চট্টগ্রাম বন্দরে চারটি টার্মিনাল আছে। এর মধ্যে সাইফ পাওয়ার টেক লিমিটেড পরিচালনা করছে দুই টার্মিনাল। এর একটি নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)। অন্যটি চট্টগ্রাম কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি)। এনসিটির পাঁচটি জেটির মধ্যে চারটি ব্যবহার করে সাইফ পাওয়ার টেক লিমিটেড। একটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যবহার করে। সিসিটি টার্মিনালে জেটির সংখ্যা দুই। বন্দরের বাকি দুই টার্মিনাল হলো–জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি) ও পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি)। 

এই টার্মিনালগুলোর মধ্যে এনসিটি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আগামী ৬ জুলাই সাইফ পাওয়ার টেক লিমিটেডের পরিচালনার মেয়াদ শেষ হচ্ছে। সরকার এখন এটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। বন্দর ব্যবহারকারী ও বিএনপি-জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলো এর বিরোধিতা করছে। 

এনসিটি চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে বড় টার্মিনাল। এটিতে এককভাবে বন্দরের মোট কনটেইনারের ৪৪ শতাংশ ওঠানামার কাজ হয়। আর সিসিটিতে কনটেইনার ওঠানামা হয় ২০ শতাংশ। জিসিবি টার্মিনালটি পরিচালনা করে ১২ জন বার্থ অপারেটর মিলে। এটিতে বন্দরের ৩৬ শতাংশ কনটেইনার ওঠানামা করে। এই টার্মিনালের ছয়টি কনটেইনার জেটি এবং ৬টি কার্গো জেটি ১২টি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে। এরা বার্থ অপারেটর নামে পরিচিত। 

পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালটি (পিসিটি) নতুন। গত দশ মাসে এর সক্ষমতায় মাত্র ১২ শতাংশ ব্যবহার করতে পেরেছে পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল (আরএসজিটিই)। গত বছর জুনে এটি কাজ শুরু করে। এ ছাড়া রাজধানীর কমলাপুরে একটি অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো রয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষের, যেখানে ঢাকার কতিপয় ব্যবসায়ী কনটেইনার খালাস করেন।  

সাইফ পাওয়ার টেক লিমিটেড দুটি টার্মিনাল পেয়েছে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়া সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে। একবার নয়, ১১ বার এভাবে কাজ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আবার উন্মুক্ত দরপত্রেও একবার কাজ পেয়েছে তারা। বন্দরের মোট ২১ জেটির ৬টি এই দুই টার্মিনালের অধীন। বাকি জেটিগুলোর ১২টি জিসিবি টার্মিনালের অধীনে। পিসিটির অধীনে জেটি আছে দুটি। অবশিষ্ট একটি জিটি জাহাজ বেশি নোঙর করলে ব্যবহার হয়। জেটিগুলোর মধ্যে ছয়টি ব্যবহৃত হয় কার্গো পণ্য ওঠানামার কাজে। ১৪টিতে কনটেইনার ওঠানামা করা হয়। 
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘বন্দর স্পর্শকাতর স্থাপনা। এখানে যে কেউ এসে ব্যবসা করতে পারবে না। এ জন্য অভিজ্ঞদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। আইনি জটিলতার কারণে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে আগে কয়েকবার দরপত্র দিলেও এখন হচ্ছে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে।’
শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আরিফ বলেন, ‘ঘুরেফিরে একই প্রতিষ্ঠান বার্থ অপারেটর থাকায় কমছে না পণ্য পরিবহন খরচ। প্রতিযোগিতা থাকলে ব্যতিক্রম হতো। মন্ত্রণালয় ও বন্দর কর্তৃপক্ষের যোগসাজশ ছাড়া ১৭ বছর ধরে একই প্রতিষ্ঠানের ঘুরেফিরে কাজ পাওয়া সম্ভব নয়।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, ‘নির্দিষ্ট কিছু অপারেটরের কাছে জিম্মি চট্টগ্রাম বন্দর। তাদের হয়ে কাজ করেন মন্ত্রণালয় ও বন্দরের অসাধু কর্মকর্তারা। তারাই শর্তের জালে নতুনদের ঠেকিয়ে রেখেছেন।’

টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ার টেক
গত বছর চট্টগ্রাম বন্দর ২০ ফুট এককের (টিইইউএস) কনটেইনার হ্যান্ডল করে প্রায় ৩২ লাখ। এর মধ্যে এনসিটি ও সিসিটি টার্মিনালের ছয় জেটি হ্যান্ডল করে ১৮ লাখ ১৫ হাজার টিইইউএস কনটেইনার। জিসিবি হ্যান্ডল করে ১০ লাখ ২০ হাজার কনটেইনার। এ হিসাবে এনসিটি ও সিসিটি মোট কনটেইনারের ৬৪ এবং জিসিবি টার্মিনাল হ্যান্ডল করে ৩৬ শতাংশ। 
২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বন্দরে মোট এসেছে ১ কোটি ৩৮ লাখ কনটেইনার। এর মধ্যে ৮৪ লাখ ৮৭ হাজার হ্যান্ডল করেছে এনসিটি ও সিসিটি; জিসিবি ৫৩ লাখ ২১ হাজার। সাইফ পাওয়ার টেকের নিয়ন্ত্রণে থাকা দুই টার্মিনালের ছয় জেটি হ্যান্ডল করেছে গড়ে ৬২ শতাংশ কনটেইনার, বাকি ৩৮ শতাংশ জিসিবি।
২০০৬ সালে বন্দরে গ্যান্ট্রি ক্রেন পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে হাতেখড়ি সাইফ পাওয়ার টেকের। সেনাসমর্থিত ওয়ান-ইলেভেন সরকার আসার পরই ভাগ্যের চাকা ঘোরে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার তরফদার রুহুল আমিনের। ২০০৭ সালে প্রথমে সিসিটি টার্মিনাল অপারেট করার সুযোগ পায়। পরের বছর প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে অংশ না নিলেও সিসিটির এক্সটেনশন ধরে এনসিটি পরিচালনার কাজ দেওয়া হয় সাইফ পাওয়ার টেককে। ২০১৫ সালে উন্মুক্ত দরপত্রের উদ্যোগ নেয় বন্দর। অভিযোগ রয়েছে, সেবারও মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দেওয়া হয়। এ নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ আপত্তিও জানায়। তখন নৌ পরিবহনমন্ত্রী ছিলেন শাজাহান খান। 

বন্দরের টাকায় অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে এনসিটিতে। অবশ্য যন্ত্রপাতি পরিচালনা করতে টার্মিনালে দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়ায় বেড়েছে সক্ষমতা। এনসিটি ও সিসিটিকে ঘিরে সক্ষমতা বৃদ্ধির সুবিধাও গেছে রুহুল আমিনের ঘরে। অন্যদের তুলনায় সমৃদ্ধ হয় তার অভিজ্ঞতাও। দরপত্র দেওয়ার সময় বন্দরও এটিকে সামনে এনে কাজ দিচ্ছে সাইফ পাওয়ার টেককে।
বন্দরে আধিপত্য ধরে রাখতে টার্মিনাল অপারেটর হিসেবে কৌশলও খাটিয়েছেন রুহুল আমিন। এ জন্য একটি দরপত্রে তখন আওয়ামী লীগ নেতা আ জ ম নাছিরের প্রতিষ্ঠান এম এইচ চৌধুরী লিমিটেড ও একরামুল করিম চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান এ অ্যান্ড জে ট্রেডার্সকে ৩০ শতাংশ করে মোট ৬০ শতাংশ শেয়ার দেন তিনি। ফলাফল নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনায় আর দরপত্র হয়নি।
সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে ছয় মাস মেয়াদে বারবার কাজ পেয়েছে সাইফ পাওয়ার টেক। গত বছরের জুলাইতে ১১তম বারের মতো তাদের কাজ দেওয়া হয়, যার মেয়াদ শেষ হয় গত ৭ জানুয়ারি। অন্তর্বর্তী সরকারও মেয়াদ বাড়িয়ে সাইফ পাওয়ার টেকেই আস্থা রেখেছে। 

