অফিসে তো বটেই, ঘরেও একটানা দীর্ঘ সময় বসে কাজ করেন অনেকে। এমনকি কাজকর্ম সেরে বাকি সময় পার করেন বসে বসে। একটানা অনেকটা সময় বসে থাকলে শরীরে জড়তা চলে আসে। ব্যথাবেদনাও হতে পারে। আর সৃষ্টি হয় দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি। তা ছাড়া মনের ওপরে পড়তে পারে নেতিবাচক প্রভাব। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানালেন রাজধানীর পপুলার মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা.

নওসাবাহ্ নূর

যেসব সমস্যা হতে পারে

আমাদের চারপাশে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা প্রায়ই কোমরব্যথা বা ঘাড়ব্যথায় ভোগেন। এসব ব্যথার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী আমাদের দেহভঙ্গি। অনেক অফিসেই এমন চেয়ার-টেবিল বা ডেস্কের ব্যবস্থা থাকে না, যাতে সঠিক দেহভঙ্গি বজায় রেখে বসে কাজ করা যায়।

একই ভঙ্গিতে বসে কাজ করতে করতে একসময় ফ্রোজেন শোল্ডারে আক্রান্ত হতে পারেন কেউ কেউ।

কম্পিউটারের পর্দায় একটানা তাকিয়ে থাকার জন্য চোখের শুষ্কতাও দেখা দিতে পারে।

বদ্ধ ঘর, যেখানে বায়ুপ্রবাহ কম থাকে, সেখানে অ্যালার্জিজনিত সমস্যার ঝুঁকি বাড়ে।

কারও কারও পায়ে পানি আসে, পা ভারী হয়ে যায়।

একটানা বসে কাজ করতে করতে একঘেয়েমি চলে আসাও খুব স্বাভাবিক।

ভবিষ্যতের বড়সড় স্বাস্থ্যঝুঁকি

একটানা বসে কাজ করতে গিয়ে বেশ কিছু দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার ঝুঁকি বাড়ে। স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের মতো সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে এই বসে কাজ করার অভ্যাস। বাড়তে পারে রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল। পরবর্তী জীবনে হৃদ্‌রোগ বা স্ট্রোকের মতো মারাত্মক রোগের ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে এভাবেই।

আরও পড়ুনকাজের ফাঁকে যেভাবে চোখকে বিশ্রাম দেবেন২০ মে ২০২২সুস্থ থাকতে যা করবেন

সুস্থ থাকতে দেহটাকে সচল রাখা চাই-ই চাই। ঠিক কতটা সময় বসে কাজ করা নিরাপদ, সে বিষয়ে সর্বজনস্বীকৃত কোনো নির্দেশনা নেই। আর জীবনের প্রয়োজনে কাজ তো করতেই হবে। তবে প্রতি ঘণ্টায় একবারের জন্য হলেও চেয়ার ছেড়ে উঠুন, অফিসের ভেতরেই একটু হাঁটাহাঁটি করুন। হাত এবং কাঁধও নাড়াচাড়া করুন।

কাজের ফাঁকে যেকোনো সময় বিরতি পেলে মুঠোফোনের পর্দায় সময় ব্যয় না করে চেয়ার ছেড়ে উঠুন। হাঁটুন, হাত-পায়ের পেশির সঞ্চালন করুন যতটা সম্ভব।

যেকোনো ডিজিটাল পর্দায় একটানা কাজ করার সময় ২০ মিনিট পরপর ২০ সেকেন্ডের জন্য ২০ ফুট দূরের কোনো কিছুর দিকে তাকিয়ে থাকুন।

প্রার্থনার জন্য উঠতে পারেন। সহকর্মীকে কিছু বলতে হলে নিজে উঠে যেতে পারেন।

সুযোগ থাকলে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ানোর পর দেহভঙ্গি খানিকটা বদলে যেসব ব্যায়াম করা যায়, সেসব করে নিন অন্তত পাঁচবার। এ ধরনের একটি ব্যায়াম হলো স্কোয়াট।

আরও পড়ুনকাজের ফাঁকে ৫ মিনিটের ব্যায়াম২০ মে ২০১৫

নিজের ডেস্কে বসেই দুপুরের খাবার বা নাশতা না খেয়ে একটু হেঁটে খাবার জায়গা পর্যন্ত যান।

বসার ব্যবস্থা স্বস্তিদায়ক না হলে অফিসের সবাই মিলে কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানান। তাঁদের অনুরোধ করুন, যাতে কর্মীদের বসার ব্যবস্থাটি স্বাস্থ্যকর হয়। চেয়ারগুলো যাতে ভালো মানের হয়, চেয়ারের গড়ন যাতে মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক বক্রতা অনুযায়ী হয়, টেবিল বা ডেস্কের উচ্চতাও যেন হয় স্বস্তিদায়ক। দাঁড়িয়ে কাজ করা যায়, এমন ডেস্কে কিছুটা সময় কাজ করার ব্যবস্থাও করতে পারেন।

