ছোট্ট দেহটির প্রায় সব হাড় দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, কঙ্কালের ওপর শুধু চামড়াটাই রয়ে গেছে। গাজায় খাদ্যাভাব কতটা তীব্র পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ এই শিশুরা। তাদের হাড্ডিসার দেহ যেন ইসরায়েলের নৃশংসতারই সাক্ষ্য।

ইসরায়েলের আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত অনাহার ও অপুষ্টিতে ফিলিস্তিনের গাজায় অন্তত ৬৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ। এ জন্য তারা গাজায় ইসরায়েলের সর্বাত্মক অবরোধকে দায়ী করেছে।

গাজার স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের ওপর চাপ বাড়াতে উপত্যকাটিতে কোনো ধরনের ত্রাণ প্রবেশ করতে দিচ্ছে না ইসরায়েল। এমনকি খাবার, পানি ও ওষুধের মতো জীবনরক্ষাকারী ত্রাণও প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।

গত শনিবার গাজার সরকারি গণমাধ্যম কার্যালয়ের এক বিবৃতিতে ইসরায়েলের প্রাণঘাতী অবরোধকে যুদ্ধাপরাধ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গাজার বেসামরিক মানুষকে নির্মূল করতে ইসরায়েল ক্ষুধাকে যে অস্ত্র হিসেবে ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহার করছে, সেটা এখন দিবালোকের মতো সত্য।

গাজা উপত্যকায় চলমান পরিস্থিতিকে ‘শৈশবের বিরুদ্ধে অব্যাহত অপরাধ’ বলে বর্ণনা করে এর নিন্দা জানিয়েছে সরকারি দপ্তরটি। পাশাপাশি ক্ষুধা, রোগ ও ধীরে ধীরে মৃত্যুর শিকার হওয়া শিশুদের দুর্দশা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের লজ্জাজনক নীরবতারও তীব্র সমালোচনা করেছে তারা।

বিবৃতিতে এ বিপর্যয়ের জন্য ইসরায়েল ও তাদের মিত্রদের দায়ী করেছে সরকারি দপ্তরটি। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি। পাশাপাশি জাতিসংঘকে অবিলম্বে গাজার সীমান্ত পথগুলো খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে।

এ বিবৃতির কয়েক দিন আগে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ সতর্ক করে বলেছিল, গাজায় অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা ‘উদ্বেগজনক হারে’ বাড়ছে। ইউনিসেফ জানিয়েছে, শুধু মে মাসে ছয় মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সী অন্তত ৫ হাজার ১১৯ শিশুকে তীব্র অপুষ্টির চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

ইউনিসেফ আরও বলেছে, এ সংখ্যা এপ্রিল মাসে ভর্তি হওয়া ৩ হাজার ৪৪৪ শিশুর তুলনায় ৫০ শতাংশের মতো বেশি আর ফেব্রুয়ারির তুলনায় প্রায় ১৫০ শতাংশ বেশি। ফেব্রুয়ারিতে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর ছিল। এতে সে সময়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ত্রাণসহায়তা গাজায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়।

ইউনিসেফের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের পরিচালক এডওয়ার্ড বেইগবেদার বলেন, শুধু এ বছর মে পর্যন্ত মাত্র ১৫০ দিনে গাজা উপত্যকায় ১৬ হাজার ৭৩৬ শিশুকে অপুষ্টির চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সে হিসাবে গড়ে দিনে ১১২টি শিশুকে অপুষ্টির জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

শিশুদের এ দুর্দশা ও মৃত্যুর মিছিল খুব সহজে থামানো সম্ভব বলে মনে করেন বেইগবেদার। তিনি বলেন, প্রতিটি ঘটনা প্রতিরোধযোগ্য। তাদের কাছে অত্যাবশ্যক খাবার, পানি ও পুষ্টি চিকিৎসা পৌঁছে দিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এতে মানুষ মারা যাচ্ছে। ইসরায়েলকে জরুরি ভিত্তিতে সব সীমান্ত পথ দিয়ে ব্যাপক পরিমাণ জীবনরক্ষাকারী সহায়তা গাজায় পৌঁছানোর সুযোগ দিতে হবে।

শিশুদের অনাহারে মৃত্যুর আশঙ্কা প্রকাশ করে শনিবার যখন এসব কথা বলা হচ্ছিল, তখন গাজা নগরীর তুফাহ এলাকায় দুই দফায় ইসরায়েলের বিমান হামলায় কয়েকটি আবাসিক ভবন ধ্বংস হয়ে অন্তত ২০ জন নিহত হন। তাঁদের মধ্যে অন্তত ৯টি শিশু রয়েছে।

