বাহরাইনকে যেন ফুটবলই শেখালেন বাংলাদেশের মেয়েরা। এএফসি উইমেন্স এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে নিজেদের প্রথম ম্যাচের প্রথম মিনিট থেকে শেষ মিনিট পর্যন্ত একের পর এক গোলই উদ্যাপন করেছে পিটার বাটলারের দল। ইয়াঙ্গুনের থুউন্না স্টেডিয়ামে আজ র্যাঙ্কিংয়ে নিজেদের চেয়ে ৩৬ ধাপ এগিয়ে থাকা বাহরাইনকে শেষ পর্যন্ত ৭-০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল, যার সুবাদে এশিয়ান বাছাইয়ে প্রথম জয়ের স্বাদও পেলেন মেয়েরা।
এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে বাংলাদেশের অতীত রেকর্ড মোটেও সুখকর ছিল না। এর আগে এই প্রতিযোগিতায় ৫ ম্যাচ খেলেও জয় দেখেনি বাংলাদেশ। ২০১৪ সালে ভিয়েতনামে তো তিন ম্যাচে হজম করতে হয়েছিল ১৫ গোল। এরপর ২০২২ সালে ভারতের মাটিতে পরের বাছাইপর্বেও দুই ম্যাচে বাংলাদেশ খেয়েছিল ১০ গোল। এবার বাহরাইনকে পেয়ে একেক করে সাত গোল দিলেন তহুরা-শামসুন্নাহাররা।
বাংলাদেশের হয়ে জোড়া গোল করেন তহুরা খাতুন। আর একটি করে গোল আসে ঋতুপর্ণা চাকমা, কোহাতি কিসুক, শামসুন্নাহার জুনিয়র ও মুনকি আক্তারের সৌজন্যে। আর অন্য গোলটি ছিল আত্মঘাতী।
আজ রোববার ম্যাচের প্রথম ১৫ মিনিট বাহরাইন খুব একটা বল পায়নি। এর মধ্যে নবম মিনিটেই গোল পেয়ে যায় বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষ গোলকিপারকে একা পেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত শটে বল বাহরাইনের জালে জড়ান শামসুন্নাহার জুনিয়র। এক গোল খেয়ে বাহরাইনও ম্যাচে ফিরতে মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু গোল শোধ দূরে থাক, উল্টো বিরতির আগে আরও চার গোল হজম করে তারা।
১৫ মিনিটে স্বপ্না রানীর চমৎকার পাসে ডি–বক্সের ভেতরে থেকেই প্রতিপক্ষের জাল কাঁপান ঋতুপর্ণা। এর দুই মিনিট পর ঋতুপর্ণার ক্রসে পা ঠেকাতে পারলেই স্কোর ৩-০ হয়ে যেত। অবশ্য তৃতীয় গোলের জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষায় থাকতে হয়নি বাংলাদেশকে। ৪০ মিনিটে সরাসরি কর্নার না নিয়ে বক্সের বাইরে থাকা মারিয়াকে বল দেন মনিকা। সেখান থেকে একটু ড্রিবল করে বল প্রতিপক্ষের গোলমুখে পাঠান মারিয়া। আর গোলমুখে বল পেয়ে জটলার মধ্যে থেকে বল জালে পাঠান কোহাতি।
তার আগে ২৪ মিনিটে মনিকা একাই গোল দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাতে সুযোগটা কেবল নষ্টই হয়েছে। অথচ পাশে থাকা তহুরাকে পাস দিলেই ইতিবাচক কিছু হলেও হতে পারত। ৩১ মিনিটে তহুরা হেডে বাহরাইনের জালে বল জড়ালেও বাংলাদেশ অধিনায়ক আফঈদা খন্দকার অফসাইডের ফাঁদে পড়ায় গোলটি বাতিল হয়ে যায়। ৩৭ মিনিটে ঋতুপর্ণার শট কোনোমতে বাইরে ঠেলে বাহরাইনকে আরেক গোল খাওয়া থেকে বাঁচান গোলকিপার খুলুদ সালেহ। এরপর কর্নার পায় বাংলাদেশ। সেখান থেকে নেওয়া মারিয়ার শট জালের ওপর দিয়ে চলে যায়।