বসা অবস্থায়ও হাত-পা কিছুটা নাড়াচাড়া করুন। পায়ে পানি আসার প্রবণতা থাকলে পায়ের নিচে একটু উঁচু, সামান্য ঢালু কিছু একটা রাখতে চেষ্টা করুন। একটা নিচু টুল রাখলেও উপকার পাবেন।

অফিসে যাতায়াতের পথে খানিকটা হাঁটুন। সব সময় লিফট ব্যবহার না করে কয়েক তলা সিঁড়ি ভেঙে ওঠানামা করুন।

অফিসের আগে বা পরে শরীরচর্চার অভ্যাস করুন। সপ্তাহে অন্তত দেড় শ মিনিট মাঝারি তীব্রতার ব্যায়াম করুন, অথবা অন্তত ৭৫ মিনিট ভারী ব্যায়াম করুন। কিংবা এই দুই ধরনের ব্যায়াম মিলিয়েও নিতে পারেন। এর পাশাপাশি দেহের সব পেশির জোর বাড়ানোর ব্যায়ামও করুন সপ্তাহে অন্তত দুবার।

আরও পড়ুননাসা বলছে, ১০ মিনিটের এই সহজ ব্যায়াম দৌড়ের চেয়ে ৬৮ শতাংশ বেশি কার্যকর ০৯ জুন ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ব যবস থ ক জ কর র জন য একট ন সময় ব সমস য

এছাড়াও পড়ুন:

নিভৃতচারী কৃষকের আর্তনাদ কি আমরা শুনছি

কৃষি এবং কৃষকই এ দেশের প্রাণ—এই ধ্রুব সত্যটি নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু বেদনাদায়ক বাস্তবতা হলো, মধ্যস্বত্বভোগী ও কপট ব্যবসায়ীদের কারণে কৃষকের স্বার্থ বরাবরই উপেক্ষিত। নীতিনির্ধারক ও মূলধারার রাজনীতিবিদদের নীরবতা এবং কৃষকের সমস্যা নিয়ে সম্প্রতি জনগুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যকে ‘ট্রল’ করার মতো দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা আমাদের জাতীয় সংবেদনশীলতার অভাবকেই প্রকটভাবে তুলে ধরে।

করোনাকালীন ভয়াবহ সংকটে কৃষি যেভাবে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করে অর্থনীতিকে রক্ষা করেছে, তা আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। অথচ এত কমিশন গঠিত হলেও, কৃষি কমিশন গঠন করা হয়নি। এর মূল কারণ সম্ভবত নিভৃতে কাজ করে যাওয়া কৃষক বা কৃষিশ্রমিকের মূল্য এই সমাজে অনেক সস্তা।

বর্তমানে কৃষি খাত নিয়ে যত আলোচনা—তা সবই যেন নিরাপদ কৃষি, বাণিজ্যিক কৃষি, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ, ভ্যালু চেইন ও উৎপাদন বৃদ্ধিকেন্দ্রিক। প্রধান স্টেকহোল্ডার কৃষক ও তাঁর জীবন-জীবিকার স্বার্থ প্রায়শই থেকে যাচ্ছে অন্তরালে। অন্যান্য পেশাজীবীর মতো কৃষকের কোনো সক্রিয় সংগঠন নেই। চাষাবাদ ফেলে ঢাকা শহরে দাবি আদায়ের আন্দোলনে নামাও তাঁদের পক্ষে অসম্ভব, কারণ তাতে তাঁদের পেটে ভাত জুটবে না।

অথচ কৃষকেরা শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, শারীরিকভাবেও চরম ঝুঁকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ক্যানসারে আক্রান্ত পুরুষ রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পেশায় কৃষক! মাস্ক, গ্লাভস বা রাবারের জুতা চোখে না দেখা, ছেঁড়া গামছা মুখে পেঁচিয়ে বিষাক্ত কীটনাশক স্প্রে করা ভূমিহীন মানুষটা আমাদের কাছে হয়তো ‘কৃষিশ্রমিক’, ‘কৃষক’ নন; কিন্তু খাদ্য উৎপাদনচক্রে তাঁর অবদান সবচেয়ে মৌলিক এবং তাঁর স্বাস্থ্যঝুঁকিও সবচেয়ে বেশি।

সমাজের চোখে ‘কৃষক’ বলতে যখন বিঘার পর বিঘা জমির মালিক, শিক্ষিত বাণিজ্যিক উদ্যোক্তাদের বোঝানো হচ্ছে, তখন প্রান্তিক, নিরক্ষর মানুষগুলোর অস্তিত্ব ও সংগ্রাম প্রায় অস্বীকৃত থেকে যাচ্ছে।

