ময়নাতদন্তের রিপোর্টেও ধোঁয়াশা কাটেনি, শেফালীর শেষ পোস্ট নিয়েও চলছে আলোচনা
Published: 28th, June 2025 GMT
মাত্র ৪২ বছরেই না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন ‘কাঁটা লাগা’ গার্ল খ্যাত জনপ্রিয় অভিনেত্রী শেফালি জারিওয়ালা। হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়ার পর তার স্বামী অভিনেত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার মৃত্যু ঘিরে এরই মধ্যে রহস্য ছড়াচ্ছে। সত্যিই কি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন নাকি এর পেছনে লুকিয়ে রয়েছে অন্য কোনো রহস্য। তা জানতেই ময়নাতদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
শুধু তাই নয়, অভিনেত্রীর বাড়িতে পৌঁছায় ফরেনসিক টিম। শুক্রবার দিবাগত রাত ১টার সময় ময়নাতদন্ত শেষ হলে সেই রিপোর্টেও ধোঁয়াশা কাটেনি। মুম্বাই পুলিশের পক্ষ থেকে ভারতের বেশিরভাগ গণমাধ্যমে এমনটাই নাকি জানানো হয়েছে। আকস্মিক মৃত্যুর পর চর্চায় শেফালির শেষ ইনস্টাগ্রাম পোস্ট।
মৃত্যুর তিন দিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় গ্ল্যাম অবতারে ফটোশুটে ধরা দিয়েছিলেন তিনি। রুপোলি জাম্পস্যুটে গ্ল্যামারাস লুকে শেফালির লুকের প্রসংশা করেন ভক্তরা। ছবি পোস্টের ক্যাপশনে লিখেছিলেন, ‘ঝলমলে স্টাইলে এসো।’
বিগ বস ১৩-এর প্রতিযোগী ও অভিনেত্রী শেফালি চিরদিন ভক্ত হৃদয়ে ‘কাঁটা লাগা’ গার্ল হিসেবেই থেকে যেতে চান। সাম্প্রতিক অতীতে এক সাক্ষাৎকারে সেই কথা নিজেই বলেছিলেন। সম্প্রতি গোয়ায় একটি অনুষ্ঠানেও অংশ নিয়েছিলেন শেফালি। ইনস্টাগ্রামে যেমন সক্রিয় ছিলেন তেমনই এক্স হ্যান্ডেলেও নিয়মিত পোস্ট শেয়ার করতেন প্রয়াত অভিনেত্রী। অভিনেত্রীর মৃত্যুর পর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল তার এক্স হ্যান্ডেলের শেষ পোস্ট।
View this post on InstagramA post shared by Shefali Jariwala ???? (@shefalijariwala)
প্রাক্তন প্রেমিক সিদ্ধার্থ শুক্লাকে নিয়ে একটি পোস্ট শেয়ার করেছিলেন শেফালি। কয়েক মাস আগে প্রয়াত বিগ বস প্রতিযোগী সিদ্ধার্থকে জড়িয়ে একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছিলেন, ‘বন্ধু আজ তোমার কথা খুব মনে পড়ছে।’
শেফালি জারিওয়ালা ২০০২ সালে ‘কাঁটা লাগা’ মিউজিক ভিডিওর মাধ্যমে রাতারাতি তারকা হয়ে ওঠেন। এই রিমিক্স গানটি তাকে ‘কাঁটা লাগা গার্ল’ হিসেবে পরিচিতি এনে দেয়। তার সাহসী চেহারা এবং নৃত্যশৈলী তৎকালীন পপ সংস্কৃতিতে একটি সাংস্কৃতিক ঘটনা হয়ে ওঠে। এরপর তিনি ‘কাভি আর কাভি পার’ সহ আরও কয়েকটি মিউজিক ভিডিওতে কাজ করেন। ২০০৪ সালে তিনি সালমান খান এবং অক্ষয় কুমার অভিনীত ‘মুঝসে সাদি কারোগি’ চলচ্চিত্রে একটি ছোট ভূমিকায় অভিনয় করেন।
এছাড়াও তিনি কন্নড় চলচ্চিত্র ‘হুদুগুরু’, ওয়েব সিরিজ ‘বেবি কাম না’ এবং ‘রাত্রি কে যাত্রী’ নামে কয়েকটি প্রকল্পে কাজ করেছেন।
টেলিভিশন জগতে শেফালি ২০০৮ সালে ‘বুগি উগি’ রিয়েলিটি শো দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি তার স্বামী পারাগ ত্যাগীর সাথে ‘নাচ বালিয়ে ৫’ এবং ‘নাচ বালিয়ে ৭’-এ অংশগ্রহণ করেন, যেখানে তাদের জুটি দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। তবে, তার জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায় সালমান খানের হোস্ট করা ‘বিগ বস ১৩’-এর মাধ্যমে। শো-তে তার সততা, সাহস এবং প্রাক্তন প্রেমিক সিদ্ধার্থ শুক্লার সঙ্গে পুনর্মিলনের মুহূর্তগুলো দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। শেফালি তখন বলেছিলেন, ‘আমরা সম্পর্ক ভাঙার পরেও সবসময় সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিলাম।’
