যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ও শুল্ক প্রয়োগ (আইসিই) অভিযানের বিরোধিতা করেছেন নিউইয়র্ক সিটির মেয়র প্রার্থী জোহরান মামদানি। এর জেরে তাকে গ্রেপ্তার ও তদন্তের হুমকি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

স্থানীয় সময় মঙ্গলবার ফ্লোরিডার একটি ডিটেনশন সেন্টারে (অ্যালিগেটর আলকাট্রাজ) এক প্রেস কনফারেন্সে ট্রাম্প বলেন, মামদানি যদি আইসিইর কর্মকর্তাদের আটক ও নির্বাসনের কাজ বাধাগ্রস্ত করেন, তাহলে আমাদের তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। এ সময় মামদানি অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছেন বলে দাবি করেন ট্রাম্প।

যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই দাবি ভিত্তিহীন বলছেন মামদানি। ছোটবেলায় পরিবারসহ আইনগতভাবে উগান্ডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন বলে জানান তিনি।

ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা বিষয়টা খুব সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করছি এবং অনেকেই বলছে যে সে অবৈধভাবে এখানে আছে। আমরা সব কিছুই দেখব। এর আগে রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান অ্যান্ডি ওগলস অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডির কাছে মামদানির নাগরিকত্ব বাতিল ও তাকে নির্বাসনের অনুরোধ জানান।

এ বিষয়ে জারি করা বিবৃতিতে মামদানি বলেন, আমি কোনো আইন ভাঙিনি; তবুও প্রেসিডেন্ট আমাকে হুমকি দিচ্ছেন, কারণ আমি আমাদের শহরকে আইসিইর ভয়ের রাজত্ব থেকে রক্ষা করতে চাই।

তিনি আরও বলেন, এই বক্তব্য শুধু আমাদের গণতন্ত্রের ওপর আক্রমণ নয়, বরং নিউইয়র্কবাসীর জন্য একটি বার্তা। আপনি যদি প্রতিবাদ করেন, তাহলে তারা আপনাকে টার্গেট করবে।

ট্রাম্প একইসঙ্গে নিউইয়র্ক সিটির বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামসের প্রশংসাও করেন, যিনি ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে অংশ না নিয়ে নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে পুনর্নির্বাচনের পথে আছেন।

ট্রাম্প বলেন, অ্যাডামস ‘খুব ভালো মানুষ’। তিনি তাকে কিছুটা সাহায্য করেছেন এমন বোঝাতে গিয়ে বলেন, অ্যাডামসের বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ ট্রাম্প প্রশাসন প্রত্যাহার করেছিল।

ট্রাম্প বলেন, অ্যাডামস সমস্যায় পড়েছিলেন, এবং তার বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন নিউইয়র্ক এত অভিবাসী নিতে পারবে না, আর পরদিনই তাকে অভিযুক্ত করা হয়।

অ্যাডামস বারবার কোনো প্রমাণ ছাড়াই দাবি করেছেন, বাইডেন প্রশাসনের অভিবাসন নীতির সমালোচনার জেরে তাকে রাজনৈতিকভাবে টার্গেট করা হয়েছে। পরে তার বিরুদ্ধে বিদেশি ধনকুবের ও অন্তত একজন তুরস্ক সরকারের কর্মকর্তার কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ ছিল, যেটি চলতি বছরের এপ্রিলে বিতর্কিতভাবে প্রত্যাহার করে নেয় বিচার বিভাগ।

এ নিয়ে একাধিক ফেডারেল প্রসিকিউটর পদত্যাগ করেন। মামলাটির তত্ত্বাবধায়ক প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত ইউএস অ্যাটর্নি অভিযোগ করেন, প্রশাসনের অগ্রাধিকার বাস্তবায়নে অ্যাডামস সহায়তা করবেন– এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়, যেটি এক প্রকার ‘কুইড প্রো কুই’ লেনদেন। অ্যাডামস এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