আরও দূরে সাইফ পাওয়ার টেকের জাল
গত ১১ বছর ধরে ঢাকার কমলাপুর কনটেইনার ডিপো এবং কেরানীগঞ্জে চট্টগ্রাম বন্দরের পানগাঁও নৌ টার্মিনাল পরিচালনা করছে সাইফ পাওয়ার টেক। আওয়ামী লীগ আমলে সাইফ লজিস্টিকস অ্যালায়েন্স লিমিটেডের (এসএলএএল) নামে নতুন মাল্টি-মডেল কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা করে। এর অংশ হিসেবে রেলওয়ের প্রতিষ্ঠান কনটেইনার কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিসিবিএল) মহানগরীর হালিশহরের বন্দর কলোনিসংলগ্ন এলাকায় ২১ দশমিক ২৯ একর জমিতে প্রাইভেট অফডক নির্মাণ ও পরিচালনার উদ্যোগ নেয়। কাজটি করার জন্য দরপত্রে সাইফ লজিস্টিকস অ্যালায়েন্সসহ ১৪ প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। তবে দরপত্রের শর্তের কারণে শুধু সাইফ লজিস্টিকস অ্যালায়েন্সই নথি জমা দিতে পেরেছিল।

বন্দরে যন্ত্রপাতি সরবরাহের কাজেও সাইফ পাওয়ার টেক। গত ১৭ বছর বন্দরে যেসব যন্ত্রপাতি স্থাপন হয়েছে, এককভাবে সবচেয়ে বেশি কার্যাদেশ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানের বিদেশি এজেন্ট।
সাইফ পাওয়ার টেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তরফদার রুহুল আমিন বলেন, ‘নিয়ম মেনে যোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে বন্দরে কাজ করছি। এনসিটি ও সিসিটিতে প্রতিদিন ৫ হাজারের বেশি কনটেইনার হ্যান্ডল করছি। অন্য টার্মিনালগুলো মিলেও এর অর্ধেক পারফরম্যান্স দেখাতে পারছে না। তাই বারবার আমাদের ওপর আস্থা রাখছে সরকার।’ বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের যথাযথ অনুমোদন নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ব্যবসা করছি। অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই।’

১২ জেনারেল জেটি যাদের নিয়ন্ত্রণে
বর্তমানে জিসিবির (জেনারেল কার্গো বার্থ) ছয় কনটেইনার জেটি পরিচালনা করছে ১৩ নম্বর বার্থে এমএইচ চৌধুরী লিমিটেড, ১১ নম্বর বার্থে এ অ্যান্ড জে ট্রেডার্স, ৯ নম্বর বার্থে ফজলী অ্যান্ড সন্স লিমিটেড, ১২ নম্বর বার্থে এভারেস্ট পোর্ট সার্ভিসেস লিমিটেড, ৭ নম্বর বার্থে এফ কিউ খান অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড এবং ৮ নম্বর বার্থে বশির আহমদ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড।
একইভাবে জিসিবির ছয় জেটি পরিচালনা করছে ২ নম্বর বার্থে রুহুল আমিন ব্রাদার্স, ৩ নম্বর বার্থে এ ডব্লিউ খান, ৪ নম্বর বার্থে ফোর জুয়েল, ৫ নম্বর বার্থে পঞ্চরাগ উদয়ন, ৬ নম্বর বার্থে কসমস এন্টারপ্রাইজ এবং ১০ নম্বর বার্থে ইউনাইটেড ট্রেডিং। পাঁচ বছর পরপর দরপত্র হলেও ঘুরেফিরে এরাই কাজ পাচ্ছে।
বার্থ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফজলে একরাম চৌধুরী বলেন, ‘যোগ্যতার কারণেই দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করছি। বন্দর যে শর্ত দিচ্ছে, সেটি পূরণ করেই কাজ পেয়েছি।’
আরেক বার্থ অপারেটর শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘অনেকেই দরপত্রের নথি নেন। কিন্তু কারিগরি ও আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় তারা জমা দিতে পারেন না। কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ঘটছে বলে মনে হয় না।’