ত্রাণের আটার ব্যাগে মাদক

এদিকে গাজার সরকারি গণমাধ্যম কার্যালয় গত শুক্রবার জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল–সমর্থিত একটি ত্রাণ সংস্থার ত্রাণকেন্দ্রগুলো থেকে বিতরণ করা আটার ব্যাগে ‘অক্সিকোডোন’ নামের মাদক বড়ি পাওয়া গেছে। সরকারি দপ্তরটি এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে।

এক বিবৃতিতে সরকারি দপ্তরটি বলেছে, ‘আমরা এখন পর্যন্ত চারজনের সাক্ষ্য পেয়েছি। তাঁরা আটার ব্যাগের ভেতরে এই বড়িগুলো পেয়েছেন।’ তারা সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, কিছু মাদক ইচ্ছাকৃতভাবে গুঁড়া বা দ্রবীভূত করে আটার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

অক্সিকোডোন একটি শক্তিশালী মাদক, যা মূলত ক্যানসার রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি ও তীব্র ব্যথা উপশমে ব্যবহার করা হয়। এ মাদক অত্যন্ত আসক্তিকর এবং এর জীবননাশক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। এর মধ্যে শ্বাসপ্রশ্বাসে জটিলতা, বিভ্রম ইত্যাদি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু পোস্টে গাজায় বিতরণ করা আটার ব্যাগে বড়ি পাওয়ার ছবি প্রকাশ হয়েছে। পরে গাজা কর্তৃপক্ষ ওই বিবৃতি দেয়। গাজার একজন ফার্মাসিস্ট ওমর হামাদ এ ঘটনাকে ‘গণহত্যার সবচেয়ে জঘন্য রূপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) নামের একটি বিতর্কিত সংস্থা বর্তমানে দক্ষিণ গাজার কয়েকটি জায়গায় ত্রাণ বিতরণ করছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকার অভিযোগে জিএইচএফের তীব্র সমালোচনা করে আসছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা। জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র থেকে ত্রাণ আনতে গিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে ৫৫০ জনের বেশি ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

এদিকে নতুন করে যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টার মধ্যেই গাজায় হামলা আরও তীব্র করেছে ইসরায়েল। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গতকাল রোববার জানিয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় নিহত ৮৮ জনের মরদেহ গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালগুলোয় আনা হয়েছে। এ সময় আহত ৩৬৫ জনকেও হাসপাতালে আনা হয়।

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের হামলার জবাবে ইসরায়েল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় নির্বিচার হামলা শুরু করে। প্রায় ২০ মাস ধরে চলা এ যুদ্ধে গাজায় কমপক্ষে ৫৬ হাজার ৫০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ৩৩ হাজার ৪১৯ জন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আট র ব য গ ইসর য় ল র ইউন স ফ র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

খাবার বা পানি নয়, ওখানে শুধু মৃত্যু   

ফিলিস্তিনের গাজার আট সন্তানের বাবা আতার রিয়াদ। তিনি বেইত হানুন এলাকার বাসিন্দা। ক্ষুধার্ত পরিবারকে বাঁচাতে প্রায়ই তাঁকে দূরদূরান্তের বিভিন্ন খাদ্যকেন্দ্রে যেতে হয়। ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় তাঁর পুরো পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

গাজার বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনা দিতে গিয়ে রিয়াদ আলজাজিরাকে বলেন, আমি প্রায়ই ১৫ কিলোমিটার হেঁটে মধ্য গাজার নেতজারিম করিডোরে যাই। আমি সেখানে দেখেছি, ক্ষুধার্ত মানুষের ভিড় কীভাবে রক্তপাতের দৃশ্যে পরিণত হয়। তিনি বলেন, একদিন সেনারা বলেছিল, ট্রাকে ত্রাণ আছে। ক্ষুধার্তরা ট্রাকের কাছে ছুটে যায়। কিন্তু খাবার না দিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষগুলোকে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট করা হয়। কোনো খাবার বা পানি নয়, সেখানে শুধুই মৃত্যু। এমন দৃশ্য কেবল সিনেমায় দেখা যায়। মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে, গাজায় অন্তত ১৭ হাজার শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।   