মামদানি বলেন, ট্রাম্পের অ্যাডামসের প্রতি প্রশংসা ‘আশ্চর্যজনক নয়’, বরং প্রমাণ করে যে এখনই অ্যাডামসের মেয়াদ শেষ হওয়া জরুরি। তিনি অ্যাডামসকে ‘ট্রাম্পের বিভাজন, বিভ্রান্তি ও ঘৃণার প্রতিধ্বনি’ বলে নিন্দা জানান।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ন উইয র ক ট র ম প বল ন ন উইয র ক ম মদ ন কর ছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

নিভৃতচারী কৃষকের আর্তনাদ কি আমরা শুনছি

কৃষি এবং কৃষকই এ দেশের প্রাণ—এই ধ্রুব সত্যটি নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু বেদনাদায়ক বাস্তবতা হলো, মধ্যস্বত্বভোগী ও কপট ব্যবসায়ীদের কারণে কৃষকের স্বার্থ বরাবরই উপেক্ষিত। নীতিনির্ধারক ও মূলধারার রাজনীতিবিদদের নীরবতা এবং কৃষকের সমস্যা নিয়ে সম্প্রতি জনগুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যকে ‘ট্রল’ করার মতো দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা আমাদের জাতীয় সংবেদনশীলতার অভাবকেই প্রকটভাবে তুলে ধরে।

করোনাকালীন ভয়াবহ সংকটে কৃষি যেভাবে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করে অর্থনীতিকে রক্ষা করেছে, তা আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। অথচ এত কমিশন গঠিত হলেও, কৃষি কমিশন গঠন করা হয়নি। এর মূল কারণ সম্ভবত নিভৃতে কাজ করে যাওয়া কৃষক বা কৃষিশ্রমিকের মূল্য এই সমাজে অনেক সস্তা।

বর্তমানে কৃষি খাত নিয়ে যত আলোচনা—তা সবই যেন নিরাপদ কৃষি, বাণিজ্যিক কৃষি, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ, ভ্যালু চেইন ও উৎপাদন বৃদ্ধিকেন্দ্রিক। প্রধান স্টেকহোল্ডার কৃষক ও তাঁর জীবন-জীবিকার স্বার্থ প্রায়শই থেকে যাচ্ছে অন্তরালে। অন্যান্য পেশাজীবীর মতো কৃষকের কোনো সক্রিয় সংগঠন নেই। চাষাবাদ ফেলে ঢাকা শহরে দাবি আদায়ের আন্দোলনে নামাও তাঁদের পক্ষে অসম্ভব, কারণ তাতে তাঁদের পেটে ভাত জুটবে না।

অথচ কৃষকেরা শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, শারীরিকভাবেও চরম ঝুঁকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ক্যানসারে আক্রান্ত পুরুষ রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পেশায় কৃষক! মাস্ক, গ্লাভস বা রাবারের জুতা চোখে না দেখা, ছেঁড়া গামছা মুখে পেঁচিয়ে বিষাক্ত কীটনাশক স্প্রে করা ভূমিহীন মানুষটা আমাদের কাছে হয়তো ‘কৃষিশ্রমিক’, ‘কৃষক’ নন; কিন্তু খাদ্য উৎপাদনচক্রে তাঁর অবদান সবচেয়ে মৌলিক এবং তাঁর স্বাস্থ্যঝুঁকিও সবচেয়ে বেশি।

সমাজের চোখে ‘কৃষক’ বলতে যখন বিঘার পর বিঘা জমির মালিক, শিক্ষিত বাণিজ্যিক উদ্যোক্তাদের বোঝানো হচ্ছে, তখন প্রান্তিক, নিরক্ষর মানুষগুলোর অস্তিত্ব ও সংগ্রাম প্রায় অস্বীকৃত থেকে যাচ্ছে।

আবার কৃষক ও কৃষির সমস্যা শুধু অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত নয়, এর শিকড় প্রোথিত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাতেও। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বাণিজ্যিক কৃষিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমাদের শিক্ষায় কৃষির নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক দিকগুলো প্রায় উপেক্ষিত।