যোগ করা সময়ের প্রথম মিনিটে চতুর্থ গোলের দেখা পায় বাংলাদেশ। ডান পায়ের শটে বাংলাদেশের গোলের হালি পূর্ণ করেন তহুরা। এরপর বিরতির আগমুহূর্তে শামসুন্নাহারের বাড়ানো বল থেকে আরও একবার বাহরাইনের জাল কাঁপান বাংলাদেশের নম্বর টেন।
দ্বিতীয়ার্ধের ৪৭ মিনিটে আরও একবার গোলকিপারকে একা পান শামসুন্নাহার। কিন্তু এবার আর গোলের খাতায় নাম লেখাতে পারেননি তিনি। ৫৭ মিনিটে বাংলাদেশের আরেকটি ক্ষুরধার আক্রমণ অফসাইডে কাটা পড়ে। ম্যাচের সময় যত গড়ায়, তত বাংলাদেশও আক্রমণের গতি বাড়াতে থাকে।
৬০ মিনিটে পাল্টা আক্রমণ থেকে লম্বা পাসে বল গোলমুখে পাঠান শামসুন্নাহার সিনিয়র। বাতাসে ভাসতে থাকা বলে পা ছোঁয়ানোর পথেই প্রতিপক্ষ ফরোয়ার্ড রাওয়ান আলালি রক্ষা করতে যান, কিন্তু বল উল্টো বাহরাইনের জালে জায়গা করে নেয়। আর বাংলাদেশ উদ্যাপন করে তাদের ষষ্ঠ গোল।
৬৬ মিনিটে বাংলাদেশের রক্ষণ অরক্ষিত পেয়েও গোল শোধ করতে পারেনি বাহরাইন। দারুণ প্রচেষ্টায় প্রতিপক্ষের আলিসার শট রুখে দেন গোলকিপার রুপনা চাকমা। উল্টো ৭৪ মিনিটে বাহরাইনের রক্ষণ চূর্ণ করে একাই বল জালে পাঠান মুনকি। ৮৫ মিনিটে অফসাইডের কারণে মোসাম্মাৎ সাগরিকার একটি গোল বাতিল হয়ে যায়।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
৪১ বছর ধরে হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিলি করেন গাইবান্ধার রহিম
গাইবান্ধার পত্রিকা বিক্রেতা আবদুর রহিম। বাড়ি পলাশবাড়ী পৌরসভার নুনিয়াগাড়ি এলাকায়। বয়স ৭১ বছর। এই বয়সেও তিনি ঘুমভাঙা চোখে একনজর পত্রিকার শিরোনাম দেখে নেন। পত্রিকা গুছিয়ে বগলে চেপে ছুটে চলেন পাঠকের কাছে। ‘ভাই, আজকে গরম খবর আছে’ বলেই পাঠকের হাতে এগিয়ে দেন পত্রিকা।
এক পাঠক থেকে আরেক পাঠকের কাছে যান আবদুর রহিম। পত্রিকা বিলি করেন সকাল ৬টা থেকে টানা ৭ ঘণ্টা। বিকেল ৫টা থেকে ৪ ঘণ্টা বিলি করা পত্রিকার টাকা সংগ্রহ করেন। ১১ ঘণ্টার বেশির ভাগ সময় হেঁটে পত্রিকা বিলি ও টাকা সংগ্রহ করেন। দূরের পাঠকের কাছে যান বাইসাইকেলে। প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হেঁটে বিলি করেন পত্রিকা। এভাবেই দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে গাইবান্ধায় পত্রিকা বিলির কাজ করছেন তিনি।
আবদুর রহিম বলেন, ‘সকাল ৬টা থেকে পত্রিকা বিলির কাজ শুরু করি। বেলা ১টার দিকে শেষ হয়। উপজেলা সদরে হেঁটে বিলি করি। তবে সদর থেকে ৬-৭ কিলোমিটার দূরে জুনদহ, কালীতলা, ঢোলভাঙ্গা, হোসেনপুর এলাকায় সাইকেলে যাই। এসব জায়গায় সাইকেল রেখে হেঁটে পত্রিকা বিলি করি। দুপুরে বাড়িতে বিশ্রাম নিই। এরপর পত্রিকা বিক্রির টাকা তোলা শুরু করি। টাকা তুলতে বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সময় লাগে। সব মিলিয়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হাঁটাহাঁটি হয়ে যায়। এ রকম ব্যস্ততায় কীভাবে ৪১ বছর কেটে গেল, টেরই পেলাম না! তবে পত্রিকা বিলি করে আনন্দ পাই। অনেক পাঠক আমাকে ভালোবাসেন, খোঁজখবর নেন।’