আবার কৃষক ও কৃষির সমস্যা শুধু অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত নয়, এর শিকড় প্রোথিত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাতেও। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বাণিজ্যিক কৃষিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমাদের শিক্ষায় কৃষির নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক দিকগুলো প্রায় উপেক্ষিত।

কৃষকের নিবিড় জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রায়শই অন্ধকারে থাকছে। গান গাইতে গাইতে ধান কাটা, ধান লাগানো বা নবান্ন উৎসব—এসব প্রথা ও রীতিনীতি কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষকের জীবনের আনন্দ, দুঃখ ও শ্রমের প্রকাশ। পাঠ্যক্রমে এসবের অনুপস্থিতি কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে নাগরিকসচেতনতা বৃদ্ধির পথে এক বড় বাধা।

আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কৃষির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো আলোচনা বা গবেষণা নেই। কীভাবে নারীর হাত দিয়ে কৃষির সূচনা হয়েছিল—ফসলের বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বপন ও পরিচর্যার প্রথম ধাপগুলোয় নারীর যে ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল, সেই গুরুত্বপূর্ণ নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক দিকগুলো পড়ানো হয় না বললেই চলে।

বাংলার কৃষিকাজে লোকায়ত জ্ঞানের অন্যতম ধারক খনার বচন প্রাসঙ্গিক হলেও আবহাওয়া, ফসল রোপণের সময়, মাটির গুণাগুণ–সম্পর্কিত হাজার বছরের পরীক্ষিত প্রথাগত প্রজ্ঞা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমে স্থান পায় না। এর বদলে শুধু স্থান পায় আধুনিক প্রযুক্তি ও বাণিজ্যিকীকরণের তত্ত্ব।

ধান লাগানো থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ, বীজ সংরক্ষণ, ফসল মাড়াই ও ঝাড়াইয়ের মতো অনেক ধাপে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ বাংলাদেশের কৃষিতে অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বিভিন্ন গবেষণায় এই সত্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে। অথচ এই বিশাল শ্রমশক্তি ও তাঁদের সমস্যা নিয়ে মূলধারার একাডেমিক আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যদিও সস্তা শ্রম আর অধিকার বঞ্চনার মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কৃষিতে নারীর উপস্থিতি বাড়ছে।

কৃষকের নিবিড় জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রায়শই অন্ধকারে থাকছে। গান গাইতে গাইতে ধান কাটা, ধান লাগানো বা নবান্ন উৎসব—এসব প্রথা ও রীতিনীতি কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষকের জীবনের আনন্দ, দুঃখ ও শ্রমের প্রকাশ। পাঠ্যক্রমে এসবের অনুপস্থিতি কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে নাগরিকসচেতনতা বৃদ্ধির পথে এক বড় বাধা।

কৃষির এই বহুমুখী সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু যান্ত্রিকীকরণ আর উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর দিলেই চলবে না। প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী নীতিগত পরিবর্তন।

যা করা যেতে পারে:

ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ: সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ফসল কেনার সরকারি উদ্যোগকে আরও বিস্তৃত ও মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমাতে শক্তিশালী ‘ভ্যালু চেইন’ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।

স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ: প্রান্তিক কৃষক ও কৃষিশ্রমিকদের জন্য বিনা মূল্যে মানসম্পন্ন কীটনাশকপ্রতিরোধী মাস্ক, গ্লাভস এবং সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম সরবরাহ করা।

শিক্ষায় কৃষির সাংস্কৃতিক পাঠ অন্তর্ভুক্তিকরণ: উচ্চশিক্ষা ও স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে কৃষির উৎপত্তি, নৃতত্ত্ব, নারীর ভূমিকা, লোকায়ত জ্ঞান (যেমন খনার বচন) এবং কৃষকের জীবন ও সংস্কৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

কৃষিশ্রমিকের স্বীকৃতি: নারীর কৃষিভিত্তিক শ্রমের স্বীকৃতি প্রদান করা। কৃষিশ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী ও স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় আলাদা বরাদ্দ রাখা।

সর্বোপরি নীতিগত সদিচ্ছা এবং কৃষকের ন্যায্য অধিকার ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধিই পারে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার মূল ভিত্তি—নিভৃতচারী কৃষককে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে। কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে প্রত্যেক নাগরিকের সচেতনতা বৃদ্ধি এখন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি।

মো. জুবায়ের ইবনে কামাল অফিসার, জনতা ব্যাংক পিএলসি। প্রাক্তন শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