৪২ কোটি টাকা বরাদ্দে নতুন প্রস্তাব
এনসিটি পরিচালনা করা সাইফ পাওয়ার টেকের চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ৬ জুলাই। টার্মিনালটি নিজেরাই পরিচালনার প্রস্তুতি নিচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণ করে টার্মিনালটি ছয় মাস পরিচালনা করলে ৪২ কোটি টাকা খরচ হবে ধারণা দিয়েছে তারা। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন চেয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মোহাম্মদ জাফর আলম বলেন, ‘বন্দর কর্তৃপক্ষ কখনও নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনা করেনি। ২০০৭ সালে লেবার বোর্ডের মাধ্যমে করেছে। লেবার বোর্ড এখন বিলুপ্ত। ফলে কাজ নিলে বন্দরকে বিপাকে পড়তে হবে। বন্দরের সক্ষমতা কমে যাওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে।’
তবে বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান ১৯ জুন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, এনসিটির বর্তমান অপারেটরের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সরকার রাষ্ট্রীয় জরুরি প্রয়োজন ও জনস্বার্থে এ পরিচালন ব্যয় সরাসরি ক্রয় পদ্ধতির মাধ্যমে করতে পারবে। এ জন্য অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন প্রয়োজন। প্রতি মাসে আনুমানিক ৭ কোটি টাকা করে ছয় মাসে মোট ৪২ কোটি টাকা খরচ হবে বলে জানানো হয় চিঠিতে।

 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র হ ল আম ন ব যবহ র দরপত র এনস ট সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

নিভৃতচারী কৃষকের আর্তনাদ কি আমরা শুনছি

কৃষি এবং কৃষকই এ দেশের প্রাণ—এই ধ্রুব সত্যটি নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু বেদনাদায়ক বাস্তবতা হলো, মধ্যস্বত্বভোগী ও কপট ব্যবসায়ীদের কারণে কৃষকের স্বার্থ বরাবরই উপেক্ষিত। নীতিনির্ধারক ও মূলধারার রাজনীতিবিদদের নীরবতা এবং কৃষকের সমস্যা নিয়ে সম্প্রতি জনগুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যকে ‘ট্রল’ করার মতো দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা আমাদের জাতীয় সংবেদনশীলতার অভাবকেই প্রকটভাবে তুলে ধরে।

করোনাকালীন ভয়াবহ সংকটে কৃষি যেভাবে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করে অর্থনীতিকে রক্ষা করেছে, তা আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। অথচ এত কমিশন গঠিত হলেও, কৃষি কমিশন গঠন করা হয়নি। এর মূল কারণ সম্ভবত নিভৃতে কাজ করে যাওয়া কৃষক বা কৃষিশ্রমিকের মূল্য এই সমাজে অনেক সস্তা।

বর্তমানে কৃষি খাত নিয়ে যত আলোচনা—তা সবই যেন নিরাপদ কৃষি, বাণিজ্যিক কৃষি, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ, ভ্যালু চেইন ও উৎপাদন বৃদ্ধিকেন্দ্রিক। প্রধান স্টেকহোল্ডার কৃষক ও তাঁর জীবন-জীবিকার স্বার্থ প্রায়শই থেকে যাচ্ছে অন্তরালে। অন্যান্য পেশাজীবীর মতো কৃষকের কোনো সক্রিয় সংগঠন নেই। চাষাবাদ ফেলে ঢাকা শহরে দাবি আদায়ের আন্দোলনে নামাও তাঁদের পক্ষে অসম্ভব, কারণ তাতে তাঁদের পেটে ভাত জুটবে না।

অথচ কৃষকেরা শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, শারীরিকভাবেও চরম ঝুঁকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ক্যানসারে আক্রান্ত পুরুষ রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পেশায় কৃষক! মাস্ক, গ্লাভস বা রাবারের জুতা চোখে না দেখা, ছেঁড়া গামছা মুখে পেঁচিয়ে বিষাক্ত কীটনাশক স্প্রে করা ভূমিহীন মানুষটা আমাদের কাছে হয়তো ‘কৃষিশ্রমিক’, ‘কৃষক’ নন; কিন্তু খাদ্য উৎপাদনচক্রে তাঁর অবদান সবচেয়ে মৌলিক এবং তাঁর স্বাস্থ্যঝুঁকিও সবচেয়ে বেশি।

সমাজের চোখে ‘কৃষক’ বলতে যখন বিঘার পর বিঘা জমির মালিক, শিক্ষিত বাণিজ্যিক উদ্যোক্তাদের বোঝানো হচ্ছে, তখন প্রান্তিক, নিরক্ষর মানুষগুলোর অস্তিত্ব ও সংগ্রাম প্রায় অস্বীকৃত থেকে যাচ্ছে।

আবার কৃষক ও কৃষির সমস্যা শুধু অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত নয়, এর শিকড় প্রোথিত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাতেও। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বাণিজ্যিক কৃষিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমাদের শিক্ষায় কৃষির নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক দিকগুলো প্রায় উপেক্ষিত।

