদের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
সংবাদ সম্মেলনে নেতানিয়াহু বলেন, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীকে গাজা সিটির অবশিষ্ট দুটি হামাস ঘাঁটি ও আল-মাওয়াসি এলাকার ঘাঁটি ধ্বংস করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি গাজায় সাহায্য বাড়াতে তিন দফা পরিকল্পনার কথা জানান নেতানিয়াহু। এর মধ্যে রয়েছে নিরাপদ করিডর স্থাপন, আকাশপথে সাহায্য পাঠানো বৃদ্ধি এবং বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) পরিচালিত বিতরণকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো।
চলতি মাসের শুরুতে জাতিসংঘ জানায়, মে মাসের শেষ দিকে গাজায় জিএইচএফ ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র স্থাপনের পর ত্রাণ নিতে গিয়ে ১ হাজার ৩৭৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
আরও পড়ুনগাজা দখলের পরিকল্পনা অবিলম্বে বাদ দিন: জাতিসংঘের মানবাধিকারপ্রধান০৮ আগস্ট ২০২৫গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, গত শনিবার থেকে এ পর্যন্ত উপত্যকায় অনাহার ও অপুষ্টিতে আরও পাঁচজন মারা গেছেন। ফলে অনাহারে মৃত মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১৭।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ৬১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
আরও পড়ুনগাজা সিটি ‘ছেড়ে যাব না’, ইসরায়েলি হুমকির মুখে বলছেন বাসিন্দারা০৯ আগস্ট ২০২৫