২০২৪ সালে তিনি ‘শৈতানি রসমে’ নামে একটি টিভি শো-তে অভিনয় করে তার টেলিভিশন ক্যারিয়ারে নতুন মাত্রা যোগ করেন। সূত্র: দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
নিভৃতচারী কৃষকের আর্তনাদ কি আমরা শুনছি
কৃষি এবং কৃষকই এ দেশের প্রাণ—এই ধ্রুব সত্যটি নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু বেদনাদায়ক বাস্তবতা হলো, মধ্যস্বত্বভোগী ও কপট ব্যবসায়ীদের কারণে কৃষকের স্বার্থ বরাবরই উপেক্ষিত। নীতিনির্ধারক ও মূলধারার রাজনীতিবিদদের নীরবতা এবং কৃষকের সমস্যা নিয়ে সম্প্রতি জনগুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যকে ‘ট্রল’ করার মতো দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা আমাদের জাতীয় সংবেদনশীলতার অভাবকেই প্রকটভাবে তুলে ধরে।
করোনাকালীন ভয়াবহ সংকটে কৃষি যেভাবে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করে অর্থনীতিকে রক্ষা করেছে, তা আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। অথচ এত কমিশন গঠিত হলেও, কৃষি কমিশন গঠন করা হয়নি। এর মূল কারণ সম্ভবত নিভৃতে কাজ করে যাওয়া কৃষক বা কৃষিশ্রমিকের মূল্য এই সমাজে অনেক সস্তা।
বর্তমানে কৃষি খাত নিয়ে যত আলোচনা—তা সবই যেন নিরাপদ কৃষি, বাণিজ্যিক কৃষি, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ, ভ্যালু চেইন ও উৎপাদন বৃদ্ধিকেন্দ্রিক। প্রধান স্টেকহোল্ডার কৃষক ও তাঁর জীবন-জীবিকার স্বার্থ প্রায়শই থেকে যাচ্ছে অন্তরালে। অন্যান্য পেশাজীবীর মতো কৃষকের কোনো সক্রিয় সংগঠন নেই। চাষাবাদ ফেলে ঢাকা শহরে দাবি আদায়ের আন্দোলনে নামাও তাঁদের পক্ষে অসম্ভব, কারণ তাতে তাঁদের পেটে ভাত জুটবে না।
অথচ কৃষকেরা শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, শারীরিকভাবেও চরম ঝুঁকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ক্যানসারে আক্রান্ত পুরুষ রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পেশায় কৃষক! মাস্ক, গ্লাভস বা রাবারের জুতা চোখে না দেখা, ছেঁড়া গামছা মুখে পেঁচিয়ে বিষাক্ত কীটনাশক স্প্রে করা ভূমিহীন মানুষটা আমাদের কাছে হয়তো ‘কৃষিশ্রমিক’, ‘কৃষক’ নন; কিন্তু খাদ্য উৎপাদনচক্রে তাঁর অবদান সবচেয়ে মৌলিক এবং তাঁর স্বাস্থ্যঝুঁকিও সবচেয়ে বেশি।
সমাজের চোখে ‘কৃষক’ বলতে যখন বিঘার পর বিঘা জমির মালিক, শিক্ষিত বাণিজ্যিক উদ্যোক্তাদের বোঝানো হচ্ছে, তখন প্রান্তিক, নিরক্ষর মানুষগুলোর অস্তিত্ব ও সংগ্রাম প্রায় অস্বীকৃত থেকে যাচ্ছে।
আবার কৃষক ও কৃষির সমস্যা শুধু অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত নয়, এর শিকড় প্রোথিত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাতেও। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বাণিজ্যিক কৃষিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমাদের শিক্ষায় কৃষির নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক দিকগুলো প্রায় উপেক্ষিত।
কৃষকের নিবিড় জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রায়শই অন্ধকারে থাকছে। গান গাইতে গাইতে ধান কাটা, ধান লাগানো বা নবান্ন উৎসব—এসব প্রথা ও রীতিনীতি কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষকের জীবনের আনন্দ, দুঃখ ও শ্রমের প্রকাশ। পাঠ্যক্রমে এসবের অনুপস্থিতি কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে নাগরিকসচেতনতা বৃদ্ধির পথে এক বড় বাধা।আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কৃষির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো আলোচনা বা গবেষণা নেই। কীভাবে নারীর হাত দিয়ে কৃষির সূচনা হয়েছিল—ফসলের বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বপন ও পরিচর্যার প্রথম ধাপগুলোয় নারীর যে ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল, সেই গুরুত্বপূর্ণ নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক দিকগুলো পড়ানো হয় না বললেই চলে।