ইউসিএলএ ল প্রমিজ ইনস্টিটিউট ইউরোপের নির্বাহী পরিচালক কেট ম্যাকিনটোশ মনে করেন, গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) খাদ্য বিতরণের নামে যা করছে, তা ফৌজদারি অপরাধ। হত্যা করা হচ্ছে, অথচ স্পষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই। এভাবে মানুষ হত্যা যুদ্ধাপরাধ। অন্যদিকে, জিএইচএফের কার্যক্রম বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ৩০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছে।  

গাজার হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় সমগ্র ভূখণ্ডজুড়ে ইসরায়েলি হামলায় কমপক্ষে ৭২ জন নিহত হয়েছেন। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, গত চার সপ্তাহে মানবিক সহায়তা পেতে গিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে কমপক্ষে ৫৪৯ ফিলিস্তিনি নিহত ও ৪ হাজার ৬৬ জন আহত হয়েছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ইসরায়েলি হামলায় কমপক্ষে ৫৬ হাজার ২৫৯ জন নিহত ও ১ লাখ ৩২ হাজার ৪৫৮ জন আহত হয়েছেন।

এদিকে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বৃহত্তর আঞ্চলিক লক্ষ্যের দিকে নজর দিয়েছেন। আলজাজিরা জানায়, নেতানিয়াহু ইরানের বিরুদ্ধে বিজয় ঘোষণা করেই থেমে নেই। তিনি এখন এই অঞ্চলজুড়ে আরও বড় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছেন। 

শুধু গাজা থেকে ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তি দেওয়া কিংবা হামাসকে ধ্বংস করা নয়, নেতানিয়াহুর মূল লক্ষ্য ইসরায়েলের ডানপন্থি দলগুলোর মধ্যে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করা। তিনি আরব দেশগুলোর সঙ্গে স্বাভাবিকীকরণ আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা করছেন, যা তাঁর ডানপন্থি জোটকে আরও বেশি দিন ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখবে। 

জাতিসংঘ মানবিকবিষয়ক সমন্বয় অফিস (ওসিএইচএ) জানায়, এক সপ্তাহে ২৩ বার হামলা করেছে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা। এসব হামলায় ফিলিস্তিনিরা হতাহত হচ্ছেন। তারা বাড়িঘর ও সহায়-সম্পদ হারাচ্ছেন। অধিকৃত পশ্চিম তীরজুড়ে ফিলিস্তিনি সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে আগুনও দেওয়া হচ্ছে। এদিকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই ত্রাণপ্রত্যাশী ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালানো হচ্ছে বলে স্বীকার করেছে ইসরায়েলি সেনারা। এক সেনা দ্য হারেৎজকে বলেছেন, নিরস্ত্র ও ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের হত্যাকাণ্ড একান্তই ইচ্ছাকৃত। ওই সেনা বলেন, গাজা এখন একটি ‘হত্যাক্ষেত্র’। যাদের হত্যা করা হয়, তারা কোনো আক্রমণকারী নয়। তাদের ওপর দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র বা কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয় না। শুধু ভারী মেশিনগান আর গাইডেন্স লঞ্চার দিয়ে আমরা তাদের দিকে আগুন ছুড়ে দিই। ‘নিরপরাধ মানুষ হত্যা’ বিষয়টিকে স্বাভাবিক করা হয়েছে।  
গতকাল ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ গোষ্ঠী খান ইউনিসের উত্তরে হামাদ শহরে ইসরায়েলি সেনাদল ও তাদের গাড়ি লক্ষ্য করে বোমাবর্ষণ করেছে। অন্যদিকে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা উত্তর গাজায় হামাসের সুড়ঙ্গ ভেঙে দিয়েছে। 

ফিলিস্তিনে জাতিসংঘ সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ ইসরায়েলকে গাজার অবরোধ প্রত্যাহার করার অনুরোধ জানিয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, ইসরায়েলি অবরোধের ফলে ২ মিলিয়ন ফিলিস্তিনির জন্য মানবিক সহায়তা বাধা পাচ্ছে। তারা ফিলিস্তিনি জলপাই গাছ ধ্বংস করে নাবলুসের কাছে অবৈধ ফাঁড়ি স্থাপন অব্যাহত রেখেছে। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় আটার ব্যাগে মাদক: মার্কিন-ইসরায়েলি ত্রাণ সংস্থার বিরুদ্ধে ভয়ানক অভিযোগ
  • গাজায় ত্রাণের আটার বস্তায় আফিমজাত ট্যাবলেট
  • খাবার বা পানি নয়, ওখানে শুধু মৃত্যু   
  • ত্রাণ নিতে আসা ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলির আদেশ দেওয়া হয়েছে, কী বলছেন ইসরায়েলি সেনারা