দীর্ঘ সময় পত্রিকা বিলি করতে সমস্যা হয় কি না, তা জানতে চাইলে আবদুর রহিম বলেন, ‘আমার কোনো অসুখবিসুখ নেই। যত দিন শরীর ভালো থাকবে, তত দিন এই কাজ চালিয়ে যাব।’
ব্যবসার শুরুরহিমের পৈতৃক বাড়ি রংপুর শহরের আরাজি গুলাল বুদাই এলাকায়। সেখানে তাঁর বাবার ৩ শতাংশ জমিতে বসতভিটা ছিল। এ ছাড়া কোনো সম্পদ ছিল না। বাবা আবেদ আলী অনেক আগেই মারা গেছেন। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। লেখাপড়া করেছেন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। ছোটবেলা থেকেই কৃষিকাজ করতেন। ১৯৭৫ সালে বিয়ে করেন একই এলাকায়। তাঁর ছয় মেয়ে ও এক ছেলে। দারিদ্র্যের কারণে সংসার চালানো একসময় কঠিন হয়ে পড়ে।
রহিমের খালাতো ভাই রংপুর শহরে পত্রিকা বিলি করতেন। তাঁর পরামর্শে ১৯৮৪ সাল থেকে রংপুরে স্থানীয় পত্রিকা দিয়ে আবদুর রহিমের এই ব্যবসার যাত্রা শুরু। এরপর তিনি বাসে ফেরি করে বিক্রি করতে থাকেন পত্রিকা। প্রতিদিন রংপুর থেকে বাসে উঠে পলাশবাড়ী পর্যন্ত আসেন। এভাবে তিন বছর কেটে যায়। এরপর পলাশবাড়ীর স্থানীয় এক সাংবাদিকের বাড়িতে থেকে পত্রিকা বিক্রি শুরু করেন। ছয় মাস থাকেন সেখানে। এরপর জমানো ও ঋণের টাকায় নুনিয়াগাড়ি এলাকায় সোয়া ৮ শতাংশ জমি কিনে টিনশেড ঘর বানান। বাড়ি থেকে ব্যবসা করতে থাকেন। পলাশবাড়ী চারমাথা এলাকায় বসে ঢাকা, রংপুর ও বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা সংগ্রহ করে পলাশবাড়ী উপজেলা সদরে বিক্রি করতে থাকেন।
হকার থেকে এজেন্টকয়েক বছর পর আবদুর রহিম নিজের নামে বেশ কিছু পত্রিকার এজেন্সি নেন। পত্রিকার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় একা সামলাতে পারছিলেন না। তাই চারজন লোক নিয়োগ করেন। তাঁরা এখনো রহিমের কাছে কমিশনে পত্রিকা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ব্যবসা শুরুর সময় প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ কপি পত্রিকা বিলি করতেন। মাসিক আয় ছিল ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। কয়েক বছর পর পাঠকের চাহিদা বেড়ে যায়। সে সময় মাসিক আয় হতো ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা। বর্তমানে ছাপা পত্রিকার পাঠক কমে গেছে। এখন প্রতিদিন ১৫০ থেকে ১৬০ কপি পত্রিকা বিলি করছেন। বর্তমানে তাঁর মাসিক আয় গড়ে ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা।
আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পত্রিকার ব্যবসা করে রংপুর থেকে এসে পলাশবাড়ীতে বাড়ি করতে পেরেছি, মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। সততার সঙ্গে চলছি। এতেই আমি সন্তুষ্ট।’
পলাশবাড়ী মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আবু সুফিয়ান সরকার বলেন, ‘আবদুর রহিমকে বহু বছর ধরেই পত্রিকা বিক্রি করতে দেখছি। তাঁকে দেখে মনে হয় না ৭১ বছর বয়স হয়েছে। তাঁর মধ্যে ক্লান্তি দেখা যায় না। দিন-রাত পরিশ্রম করেন। কখনো তাঁকে মিথ্যা বলতে শুনিনি। এলাকার মানুষ তাঁকে ভালোবাসেন।’