কৃষকের নিবিড় জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রায়শই অন্ধকারে থাকছে। গান গাইতে গাইতে ধান কাটা, ধান লাগানো বা নবান্ন উৎসব—এসব প্রথা ও রীতিনীতি কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষকের জীবনের আনন্দ, দুঃখ ও শ্রমের প্রকাশ। পাঠ্যক্রমে এসবের অনুপস্থিতি কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে নাগরিকসচেতনতা বৃদ্ধির পথে এক বড় বাধা।

আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কৃষির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো আলোচনা বা গবেষণা নেই। কীভাবে নারীর হাত দিয়ে কৃষির সূচনা হয়েছিল—ফসলের বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বপন ও পরিচর্যার প্রথম ধাপগুলোয় নারীর যে ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল, সেই গুরুত্বপূর্ণ নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক দিকগুলো পড়ানো হয় না বললেই চলে।

বাংলার কৃষিকাজে লোকায়ত জ্ঞানের অন্যতম ধারক খনার বচন প্রাসঙ্গিক হলেও আবহাওয়া, ফসল রোপণের সময়, মাটির গুণাগুণ–সম্পর্কিত হাজার বছরের পরীক্ষিত প্রথাগত প্রজ্ঞা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমে স্থান পায় না। এর বদলে শুধু স্থান পায় আধুনিক প্রযুক্তি ও বাণিজ্যিকীকরণের তত্ত্ব।

ধান লাগানো থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ, বীজ সংরক্ষণ, ফসল মাড়াই ও ঝাড়াইয়ের মতো অনেক ধাপে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ বাংলাদেশের কৃষিতে অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বিভিন্ন গবেষণায় এই সত্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে। অথচ এই বিশাল শ্রমশক্তি ও তাঁদের সমস্যা নিয়ে মূলধারার একাডেমিক আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যদিও সস্তা শ্রম আর অধিকার বঞ্চনার মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কৃষিতে নারীর উপস্থিতি বাড়ছে।

কৃষকের নিবিড় জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রায়শই অন্ধকারে থাকছে। গান গাইতে গাইতে ধান কাটা, ধান লাগানো বা নবান্ন উৎসব—এসব প্রথা ও রীতিনীতি কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষকের জীবনের আনন্দ, দুঃখ ও শ্রমের প্রকাশ। পাঠ্যক্রমে এসবের অনুপস্থিতি কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে নাগরিকসচেতনতা বৃদ্ধির পথে এক বড় বাধা।

কৃষির এই বহুমুখী সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু যান্ত্রিকীকরণ আর উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর দিলেই চলবে না। প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী নীতিগত পরিবর্তন।

যা করা যেতে পারে:

ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ: সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ফসল কেনার সরকারি উদ্যোগকে আরও বিস্তৃত ও মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমাতে শক্তিশালী ‘ভ্যালু চেইন’ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।

স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ: প্রান্তিক কৃষক ও কৃষিশ্রমিকদের জন্য বিনা মূল্যে মানসম্পন্ন কীটনাশকপ্রতিরোধী মাস্ক, গ্লাভস এবং সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম সরবরাহ করা।

শিক্ষায় কৃষির সাংস্কৃতিক পাঠ অন্তর্ভুক্তিকরণ: উচ্চশিক্ষা ও স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে কৃষির উৎপত্তি, নৃতত্ত্ব, নারীর ভূমিকা, লোকায়ত জ্ঞান (যেমন খনার বচন) এবং কৃষকের জীবন ও সংস্কৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

কৃষিশ্রমিকের স্বীকৃতি: নারীর কৃষিভিত্তিক শ্রমের স্বীকৃতি প্রদান করা। কৃষিশ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী ও স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় আলাদা বরাদ্দ রাখা।

সর্বোপরি নীতিগত সদিচ্ছা এবং কৃষকের ন্যায্য অধিকার ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধিই পারে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার মূল ভিত্তি—নিভৃতচারী কৃষককে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে। কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে প্রত্যেক নাগরিকের সচেতনতা বৃদ্ধি এখন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি।

মো. জুবায়ের ইবনে কামাল অফিসার, জনতা ব্যাংক পিএলসি। প্রাক্তন শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