কৃষকের নিবিড় জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রায়শই অন্ধকারে থাকছে। গান গাইতে গাইতে ধান কাটা, ধান লাগানো বা নবান্ন উৎসব—এসব প্রথা ও রীতিনীতি কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষকের জীবনের আনন্দ, দুঃখ ও শ্রমের প্রকাশ। পাঠ্যক্রমে এসবের অনুপস্থিতি কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে নাগরিকসচেতনতা বৃদ্ধির পথে এক বড় বাধা।

আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কৃষির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো আলোচনা বা গবেষণা নেই। কীভাবে নারীর হাত দিয়ে কৃষির সূচনা হয়েছিল—ফসলের বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বপন ও পরিচর্যার প্রথম ধাপগুলোয় নারীর যে ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল, সেই গুরুত্বপূর্ণ নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক দিকগুলো পড়ানো হয় না বললেই চলে।

বাংলার কৃষিকাজে লোকায়ত জ্ঞানের অন্যতম ধারক খনার বচন প্রাসঙ্গিক হলেও আবহাওয়া, ফসল রোপণের সময়, মাটির গুণাগুণ–সম্পর্কিত হাজার বছরের পরীক্ষিত প্রথাগত প্রজ্ঞা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমে স্থান পায় না। এর বদলে শুধু স্থান পায় আধুনিক প্রযুক্তি ও বাণিজ্যিকীকরণের তত্ত্ব।

ধান লাগানো থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ, বীজ সংরক্ষণ, ফসল মাড়াই ও ঝাড়াইয়ের মতো অনেক ধাপে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ বাংলাদেশের কৃষিতে অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বিভিন্ন গবেষণায় এই সত্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে। অথচ এই বিশাল শ্রমশক্তি ও তাঁদের সমস্যা নিয়ে মূলধারার একাডেমিক আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যদিও সস্তা শ্রম আর অধিকার বঞ্চনার মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কৃষিতে নারীর উপস্থিতি বাড়ছে।

কৃষকের নিবিড় জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রায়শই অন্ধকারে থাকছে। গান গাইতে গাইতে ধান কাটা, ধান লাগানো বা নবান্ন উৎসব—এসব প্রথা ও রীতিনীতি কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষকের জীবনের আনন্দ, দুঃখ ও শ্রমের প্রকাশ। পাঠ্যক্রমে এসবের অনুপস্থিতি কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে নাগরিকসচেতনতা বৃদ্ধির পথে এক বড় বাধা।

কৃষির এই বহুমুখী সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু যান্ত্রিকীকরণ আর উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর দিলেই চলবে না। প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী নীতিগত পরিবর্তন।

যা করা যেতে পারে:

ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ: সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ফসল কেনার সরকারি উদ্যোগকে আরও বিস্তৃত ও মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমাতে শক্তিশালী ‘ভ্যালু চেইন’ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।

স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ: প্রান্তিক কৃষক ও কৃষিশ্রমিকদের জন্য বিনা মূল্যে মানসম্পন্ন কীটনাশকপ্রতিরোধী মাস্ক, গ্লাভস এবং সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম সরবরাহ করা।

শিক্ষায় কৃষির সাংস্কৃতিক পাঠ অন্তর্ভুক্তিকরণ: উচ্চশিক্ষা ও স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে কৃষির উৎপত্তি, নৃতত্ত্ব, নারীর ভূমিকা, লোকায়ত জ্ঞান (যেমন খনার বচন) এবং কৃষকের জীবন ও সংস্কৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

কৃষিশ্রমিকের স্বীকৃতি: নারীর কৃষিভিত্তিক শ্রমের স্বীকৃতি প্রদান করা। কৃষিশ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী ও স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় আলাদা বরাদ্দ রাখা।

সর্বোপরি নীতিগত সদিচ্ছা এবং কৃষকের ন্যায্য অধিকার ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধিই পারে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার মূল ভিত্তি—নিভৃতচারী কৃষককে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে। কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে প্রত্যেক নাগরিকের সচেতনতা বৃদ্ধি এখন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি।

মো. জুবায়ের ইবনে কামাল অফিসার, জনতা ব্যাংক পিএলসি। প্রাক্তন শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