বাংলার কৃষিকাজে লোকায়ত জ্ঞানের অন্যতম ধারক খনার বচন প্রাসঙ্গিক হলেও আবহাওয়া, ফসল রোপণের সময়, মাটির গুণাগুণ–সম্পর্কিত হাজার বছরের পরীক্ষিত প্রথাগত প্রজ্ঞা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমে স্থান পায় না। এর বদলে শুধু স্থান পায় আধুনিক প্রযুক্তি ও বাণিজ্যিকীকরণের তত্ত্ব।
ধান লাগানো থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ, বীজ সংরক্ষণ, ফসল মাড়াই ও ঝাড়াইয়ের মতো অনেক ধাপে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ বাংলাদেশের কৃষিতে অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বিভিন্ন গবেষণায় এই সত্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে। অথচ এই বিশাল শ্রমশক্তি ও তাঁদের সমস্যা নিয়ে মূলধারার একাডেমিক আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যদিও সস্তা শ্রম আর অধিকার বঞ্চনার মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কৃষিতে নারীর উপস্থিতি বাড়ছে।
কৃষকের নিবিড় জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রায়শই অন্ধকারে থাকছে। গান গাইতে গাইতে ধান কাটা, ধান লাগানো বা নবান্ন উৎসব—এসব প্রথা ও রীতিনীতি কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষকের জীবনের আনন্দ, দুঃখ ও শ্রমের প্রকাশ। পাঠ্যক্রমে এসবের অনুপস্থিতি কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে নাগরিকসচেতনতা বৃদ্ধির পথে এক বড় বাধা।
কৃষির এই বহুমুখী সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু যান্ত্রিকীকরণ আর উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর দিলেই চলবে না। প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী নীতিগত পরিবর্তন।
যা করা যেতে পারে:
ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ: সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ফসল কেনার সরকারি উদ্যোগকে আরও বিস্তৃত ও মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমাতে শক্তিশালী ‘ভ্যালু চেইন’ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ: প্রান্তিক কৃষক ও কৃষিশ্রমিকদের জন্য বিনা মূল্যে মানসম্পন্ন কীটনাশকপ্রতিরোধী মাস্ক, গ্লাভস এবং সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম সরবরাহ করা।
শিক্ষায় কৃষির সাংস্কৃতিক পাঠ অন্তর্ভুক্তিকরণ: উচ্চশিক্ষা ও স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে কৃষির উৎপত্তি, নৃতত্ত্ব, নারীর ভূমিকা, লোকায়ত জ্ঞান (যেমন খনার বচন) এবং কৃষকের জীবন ও সংস্কৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
কৃষিশ্রমিকের স্বীকৃতি: নারীর কৃষিভিত্তিক শ্রমের স্বীকৃতি প্রদান করা। কৃষিশ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী ও স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় আলাদা বরাদ্দ রাখা।
সর্বোপরি নীতিগত সদিচ্ছা এবং কৃষকের ন্যায্য অধিকার ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধিই পারে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার মূল ভিত্তি—নিভৃতচারী কৃষককে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে। কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে প্রত্যেক নাগরিকের সচেতনতা বৃদ্ধি এখন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি।
মো. জুবায়ের ইবনে কামাল অফিসার, জনতা ব্যাংক পিএলসি। প্রাক্তন শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়